জিন্নার জন্ম সুদূর আরবে

0
1477

বঙ্গদেশ বিশেষ প্রতিবেদন: কাদের জন্য ভারত ভাগ হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে খুব সহজেই মুসলিম লিগ এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উপর আঙুল তোলা যায়। কিন্তু তা কতটা ঠিক? এটা কী খুব সরলীকরণ নয়? উত্তর খুঁজতে গেলে আপনাকে ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন সিন্ধু প্রদেশে ফিরে যেতে হবে। যখন হিন্দুকুশ পর্বত থেকে কাশ্মীর সন্নিহিত অঞ্চলে রাজত্ব করতেন বিভিন্ন হিন্দু রাজারা।

৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে হজরত মহম্মদের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর মুসলিমরা ইসলাম ধর্মকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ধনুকভাঙা পণ করে একের পর এক যুদ্ধ করতে থাকেন। সেই যুদ্ধ আজও চলছে। শুধু সময়ে সময়ে মহম্মদ বিন কাসিমের জায়গা নিয়েছে মামুদ, কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, বলবন, আলাউদ্দিন খিলজি, বাবর, ঔরঙ্গজেব হয়ে
লাদেন, আল বাগদাদি, আলকায়দা, ISIS…
কিন্তু সারা বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ থেকে আজও সরে আসেনি মুসলমানরা।

যাই হোক, যেটা নিয়ে বলছিলাম। ভারত ভাগ হওয়ার বীজ ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লিগ জন্মের সঙ্গে রোপিত হয়নি।
বরং ভারতভাগের বীজ পোঁতা হয়ে গেছিল ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে যখন ব্রাহ্মণাবাদ/ বাত্তয়ের যুদ্ধে আরবের সেনাপতি মহম্মদ বিন কাসিম হিন্দুরাজা দাহিরকে পরাজিত ও নিহত করে প্রথম বিজয়ী মুসলিম হিসেবে ভারত
ভূখন্ডে পা রাখেন। সেদিনই পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে গেছিল। ধীরে ধীরে ভারতের মানচিত্রের চেহারা বদলে ফেলেন ইসলামের নেক বান্দারা।

৭১২ থেকে ২০১৮-র আজকের দিন অবধি প্রায় ১৩০৬ বছর ধরে ভারতে ইসলাম দায়িত্ব নিয়ে ভাঙ্গাভাঙ্গি করে গেছে। এখনও করে চলেছে। সেরা কী কী রয়েছে এই ভাঙ্গাভাঙ্গির তালিকায়?

*থানেশ্বরের চক্রস্বামী, বিষ্ণু মন্দির(১০১৪ খ্রীষ্টাব্দ)
*গুজরাটের সোমনাথ মন্দির (১০২৫-২৬ খ্রীষ্টাব্দ)
২টোর কৃতিত্ব – সুলতান মামুদ
হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির ভাঙার জন্য ইসলাম দুনিয়াতে মামুদের সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং তিনি “বাতসিকান: মূর্তি ধ্বংসকারী” হিসেবে বিখ্যাত হন।
*নালন্দা মঠ ও বিশ্ববিদ্যালয়(১১৯৩ খ্রীষ্টাব্দ)
ভারত তথা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দাকে ধ্বংস করেন কুতুবউদ্দিন আইবকের সেনাপতি, ইখতিয়ার আল-দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। ভাবতে পারেন ওই সময় দেশ বিদেশ মিলিয়ে ১০০০০ ছাত্র, ২০০০ শিক্ষক জ্ঞানের আদান-প্রদান করতেন নালন্দাতে।
*ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় (বাংলার পাল রাজাদের তৈরী) : নালন্দার পর ওদন্তপুরী ধ্বংস করেন বখতিয়ার।
কাশ্মীরের সূর্য মন্দির, বিহারের রুদ্র মহালয়া, হাম্পির মন্দির, এরকম অজস্র ভারতীয় সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির প্রতীক মাটিয়ে মিশিয়ে দেন ভারতের মুসলিম শাসকরা। মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয় মসজিদ। পশ্চিমবাংলার পান্ডুয়ার মসজিদও মন্দির ভেঙে বানানো।

হিন্দুদের কাফের ঠাওর করিয়ে বিভেদের রেখাটা বিন কাসিম, মামুদের সময় থেকেই চলে আসছিল। সেটা বড় ফাটল হয়ে সময়ে সময়ে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।

এরপর আসি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিভিন্ন ইসলামিক মুভমেন্টে।

১. ওয়াহাবি আন্দোলন :
ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬ – ১৮১৩ খ্রি.) এবং তাঁর অনুগামীদের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন অচিরেই একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে । সুতরাং এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১খ্রি.) । তিনি কিছুদিন মুসলিম তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থান করেন । সেখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। এই ভদ্রলোককে বাংলা ইতিহাস বইতে বীর বিপ্লবী আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এঁর লড়াই কখনও দেশের জন্য ছিলই না, ছিল ইসলামের জন্য।
“দার-উল-হার্ব” কে “দার উল ইসলাম”-এ পরিণত করার জন্য। তিতুমীর বেছে বেছে হিন্দু জমিদারদের লুঠ করতেন এবং তাদের মেয়েদের গণিমতের মাল বানাতেন।

