হিন্দু আমাদের ধর্মের নাম

0
5730

আমাদের ধর্মের নাম হিন্দু। বিশ্ববাসী আমাদের হিন্দু পরিচয়েই জানে। কিন্তু হিন্দু আমাদের ধর্মের নাম না জাতির, এই প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায় সব হিন্দুকেই হতে হয়। হিন্দু নামের উল্লেখ আমাদের প্রাচীনতম ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ ঋকবেদে নেই, উপনিষদে নেই; রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন পুরাণগুলিতেও নেই। তাই অধিকাংশ হিন্দুই হিন্দু পরিচয়ের প্রামাণ্য তথ্য পেশ করতে অক্ষম এবং শেষ পর্যন্ত ইদানীং কালে নিজেদের ধর্মকে ‘সনাতন’ পরিচয়ে পরিচিত করছে। এখন তো হিন্দুধর্মের প্রধান প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও নিজেদের সনাতন বলে বিজ্ঞাপিত করছে। কিন্তু সত্যটা কি? আমার কি সত্যিই নিজেদের হিন্দু বলতে পারিনা? আমাদের ধর্মের নাম কি হিন্দু নয়, সনাতন? সনাতন নামটিই বা কোন শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে? সনাতন শব্দের অর্থ চিরন্তন। যেহেতু ২০০০ বৎসর পূর্বে ক্রিশ্চান ধর্ম ছিলোনা, ১৪০০ বৎসর পূর্বে ইসলাম ধর্ম ছিলোনা; অথচ হিন্দু ধর্ম ১০, ০০০ পূর্ব বৎসর থেকে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে – তাই সনাতন। অতএব হিন্দুনামের ব্যুৎপত্তি যখন খুঁজে পাওয়া গেলোনা  – সুতরাং, সনাতন। কিন্তু সনাতনই বা কেন? যে কারণে হিন্দু নাম ত্যাগ করে সনাতন নাম গ্রহণ করা হচ্ছে, সনাতনও তো সেই একই দোষে দুষ্ট।

হিন্দুনামের উল্লেখ নেই যাঁরা বলছেন তাঁরা কি হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ইতিহাস জানেন? ‘আমি দেখতে পাইনি’ বলে নেই, ব্যাপারটি এইরকম গোছের হয়ে যাচ্ছে। সনাতন নামটিও তো কোন হিন্দুগ্রন্থে নেই। সনাতন অর্থাৎ চিরন্তন, যা আমাদের ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য; ধর্মের নাম নয়। যেমন আম একটি মিষ্টিফল, কিন্তু ফলটির নাম মিষ্টি নয়। সনাতন শব্দটিও তাই।

তাহলে আমাদের ধর্মের সঠিক নাম কী? এমন অদ্ভুত প্রশ্নের মুখে বিশ্বের আর কোন ধর্মকে পড়তে হয়নি, আমাদের হতে হচ্ছে। আমরা আমাদের ধর্মের সঠিক নাম জানিনা,  যা জানি তার প্রামাণ্য তথ্য খুঁজে পাই না। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। আমাদের দেশের নাম ঠিক কী, তা জানার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রশ্ন করছেন; এমনই স্মৃতিভ্রষ্ট জাতি আমরা! আমাদের অতীত আছে, অতীতের কোন প্রমাণ নেই। সুদীর্ঘ ৯৬০ বৎসর ধরে আরবী মুসলিম শাসক ও ইংরেজরা একটু একটু করে আমাদের সব জ্ঞান, সব গ্রন্থ ধ্বংস করে অতীতটাই ভুলিয়ে দিয়েছে। তাই কোন তত্ব মনে এলেও, প্রামাণ্য তথ্যের অভাব রয়ে যায়। বেদে লেখা আছে গাছের প্রাণ আছে, গীতায় লেখা আছে মাধ্যাকর্ষণ তত্ব; প্রমাণ করার সূত্রগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

