বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫১

– অভীক মুখোপাধ্যায় 

(পঞ্চশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৫১ 

সন্দেহভাজন ১ : ফিদেল কাস্ত্রো

‘কাস্ত্রোকে আমরাই তৈরি করেছি, দাঁড় করিয়েছি। আমরা ওই ঘুষখোর একনায়ক বাতিস্তার অত্যাচার দেখে না – দেখার ভান করেছি, আর তা থেকেই জন্ম হয়েছে কাস্ত্রোর। আর এখন আমরা সেই কাস্ত্রোকেই ভয় পাচ্ছি।’

–জন এফ কেনেডি।

কাস্ত্রো কেনেডিকে কেন হত্যা করবেন? তাও এমন একটা সময়ে, যখন কেনেডিকে তাঁরই দেশে কমিউনিস্ট বলে দাগানো হচ্ছিল। সোভিয়েতের সঙ্গে পরমাণু সঙ্কটের পরে কেনেডি কথা দিয়েছিলেন, তিনি কখনও কিউবাকে আক্রমণ করবেন না। কাস্ত্রো – বিরোধী মাফিয়া আর জিমি হোফফাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিচ্ছিলেন ববি কেনেডি। সবকিছু দেখলে বলা চলে, কেনেডির মৃত্যুর পরে রিচার্ড নিক্সন মসনদে বসলে কাস্ত্রোর পক্ষে তা বেশি বিপজ্জনক ছিল। তাহলে কেন?

হতে পারে অপারেশন মনগুজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে। কেনেডি একটা সময়ে কাস্ত্রোকে সাপ মনে করেছেন বলেই নেউল পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। সি আই এ স্পনসরড এই অপারেশন মায়ামি ইউনিভার্সিটিতে চলছিল। বহুমুখী পরিকল্পনা। কোনও পরিকল্পনার মাধ্যমে কিউবার ফসল নষ্ট করে দেওয়ার ব্যাপার ছিল, আবার কোনওটায় কিউবার আম আদমিকে ক্ষেপিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা হতো। কাস্ত্রো – বিরোধী কিউবান নাগরিকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার কথা যেমন ছিল, তেমনই ছলে – বলে – কৌশলে কাস্ত্রোকে গুপ্তহত্যার ব্যাপারেও ভাবা হয়েছিল। এই সবকিছুই চলছিল একজন ব্যক্তির অঙ্গুলিহেলনে, তাঁর নাম ববি কেনেডি।

হ্যাঁ, অপারেশন মনগুজের রাজনৈতিক মস্তিষ্ক ছিলেন ববি, কিন্তু ববিকে তো গুলি মারা হয়নি। তাহলে কি নিশানায় ভুল ছিল? নাকি প্রতিশোধের শৃঙ্খলার শুরুটা রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডিকে দিয়েই হয়েছিল?

কাস্ত্রোকে হত্যা করার সম্ভাব্য সকল প্রয়াস করা হয়েছিল। ঘৃণ্য সকল চেষ্টাই করেছিল সি আই এ। কেনেডির মাফিয়া বন্ধু গিয়াংকানোকে সুপারি দেওয়া হল, কাস্ত্রোকে মেরে দাও। অপর একট পরিকল্পনায় একখানা সোভিয়েত ফাইটার প্লেন জোগাড় করে রাখা হল। সেটাকে দিয়ে নিজেরাই আমেরিকার বুকে আক্রমণ করিয়ে বলা হবে সোভিয়েত অ্যাটাক করেছে, তারপর আমেরিকা আক্রমণ করবে। কাস্ত্রোর এক মন্ত্রীকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করা হল, যাতে সে কাস্ত্রোকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে মারে। কাস্ত্রোর চুরুটে কখনও মাখানো হল বিষ, কখনও গুঁজে দেওয়া হল বিস্ফোরক পদার্থ।

