শরৎ বসু এবং অবিভক্ত বঙ্গ

0
3595

স্বর্গীয় শরৎ চন্দ্র বসু  বাংলার রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র এবং এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি নিজের জীবদ্দশায় খ্যাতির শিরোনাম থেকে নিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, সবটাই ভোগ করেছেন। অবশ্যই শরৎবাবুর রাজনৈতিক উত্থান এবং পতনের সাথে ওঁর ছোটভাই কংগ্রেস এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বোচ্চ স্তরের নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনীতি ওতপ্রোতঃভাবে জড়িত, পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ সরকারের নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সাথে কিন্তু নয়। শরৎবাবুর পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্ম এখনো সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে, বাংলাভাগের সাথে ওঁর সংযোগটির নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নে কারো ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগতে পারে, কিন্তু এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য তা নয়। ব্যক্তি শরৎ বসু কেমন রাজনেতা ছিলেন, ভাই সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিতে তাঁর কি ভুমিকা ছিল, অবিভক্ত বাংলায় কংগ্রেসে তাঁর অবদান কি, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর উল্লেখযোগ্য যোগদান ইত্যাদি ছেড়ে দিয়ে, আমরা কেবল বাংলার বিভাজনের পটভূমিকায় শরৎ বসুর ঐতিহাসিক ভুমিকার দায়রায় নিজেদের সীমিত রাখবো। এই কাহিনী ১৯৪৫এ নেতাজীর শেষবার জনসমক্ষে আসার বছরদুয়েক পরের, দা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং নোয়াখালীর নরসংহারেরও পরের, সেই সময়টার, যখন মুসলিম লিগ দেশভাগের জন্য বদ্ধপরিকর, জিন্নার জয়ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে সুরাওয়ারদির শাসনের অধীনস্থ অবিভক্ত বাংলা।

৯ই অগাস্ট ১৯৪৬, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ারদি প্রথমবার হুমকি দিয়েছিলেন যে উনি ভারত ভাগ করে স্বাধীন বাংলাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটা ডাইরেক্ট একশনের বেশ কিছু মাস আগেকার কথা। তারপর পাকিস্তানের দাবিতে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল কলকাতার রাজপথে এবং গ্রামবাংলায়, সে ইতিহাস আমরা সবাই জানি। হিন্দু মহাসভা উপায় খুঁজছিলেন বাংলার পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তিকে এড়াবার, ১৯৪৭এর ২০শে ফেব্রুয়ারি সেই সুযোগ এসে গেল আর তাই পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। কংগ্রেসের পাঞ্জাব ভাগের দাবিতে সম্মতির ইঙ্গিত পেয়েই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা এবং বাংলার হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহদাংশ সেদিন বাংলাভাগেরও দাবি জানিয়ে বসলেন। স্বভাবতঃই বাধ সাধলেন সুরাওয়ারদি, তিনি সঙ্গে পেলেন বেশ কয়েকজন কংগ্রেসী হিন্দু নেতা সমেত কিরণ শঙ্কর রায় এবং শরৎ চন্দ্র বসুকে। তাঁদের অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানালেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর ফ্রেড্রিক বারোস। ১২ই মার্চ ১৯৪৭ জিন্না বম্বেতে বিবৃতি দিয়ে জানালেন যে ভারত ভাগ করে পাকিস্থানকে মেনে নেওয়া ছাড়া ভারতের স্বাধীনতার অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। এ বড় টালমাটাল সময়।

একদিকে দেখছি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলাভাগের সমর্থনে সারা বাংলার হিন্দু সমাবেশ হচ্ছে আর অপরদিকে ১৯শে মার্চ ১৯৪৭এ গভর্নর বারোস এক চিঠিতে লিখছেন,

“The movement for partitioning Bengal is gathering momentum. Hindu opinion is at present very divided. For once Sarat Bose and Gandhi see eye to eye, and both condemn the movement, of which Syamaprasad Mookherjee and the Hindu Mahasabha are the chief protagonists.”

অর্থাৎ বাংলাভাগের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন যুক্তবঙ্গের দাবিতে মুসলিম লিগ, মহাত্মা গান্ধী, বাংলা কংগ্রেসের একাংশ এবং কংগ্রেসের সাথে বিস্তর অন্য মতান্তর থাকা সত্ত্বেও শরৎ চন্দ্র বসু , সবাই একজোট হয়ে গিয়েছেন ততক্ষণে। ১৯৪৭ এর ২৬শে এপ্রিল জিন্না এবং সুরাওয়ারদি একইদিনে আলাদা আলাদা সময়ে বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন দিল্লিতে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ওই বৈঠকে সুরাওয়ারদি বড়লাটকে বললেন উনি জিন্নাকে স্বাধীন বঙ্গদেশ মেনে নিতে রাজি করাতে পারবেন এবং একদম স্ক্রিপ্ট মেনে পরের বৈঠকেই জিন্না বললেন,

“What is the use of Bengal without Calcutta; they had much better remain united and independent; I am sure that they would be on friendly terms with us.”

