চতুর্থ অধ্যায় – গিরিব্রজ

0
1133

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

প্রভাতকাল। রাজকীয় এক বজরা বরুণা নদীর তীরে প্রাসাদের ঘাট থেকে রওনা দিতে তৈরী। পূর্বদিকে যাবার জন্য এই ঘাটটি রাজপরিবার ব্যবহার করে। পশ্চিম দিকে যাবার জন্য অসি নদীর মুখের সাইমবেদ ঘাট ব্যবহৃত হয়। মগধের দুই রাজকন্যা যখন বজরাতে ওঠার জন্য সুসজ্জিত ঘাটে এলেন, মগধের একদল সৈন্য পূর্ণ সামরিক সজ্জায় সেখানে প্রস্তুতই ছিল তাঁদের অনুগামী ও প্রহরী হিসাবে। অশ্বারোহীরা পালাক্রমে গেলে কাশী থেকে অর্ধদিবসের মধ্যে গিরিব্রজে পৌঁছতে পারে। পূর্বদিবস প্রভাতে মগধ থেকে এই সৈন্যদলকে পাঠানো হয়েছিল। তারা কাশীতে পৌঁছেছে মধ্যরাত্রির কিয়ৎক্ষণ পরে।

অস্তি বজরায় প্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁর পরে প্রাপ্তি যখন বজরায় প্রবেশ করতে উদ্যত, এক অবধূত কোথা হতে বজরার পাশে উপস্থিত। প্রাপ্তির নিকটে দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি মন্ত্রোচ্চারণ করলেন – “কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্।” এবার প্রাপ্তি মোটেই বিস্ময়ান্বিত হলেন না। তিনি পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুধাবন করতে পারছেন।

অপরাহ্নে বজরা পাটলিপুত্রে পৌছাল। রাজকীয় ভবনে একটু বিশ্রামের পর, রাজবাহিনী সমেত যাত্রা শুরু হল গিরিব্রজের (আজকের রাজগীর) পথে। দূরত্ব সামান্য নয়, পাঁচ যোজন। রাজধানীতে সন্ধ্যার পূর্বে পৌঁছনোই লক্ষ্য। রাস্তাটি পাকা না হলেও নিয়মিত দেখাশুনার ফলে যাতায়াতের উপযুক্ত। রাজকন্যাদের নিয়ে রথটি দ্রুতগতিতে চলতে লাগল। গতি ছিল প্রতি মুহূর্তে (৪৮ মিনিট) প্রায় দুই যোজন।

তৃতীয় প্রহরের মাঝের দিকে হরিৎ কৃষিক্ষেত্র কমতে লাগল আর গভীর জঙ্গল অদূরেই শোভা পেতে লাগল। সুদূরে দেখা যাচ্ছে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এই প্রাচীর পাঁচটি গিরির সমন্বয়ে রচিত – চৈত্যক, গৃদ্ধকূট, বৈভার, স্বর্ণ আর শৈল। এরা গিরিব্রজকে সমস্ত দিক থেকে রক্ষা করত। মাঝের উপত্যকায় সুউচ্চ প্রাচীররক্ষিত হয়ে শোভা পাচ্ছে গিরিব্রজ। রাস্তাটি চলে গেছে চৈত্যক আর স্বর্ণ পাহাড়ের মাঝের এক গিরিপথের দিকে। এখানেই মাগধৈয় দুর্গের প্রধান দ্বার। এই গিরিপথের দুই যোজন পূর্ব থেকে বন্য প্রাণী সংকুল গভীর বন। এই কারণেই তাঁরা সন্ধ্যার আগে গিরিব্রজে পৌঁছতে চাইছিলেন।

অশ্বগুলি গিরিপথে ওঠার সময় মন্দগতি হয়ে গেল। প্রাপ্তির মনে পড়ে গেল এই জঙ্গলে তাঁর বহুবার বন্য শূকর শিকারের কথা। কি অপূর্ব ছিল সেই দিনগুলি! এই জঙ্গলে নেই কোন ব্যাঘ্র। গিরিব্রজ থেকে প্রতিবৎসরের শিকারাভিযান ব্যাঘ্রকুলকে এই জঙ্গল থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। গয়ার দক্ষিণে নিরঞ্জনা (আজকের ফল্গু) নদীতীরের জঙ্গলেই একমাত্র পাওয়া যায় ব্যাঘ্র। স্থানীয় প্রবাদ বলে নিরঞ্জনা চিত্তের সব মল পরিষ্কার করে। মগধ রাজপরিবারের কাছে নিরঞ্জনা ছিল অত্যুত্তম বন্যপক্ষী এবং মৎস্যের ভাণ্ডার।

