কৃষ্ণ গোপেশ্বর – বিংশতিতম অধ্যায় – ব্রহ্মাণ্ড

0
1210

অনুবাদকঃ সূর্যদেব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অধুনা বিখ্যাত ‘কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্’ মন্ত্রের মন্দ্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এক্ষণে কৃষ্ণের ধ্যান আরম্ভ করলেন আচার্য চন্দ্রকৌশিক। বিগত কয়েক দিবসে জরাসন্ধ ও তাঁর দলবলের অশেষ বিরক্তি সাধনে সক্ষম হয়েছে উক্ত মন্ত্রটি।

‘দ্বিতীয় বর্ষে কৃষ্ণের দর্শনার্থী অতিথির সংখ্যা গোকুলে আরওই বৃদ্ধি পেল। ওই সামান্য বয়সেই সে হয়ে উঠেছিল দারুণ কুশলী এবং বড়োই চঞ্চল, আমুদে ও দুষ্টু।

‘আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র রূপেও গোকুলের বিকাশ ঘটেছিল এ সময়। গর্গাচার্য তাঁর আশ্রম মথুরা-পাঞ্চাল সীমান্তে স্থানান্তরিত করে যমুনার প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেছে নিয়েছিলেন। এলাকাটি গোকুল থেকে মাত্র দ্বিযোজন দূরবর্তী। যাদবগণের যুক্তবাহিনী গঠনপদ্ধতির একটি সুবিধা ছিল এই যে, সৈন্যদল সর্বদা বৃষ্ণি অঞ্চল থেকে মথুরা অভিমুখে গমন করত, বিপরীত অভিমুখে কদাচ নয়। অঙ্গিরসের গোকুলস্থ আশ্রমে বহু গার্গ ও আঙ্গিরসের সমাগম ঘটত নিয়মিত। সৎসঙ্গে অংশগ্রহণের নিমিত্ত আমার শিষ্যরাও মধ্যে মধ্যে তত্র যেত। সৎসঙ্গ ও যোগাভ্যাসের উদ্দেশ্যে নন্দ ও যশোদা প্রায়শই আশ্রমে পদার্পণ করতেন। শিশু বয়সেই কৃষ্ণ যোগাসনে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল। অপরাপর গো-পালক সখাদেরকে সে আমন্ত্রণ করত তাকে অনুকরণ করার। আবার মাঝেমধ্যেই প্রতিযোগিতারও আয়োজন করত। অল্পকালেই তার স্বাভাবিক নেতৃত্ব গুণের সম্যক বিকাশ ঘটেছিল। দ্বিতীয় জন্মতিথির প্রাক্কালেই শিশু কৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল সকলের প্রিয়পাত্র।

‘কৃষ্ণের সরল দুষ্টুমিতে মোহিত জনৈক আঙ্গিরস তো একখানা গীতই রচনা করে ফেললেন। কী তার সুমিষ্ট হাস্য! কী তার মধুর বচন, কী মধু তার অক্ষিদ্বয়ে, তার চলনে-বলনে কী এক অমোঘ আকর্ষণ! তার স্বাভাবিক চপলতা, বলরামের সঙ্গে খুনসুটি, গোশাবকদের সঙ্গে আত্মিক সখ্য – কত না কাহিনী ছড়িয়ে পড়ল মায়াবী এই শিশুকে কেন্দ্র করে।

আচার্য পুনরায় আরম্ভ করলেন কৃষ্ণের গুণগান।

নারীগণ এই মুহূর্তে আচার্যের কণ্ঠে সুরেলা কৃষ্ণস্তব উপভোগই করছিলেন। একবার তাঁরা উৎসুকভাবে দৃষ্টিপাত করলেন জরাসন্ধের প্রতি, দখলেন মহারাজ কোনোক্রমে তীব্র বিরক্তি গোপন করে গম্ভীর বদনে উপবিষ্ট রয়েছেন।

