“বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পূর্বে বাংলার মানুষ রামমন্ত্রে দীক্ষা নিত”

0
4350

দ্বিতীয় কিস্তির পর

বঙ্গদেশ :একটা বিতর্কের জায়গা থেকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। গতবার রামনবমী চলাকালীন কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা অনেকে দাবী করছিলেন যে বাংলার সংস্কৃতির সাথে রামের বা রামায়ণের কোন সংযোগ নেই। আপনার ক্ষেত্রসমীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে এই বক্তব্যের উপর আলোকপাত করতে পারেন কি? 

ডঃ ঠাকুর : কলকাতার লোকেরা এই যে বক্তব্য রেখেছেন এটা মূলত হচ্ছে দুইরকম, এক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, দুই অজ্ঞতাভিত্তিক। তারা শুধু কলকাতাতেই ঘোরে, গ্রামবাংলায় তারা ঘোরে না। গ্রামবাংলার সাথে রামের সম্পর্কের কথা বলতে গেলে প্রথম যে কথা বলতে হয়, রামচন্দ্রকে নিয়ে আদৌ কেউ কোনদিন মাথা ঘামাত না যদি না একটি রাজনৈতিক দল তার সাথে সম্পৃক্ত থাকত। ভারতবর্ষের এবং বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসের চর্চার ক্ষেত্রে আমরা যারা ক্ষেত্রসমীক্ষকরা তারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আমি নিজে এর প্রতিবাদ জানিয়ে কলম ধরেছিলাম। প্রাক্তন আমলা জহর সরকার আনন্দবাজারে একটি প্রবন্ধ লেখেন যেখানে তিনি দাবী করেন যে রামের সংস্কৃতি বাংলায় বহিরাগত, মূলত উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত। এই বিষয়ে এই সময়ে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয় এই বছরে যাতে আমি দেখিয়েছি যে রামচন্দ্র বাংলাতেও খুব প্রাচীন। আমাদের চিন্তায় চেতনায়, বৈষ্ণব সংস্কৃতির ধারায় রামের অস্তিত্ব বিরাজমান। ইতিহাসগত যে প্রমাণ সেটা বলি, আপনি দেখবেন বর্তমানে অনেকেই বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে। বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পূর্বে বাংলার মানুষ রামমন্ত্রে দীক্ষা নিত। বাংলার পরিমণ্ডলে রামায়ণ কিন্তু অত জনপ্রিয় হত না। অন্যতম চৈতন্যজীবনীকার দয়ানন্দের নিজের পরিবার ছিল রামচন্দ্রের পরিবার। চৈতন্যদেবের বন্ধু মুরারি গুপ্ত নিজে ছিলেন রামভক্ত। রামমন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার যে ঐতিহ্য সেটা আমার কথা নয়, এটা সর্বপ্রথম জোরগলায় বলে গিয়েছেন সুকুমার সেন। সুকুমার সেন একজন জহুরী, যদিও কলকাতার লোক তাকে অতটা পাত্তা দিত না কারণ কলকাতার লোক ইতিহাসকে অতটা গ্রাহ্য করে না। আপনি যদি কৃত্তিবাসী রামায়ণ ভালো করে অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন যোগাদ্যা তন্ত্রের সাথে রামায়ণের যোগ আছে। রাঢ়বাংলার অন্যতম জাতীয় দেবতা হলেন ধর্মরাজ। এই ধর্মরাজপালায় প্রচুর জায়গায় রামায়ণ গান হয়। এছাড়াও, প্রচুর পরিমাণে টেম্পল কয়েন পাওয়া গিয়েছে যা রামচন্দ্রকেন্দ্রিক। সপ্তদশ শতাব্দী, অষ্টদশ শতাব্দী বা পঞ্চদশ শতাব্দীর এইসব মুদ্রা রাঢ়বাংলায় মাটির তলা থেকেই পাওয়া গিয়েছে। আর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে এই কাটোয়া মহকুমাতেই কম করে প্রায় কুড়িটি প্রাচীন রামচন্দ্রের বিগ্রহ রয়েছে। হতে পারে উত্তরপ্রদেশের লোকেরা সেই সংস্কৃতি অনেকটা[তুলসীদাসের প্রভাব অনেক বেশি] বেশি চর্চা করে, কিন্তু তারা বাংলার মাটিতে এসে তা পুঁতে দিয়েছে এটাও ঠিক না। তাহলে তো বলতে হয় উত্তরপ্রদেশে যত জায়গায় কৃষ্ণ আছে সেটাও বাঙালিরা গিয়ে পুঁতে দিয়েছে।

