হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল? প্রাথমিক সমীক্ষা – ৬

রাম জন্মভূমি নিয়ে ১৯৮০র দশকের বিতর্কের মধ্য়ে সীতারাম গোয়েল দেখেছিলেন হিন্দু মন্দিরগুলির উপর প্রভূত মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিয়ে আছে ততোধিক অজ্ঞতা। তাই তিনি এই বিষয়টিকে নিয়ে লেখেন Hindu Temples: What Happened to Them. এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে  প্রাথমিক সমীক্ষা। লিখেছন অরুণ শৌরী, হর্ষ নারায়ণ, জয় দুবাসী, রাম স্বরূপ এবং সীতারাম গোয়েল।

এই বইয়ের সূচীপত্রটি নিম্নরূপ।

মুখবন্ধ
১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার

১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।

আগের পর্ব  [] – [] – [] – [] – []

ষষ্ঠ অধ্যায় : ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস

রাম স্বরূপ

আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী ওল সোইঙ্কা, ১৯ নভেম্বর, ১৯৮৮ সালে ২০-তম নেহরু স্মৃতি বক্তৃতানুষ্ঠানে যে বক্তৃতা প্রদান করেন তাতে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেন, যদিও এটি কোনও নতুন পর্যবেক্ষণ ছিল না, যে ঔপনিবেশিক ইতিহাস ছিল ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা যা লিখেছেন তার প্রত্যেকটিতেই একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে। তিনি আরও যোগ করেন যে আফ্রিকার ইতিহাস পুনর্লিখনের জন্য ইতিহাসবিদরা মারাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা জানি না যে এই প্রকল্পটি কী এবং এটি আফ্রিকাতে কীভাবে চলছে, কিন্তু ভারতবর্ষে এই দিক দিয়ে করা প্রচেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। লেখকদের অভাব দেখা দিয়েছে তা নয়, তবে তাদের প্রতিভা তাদের উৎসাহের সম্মান হয়নি।

ইতিহাসের পুনর্লিখনের বাক্যটি আমাদের খুব একটা স্বস্তি দেয় না এবং এটি আমাদের সত্যের বোধের পক্ষে আপত্তিজনক। পুনরায় লেখার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্তগুলি পুরোনো চিত্রের উন্নতি করতে পারেনি, সেই সঙ্গে কাজটির প্রতি উদ্দীপনা সৃষ্টি করতেও ব্যর্থ হয়েছে। বৈধ পুনর্লিখন কোথায় শেষ হয়েছিল এবং কোথায় জালিয়াতি শুরু হয়েছিল তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ জানত না। ব্যবহারিক ভাষায়, এর অর্থ হল ইতিহাস সর্বশেষ দলীয় সিদ্ধান্ত বা সর্বশেষ একনায়ককে সমর্থন করার জন্য রচিত।

ইতিহাসের পুনর্লিখনের অর্থ কী? আমরা কতদূর যেতে পারি সেই দিকে? এর অর্থ কি সত্য এবং বস্তুগত পরিবেশনের সমস্ত বোধকে বিদায় জানানো বা এর অর্থ কেবল কিছু অবহেলিত সত্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি পুনরুদ্ধার করা? কেউ কেউ অতীতের দৃষ্টিতে আমাদের বর্তমানকে দেখেছেন, অবশ্যই সেটা কাম্য নয়। তবে বর্তমানের চোখের মধ্য দিয়ে আমাদের অতীতকে দেখাটাও কি ভালো কিছু? নাকি আরও ভাল বিকল্পটি, ভবিষ্যতের কোনো চরমপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের কথা মনে রেখে এখন থেকেই আমাদের অতীত ও বর্তমান দুয়েরই সত্যকে পরিবর্তিত করে ফেলা?