এমনি করেই আমাদের সমস্ত শাস্ত্র নষ্ট করে দেওয়ার জন্য আমরা এক আত্মবিস্মৃত জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। মুঘল আমলে ভারতীয়রা রুজি রোজগারের স্বার্থে গ্রহণ করেছে আরবী, ফার্সী ভাষা; ইংরেজ রাজত্বে ইংরেজী। তাহলে ভারত বা হিন্দু শব্দ নিয়ে গবেষণা করবে কে? আমাদের ইদানীং কালের যুগাবতাররা তো বলেই দিয়েছেন, বেদ সংহিতার কোন অর্থ নেই। তাই এখন কেউ বেদ পরেও দেখেন না। বিজ্ঞানের অমূল্য সূত্রগুলি ধুলো ঝেড়ে বোঝার কেউ নেই। বেদে হিন্দু শব্দটি না থাকলেও আর্য শব্দটি রয়েছে। আমাদের যে আর্য বলে একটি পরিচিতি ছিল, আমরা তাও ভুলতে বসেছি। এই আর্য নাম এসেছিল আর্যান দেশ থেকে, অধুনা যার পরিবর্তিত নাম – ইরান। আর্য শব্দটি খুবই গৌরবসূচক ছিল। আর্যধর্ম অর্থে ন্যায়, সদাচার ও বীরত্বের গাথা রামায়ণে বর্ণিত রয়েছে। বেদে আর্য শব্দের অর্থ কৃষিজীবী। আর্যজাতি আর্যান থেকে এসে  যে স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল অর্থাৎ কাশ্মীর, গান্ধার (বর্তমানে আফগানিস্তান), পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড সহ উত্তর ভারত আর্যাবর্ত নামে খ্যাত হয়েছিল। অতএব, আর্য শব্দটি একাধারে জাতি অর্থে এবং ধর্ম অর্থে ব্যৱহৃত হত। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। ক্রিশ্চান শব্দ যেমন জাতি ও ধর্ম – উভয় অর্থই একযোগে বহন করে।

এরপর পুনরায় একই প্রশ্নে আসা যাক। আমাদের ধর্ম হিন্দু না আর্য না বৈদিক না ভারত? এগুলির মধ্যে ভারত, বৈদিক ও আর্য শব্দ হিন্দুশাস্ত্রে বিদ্যমান কিন্তু হিন্দু শব্দটির উল্লেখ কোথাও নেই।

কিন্তু – আছে।  যাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের আর্য নামে সম্বোধন করতেন, তাঁদের প্রাচীন শাস্ত্র জেন্দআবেস্তায় আছে। জেন্দআবেস্তা ঋকবেদের সমসাময়িক এবং এটি আর্যান দেশের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। প্রাচীন আর্যান দেশে ভারতীয় আর্য ছাড়াও তাঁদের আর একটি শাখা বাস করতেন যাঁরা বর্তমানে পার্সী নামে পরিচিত। আর্যান দেশের অপর নাম পারস্য এবং সেখান থেকেই পারসিক বা পার্সী শব্দটি উদ্ভুত। উভয় আর্য সম্প্রদায়েরই ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, উপাস্যদেবতা সবই এক ছিল। একই ইন্দ্র বেদে বৃত্রঘ্ন, জেন্দআবেস্তায় বেত্রঘ্ন। ভগ – বগ, মিত্র – মিথ্র, বরুণ – অরুণস, অর্যমা – অইযর্মন, সোম – হোম। উভয় জাতিরই উপাসনাবিধি যজ্ঞ বা হোম, মন্ত্র এবং উভয় ধর্মগ্রন্থ বেদ ও জেন্দআবেস্তায় মন্দিরভিত্তিক পূজার কোন উল্লেখ নেই। তাছাড়া দুই সম্প্রদায়েরই বিবাহযজ্ঞে অর্যমা বা অইযর্মন দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতিপ্রদান গত ১০, ০০০ বছর ধরে অদ্যাবধি চলে আসছে। নববর্ষ পালন ও একই দিনে, বাসন্তিক বিষ্ণুব দিবসে, অর্থাৎ বর্তমানে ২২ শে মার্চ। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, উভয় ধর্মগ্রন্থেই সপ্তসিন্ধু বা সিন্ধু-সরস্বতী সহ সপ্ত নদীর উল্লেখ আছে এবং সেই নদীগুলিকে অতীব পুণ্যবতী আখ্যায় বর্ণনা করা হয়েছে।