বঙ্গদেশ : আচ্ছা রামচন্দ্র নিয়ে একটি প্রশ্ন আছে। বাংলায় রামচন্দ্রের যত বিগ্রহ দেখা যায় তার বেশিভাগের মধ্যে দেখা যায় রামচন্দ্রের গোঁফ আছে। সেটার কি কোন বিশেষত্ব আছে? অন্য জায়গায় কিন্তু এটা দেখাতে পাই না। 

ডঃ ঠাকুর : এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাকেই চূড়ান্ত ধরতে হবে। আমাদের পরিবারজীবনের ঘরের কথাকেই বড় করে দেখানো হয়েছে।এই সময় বাংলাদেশে অখণ্ড পরিবার ছিল যে পরিবারের বড়কর্তা পরিবারের হাল ধরতেন। পরিবারে আগে বড়কর্তা, মেজকর্তা, ছোটকর্তা ইত্যাদি থাকত। অষ্টাদশ বা একবিংশ বাড়ির বড় ভাইয়ের উপর মূল দায়িত্ব থাকত পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আপনি যদি রামচন্দ্রের চেহারা যদি দেখেন তো দেখবেন ঝেঁটে গোঁফ আছে, একদম পরিবারের বড়কর্তার মত চেহারা, বাবার পরেই যাঁর স্থান, যার ভাইরা তার অনুগত।এগুলো নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ করে নেয়, মাটির সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে তাদের কাছে এসব নিয়ে সংশয় থাকার কোন কারণ নেই।

বঙ্গদেশ : অদ্বৈত আচার্য ইত্যাদির অর্চনা করা শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, শ্রীরঘুনাথজীউ নামধারী। 

ডঃ ঠাকুর :মধ্যযুগে যখন বিষ্ণু উপাসনা বন্ধ হয়ে গেল তখন যে শালগ্রাম শিলার পূজা আরম্ভ হল, তার মধ্যে অনেকগুলিই পূজিত হত রঘুনাথশিলা রূপে। আপনি জানেন যে রঘুনাথজি ছিলেন রামকৃষ্ণের বাড়ির গৃহদেবতা।ওইভাবে গবেষণাটাকে দেখা হয়নি। এখন আমরা হাসি গবেষণার বর্তমান রূপ দেখে। আমি তো জানি যত খুঁড়বেন তত বেশি আপনি জিনিস পাবেন।[কাজী নজরুল ইসলামের গান আছে শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে, রসঘন রাম, নব দুর্বাদল শ্যাম। উনি তো বর্ধমান জেলারই লোক] দেখুন রামচন্দ্র পারিবারিক জীবনে বড়কর্তা, ছোটকর্তা, বড় দাদা , বড়বৌদি, যারা বাবার সমান, মায়ের সমান, এটা একটি প্রাচীন গার্হস্থ্য কণ্ঠস্বর বাঙালির।

বঙ্গদেশ : শেষ একটি প্রশ্ন আছে, বাংলার যে মন্দির আমরা দেখতে পাই টেরাকোটার, মূলত মাটির তৈরি। এর পূর্বে কি বাংলায় পাথরের মন্দির ছিল? পুরুলিয়ায় বেশ কিছু প্রাচীন পাথরের মন্দির দেখা যায় জৈনদের। মালদার আদিনার নিম্নভাগ দেখা যায় পাথরের। কখনো কি মাটি থেকে পাথরে উত্তরণ হয়েছে? অথবা দুটো কি একইসাথে চলেছে?