‘কৃষ্ণের দ্বিতীয় জন্মতিথি পালন বিষয়ে নন্দ স্বাভাবিক কারণেই যথেষ্ট শঙ্কিত ছিলেন। ইতোমধ্যেই নামকরণ অনুষ্ঠান এবং প্রথম জন্মতিথি সমারোহে বালগোপালের প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল। এযাত্রা তাই নন্দরাজ উৎসব বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, পরিবর্তে আশ্রমে অল্প কিছু পরিবারের জন্য সৎসঙ্গ ও পাঠের আয়োজন হল।

‘আসন ও প্রাণায়াম পর্ব সমাধা হলে পূর্বোক্ত তরুণ আঙ্গিরস ব্রহ্মাণ্ড ও ব্রহ্মতেজ বিষয়ে বলতে লাগলেন। সকল জীব ও জড়ে অভিন্ন ব্রহ্মশক্তির উপস্থিতি তুলে ধরলেন তিনি, বর্ণনা করলেন নটরাজের তাণ্ডবনৃত্য। সর্বভূতে সমদৃষ্টি, সমভাবের তত্ত্ব প্রাঞ্জল হল তাঁর বক্তব্যে। “জীব ও জড় সহ সমগ্র ভৌত বাস্তব অভিন্ন, অবিভাজ্য; এরই বহুবিধ নাম রেখেছি আমরা। ব্রহ্মশক্তির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অংশমাত্র পরিচালনা করে এই সৃষ্টিকে। কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্লহ্ম, আবার আত্মাও বলা যায় তাকে। ঈশ্বরের সন্ধান লাভ করতে হলে সর্বাগ্রে তাঁকে আবিষ্কার করতে হবে নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলে। পরব্রহ্ম বিরাজ করেন আমাদের মধ্যেই, ফলে বহির্জগতে তাঁর সন্ধান করে ফেরা বৃথা। ব্রহ্মের বোধ আমাদের সকলেরই রয়েছে। লক্ষ্য করুন যমুনার ঢেউ কীভাবে ঘাটে এসে আছড়ে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে কোটি কোটি জলবিন্দুতে। প্রতিটি জলবিন্দুর রয়েছে আপন সত্তা, নিজস্ব শক্তি, আবার তারা যমুনার বিপুল জলরাশির অংশও বটে। মহাসমুদ্রের ঢেউ আপনারা প্রত্যক্ষ করেন নি, সেক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারতেন। ঢেউয়ের প্রতিটি কণা একাধারে পৃথক এবং সমুদ্রের জলরাজির অঙ্গ। প্রতি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে যমুনাতীরে উপবেশন করে জলকণা ও জলরাশির উপমার মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝার চেষ্টা করুন।”

‘সহসা মায়ের কোল থেকে আধোস্বরে কিছু প্রশ্ন করল কৃষ্ণ, যার মর্মার্থ এই, “গুরুদেব, ব্রহ্মাণ্ড কি আমার মধ্যেও আছে?”

আঙ্গিরস সহাস্যে বললেন, “নিশ্চয়ই! দেখতে চাও নাকি?”

যশোদার কোল ছেড়ে এক ছুটে পৌঁছে গেল গোপাল, “কই দেখান? এখনি দেখান!” তার কীর্তিতে উপস্থিত সকলে ফেটে পড়লেন অট্টহাস্যে। “এসো কৃষ্ণ, কোলে এসো আমার। চারপাশে দেখো, কাদেরকে দেখছ?”

“আপনাকে দেখছি, মা, বাবা, পিসিমা (পদ্মা) কে দেখছি। আরও কাকা, জ্যাঠা, পিসি আর গোপ-গোপীদের দেখছি। একবার দম নিয়ে কৃষ্ণ বলল, “কুটিরের বাইরে গাছপালা, ঘাস, আকাশ, পাখিদের দেখছি। কিন্তু আমার গরু-বাছুরগুলোকে দেখতে পাচ্ছি না।”

“এবার চোখ বন্ধ কর মোহন”, গুরুদেব বললেন।

‘নির্দেশ পালন করল কৃষ্ণ।

“কী দেখছ এবার?”