কেনেডি সম্মতি দিয়েছিলেন, চালাও অপারেশন। তবে তাঁর মনে আরেকটা কোথাও উঁকি মারছিল। এ ধরণের অপারেশন চালিয়ে কিউবান হিরোকে নিকেশ করে দিলে কিউবা আরও সাংঘাতিক হয়ে উঠতে পারে। কাস্ত্রো কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে বেশ উঁচু দরেরই ছিলেন। মাথা খাটাতেন। শত্রুর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলে সে বন্ধু না হলেও শত্রু অন্তত থাকবে না এটা বুঝতেন। সুযোগের সদ্বব্যবহার করার সমস্ত গুণাগুণ তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি যেমন সোভিয়েতের সাহায্য নিয়েছেন, সোভিয়েতের নিন্দে করতেও পিছপা হননি। নিহত হওয়ার কিছুদিন আগেই কেনেডি তাঁকে একটি বার্তা পাঠান। কাস্ত্রো সেই বার্তা পেয়েই কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। আমেরিকা তুলনামূলক ভাবে ফিদেলকেই চাইছিল, কারণ তাঁদের মনে হচ্ছিল ফিদেল মরে গেলে তাঁর ভাই রাউল আর কমরেড চে গেভেরার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে, দুজনেই বিপ্লবী মেজাজের লোক — দক্ষিণ আমেরিকায় জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবে।

হয়তো এই কারণেই ১৯৬৩ সালের জানুয়ারির শুরু থেকেই কেনেডি বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে, এবার সি আই এ-এর অপারেশন মনগুজ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এর চেয়ে বরং কিউবা সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার দেখার জন্যে একটা কমিটি গঠন করা হোক। সি আই এ – এর হস্তক্ষেপের ক্ষমতা খর্ব করার কথাও উঠল।

কিন্তু রাজনীতির রঙ সোনালী পাপড়ি কিংবা গোলাপি পরাগ নয়, চোরাবালির মতো ধূসর। তাতে একবার পা ফেলেছ কি মরেছ। সে তোমাকে গিলতেই থাকবে। বেরিয়ে আসার প্রত্যেকটা হরকৎ তোমার আয়ুরেখাকে ছোট করতে থাকবে তখন। যে চক্রব্যূহে কেনেডি প্রবেশ করেছিলেন, তা থেকে বেরোনোর আর একটাই পথ খোলা ছিল — কেনেডির মৃত্যু।

কাস্ত্রো এই রাজনীতিটা ভালো বুঝতেন। তাই তিনি সারভাইভ করে গিয়েছিলেন। নিজেকে সদা প্রস্তুত রাখতেন। কাস্ত্রোর বোন ইয়ুনিতা আমেরিকার পক্ষে চলে গিয়েছিলেন। ডোমিনিকান রিপাবলিক আর ভিয়েতনামের একনায়কদের শেষ করে দিচ্ছিল সি আই এ। কাস্ত্রো অনুভব করছিলেন, হিট লিস্টে পরের নামটা তাঁরই রয়েছে। নেউলের দলে এবার কাস্ত্রোর লোক ঢুকে পড়ল। কাস্ত্রোর গুপ্তচরেরা সি আই এ – এর অপারেশন মনগুজকে ট্র্যাক করছিল।

কেনেডির হত্যাকারী রূপে পরিচিত অসওয়াল্ডের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে বসলে অবাক লাগে। মরার আগে সে বলেছিল যে তাঁকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। কিন্তু কে করল? সে কথাটি বলে যাওয়ার সুযোগ বাবু পাননি। সম্প্রতিকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প কেনেডির হত্যা সংক্রান্ত কয়েকটি গোপন ফাইলকে সার্বজনীন করেন। তা থেকে জানা যায় অসওয়াল্ড কিউবার সিক্রেট এজেন্সিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল। কেনেডি নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে অসওয়াল্ড কাস্ত্রোর সমর্থনে লিফলেট বিলি করেছিল। কাস্ত্রো – বিরোধীদের সঙ্গে সে ঝামেলাতেও জড়িয়ে পড়ে। আবার গ্যারিসন রিপোর্ট বলছে, অপারেশন মনগুজে নিয়োজিত অনেক লোকের সঙ্গেই অসওয়াল্ডের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। সমকামীদের একটি পার্টিতে অসওয়াল্ডকে দেখা গিয়েছিল বলেও শোনা যায়।

কেনেডি হত্যাকাণ্ডের আগে একবার অসওয়াল্ডকে মেক্সিকো সিটির কিউবা এমব্যাসিতে ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে ডাবল গেম খেলছে কিনা। সে নিজের বন্দুকও বের করে দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমি নিজের সততা প্রমাণ করে দেব। কেনেডিকে আমি নিজের হাতে করে মারব।’

(ক্রমশ)