এখন এই সম্পর্কিত অন্যান্য প্রশ্ন আছে। এশিয়া ও আফ্রিকার ইউরোপীয় ইতিহাস কি সব ভুল এবং এর কি পুরোপুরি প্রতিস্থাপনের দরকার আছে? এর কি কিছু মূল্যবান উপাদান রয়েছে, এর উপসংহারটিতে অথবা এর পদ্ধতিতে, যেটিকে ধরে রাখা এবং আরও উন্নত করা উচিত? ভারতীয় প্রসঙ্গে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইতিহাস কি একচেটিয়া ও পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসবিদদের দ্বারা খারাপ ভাবে অঙ্কিত হয়েছে? অথবা, এটিও বহুবচনবাদী এবং এতে অনেকগুলি মতামত রয়েছে, যাদের মধ্যে কিছু দেশের সংস্কৃতি, দর্শন এবং শৈল্পিক সৃষ্টির প্রতি সপ্রশংস?

যদি নিরপেক্ষভাবে দেখা যায় তবে, লেখকদের উদ্দেশ্য এবং এমনকি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক না হওয়া সত্ত্বেও, তাদের ইতিহাস কখনও কখনও আমাদের অতীত সম্পর্কে আরও সচেতন হতে সহায়তা করে। “অতীত” এবং “পুনরায় আবিষ্কার” বলতে সেটাই বলা হয়েছে এখানে।

ভারতের সমস্ত ব্রিটিশ ইতিহাস ভুল ছিল এমন ভাবনা অত্যন্ত অবাস্তব হবে এবং তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এটা সত্যি যে অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক একচোখা ছিলেন। তবে এমনও অনেক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁদের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁদের কাজ করার সত্যিকারের কৌতূহল ছিল এবং তাঁদের পূর্ব-ধারণা এতে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। গবেষণার জন্য তাঁরা ইউরোপে অনুসরণ করা পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করেছিলেন, যেমন পুরাতন পাণ্ডুলিপিগুলি সংগ্রহ করা, জড়ো করা এবং তুলনা করা। তাঁরা পুরানো, ভুলে যাওয়া লিপিগুলি উদ্ধার করেছিলেন এবং প্রক্রিয়াটিতে আমাদের অতীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ আবিষ্কার করেছিলেন। ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, কার্বন-ডেটিং, সংখ্যাতত্ত্বের বিভিন্ন কাজে তাঁদের অবদান রয়েছে। তাঁরা এশিয়ায় ভারতের সাংস্কৃতিক উপস্থিতির যথেষ্ট প্রমাণ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছেন। এটা সত্যি যে, বহুবার তাঁরা তথ্যগুলি বিকৃত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এতে মনগড়া কাহিনী আরোপ করেছিলেন, তবে তথ্যের প্রতি এই নতুন দায়বদ্ধতা নিজস্ব শৃঙ্খলা আরোপ করে এবং সত্যকে নতুন বস্তুধর্মী মাপকাঠিতে অভিব্যক্ত করে। এই বস্তুধর্মী মাপকাঠির জন্য, তাঁদের অনুসন্ধানগুলি সর্বদা তাঁদের পক্ষপাত এবং পূর্ব ধারণাগুলি সমর্থন করে না। উদাহরণস্বরূপ, তাঁদের তথ্য এটা প্রমাণ করেছে যে ভারত উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিকতা এবং ব্যাপক প্রভাব সহ একটি প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে স্বশাসন, স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র, মুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং অবাধ আলোচনার একটি দীর্ঘ ও সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য ছিল।

তবে এই ইতিবাচক বিষয়গুলি স্বীকার করার সময়, এটাও সত্যি যে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা কিছু অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিতে ভারতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করেছিলেন। যদিও সেটা তাঁরা সচেতন ভাবে করেননি ; তবে, এই ক্ষেত্রে সেটি যথেষ্ট বাস্তবসম্পন্ন ও শক্তিশালী ছিল।