“আজ্ঞে গুরুদেব, এখন তো আর কিছুই দেখছি না!”

“প্রিয় গোবিন্দ, ব্রহ্ম তা নয় যা তুমি দেখ, ব্রহ্ম হল তা যা তোমাকে দেখায়।”

“দয়া করে ব্রহ্মকে বলুন যেন আমার নন্দিনীকে একটিবার দেখায় “, কৃষ্ণ এবার ব্যাকুল।

‘ওদিকে বলরাম কাণ্ড দেখে জোরে জোরে হাসতে লাগল, গুরুদেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। “ও তো ওর প্রিয় গরুটার কথা বলছে, যেটা এখন চরতে গেছে”, সহাস্যে জানাল সে।

‘ছোট্ট এক বালকের কৌতুকবোধ লক্ষ্য করে গুরুদেব বেশ আনন্দ লাভ করলেন, আবার প্রশ্নটির প্রকৃত গভীরতা অনুভব করে আশ্চর্যও কম হলেন না। শিশু বয়সেই কৃষ্ণ প্রশ্ন করছে চর্মচক্ষের ক্ষমতার সীমা আর দৃষ্টির প্রকৃত ব্যাপ্তি সমান কিনা। কপোলে তার মৃদু টোকা দিয়ে গুরুদেব বললেন, “আরেকটু বড়ো হও, ওখন এর উত্তর তোমায় আমি অবশ্যই দেব। আপাতত জেনে রাখ, পরমাত্মা অধিষ্ঠিত রয়েছেন সমস্ত ব্যক্তির মধ্যে, স্ব-স্ব আত্মা রূপে। জ্ঞানীগণ নানান নামে তাঁকে চেনেন।”

‘সৎসঙ্গের পর একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হল কৃষ্ণের জন্মতিথি। আমন্ত্রিতদের জন্য ছিল পর্যাপ্ত মিষ্টান্ন ও ভাজাভুজি। কৃষ্ণ কিন্তু কিছুই মুখে তুলল না, সে কেবল মাখনেই তুষ্ট। বেশ অনেকটা মাখন পেলে তবেই অন্য কিছু ভক্ষণ করতে সম্মত হবে।

‘অপরাহ্ণে প্রত্যাবর্তন কালে অভ্যাগতদের যাত্রাপথে এসে পড়ল ধাঙরনি অঙ্গিরা। “ওহে, এদিকে এস না, এস না, দেখছ না কারা চলেছেন এই পথ ধরে?”, এই বলে তাকে দূর করে দিতে গেল পদ্মা।

‘গোপাল কিন্তু খেলাচ্ছলে গিয়ে ধাঙরনির পা দুখানি জড়িয়ে ধরল। এতে ভীষণ অবাক আর লজ্জিত হয়ে অঙ্গিরা ওখানেই স্থির হয়ে রইল।

‘পদ্মা চিৎকার করে আহ্বান করল কৃষ্ণকে, “এই, এদিকে আয় বলছি! নিজেকে নোংরা করতে কী এত আমোদ রে?”

‘নিষ্পাপ মনে কৃষ্ণ জিজ্ঞেস করল, “কেন পদ্মা মা? অঙ্গিরা পিসির আত্মা কি পরমাত্মার অংশ নয়? ওর দেহ থেকে দূরে থাকব, নাকি আত্মা থেকে? সে তো নতুন বস্ত্র পরিধান করেছে, এমন কী আতরও মেখেছে। নোংরা কেন হতে যাবে?”