সন্ধ্যার পর প্রথম বাতি যখন জ্বলে উঠছে, দুই রাজকন্যা মূল প্রাচীর থেকে গোলকধাঁধার মত রাস্তা অতিক্রম করে প্রাসাদের সিংহদ্বারে উপস্থিত হলেন। পশ্চিমের সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে ডাইনে গিয়ে দক্ষিণে আসে রাজপ্রাসাদ। ডানদিকে রাজদরবার এবং রাজকর্মচারীদের বাসস্থান। প্রাসাদের প্রসর অতীব দীর্ঘ নয়, গিরিব্রজের চারিদিকের পাহাড়গুলিই প্রসরতাকে খর্ব করেছে।

রাজপ্রাসাদের দুইটি দ্বারের মধ্যে ক্ষুদ্রতর দ্বারটির সামনে রথ সশব্দে দাঁড়াল। এই দ্বারটি মহিলাদের জন্য। দুই দীর্ঘবপু প্রহরী দ্বার খুলে দিল এবং রথ ভিতরের অঙ্গনে এল। দুই দাসীর সাহায্যে অস্তি এবং প্রাপ্তি রথ থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের জননী মগধরাজ্ঞী সৌদামিনী সিঁড়ির উপরে রাজ্ঞীনিবাসের উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

অস্তি আর প্রাপ্তির পরণে বিধবার বেশ। মগধরাজ্ঞী অবগত ছিলেন না তাঁর কন্যাদ্বয়ের আসার কারণ বিষয়ে। কন্যাদের বিধবার বেশে দেখে তাঁর হৃদকম্পন হয়ে উঠল ক্ষীণ। যখন তাঁর সুন্দরী কন্যারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন, তাঁর কণ্ঠ হল শুষ্ক। তাঁর মনে হল এ যেন সূক্ষ্ম শ্বেতবস্ত্রে সজ্জিতা দুই ডাকিনী। তিনি আপনাকে চিমটি কেটে দেখলেন, যা দেখছেন তা সত্য তো। বাতিগুলি প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। এই সন্ধ্যাকালে চক্ষু ক্ষীণালোকের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলে। কিন্তু না, রাণীমার দেখায় কোন ত্রুটি নেই। বিধবারূপেই তাঁর কন্যারা তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। নিশ্চল হয়ে সৌদামিনী দাঁড়িয়ে রইলেন, কন্যারা তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। রাজ্ঞীনিবাসের অন্যান্য হতচকিতা নারীরাও সেখানে এলেন। জায়গাটি ভরে উঠল আর্তনাদ, হাহাকার আর আর্তস্বরে। বিষাদগম্ভীর পরিবেশ।

রাজ্ঞীনিবাসের সাথে পুরুষদের পরিসরের সংযোগকারী দ্বার খুলে গেল। এক সুবিশাল দরজা। দরজার গায়ে দাঁড়িয়ে এক সুদীর্ঘ সাতফুট দীর্ঘ পুরুষ। ঊর্ধ্বাঙ্গে তাঁর কেবল অঙ্গবস্ত্র, তাঁর মাংসপেশীবহুল শরীর শোভা পাচ্ছে। তাঁর বাহুগুলি হস্তীশুণ্ডের ন্যায়, তাঁর চরণদ্বয় হস্তিশাবকের মত, তাঁর মধ্যদেশ ব্যাঘ্রের মত এবং প্রত্যেক পেশী সুপুষ্ট, যেন ছাঁচে নির্মিত এবং প্রত্যেক তন্ত্রী ঢেউ-খেলানো, যেন এখনই বিস্ফোটিত হবে।

জরাসন্ধ প্রবলবেগে প্রবেশ করলেন। তাঁর চক্ষুগুলি রক্তপ্রায়, নাসারন্ধ্র স্ফূরিত, দন্তপাটিগুলি একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে। তিনি যখন নিষ্ঠীবন ত্যাগ করলেন মনে হল যেন শত্রুর প্রতি বিষোদ্গার করছেন। তিনি শার্দুলপ্রতিম ভঙ্গিমায় আসতে লাগলেন। অস্তি আর প্রাপ্তি পিতার দিকে ধাবিত হলেন এবং তাঁর বিশাল বক্ষে যেন মিলিয়ে গেলেন।

জরাসন্ধ জানতেন যে তাঁর কন্যাদের পতি নিহত হয়েছেন। তিনি তাঁর ক্রোধ গোপন করার ব্যর্থপ্রায় চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কাশী থেকে প্রবল যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল বিস্তারিত। তাছাড়াও মথুরা থেকে আসা তাঁর জামাতার হত্যার যে অশ্বপ্রেরিত বার্তা তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছিল, তা প্রবলের কথার সমর্থনসূচকই ছিল। এই বলশালী পুরুষ তাঁর ক্রন্দনরতা কন্যাদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

“বলো সোনামণিরা কি হয়েছিল?”