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক

ব্রিটিশ পণ্ডিতদের মন দ্রুত-বিস্তৃত সাম্রাজ্যের শাসক হিসাবে তাঁদের অবস্থানকে রূপান্তরিত করেছিল এবং এর দ্বারা নিজেকে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে সুসংহত করার প্রয়োজন হয়েছিল। শাসক হিসাবে তাঁরা একটি নতুন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করেছিলেন এবং তাঁদের ধর্ম দ্বারা আরও শক্তিশালী হয়ে সকলকে সুসভ্য করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই খ্রিস্টান নৈতিকতা এবং একটি খ্রিস্টান ঈশ্বরের আশীর্বাদ দ্বারা অখ্রিস্টানদের সভ্যতার আলোয় আলোকিত করার প্রয়াস করেছিলেন, যতক্ষণ না এই প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যের ক্ষতি করে।

শাসকদের আরও স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। অখ্রিস্টান লোকদের বর্তমান অবস্থা থেকে তাদের অতীত সম্পর্কে কোনও উচ্চ ধারণা থাকলে চলবে না, এটি তাদের প্রশ্ন ছাড়াই এবং এমনকি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখা উচিত। ব্রিটিশ শাসকদের ভারতীয় জনগণকে জানাতে আগ্রহ ছিল যে এখানে কখনও এক জাতি ছিল না। বিবিধ উৎস থেকে আগত বিবিধ লোকদের একত্রিত করা হয়েছিল এবং এই ঐক্যও কোনও নীতি দ্বারা করা হয়নি; তাদের ইতিহাস হানাদার এবং বিজয়ীদের ইতিহাস ছিল এবং তারা কখনও একদেশীয় শাসন জানতে পারেনি; এবং, প্রকৃতপক্ষে তারা স্ব-শাসনের প্রতি উদাসীন ছিল এবং তাদের গ্রাম-জীবন যতদিন অক্ষত ছিল; কে এবং কেন তাদের শাসন করত তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। এই সমস্ত পাঠ এত নিরলসভাবে এবং কর্তব্যপরায়ণভাবে শেখানো হয়েছিল যে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পরেও এই অনুমান এবং বিষয়গুলি এখনও আমাদের বৃহত্তর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিকে রূপ দেয়। এবং সেই রূপটি হলো “ভারত বহু-বর্ণ, বহু-জাতি, বহু-ভাষিক, বহু-সাংস্কৃতিক দেশ এবং তাদের ঐক্যটি প্রকৃতপক্ষে জোর করে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা।” এটা বর্তমানে অনেক নেতা ও অভিজাতদেরও ধারণা।

এগুলি ছিল ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের পূর্ব ধারণা। কিন্তু এই পরিকাঠামোর মধ্যেও বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের ভারতের অতীতের প্রতি একটি সশ্রদ্ধ প্রশংসার স্থান ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ঐতিহাসিক, হিন্দু ভাষা, ব্যাকরণ, স্থাপত্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের জন্য তাঁদের অকৃত্রিম প্রশংসা প্রদর্শন করেছিলেন, তবে এই প্রশংসা একটি নির্দিষ্ট বিন্দু ছাড়িয়ে যেতে পারেনি বা এমন দিঙ্‌নির্দেশও করেনি যাতে জনগণের বৃহত্তর জাতীয় চেতনা এবং গর্ববোধ তাদের নিজেদের একটি প্রাচীন জাতি হিসাবে জাগিয়ে তুলতে পারে। এই ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিজীবী অভিজাতরাও ব্রিটিশ পণ্ডিতদের নেতৃত্ব অনুসরণ করে। তাদের মধ্যে অনেকেই, যদি তারা মার্ক্সবাদী বা মেকলেপন্থী না হন, আমাদের কিছু পুরানো সাংস্কৃতিক সৃষ্টির জন্য গর্ব অনুভব করেন। তবে এই প্রশংসা বৃহত্তর সংস্কৃতিতে পৌঁছাতে পারেনি যার স্রষ্টা ছিল আমাদের প্রাচীন সমাজ এবং যে সমাজের মানুষ, ধর্ম, চেতনা, যেগুলির দ্বারা সেই সংস্কৃতি তৈরী হয়েছিল তাকেও ছুঁতে পারেনি।