‘সমবেত জনতার চেয়ে নন্দ ছিলেন বিশ কদম অগ্রে। কথোপকথন শ্রবণ করে ফিরে চাইলেন তিনি, এক অনির্বচনীয় আনন্দ তখন তাঁর হৃদয় গ্রাস করেছে। “বসুদেব যথার্থ বলেছিলেন। এই শিশুর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বিষয়ে কংসের সন্দেহও যথাযথ। নচেৎ, এত সব গূঢ় প্রশ্ন কীভাবে নিঃসৃত হচ্ছে এর মুখ থেকে?” কৃষ্ণের ঐশ্বরিক প্রতিভা নিয়ে নিশ্চিত হলেন তিনি, সানন্দে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। অঙ্গিরার থেকে তাকে দূরে রাখার কোনো চেষ্টাই নন্দ আর করলেন না।

‘এক স্বর্গীয় সুখানুভূতির স্পর্শে তখন অঙ্গিরা আর নন্দের অশ্রুধারা বহমানা। কৃষ্ণ-উচ্চারিত ওই সরল সারসত্যেই তাঁরা পেয়েছেন ব্রহ্মের এক ঝলক। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন উপস্থিত সকলেই। অতঃপর নন্দালয়ের নতুন সদস্যা হল অঙ্গিরা, কারণ কোনো অবস্থাতেই কৃষ্ণ তাকে একলা ছাড়তে সম্মত হল না।

‘ওইদিন কৃষ্ণের লীলা যদিও তখনও অবশিষ্ট ছিল। নন্দ ভবনে চলছিল দিবসের বিভিন্ন ঘটনা সংক্রান্ত নানা আলোচনা। এমন সময় গোবিন্দ এসে বসল যশোদার ক্রোড়ে, “মা, আমায় ব্রহ্মাণ্ড দেখাও তো!” কপট রাগ দেখিয়ে যশোদা উত্তর দিলেন, “ওরে বোকা, তোর মধ্যেই তো রয়েছে, যা গিয়ে দেখ!” “দেখ না মা একটু! আমি তো খুব ছোটো, নিজের ভিতরটা দেখতেই পাচ্ছি না। তুমি একটি বার দেখ”, কৃষ্ণও নাছোড়। শেষমেশ যশোদাকে দেখানোর জন্য বড়ো করে হাঁ করল সে। এতসব ছলাকলা দেখে যশোদা ততক্ষণে বাৎসল্য রসে দ্রব হয়েছেন।

‘কৃষ্ণের মুখগহ্বর পানে চেয়ে তিনি সম্মোহিত হলেন। ছোট্ট ওই গহ্বরে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন বিশ্ব-চরাচর। কৃষ্ণের অপূর্ব সারল্যে সংবেশিত হয়েছিলেন যশোদা। স্নেহভরে যখন চাইলেন কৃষ্ণের হাঁ-মুখ পানে, দেখতে পেলেন সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পঞ্চ মহাভূত, কত না দেবদেবী, আরও কত কী!

‘আবেশের ঘোরে রইল না কালের মাপ। শেষে মুখগহ্বরে স্বয়ং তার অপরূপ মুখমণ্ডল ফুটে উঠতেই ছিন্ন হল মায়াডোর। দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিলেন যশোদা, অচেনা এক জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নতুন এই অভিজ্ঞতা অবশ্য তাঁর বেশ ভালোই লাগল। কৃষ্ণের চুলে বিলি কেটে বললেন, “হয়েছে নে, দেখলাম তোর মুখে ব্রহ্মাণ্ড। তোর মধ্যে, অঙ্গিরা-পদ্মার মধ্যে, আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে ব্রহ্মাণ্ড। আমাকে শেখানোর জন্য ধন্যবাদ। যাও, এবার গরুগুলো ফিরে আসবে, তাদের যত্ন নাও গে। বলদাওয়ের সঙ্গে খেলো গে, যাও!” সন্তানের জন্য তিনি যেমন গর্বিত, তেমনই ঈষৎ আশঙ্কিতও বটে। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি থেকে সাধারণ লোকজন, কৃষ্ণের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন সকলেই। আজকে তো তাঁর পুঁচকে ছেলেটা সব্বাইকে মাত করে দিয়েছে।

‘কৃষ্ণ চলে গেল, ওদিকে যশোদা ভাবতেই রইলেন – স্বপ্ন দেখলেন? নাকি অতসব সত্যিই ছিল কৃষ্ণের মুখগহ্বরে?’

(ক্রমশ)

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিৎ কর

সৌজন্য: Bloomsbury India