তারপরের দিনই, অর্থাৎ ২৭শে এপ্রিল সুরাওয়ারদি অভিভক্ত স্বাধীন বাংলার জন্য জোর সওয়াল করলেন প্রেসে আর সেই সূত্র ধরে ২২শে মে  হিন্দুনিধনের প্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করা শরৎ বসু এবং হিন্দু নিধনকারী দাঙ্গার সমর্থক ও বর্ধমানের মুসলিম লিগ নেতা আবুল হাশিম প্রেস কনফারেন্স ডেকে পেশ করে দিলেন অভিভক্ত স্বাধীন বাংলার সংবিধানের মূল সূত্রগুলি। শরৎবাবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুসলমানপ্রধান স্বাধীন বঙ্গভূমির সংবিধান রচনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। উনি প্রেসকে জানালেন যে সেই দেশে সংবিধান সমিতির ৩০জন সদস্য থাকবেন যার মধ্যে ১৬ জন মুসলমান এবং ১৪ জন হিন্দু, মন্ত্রিত্বে হিন্দু এবং মুসলমান মন্ত্রী থাকবেন সমসংখ্যক, প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান এবং গৃহমন্ত্রী হিন্দু। আর স্বাধীন বঙ্গভূমির সরকারি সহায়তার ওপর মুসলমানদের নিরবিচ্ছিন্ন অধিকার থাকবে।

এই ঘটনা পরম্পরা না বললে, শরৎ বসুর ভুমিকা নিয়ে যে বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছি, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝানো সম্ভব নয়। শরৎবাবু মনেপ্রাণে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, উনি বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীন অবিভক্ত বঙ্গভূমি হবে একটি সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিক, যার রাজনীতিতে ওঁর এক অগ্রণী ভুমিকা থাকবে। যেটা উনি বুঝতে পারেননি তা হল সুরাওয়ারদির এবং জিন্নার যৌথ অভিসন্ধি, প্রথমে ওঁদের মতন হিন্দু নেতাদের ব্যবহার করে অবিভক্ত বাংলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে আনা, তারপর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাহায্যে আবার ডাইরেক্ট একশন করে হিন্দুদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে গোটা বাংলাটাই পাকিস্তানের সঙ্গে বিলীন করে দেওয়া, যেটা ডঃ মুখোপাধ্যায়, নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি প্রমুখ হিন্দু মহাসভার নেতারা মিলে বাংলা ভাগ করে ফেললে আর সম্ভব হতো না, জিন্নার চোখের মনি কলকাতাকে পাওয়ার আশাও ত্যাগ করতে হতো। প্যাটেল বুঝেছিলেন, পরে নেহরুকেও বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওঁরা এই সহজ সত্যটা শরৎবাবুকে বোঝাতে পারেননি। শ্যামাপ্রসাদের বোঝাতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না কারণ শরৎবাবু ওঁকে ঘোর সাম্প্রদায়িক তথা অচ্ছ্যুত বলে মনে করতেন। নিজের যে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা উনি খুঁজছিলেন, সেটা স্বাধীন বঙ্গভূমিতে না হলেও চলত কিন্তু নেতাজীর অন্তর্ধানের পর উনি যাঁদের পরামর্শের ওপর নির্ভর করতেন, তাঁদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন আছে। আসলে সেই সময়ে উনি একা নন, যোগেন মণ্ডলও এই একই রকমের ভুল করে পরে গোটা নমঃশুদ্র সমাজটাকে কসাইদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে কলকাতায় পালিয়ে এসে আইনমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হন, স্বাধীন বঙ্গভূমি হলে শরৎ চন্দ্র বসুকেও হয়ত তাই করতে হতো। ভাগ্যিশ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পাকিস্তান ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম দিয়েছিলেন তাই আমরা হাইকোর্টের সামনে শরৎবাবুর মূর্তি এবং কলকাতার একটি মুখ্য রাস্তা ওঁর নামে দেখতে পাই, অবিভক্ত স্বাধীন বঙ্গভূমিতে বোধহয় ওঁর স্মৃতির কণামাত্র আজ আর অবশিষ্ট থাকতো না।