আমাদের বলা হয় যে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ঘটিয়েছিল। তারা অবশ্যই তা করেছে। তবে ভারতীয়দের কাছে এটা বলতে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না যে “ভারতীয়দের পূর্বপুরুষেরা একটি সাধারণ ধর্ম ভাগ করে নিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিগুলির আজ আর কোনো অস্তিত্ত্ব নেই এবং তাদের সংস্কৃতির মূল স্রোতে ফিরে আসতেও কোনো বাধা নেই।” অন্যদিকে, ব্রিটিশরা তাদের ইতিহাস যেভাবে রচনা করেছিল তা একটি মুসলিম শাসন এবং একটি মুসলিম আমলের কাল্পনিক রূপকে স্থায়ী করে দেয় যা হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে এবং মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রচার করতে সাহায্য করেছে।

ব্রিটিশদের মূল আগ্রহ ছিল এমন একটি ইতিহাস লেখা যা ভারতে তাদের উপস্থিতি সমর্থন করে। তারা সাম্রাজ্যবাদী শাসক ছিল এবং তাদের পরিস্থিতি ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা তারা তাদের পূর্বের শাসকদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিল। তারা ভারতকে ‘বিজয়ের অধিকারে’ ধরে রেখেছিল; সুতরাং, মোগল, আফগান এবং আরবদের ক্ষেত্রেও তাদের এই অধিকারের বৈধতা স্বীকার করতে হয়েছিল।

তবে এই আত্মপক্ষ সমর্থনটি ব্রিটিশ বিবেকের পক্ষে খুব কুরুচিপূর্ণ এবং নগ্ন ছিল। এটি প্রশমিত করার জন্য, ব্রিটিশরা একটি আইনী এবং নৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলো। তারা বলেছিল যে তারা মোগলদের বৈধ উত্তরসূরি এবং ভারতের অতীতের সঙ্গে ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করেছিল। মোগলদের সাম্রাজ্য নির্মাতা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যারা ভারতকে একত্রিত করেছিল এবং এটিকে আইনশৃঙ্খলা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা দিয়েছিল, “একক সাম্রাজ্য—প্রাকৃতিক আশীর্বাদ”। ব্রিটিশরা নিজেরাই কেবল মোগলদের সাম্রাজ্যিক অধিকারের উত্তরসূরি ছিল এবং দিল্লির সাম্রাজ্যিক কর্তৃত্বকে সমর্থন করেছিল। যা কিছু দিল্লিতে মোগলদের ক্ষমতাকে বাড়িয়েছিল সেগুলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকেও উন্নত করেছিল।

বাস্তবিক ঘটনাবলী মাঝে মাঝে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদেরকে মুসলিম শাসনের নৃশংসতা ও ভাঙচুরের কথা বলতে বাধ্য করেছে, কিন্তু এটি তাদের কর্তৃত্বকে ধরে রাখার বিরুদ্ধে মতামত দেয়নি। কারণ তারা জানত যে সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী সর্বত্র এক এবং অদ্বিতীয়। মোগল শাসকদের গৌরব এবং তাদের অপরাজেয়তার কাহিনীটি খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকেও গৌরবান্বিত করেছিল।

সুতরাং এই সমস্ত কারণগুলি ব্রিটিশদের ভারতে মুসলিম শাসনের ক্ষেত্রে নতুন উৎসাহ দেয়। তাদের নিজস্ব শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করার সময় তারা পূর্বসূরিকে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছিল, যা মোগলরা ভারতীয় জনগণের চোখে কখনও পায়নি। প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর জাতীয় চেতনায় মুসলিম শাসনের ততটুকু বৈধতা ছিল যতটা পরে ব্রিটিশ শাসনের ছিল। উভয়ই বিদেশী শক্তি হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল এবং উভয়কেই একইরকম ভাবে প্রতিরোধ করা হয়েছিল; সময়, সুযোগ এবং প্রচলিত শক্তি দ্বারা যতটা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।

