শ্যামাপ্রসাদ: ফিরে দেখা – ২

0
1428

(পূর্ব প্রকাশিতের পর…..)

১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির দাবিতে কলকাতায় এক গণবিক্ষোভের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মতপার্থক্যের জন‍্য বহিষ্কৃত হলেও কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে নেমে পড়ে। মুসলিম লীগ অবশ‍্য মুসলিম অফিসারদের মুক্তির দাবিতে বেশি জোর দিয়েছিল। তবে দুই দলেরই আসল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৪৫-৪৬এর সেন্ট্রাল লেজিসটেটিভ অ্যাসেম্লীর নির্বাচন। ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় এই গণবিক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের উদ‍্যোগে ২১শে নভেম্বর কলকাতায় ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং আইএন এ অফিসারদের মুক্তির দাবিতে এক শোভাযাত্রা হয়। সুভাষচন্দ্র বসুর মুক্তি সংগ্রাম এবং আগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করার পরে রাজনীতির মূলস্রোতে ফিরে আসার চেষ্টায় কমিউনিস্ট পার্টিও এতে যোগ দেয়।মিছিলের গন্তব্য ছিল ডালহৌসী স্কোয়ার এবং ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে মিছিল এগোতে থাকে। ম‍্যাডান স্ট্রিটের কাছে পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করে, কেননা ডালহৌসী স্কোয়ার ছিল prohibited place, ছাত্রদের সেটা জানা ছিল না,তারা পুলিশের নিষেধ মানতে রাজী হয় না।আনন্দবাজার পত্রিকার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক শ্রী শংকর ঘোষের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, রাত আটটা পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ছিল। তারপর ভিড়ের মধ‍্যে ইটপাটকেল পড়ে, অশ্বারোহী এবং সাধারণ পুলিশ ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পুলিশ গুলি চালায়। রামেশ্বর বন্দোপাধ‍্যায় এবং আবদাস সালাম নামে দুইজন ছাত্রের মৃত্যু হয়।রাত দশটায় গভর্নর কেসি ঘটনাস্থলে আসেন।। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের কাতর অনুরোধ ছিল যে অন্তত একবার শ্রী শরৎচন্দ্র বসু ঘটনাস্থলে আসেন, যিনি মাত্র কয়েকমাস আগে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং বাঙ্গালী এক অভূতপূর্ব সম্বর্ধনার মাধ‍্যমে তাঁকে বরণ করেছিল। শরৎবাবু আসতে অসম্মত হন, এবং তিনি যে বার্তা পাঠান, তার শুরুতে লেখা ছিল, “Students,you have broken my heart”. ছাত্ররা বিস্মিত, ব‍্যথিত ও ক্রুদ্ধ হয়।

শ্রী শংকর ঘোষের লেখা থেকে জানা যায়, গভীর রাতে শ‍্যামাপ্রসাদ ছাত্রদের মধ্যে উপস্থিত হন। আসলে শ‍্যামাপ্রসাদ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাধাবিনোদ পাল, দুজন একসঙ্গে এসেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের ডাইরি অনুযায়ী, ” ওয়াছেল মোল্লার দোকানের কাছে মোড়ের ওপর দেখলাম রণসজ্জা।পুলিশ বহুসংখ্যক, তারা সাজসজ্জা নিয়ে প্রস্তুত।  সামনে ছেলের দল-কখনও চিৎকার করছে-সব মাটিতে স্থির হয়ে বসে আছে।শুনলাম লাটসাহেব সেখানে উপস্থিত।আমরা এসেছি শুনে তিনি এগিয়ে এলেন। আমাদের অনুরোধ করলেন ছেলেদের বলতে,তারা যেন এখন রাস্তা থেকে উঠে বাড়িতে চলে যায়। আমি ছেলেদের কাছে এগিয়ে গেলাম।তারা বিপুল ধ্বনি করে চেঁচিয়ে উঠল”।