সাদৃশ্যগুলি দেখে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, উভয় জাতিই কোন একসময় ভারতবর্ষে বসবাস করতো। মহাপ্লাবনের পূর্বে সম্ভবত উভয় জাতিই ভারতবর্ষের আদি বাসস্থান ত্যাগ করে জীবনরক্ষার তাগিদে আর্যান দেশের উচ্চভূমিতে (পামীর মালভূমি) গিয়ে বাস করেছিল। মহাপ্লাবনের পরে জল সরে গেলে যাঁরা তাঁদের প্রাচীন পিতৃভূমি ভারতে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা পরিচিত হয়েছিলেন আর্য বা ভারত নামে। বেদে সূর্যের অপর নাম হল ভরত।  সূর্যকে উপাসনা করে আর্যরা ভারত নামেও পরিচিত ছিলেন। ঋকবেদের ২/৭/৫ ঋকে বলা হয়েছে – ” ত্বং নো অসি ভারতাগ্নে”..অর্থ – হে ভারত অগ্নি (সূর্য) তুমি আমাদের উপাস্য।

অপরদিকে আর্যান বা পারস্যে যাঁরা থেকে গিয়েছিলেন তাঁরা পরিচিত হয়েছিলেন পার্সী নামে। এই পার্সী সম্প্রদায় ‘স’ বর্ণকে ‘হ’ উচ্চারণ করতো। অসুরকে বলতো অহুর, সিন্ধুকে হিন্দু। তাঁদের ধর্মগ্রন্থ জেন্দআবেস্তায় উল্লিখিত আছে, সপ্তসিন্ধুকে হপ্তহিন্দু, সরস্বতীকে হরৈখতি নামে। তাঁরাই তাঁদের স্বধর্মীয় ভারতীয় আর্যদের সপ্তসিন্ধুর তীরে বসবাস করার কারণে “হিন্দু” নামে সম্বোধন করতেন। জেন্দআবেস্তাতেও হিন্দু শব্দের উল্লেখ আছে। এই সম্বোধন আজকের নয়। জেন্দআবেস্তা রচিত হয়েছিল ঋকবেদের আমলে। অর্থাৎ ঋকবেদের যুগ থেকেই ভারতীয় আর্যরা হিন্দু নামে সম্বোধিত ও পরিচিত হয়েছিলেন।

ভারতীয়দের ইতিহাস প্রায় ১০, ০০০ বছরের। অনেক ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে কখনো আর্য, কখনো ভারত, কখনো বৈদিক, কখনো হিন্দু নামে পরিচিত হয়েছে। ইতিহাস,শাস্ত্র, ধর্মগ্রন্থ বিদেশী বিধর্মী শাসকগোষ্ঠীগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। তার মধ্যেই অন্তঃসলিলার মতো একটি পরিচয় নিয়েই বেঁচে আছে ভারতবাসী। তা হল হিন্দু। সেই পরিচয়ের মূলেও কারা যেন কুঠারাঘাত করতে শুরু করেছে।  প্রাচীনতম “হিন্দু” পরিচয়টিও ভুলিয়ে দেওয়ার একটি সুগভীর চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সনাতন আমাদের ধর্মের নাম নয়। আমরা হিন্দু জাতি, হিন্দু ধর্ম। দয়া করে হিন্দু নামকে পাল্টে অবৈদিক, সনাতন নামে পরিচিত হবেন না। তাহলে অনেকটা পিতৃপরিচয়হীন জাতি, ধর্ম হিসেবেই মনে হবে।