কিন্তু এই একই কারণে দীর্ঘ ও জেদী এই প্রতিরোধকে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা মানতে পারলেন না এবং এটিকে কেন্দ্রের বৈধ সাম্রাজ্যিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ‘অভ্যুত্থান’ বা ‘বিদ্রোহ’ হিসবে উপস্থাপন করেছিলেন। তারা অনুভব করেছিলেন, এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি যথাযথ ছিল যে, ভারতীয় ইতিহাসে এমন কিছু উপস্থাপনার দরকার নেই যা দেখায় ভারতের মানুষ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়েছিল এবং আক্রমণকারীকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং, এইভাবে, ভারতে একটি ইতিহাস তৈরী হয়েছিল, যা ছিল তার আক্রমণকারীদের ইতিহাস এবং যার আধিপত্য তার লোকেরা নম্রভাবে গ্রহণ করেছিল।

মুসলিম ঐতিহাসিকগণ

ব্রিটিশরা মঞ্চে আসার আগেই মুসলিম ইতিহাসবিদরাও একই রকম ইতিহাস লিখেছিলেন। এই ইতিহাসগুলি বেশিরভাগই মুসলিম বাদশাহ্‌দের দ্বারা নিযুক্ত লেখনীকার বা মুন্সিদের দ্বারা লিখিত হয়েছিল। এই লেখকদের কাজ ছিল ইসলাম ও তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থকদের গৌরবান্বিত করা, এমন একটি কাজ যা তারা অত্যন্ত উৎসাহ ও অলংকরণের সঙ্গে সম্পাদন করেছিল। এই কর্ম সম্পাদনে তারা কোনও নৈতিক বা বৌদ্ধিক ছদ্মবেশ গ্রহণ করেনি। ইসলামের গৌরব এবং ‘দারুল-ইসলামে’র (ব্রিটিশ ‘সাম্রাজ্যের’ সমতুল্য মুসলমান সাম্রাজ্য) বর্ধন স্ব-সমর্থনযোগ্য ছিল এবং এর জন্য কোনো কৃত্রিমতার প্রয়োজন ছিল না। তারা কাফেরদের গণহত্যার কথা, তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা, তাদের মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করা এবং একই রকম অত্যাচারের কথা খুব আনন্দের সঙ্গে বলেছিল। স্যার এইচ. এম. এলিয়ট এই দিক্‌টি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

‘হিন্দু’ ঐতিহাসিকগণ

যে সব হিন্দু ঐতিহাসিকরা ব্রিটিশ ও মুলমান ঐতিহাসিকদের সঙ্গে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল তারাও খুব একটা আলাদা ছিল না। এলিয়ট আবারও পর্যবেক্ষণ করেছেন যে “সেই জাতির একজনের কাছ থেকে আমরা সম্ভবত এটাই আশা রাখবো যে তার জাতির অনুভূতি, আশা, বিশ্বাস, ভয় এবং আকুলতা কী, তা সে আমাদের বিবৃত করবে।” তবে এটি এমন ছিল না। অন্যদিকে, তাঁর লেখায়, তিনি বলেছেন যে “তাদের (সেই হিন্দু ঐতিহাসিকদের) ধর্ম বা তাদের জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার কিছুই নেই। তাদের কাছে একজন হিন্দু হল একজন “কাফের” এবং একজন মুসলমান “সত্য বিশ্বাসের একজন”, হিন্দুদের যখন হত্যা করা হয় তখন “তাদের প্রাণ নরকে প্রেরণ করা হয়েছে”, এবং যখন একজন মুসলমান একই পরিণতি ভোগ করেন, তখন তিনি “শাহাদতের পেয়ালা পান করেন বা তাঁকে জন্নতে (স্বর্গে) প্রেরণ করা হয়” বলে তারা লিখেছিলো।