আসুন দেখে নেওয়া যাক ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তিতুমীর এবং ওয়াহাবি আন্দোলন নিয়ে কী বলছেন?
“ওয়াহাবি আন্দোলন কখনই জাতীয় আন্দোলন ছিল না এবং এই আন্দোলনের চরিত্র সাম্প্রদায়িকতামুক্তও ছিল না । ইংরেজ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।”
– ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার।

পরাধীন ভারতে যে মুসলিমদের যুদ্ধ ওয়াহাবি আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার পরিণতি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হবে না তো কী স্বাধীন অখন্ড ভারত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজুন।

অনেকেই বলে থাকেন অশিক্ষাই ধর্মান্ধতার কারন। অশিক্ষার কারণেই মুসলিমরাই এমন করে থাকেন। যারা এরকম বলে থাকেন তাদের মহমেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়) এবং সৈয়দ আহমেদ খান-এর কথা বলতে ইচ্ছে করে।

২. আলিগড় আন্দোলন

পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খান উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে আলিগড়ে তিনি মহমেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ-এর প্রতিষ্ঠা করেন । এই কলেজটিই পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয় । ইংরেজ শিক্ষাবিদগণের তত্ত্বাবধানে এই কলেজে কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

তো এখানে শিক্ষিত হয়ে শিক্ষিত মুসলিমরা কী করলেন?

সৈয়দ আহমেদ খান ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার নীতি গ্রহণ করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা রুখতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি ‘এডুকেশনাল কংগ্রেস’, ‘ইউনাইটেড পেট্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তিনি কংগ্রেসের তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা গঠন করেন।

রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন,
“আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার অপূর্ব সুযোগ পায় এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতিকে তোষণ করতে শুরু করে। বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজ সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির প্রথম দৃষ্টান্ত।

সর্বোপরি আলিগড় আন্দোলনের কার্যকলাপ পরাধীন ভারতের রাজনীতিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয়।”

এরপরও ভারতকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের মুসলিম সমাজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ লড়াই খিলাফৎ আন্দোলন করেছেন। কিন্তু কেন জানি না তুরস্কে খিলাফৎ প্রথার অবসান হলে এই আন্দোলন থেকে সরে আসেন পরাধীন ভারতের মুসলিম সমাজ। কিন্তু এরপরও আমাদের ইতিহাস বইয়ের “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম” অধ্যায়ে অন্যতম বড় আন্দোলন হিসেবে খিলাফৎ আন্দোলনের নাম জ্বলজ্বল করে আজও।

তো ওয়াহাবি এবং আলিগড়ে যে “দার উল ইসলাম”এর এবং “দ্বিজাতি তত্ত্ব”এর মাটি শক্ত হয়েছিল তাতে “পাকিস্তান” নামক পাক ইমারতটি গঠনের জন্য মুখ্য ভূমিকা নেয় “মুসলিম লিগ”।
১৯৩০ সালে এলাহাবাদে মুসলিম লিগের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে স্যার মুহাম্মদ ইকবাল ভারতে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেন। চৌধুরী রহমত আলি ১৯৩৩ সালে একটি পুস্তিকায় সিন্ধু অববাহিকায় ও ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য স্থানে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানান। ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালে জিন্নাহ ও ইকবাল মত বিনিময় করেন। পরের বছরগুলোতে জিন্নাহ ইকবালের ধারণাকে গ্রহণ করেন।

তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস মুসলিম লিগ না থাকলেও ভারত ভাগ একদিন হতই। আর তা রক্ত ঝরিয়েই হত। কারণ যে ধর্ম বলে, আমাকে না মানলে তুমি কাফের, আর নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হলেই কাফেরের কল্লা কাটো, দার উল ইসলাম বানাও, তাদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষের সহাবস্থান সম্ভব নয়।

এমনিতে ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হোক এটা আমার দাবি নয়। আমি মনেও করি না সাধারণভাবে কিংবা ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার দরকার আছে বলে। কিন্তু যেহেতু ভারতের তিনদিকে তিনটি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে তাই “হিন্দু রাষ্ট্র” এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ধর্মীয়ভাবে না হোক, মানসিকভাবে তো বটেই। ইজরায়েলের চারপাশেও একই অবস্থা। কিন্তু ওরা টিকে আছে কারণ ওরা ইহুদী রাষ্ট্র।

আজ যারা দেশভাগ এবং দেশে সাম্প্রদায়িকতার জন্য হিন্দুদের কিংবা হিন্দু সংগঠনগুলিকে দায়ী করে থাকেন, তাদের বলব, স্যার হিন্দুরা তখনও ভারতভাগ চায়নি, এখনও চায় না। সে কারণেই পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র আর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়ার পরও ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আজ ওরা পশ্চিমবাংলায় ৩০%, আবার বাংলাভাগের দাবী কিন্তু উঠে গেছে। ইতিহাস কিংবা বর্তমান যেখানে খুশি চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন, ওরা সংখ্যায় বাড়লেই কিন্তু দেশভাগ।