সেদিন রাত তিনটে পর্যন্ত শ‍্যামাপ্রসাদ ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন। শ্রীমতী জ‍্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীর সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়। জ‍্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী শরৎ বসুকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। শ‍্যামাপ্রসাদের ডাইরীর অনুসারে ” সেখানে পারিষদবর্গ পরিবেষ্টিত হয়ে নেতা মহারাজ বসে ছিলেন।পার্ষদরা বল্লেন যে তাঁরা শরৎবাবুকে এই বিপদের মধ্যে যেতে দিতে পারেন না। বাংলায় আর নেতা নেই(?), শরৎবাবু সেখানে গেলে হয়ত তাঁর‌ই মাথায় লাঠির র ঘা বা গুলির আঘাত পড়বে।এত বড় বিপদের মধ‍্যে তিনি যান কিভাবে ইত‍্যাদি। এইবার বেলুন ফাটার মত শরৎ বোসের নেতৃত্বের ভন্ডামী ধরা পড়ে গেল। প্রভেদ তাঁর আর সুভাষের মধ্যে কত তাও বুঝতে পারা গেল। কিরণশঙ্কর রায়কে তিনি ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও কিছু করতে পারেন নি।”

অত‍্যন্ত দুঃখের বিষয় পরের দিনই জ‍্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী যে গাড়িতে যাচ্ছিলেন, তাকে একটি মিলিটারী ট্রাক ধাক্কা মারে এবং তিনি নিহত হন।

পরের দিন শ‍্যামাপ্রসাদ হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজ নেন। ইতিমধ্যে ধর্মতলায় আবার জনসমুদ্র তৈরী হয়েছিল। শ‍্যামাপ্রসাদ পুলিশ কমিশনারকে বলেন, বাধা দিলে জালিয়ান‌ওয়ালাবাগের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বরং তিনি অনুরোধ করলে এরা এখন শান্তভাবে চলে যাবে,এবং পরে রামেশ্বরের মৃতদেহ সৎকারের জন‍্য কেওড়াতলা শ্মশানে যেতে পারে।

কমিশনার মাথা ঠান্ডা রেখে শ‍্যামাপ্রসাদের অনুরোধ রেখেছিলেন। শ‍্যামাপ্রসাদ রামেশ্বরের বাবা মা কে নিয়ে মর্গে যান, সেখান থেকে শবদেহ নিয়ে কেওড়াতলায় সৎকার সমাধা করেন।

১৯৪৬ এর ২৪শে মার্চ ক‍্যাবিনেট মিশন ভারতে পদার্পণ করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ভারতসচিব পেথিক লরেন্স, বাকি সদস‍্যরা ছিলেন স‍্যার স্ট‍্যাফোর্ড ক্রীপ্স এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান এ.ভি আলেকজান্ডার। ১৬ই মে মিশন এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের পরিকল্পনা ঘোষণা করে ।পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে একটি কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে যার হাতে থাকবে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ। বাকি সব ক্ষমতা থাকবে রাজ‍্যগুলোর হাতে। রাজ‍্যগুলোকে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করা যেতে পারে

১)হিন্দুপ্রধান রাজ‍্য,যেমন মাদ্রাজ,বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড), মধ্য ভারত এবং ওড়িশা।

২)মুসলিম প্রধান রাজ‍্য যেমন পঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধ।

৩) যেখানে মুসলিমদের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে সামান্য বেশী, বাংলা ও অসম।

রাজ‍্য বিধানসভাগুলি গণপরিষদের জন‍্য প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে যা রাজ‍্যে হিন্দু মুসলমানের জনসংখ্যার অনুপাতে ঠিক হবে। গণপরিষদ বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রুপের জন‍্য সংবিধান বানাবে,তবে যতদিন তা না হয় প্রশাসন চালানোর জন‍্য কেন্দ্রে একটি অন্তর্বতী সরকার গঠিত হবে।

তবে এই তিনটি গ্রুপ এমন একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন ছিল যার হাতে কোন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল না, অর্থাৎ দুই গ্রুপের মধ‍্যে ঝামেলা হলে কে মেটাবে তার কোন ব‍্যবস্থা নেই।

কংগ্রেস গ্রুপিং এর বিরোধী ছিল, আপোষহীন ভাবে বিরোধিতা করেছিলেন গান্ধী এবং পটেল। যদিও মৌলানা আজাদ এবং নেহরু রাজী ছিলেন।জিন্নার কাছে মনে হয়েছিল এটা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ।