তবে এর পরবর্তী বিষয় এলিয়টকে আরও বেশি অবাক করে। অত্যাচারীরা চলে যাবার পরেও, যখন আর মিথ্যা ইতিহাসকে জোর করে ধরে রাখার দরকার ছিল না, তখনও দাসত্ব মনোভাবাপন্ন ঐতিহাসিক দলের কেউই নিষ্ঠা, আবেগ ও সহমর্মিতার সঙ্গে বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেনি—যেটা একটা জাতির দীর্ঘদিনের অবদমিত ব্যাথাকে স্বীকৃতি দেয়।

হিন্দু মুন্সিদের এই দলটির বা এলিয়ট যাদের ‘স্লেভিশ ক্রু’ বা ‘দাসত্ব মনোভাবাপন্ন’ বলে অভিহিত করেছেন, তাদের একটি দীর্ঘ অতীত রয়েছে এবং সেইসঙ্গে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিকতা। কমা তো দূরের কথা, তাদের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ, তারা বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যম এবং দেশের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় আধিপত্য বিস্তার করেছে।

তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির একটি কারণ হল তাদের দলে ব্রিটিশ ঐতিহ্যবহনকারী ঐতিহাসিকদের যোগদান। তাদের মধ্যে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল তারা শাসন বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক পরেও মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসকদের দৃষ্টিতে ভারতকে বুঝতে চায়। এলিয়ট ‘নৈতিক ক্রোধে’র সঙ্গে সমস্যাটিকে বর্ণনা করেছেন তবে এই ঘটনায় গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিষয়ও জড়িত। পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করা বা অত্যাচার প্রত্যাহার করার তুলনায় এটি আরও জটিল।

হিন্দুরা বহু শতাব্দী ধরে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করেছে এবং এই সময়ে তাদের মনন (Psyche) দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী অত্যাচার একটি চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয়, তবে দীর্ঘমেয়াদী অত্যাচার মননকে অবশ করে মনুষ্যোচিত বৈশিষ্ট্য থেকে ভ্রষ্ট করে। দীর্ঘদিন যাবৎ সামরিক ও আদর্শগত আক্রমণে বহু হিন্দু উদ্যোগ এবং মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলেছে; তারা স্বাভাবিকতা এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে; তারা নিজের মধ্যে গর্ব, তাদের অতীত, তাদের ইতিহাস এবং তাদের জাতির জন্য গর্ব হারিয়েছে। তারা একরকম ‘ভূগর্ভস্থ জীবনে’ বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সবার অলক্ষে এবং ক্ষমাভিক্ষা করে। কেউ কেউ তাদের চিন্তাকে শাসকদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বিন্যাস করে আত্ম-সম্মান উপার্জনের চেষ্টা করেছে। এমনকি তারা শাসকদের হয়ে তাদের নিজের লোকেদের অবমাননাও করেছিল।

দীর্ঘ সময় ধরে এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলি আমাদের দ্বিতীয় প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে এবং তারা একটি নিজস্ব গতিশীলতা অর্জন করেছে। আমরা শাসকদের চোখ দিয়ে নিজেদের দেখতে শুরু করেছি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে, কেউ কেউ ভাবতেন, যে এই সমস্ত কিছু বদলে যাবে, কিন্তু এটি হয়নি। বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক দাসত্বকে মুছে ফেলা রাজনৈতিক দাসত্বকে মুছে ফেলার থেকেও অনেক বেশি কঠিন।

আমরা আমাদের শাসকদের দ্বারা রচিত আমাদের পুরানো ইতিহাস ধরে রেখেছি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতারা এ নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট, এ ছাড়া তারা এটিতে আরও একটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন যা তাদেরকে একটি অতি-বীরের ভূমিকায় চিত্রিত করেছে। নতুন নেতাদের ভারতীয় ইতিহাসের কোনো বৃহত্তর ধারণা নেই এবং তাঁরা নিজেদেরকে বিখ্যাত করার চেয়ে বৃহত্তর কোনও কাজে যোগ দিতেও চেষ্টা করেন না।

