এক হতভাগ্যের দীর্ঘশ্বাস …..

[লেখক অজ্ঞাত থাকতে চান পাঠকের কাছে – নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণেই প্রকাশ্যে উপস্থিত হতে অনিচ্ছুক। গত ৭২ বছরে হতভাগ্য বাঙ্গালী হিন্দুর সার্থক প্রতিমূর্তি হিসেবেই এই ছবিটি দেওয়া হয়েছে – সম্পাদকীয়।] 

 

আমার স্বর্গগত মুক্তিযোদ্ধা দাদুর জন্মদিন আজ। জ্ঞান হবার পর দাদুর হাত ধরেই আমার মধ্যে বাঙালি জাত্যভিমানের বীজটা অঙ্কুরিত হয়। দাদু কয়েকটা অমূল্য কথা বলে গিয়েছিলেন আমাকে যেগুলো আজ আর কাউকে বলতে শুনিনা।

প্রথমে আমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রাখি। বাংলাদেশের ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী জেহাদী তান্ডবে আমাদের সাভারের বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়। বাড়ির মহিলারা, হ‌্যাঁ তাদের মধ্যে আমার মা আর দুই বোনও ছিলেন, ওনারা সমবেত হাজারখানেক জেহাদী বিএনপি নরপশুর উন্মত্ত মিছিল দেখে কালক্ষেপ না করে গায়ে আগুন দিয়ে নিজেদের সম্মান রক্ষা করেন। ওইদিন জেহাদীরা আমাদের বাড়ির প্রত্যেক পুরুষ সদস্যকে নির্মম ভাবে প্রহার করে। দাদু লাঠিখেলা জানতেন, সত্তর বছর বয়সেও একাই প্রায় তিরিশ মিনিট ওদেরকে লাঠির দাপটে আটকে রাখলেও শেষরক্ষা করতে পারেন নি। আমার মুক্তিযোদ্ধা দাদুকে হাজারখানেক জেহাদীর দল সংখ্যার জোরে কাবু করে ফেলে। তারপর প্রত্যেককে বেঁধে বাড়ির মধ্যে ফেলে রেখে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে চলে যায়। এবং বাড়ির মহিলাদেরকে দেখতে না পেয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে চলে যায়।

আমি এসবই দেখেছিলাম বাড়ির পাশের কাঁঠালগাছটার ডালে চড়ে। বাবা, হ্যাঁ আমার বাবা সেই সৌভাগ্যবান মানুষ, দুর্ভাগ্যবানও বলতে পারেন, যিনি ঢাকার কর্মস্থলে থাকার জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন সেইদিন, এই পরিবার ঘাতী দুর্যোগের হাত থেকে।

সেদিন ভয়ে সারারাত আমি ওই গাছেতেই বসে রইলাম। তখন সবে নাইনে উঠেছি। পরের দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার অফিসের পথে যাত্রা। তারপর অফিস থেকে বাবার সাথে নিজের মাতৃভূমিকে শেষ প্রণাম জানিয়ে ভারতের পথে যাত্রা। মনে হচ্ছিল যেন নিজের মায়ের কোল ছেড়ে কোন অজানার দেশে চলে যেতে হচ্ছে। এত লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে মুক্ত হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে, আমাদের চোদ্দোপুরুষের স্মৃতিমাখা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে আমাদেরকে। এই দেশ আজও বাঙালি হিন্দুর বধ্যভূমি হিসাবেই রয়ে গেল। দাদু তুমি এই দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে এ কি পুরস্কার পেলে! এই পরিণতি দেখার জন্যেই ঈশ্বর তোমাকে মুক্তিযুদ্ধে লড়িয়েছিলেন?

কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি। সে যে কী দুঃসহ বেদনার অনুভূতি, যারা নিজেরা ছিন্নমূল হতে বাধ্য হয়েছে তারাই জানে।

যাক সে কথা। দাদু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবতেন সেই প্রসঙ্গে আসছি এবার। উনি শেখ মুজিবকে আর পাঁচজন বাংলাদেশীর মত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে মনে করতেন না, বরং বলতেন মুজিবের জন্যই বাংলাদেশ এক অভিশপ্ত ইসলামিক রাষ্ট্রে পর্যবসিত হতে চলেছে। যে কথাটার আজ আমি হাতেনাতে প্রমাণ দেখতে পাই।

দাদু মুক্তিযুদ্ধ নামটা পছন্দ করতেন না। আপনাদের মনে হতে পারে এ আবার কেমন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এ বিষয়ে দাদু যে যুক্তিগুলো দিয়ে গেছেন, আমি একটা যুক্তিকেও আজ অবধি খন্ডন করতে পারিনি।

প্রথমত, এ যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্তির যুদ্ধ। পাকিস্তানের অধীনে যাওয়ার আগে ভাষাগত আর সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমরা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলাম হাজার হাজার বছর ধরে। তাই আজও বাংলাদেশের মাটি খুঁড়ে বিষ্ণু মূর্তি, শিব মূর্তি, আরও কত হিন্দু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে যে নতুন জীবন লাভ করল বাংলাদেশের মানুষ, তারা কিন্তু তাদের শিকড়ের কথা ভুলে গেল। পাকিস্তানের অংশ হওয়ার আগে তারা যে অনাদি অনন্তকাল থেকে ভারতের অংশ ছিল, প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতি-বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়, বাঙালিরা ভারতমায়ের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অংশীদার—এসব কথা কেউ তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়নি। ভারত থেকে ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়ে নবজন্ম লাভ করার পরেই মুজিব সেই রাষ্ট্রের খতনা করে দিলেন। ঘোষণা করলেন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামিক রাষ্ট্র হিসাবে। ভারতমাতার আশ্রয় থেকে যে করাল গ্রাসে চলে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান, সেই করাল গ্রাস থেকে আমার বাংলাদেশ মুক্ত হল কই! নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা, নিজেকে সঠিকভাবে জানাই মুক্তিলাভের কঠিন পথে যাত্রার পাথেয়। মুজিব সেটা করার কোনোরকম চেষ্টা তো করেনইনি, উল্টে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে পাকিস্তানের সরকারের উত্তরাধিকারী সরকার বলে ঘোষণা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে মুক্ত হওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য তাঁর কোনোদিন ছিলনা।

দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু পরিবার নিজেদের প্রাণ আর মান বাঁচানোর তাগিদে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দেশ পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করছে, অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে যাঁরা অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করলেন, দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন, তাঁদেরকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, তবেই পাকিস্তানী চেতনার সমূলে বিনাশ হবে—একথাও মনেহয় মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারী ওই মুজিব ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। 

তাই আমার দাদু মুক্তিযুদ্ধ নামটাকে একটা নিদারুণ তামাশা বলে আক্ষেপ করে গেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। এবং সবসময় বলতেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের নিজেদের অধিকার নিজেদেরকেই বুঝে নিতে হবে, কারোর মুখাপেক্ষী না থেকে। এবং বাংলাদেশের জাতীয় চেতনায় এখন ইসলামকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের হিন্দুদের জাতিসত্তা তার থেকে পৃথক।

বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে এখন একজন চিন্তানায়কের খুব প্রয়োজন যিনি পথ নির্দেশ করবেন কীভাবে বাংলাদেশী হিন্দুরা তাদের কৌমের ভালো মন্দ বুঝে নেবে। আমার মনে হয় দাদুর এই চিন্তাভাবনাগুলো তাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।

জয় বাংলা মা।