১৬ই জুন মিশনের তরফ থেকে চোদ্দজনের এক মন্ত্রীসভা ঘোষণা করা হয়।মন্ত্রীরা ছিলেন শ্রী জ‌ওহরলাল নেহরু, সর্দার প‍্যাটেল, শ্রী সি রাজাগোপালাচারী, শ্রী রাজেন্দ্র প্রসাদ, শ্রী হরেকৃষ্ণ মহতাব, জনাব মহম্মদ আলী জিন্না, জনাব লিয়াকত আলী খান, জনাব খাজা নাজিমুদ্দিন, জনাব মহম্মদ ইসমাইল খান, জনাব আবদুর রব নিস্তার, সর্দার বলদেব সিং, এন পি ইঞ্জিনিয়ার, শ্রী জন মাথাই এবং বাবু জগজীবন রাম ।কংগ্রেস তা প্রত‍্যাখান করে, যদিও তারা ১৬ই মের  প্রস্তাবে রাজী হয়, কেননা তা প্রত‍্যাখান করলে ভাইসরয় ওয়াভেল জিন্নাকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন‍্য ডাকতে পারেন।

জিন্না কংগ্রেসের ১৬ই জুনের প্রস্তাব অস্বীকার করায় ক্রুদ্ধ হন এবং অন্তর্বতী মন্ত্রীসভায় যোগদানে বিরত থাকেন। লীগ ১৬ই মের চুক্তির প্রতি সমর্থন প্রত‍্যাহার করে। ক‍্যাবিনেট মিশন ব‍্যর্থ হয়। প্রস্তাব প্রত‍্যাহারের সময় জিন্না এক স্মরণীয় ভাষণে বলেন, “আজ আমাদের হাতেও পিস্তল আছে এবং আমরাও তা ব‍্যবহার করতে জানি।”

ব‍্যবহার করতে যে জানেন তা কিছুদিনের মধ‍্যেই জানা যায়, ১৬ই অগস্ট কলকাতায়ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা মহাসমরের মাধ্যমে।কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন করে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তণ অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্র তাঁ আত্মজীবনীতে লিখেছেন “আমরা অবশ‍্য মনস্থির করেছিলাম ,যে কংগ্রেস দল আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল, যে দল স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেবে ,তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হ‌ওয়াই ভালো, আমরা পাকিস্তানের বিশ্বস্ত নাগরিক হবো,সব সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলে মিশে নতুন দেশ গঠন করব “।

ষোল থেকে কুড়ি অগস্ট কলকাতা শহরে প্রেতনৃত‍্য চলে, ১৫ই অগস্ট শেষরাত থেকে মুসলিম প্রধান এলাকা থেকে ট্রাকভর্তি করে সশস্ত্র জেহাদীদের হিন্দুপ্রধান এলাকায় পাঠানো হয় । এর পর হিন্দু প্রত‍্যুত্তর শুরু হয়। দাঙ্গার তৃতীয় দিনে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক শ্রী শংকর ঘোষ এক সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গী হিসেবে লালবাজারে ঢুকে সেখানকার কন্ট্রোল রুম থেকে বেঙ্গল প্রিমিয়ার সুরাবর্দীকে বেরিয়ে আসতে দেখেন। দুইজন ব্রিটিশ লেখক লেওনার্ড মোসলে  ( লাস্ট ডেজ অফ ব্রিটিশ রুল ) আর মাইকেল এড‌ওয়ার্ডস(লাস্ট ইয়ার্স অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া)  স্পষ্টভাবে লিখেছেন সুরাবর্দী কিভাবে পুলিশকে হিন্দু নিধন যজ্ঞে ব‍্যবহার করেছিলেন।

“গ্রেট ক‍্যালকাটা কিলিং” র দুইমাসের মধ‍্যে নোয়াখালীতে পরিকল্পিত হিন্দুহত‍্যা হয়।চট্টগ্রাম বিভাগের ইংরেজ কমিশনার উইলিয়াম ব‍্যারেট একটি রিপোর্ট ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছিলেন, যাতে অকুন্ঠভাবে বলেছিলেন সুরাবর্দী কিভাবে ব্রিটিশ ম‍্যাজিস্ট্রেট, ডিভিশনাল কমিশনার এবং পুলিশ সুপারদের কাছে নিষ্ক্রিয় থাকার অলিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুরাবর্দীর কাজে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল লর্ড ওয়াভেলের।

এই পরিস্থিতিতে শ‍্যামাপ্রসাদ বলতে বাধ‍্য হলেন”পাকিস্তান হোক বা না হোক,বাংলার বর্তমান প্রাদেশিক সীমানার মধ‍্যেই দুটি আলাদা প্রদেশ গঠনের দাবী জানাচ্ছি।” এক খোলা চিঠিতে তিনি লেখেন  ” বাংলা যদি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে বাঙালী হিন্দু চিরতরে মুসলমান শাসনের অধীন হয়ে যাবে। সম্প্রতি হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর যেভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে, এর ফলে হিন্দু বাঙ্গালী সংস্কৃতির অবসান ঘটবে।”বলাবাহুল্য বাঙ্গালী হিন্দুর পুরো সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর সুরাবর্দীকে আর বাঙ্গালী হিন্দুরা বিশ্বাস করতে পারেন নি।