প্রকৃতপক্ষে তাঁরা পুরানো ইতিহাসে একটি স্বার্থান্বেষী আগ্রহ গড়ে তুলেছিল যা প্রচার করে যে ভারত কখনই কোনও জাতি ছিল না, এটি এর আগে কোনও স্বাধীনতা-সংগ্রামও করেনি। তাদের ভূমিকাকে উজ্জ্বল করে এমন কিছু জিনিস তারা বিশ্বাস করতে চায়, যে তারাই প্রথম দেশ নির্মাতা, তাঁরাই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভারত তাঁদের হাত ধরেই প্রথমবারের জন্য স্বাধীন হয়েছে। এটি তাদের অহংকে চূড়ান্ত করে তোলে। ভারতের অতীতের প্রতি তাঁদের অশ্রদ্ধা ব্রিটিশ ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতোই অজ্ঞ ও বিদ্বেষপূর্ণ। তাই এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে আমরা অতীতে, বিদেশী আধিপত্যের দিনগুলিতে, যে অবজ্ঞার সঙ্গে আমাদের ইতিহাসকে অনুভব করতে শিখেছি, এখনও সেরকমই চলছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে বিকৃতির একটি নতুন উৎস সৃষ্টি হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী নেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে মুসলিমদের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। এই পরিণতির কথা মনে রেখে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিজেই মধ্যযুগীয় ইতিহাসের পুনর্লিখন শুরু করে। এই অনুপ্রেরণায়, মুসলিম শাসকরা ‘স্বদেশী’ হয়ে যান, এমনকি তাঁরা ‘জাতীয়তাবাদী’ হয়ে ওঠেন। যেসব হিন্দু রাজারা অতীতে এইসব মুসলিম রাজাদের মুখোমুখি হয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করেছিল তাদের মর্যাদা সুপরিকল্পিতভাবে হ্রাস করা হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, কীভাবে এই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয় নেতারা একটি ‘কাল্পনিক ইতিহাস’ প্রস্তুত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটি এমনও ঘোষণা ছিল যে “মুসলিম শাসনকালে হিন্দুরা কোনো জাতিই ছিল না।” এই অযৌক্তিক ও হাস্যকর ধারণাটি উনিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় নেতাদের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল! শতাব্দীর শেষে তাকেই ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।

মার্ক্সবাদী বিকৃতি

মার্ক্সবাদীরা ভারতীয় ইতিহাসকে বৃহৎ আকারে নতুন করে লেখার উদ্যোগ নিয়েছে; এর পদ্ধতিগত মিথ্যাচারই এর মূল লক্ষ্য। তাদের একটি গোঁড়া মতবাদ রয়েছে এবং তাদের কাছে যে কোনও ইতিহাসের ব্যবহারই হল সেই গোঁড়ামি প্রমাণ করার জন্য। তাদের সত্যই সত্যের কাছে ক্ষতিকারক। তবে এটি একটি বৃহৎ বিষয় এবং এটি এখানে আলোচনার পরিধির বাইরে যদিও তাদের পদ্ধতিটি বর্তমান বিষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