ডঃ ঠাকুর : আমার যা মনে হয় এই বিষয়ে, বিশেষ করে বাংলার জন্য, আপনি জানেন এখানে সবচেয়ে সস্তা এবং সহজলভ্য হল মাটি। তুলনায় পাথর খুবই দুর্লভ। এবং এটাও সত্যি যে মাটি পাথরের মতই সমান টেঁকসই। আমাদের দেশের কুম্ভকাররা এই কাজটা বারবার করে এসেছে, অর্থাৎ সহজলভ্য উপাদান দ্বারা টেরাকোটার কাজ করে এসেছে। কিন্তু এক সময় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র শাসিত হিন্দু সমাজে কিন্তু মাটির মূর্তিতে পূজা হত না। সেখানে পাথরেই পুজো করা হত। মাটি বরাবর নিন্দিত ছিল। পরবর্তীতে ইসলামিক শাসন আসার পর তারা যখন মূর্তি ভেঙ্গে দিতে শুরু করল ঘোরতরভাবে মূর্তির বিরোধী হওয়ার কারণে, তখন মাটির মূর্তিতে পূজা চালু হল বিসর্জনের রীতি অনুসারে।তার পরেই টেরাকোটার এরকম ব্যাপক নিদর্শন পাওয়া শুরু হল। নাহলে তৎপূর্বের অনেক টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া যেত।

বঙ্গদেশ :তাহলে কি এটা বলা যেতে পারে যে পাথরের মূর্তি থেকে মাটির মূর্তিতে বিবর্তনের যে ক্রমবিকাশ তা হয়েছে ইসলামিক শাসনের কারণেই? 

ডঃ ঠাকুর :অবশ্যই সে কথা বলা চলে। ইসলামিকরা প্রথম থেকেই মাটির কাজ গ্রহণ করেছিল, তাদের মসজিদগুলি তার প্রমাণ দেয়। কিন্তু মন্দিরে টেরাকোটার যে বিপ্লব এলো সেটা মোটামুটি ইসলামিকরা শেষ হচ্ছে, এবং ইংরেজরা ঢুকছে সেই সময় থেকে। যদিও মোগল আমলে বিষ্ণুপুরে টেরাকোটার বিকাশ হয়েছিল, এবং তাছাড়া মোগলরা তাদের সাথে বৈরিতায় যেতে করে চায়নি। তাদের ভৌগলিক অবস্থানের জন্য কেউ তাদের চট করে ঘাঁটাত না। তা নাহলে মন্দির বহু আগেই ভেঙ্গে দিত মুসলমানরা।

বঙ্গদেশ :বাংলায় যে প্রাচীন মন্দিরের বড় অভাব সেটা কি এই মাটির মন্দিরের কারণেই? 

ডঃ ঠাকুর :আমাদের দেশে জল হাওয়া এমনি যে একটি পাকা বাড়ি একশো বছরও টিকছে না। তুলনায় মাটির বাড়ি একশো বছর টিকে যাচ্ছে। মন্দিরের গায়ে একশো বছরে একটি গাছ জন্মে গেলে তারপর আর আর পঞ্চাশ বছরেই গাছটি মন্দিরকে গ্রাস করে নিচ্ছে। ১৮১৮ সালে কাটোয়ায় একটি বিশাল নবরত্ন মন্দিরের ছবি এঁকেছিলেন অলি সাহেব, সে মন্দিরকে আর কোনদিন দেখতেই পাওয়া গেল না। বন্যাপ্রবণ এলাকায় এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার, কাটোয়ায় ৭৮ সালের বন্যায় দশ ফুট জল।নদীর পাশে লোকে ভিড় করত বলে মন্দির তৈরি হত সেখানে, কাজেই ওই একশো বছর বা তার কিছু বেশি সময় টিকত মন্দিরগুলি। দাঁইহাটে অষ্টম শতাব্দীর একটি মন্দির ছিল, যা গঙ্গার জলে পড়ে ছিল। লঙ সাহেব কলকাতা যাওয়ার পথে সেটি দেখতে পান, এবং লোক লাগিয়ে তার শিলালিপি উদ্ধার করেন এবং এশিয়াটিক সোসাইটিতে জমা করেন।এছাড়া তো কোন উপায় নেই, বন্যাপ্রবণ এলাকায় এরকমই ধারা।

(ক্রমশ)….