১৯৪৬-৪৭ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক অন‍্যতম অন্ধকার অধ‍্যায়। নোয়াখালীর পর দাঙ্গা শুরু হয় বিহারে, পঞ্জাবে। ১৯৪৭ র ২২শে মার্চ লর্ড ওয়াভেলের জায়গায় ভাইসরয় হয়ে আসেন লর্ড মাউন্টব‍্যাটেন। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি গান্ধীজীকে না জানিয়েই দেশভাগের প্রস্তাবে সম্মতি জানায় কেননা সংশ্লিষ্ট নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে পচন ধরা অংশটি অস্ত্রোপচার না করলে ধ্বংস অনিবার্য। পঞ্জাব আর বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত  হয়। মাউন্টব‍্যাটেনের কূটনীতিতে পরাস্ত হয়ে জিন্নাও বাধ‍্য হন পোকায় কাটা পাকিস্তান গ্রহণ করতে।

শ‍্যামাপ্রসাদ এইসময় বাংলা বিভাগের পক্ষে জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।’৪৭ র মার্চেই  কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকার এক সমীক্ষায় দেখা যায় ৯৮.৬% পাঠক‌ই দেশবিভাগের পক্ষে।তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার এক বিশাল জনসভায় দেশভাগের আনুষ্ঠানিকভাবে দেশভাগের দাবি গৃহীত হয়। পরের মাসেই হিন্দু মহাসভা আর কংগ্রেসের যৌথ উদ‍্যোগে দেশভাগের দাবীতে কলকাতায় এক বিশাল সভা হয়, যার সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স‍্যার যদুনাথ সরকার।

এদিকে বাংলায় এক নতুন নাটকের যবনিকা উত্তোলন হয়। বাংলায় ব্রিটিশ পুঁজি এবং ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার্থে গভর্নর বারোজ কলকাতাকে একটি স্বাধীন শহর এবং বন্দর ঘোষণার প্রস্তাব করেন,এবং সেটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাবে পরিণত হয়। এই প্রস্তাবের প্রবল সমর্থক ছিলেন দেশভাগের তীব্র বিরোধী শ্রী শরৎচন্দ্র বসু। বাংলা কংগ্রেস থেকে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন শ্রী কিরণশঙ্কর রায়।সুরাবর্দী শরৎবাবুকে সমর্থন করেন।তাঁর সঙ্গে শরৎবাবুর বোঝাপড়া হয় এই শর্তে যে স্বাধীন বাংলা সরকারে হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় থেকে সমসংখ্যক মন্ত্রী থাকবে, প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম, গৃহমন্ত্রী হবেন হিন্দুনেতা । এই ফয়সলা শুনে ফর‌ওয়ার্ড ব্লকের সদ‍স‍্যরাও শরৎ বসুর বিপক্ষে চলে যায়। ওইসময় এক ইস্তাহারে কড়া ভাষায় লেখা হয়েছিল, “শ্রী শরৎ বসু দেশভাগের বিরোধিতা করছেন কেননা তিনি নিজে সুরক্ষিত এলাকায় বাস করেন…. যদি তিনি নেতাজীর ভাই না হতেন, আমরা এই কাপুরুষের মুখ চিরকালের জন‍্য বন্ধ করে দিতাম। আমরা চাই দেশভাগ হয়ে হিন্দুপ্রধান মন্ত্রীসভা গঠিত হোক কিন্তু শরৎ বসুর মত হিন্দু যেন সেখানে স্থান না পায়। আমরা চাই শ‍্যামাপ্রসাদের মত হিন্দু মন্ত্রী।”