মার্ক্সবাদীরা ভারতের, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং দর্শনের জন্য ভারতবর্ষের প্রতি অবজ্ঞার দৃষ্টি পোষণ করেন। এটি সবচেয়ে গোঁড়া সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের, যা মানুষের অবমানকে ছাড়িয়ে যায়। কিছু ব্রিটিশদের প্রাচ্যের প্রতি সহজাত আকর্ষণ ছিল বা তাদের পূর্বসূরিদের শাসিত রাজ্যের প্রতি একটি পিতৃসুলভ উদ্বেগ ছিল, মার্ক্সবাদীদের এসব কোনও সংবেদনশীলতাও নেই। উৎপাদনের আদিম ভিত্তিটি ছিল অত্যন্ত বর্বর এবং এটা সহজেই বোঝা যায়। সুতরাং এর উপর যে সাংস্কৃতিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল সেটাও একইরকম, তা সহজেই অনুমেয়। মার্ক্স কতটা ইউরোপ-অভিমুখী ছিলেন সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তিনি সমস্ত এশিয়া ও আফ্রিকাকে পশ্চিমি সভ্যতার আরেকটা সংযোজন হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত তত্ত্ব ধার নিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে, ভারত সম্পর্কে তাঁরা যা লিখেছিলেন সেগুলিই ছিল তাঁর চিন্তার ভিত্তি। তাঁদের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন যে ভারতীয় সমাজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, থাকলেও তা ছিল অজানা। যেটাকে আমরা ভারতের ইতিহাস বলি, এটি অনুপ্রবেশকারীদের ইতিহাস ও তাদের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে যুক্ত। তাদের সঙ্গে তিনি এও বিশ্বাস করেন যে ভারতে স্ব-শাসন বলে কিছু ছিল না। তাঁর আলোচনাটির কেন্দ্র হল ভারত কেন ব্রিটিশ দ্বারা প্রভাবিত (এবং শাসিত) হবে, কেন তা পার্সিয়ান বা রাশিয়ান বা তুর্কী দ্বারা নয়। এ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব পছন্দটি খুব পরিষ্কার। তিনি ভারতকে পরোক্ষভাবে তার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থেকেই বঞ্চিত করেছেন। ভারতীয় মার্ক্সবাদীরা এই তত্ত্বকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন। তা ছাড়াও তাঁরা ‘তুর্কি’দের ভারত বিজয়ের বিষয়েও যথেষ্ট সপ্রশংস। ভারতীয় মার্ক্সবাদীরা এই বিজয়ে একটা কাব্যিক পরিপূর্ণতা খুঁজে পায়। আসুন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদাহরণ দিয়ে এটি বর্ণনা করি। আমাদের বলা হয় যে রায় মার্ক্সবাদ ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাঁর প্রশংসা বজায় রাখতে যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহী ছিলেন। তিনি ‘ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা’ শীর্ষক একটি বইতে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ‘আরব সাম্রাজ্য’কে মোহাম্মদের স্মরণে একটি দুর্দান্ত স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে প্রশংসা করেন। তিনি ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণের প্রশংসা করেন এবং জানান যে ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ার ভুক্তভোগীদের দ্বারা কীভাবে এটিকে নতুন আশা ও স্বাধীনতার বার্তা হিসাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এর আগে মানবেন্দ্রনাথ রায় ‘আমাদের দেশের’ কথা একটি এমন প্রসঙ্গে বলেছিলেন যা মোসলেম সাম্রাজ্য থেকে প্রায় মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এটি বহু আগে ছিল যখন তিনি নিছক জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং মার্ক্সবাদের প্রভাবে আসেননি। মার্ক্সবাদ মানুষকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি সপ্রশংস হতে শেখায়; এটি পুরানো সাম্রাজ্যবাদকে আদর্শায়িত করে এবং একটি নতুন সাম্রাজ্যবাদের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করে। এর গভীর চালিকা শক্তি হল স্ব-বিচ্ছিন্নতা এবং তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা।

মার্ক্সবাদী লেখক এবং এই ধরনের ইতিহাসবিদরা পুরো জায়গা জুড়ে রয়েছে এবং শিক্ষা এবং প্রচারমাধ্যমের বিভিন্ন বিভাগেও তাদের উপস্থিতি পুরোভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি, গবেষণা অনুদান প্রদান, পাঠসূচী নির্ধারণ, এবং পাঠ্য-পুস্তক বাছাই ও নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের বক্তব্য অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। তাদের দর্শন, ধারণা এবং প্রভাবকে অপসারিত না করে ভারতের সত্য ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৮৯

(ক্রমশ)