স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবে জিন্না মৌন ছিলেন, তবে নেহরু এবং সর্দার প‍্যাটেল এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, কেননা এই প্রস্তাব ছিল ভারতের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। বামপন্থীদের মনোভাব অবশ‍্য অন‍্যরকম ছিল । কমরেড অশোক মিত্র লিখছেন, “এই বিশেষ মুহূর্তে শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাসেম কর্তৃক অখণ্ড বঙ্গদেশের যুগ্মপ্রস্তাব যার সঙ্গে হাসান শহিদ সোহরাবর্দিও খানিক বাদে নিজেকে যুক্ত করলেন।অকূলপাথারে যেন পরিত্রাণের ইঙ্গিত পেলাম।বঙ্গভূমিস্থ প্রায় প্রতিটি বামপন্থী দল এই প্রস্তাবের পক্ষে, কিন্তু হলে কি হবে কংগ্রেসের অন‍্যদিকে ঝুঁকে পড়া।এবং কংগ্রেসের নতুন মিত্র হিন্দু মহাসভা। শ‍্যামাপ্রসাদ উঠে পড়ে লাগলেন, বাংলাদেশ যাতে ভাগ হয়ে যায় এবং হিন্দুপ্রধান পশ্চিমপ্রান্তের জেলাগুলি যাতে ভারতের অঙ্গীভূত হয়,পুবের জেলাগুলির মানুষজন পড়ে মরুক গে।” অবশ‍্য অখণ্ড যুক্তবঙ্গে সংখ‍্যালঘু হিন্দুদের কি হাল হত কমরেড তা লেখেন নি।

জনসমর্থনের অভাবে যুক্তবঙ্গ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হয়। ১৯৪৭এর দোসরা জুন সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ ভারত বিভাগের প্রস্তাব মেনে নেন। ঐ প্রস্তাবে এটাও বলা হয়েছিল যে বাংলা, সিন্ধুপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের বিধানসভায় নির্বাচিত সদস‍্যরা ভোটের মাধ‍্যমে তাঁদের রাজ‍্য কোন দিকে থাকবে স্থির করবেন। দুভাগে ভোট হয়। প্রথম ভোটে পাকিস্তানপন্থীরা ১২৬-৯০  ভোটে জেতেন। এরপর দেশভাগের সমর্থকরা জেতেন ৫৮-২১ ভোটে। দেশভাগের পর হিন্দুপ্রধান বাংলার অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। শ‍্যামাপ্রসাদ দীপ্তকন্ঠে কংগ্রেস নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “You partitioned India ,and I partitioned Pakistan” .

বামপন্থীদের তরফ থেকে শ‍্যামাপ্রসাদের সম্পর্কে যে অভিযোগ করা হয়, সেগুলি কতটুকু সত‍্য? বলা হয় শ‍্যামাপ্রসাদ সাম্প্রদায়িক, ব্রিটিশদের দালাল। একজন সাম্প্রদায়িক ব‍্যাক্তিকে ফজলুল হক কি মন্ত্রীত্বের জন‍্য আমন্ত্রণ জানাতেন?একজন ব‍্যাক্তি ভাইস চ‍্যান্সেলর হিসেবে যদি ব্রিটিশ প্রতীকের পরিবর্তে নিজস্ব প্রতীক প্রবর্তন করার চেষ্টা করেন, যিনি পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর  সরকারের কুকীর্তির প্রকাশ‍্য সমালোচনা করে মন্ত্রীসভা থেকে পদত‍্যাগ করেন, তাঁকে কি ব্রিটিশদের দালাল বলা যায়? শ‍্যামাপ্রসাদ এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে হিন্দু বাঙ্গালীর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। পরিশেষে বলা যায় যে বামপন্থী মহল থেকে শ‍্যামাপ্রসাদের সম্পর্কে এইসব কুৎসা যটনা করা হয়, সেই কমিউনিস্টরা ১৯৪২এর ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করে, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে পরবর্তী সময়ে স্বয়ং স্ট‍্যালিনের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সত‍্যি চিরকাল চাপা রাখা যায় না।

 

তথ‍্যসূত্র:

১) শ‍্যামাপ্রসাদ , কবিশেখর কালিদাস রায়, শ‍্যামাপ্রসাদ ফাউন্ডেশন, আশুতোষ মুখার্জী মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট।

২) হস্তান্তর,প্রথম পর্ব,শংকর ঘোষ,আনন্দ পাবলিশার্স।

৩) ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, পত্রলেখা।

৪)বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী,আনন্দ পাবলিশার্স।

৫)আপিলা চাপিলা,অশোক মিত্র,আনন্দ পাবলিশার্স।

৬)এমনটা তো হয়েই থাকে, নারায়ণ সান‍্যাল, দে’জ পাবলিশিং।

৭)The Shadow of The Great Game, The Untold Story of India’s Partition, Narendra Singh Sarila HerperCollins Publishers India.

 

প্রথম পর্ব – https://www.bangodesh.com/2018/11/a-leaf-on-shyamaprasad-1/

(সমাপ্ত)