প্রাপ্তি বলার চেষ্টা করল। “বাবা, ভালো করে জানি না। যে মুহূর্তে ঐ গোয়ালা মথুরাপতিকে হত্যা করল, প্রবলকাকা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে এলেন। তার নাম কৃষ্ণ। কাশীতেও দেখলাম সে খুব জনপ্রিয়। লোকে বলে, সে নাকি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।”

জরাসন্ধ সচকিত হলেন।

তিনি বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা করলেন, “আমি, মগধনরেশ, মহাদেবের শপথ নিয়ে বলছি যে আমি আমার জামাইয়ের হত্যাকারীকে অনুসরণ করে নিধন না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেব না।”

“প্রবলকে আমার কাছে ডাক,” জরাসন্ধ রাজ্ঞীনিবাসের বাইরে দাঁড়ানো তাঁর রক্ষীদের নির্দেশ দিলেন।

প্রবল আনীত হলেন।

“কি হয়েছে বলুন,” জরাসন্ধ বললেন।

প্রবল আপন কণ্ঠ পরিষ্কার করে নিলেন। আপন গর্দান পরিরক্ষিত হয়, এমন এক গল্প শোনাতে তিনি প্রস্তুত হলেন।

“মহারাজ, পুরো ব্যাপারটাই হয়েছিল হঠাৎ। মথুরাপতি এক কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। যে দ্বারটি রাজপ্রাসাদকে রঙ্গভূমি থেকে পৃথক করেছে, আমি সেই দ্বারে প্রহরার তদারকি করছিলাম। দুই গোয়ালা মহাহস্তী কুবলয়পীড়কে হত্যা করে ভিতরে প্রবেশ করে এবং রাজকীয় আখড়ার কুস্তিগীরদের লড়াইয়ে আহ্বান জানায়। কৃষ্ণ চানুর এবং অন্যান্য যারা তাঁকে সাহায্য করতে এসেছিল তাদের বধ করে। বলরাম বাকীদের বধ করে। এরপরেই কৃষ্ণ বিদ্যুৎগতিতে রাজসিংহাসনে লাফিয়ে আসে। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে মথুরাপতিকে রঙ্গভূমিতে নামিয়ে আনে আর তাঁর ঘাড়ের দুর্বল মর্মগ্রন্থিতে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে। এরপর মথুরায় সম্পূর্ণ অরাজকতা নেমে আসে। আমি রাজকন্যাদের হানির ভয় করেছিলাম, তাই তাঁদেরকে নিয়ে  মথুরা থেকে দ্রুত চলে আসি।”

“ভালো কাজই করেছেন আপনি। কিন্তু এক সামান্য গোয়ালা মহাবীর কংসকে বধ করতে সমর্থ হল কিভাবে?”

“আমি ওর সম্বন্ধে প্রয়াগ আর কাশীতে অনেক কথা শুনেছি।”

“আমাকে খুলে বলুন,” জরাসন্ধ আদেশ দিলেন।

প্রবল ঈষৎ ঘাবড়েছেন কিন্তু বলতে লাগলেন, “শোনা যাচ্ছে এই কৃষ্ণ নামক ব্যক্তিটি কিছু দৈবী শক্তির অধিকারী। কাশীর বোধকরি প্রতি তিনটি লোকের একজন তার নামজপ করে এবং তাকে জগদ্গুরু বলে।”

“আরে, এই বাচ্চা ছেলেটা জগদ্গুরু নামে খ্যাত? আমাকে তো দেখছি এই কাশীর আত্মীয়দের সঙ্গেও বোঝাপড়া করতে হবে। ওরা কোনকিছু না করেই আমার শ্যালিকা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকাকে হস্তিনাপুরের ঐ অসার ব্রহ্মচারী ভীষ্মের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল।”

“শোনা যাচ্ছে এই ছেলেটির কিছু অদ্ভূত ক্ষমতা আছে। ওকে সামরিক শিক্ষণ দিয়েছে আঙ্গিরসরা। একটি বালিকা মেয়ে ওকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছে। লোকে বলে, ও নাকি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছে। মহারাজ কংস, শোনা যায় যে, ওকে বহুবার মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পাঠানো প্রত্যেক আততায়ীকেই কৃষ্ণ মেরে ফেলেছিল।” প্রবল এমনভাবে বলল যাতে মনে হয় তার বেশি কিছু জানা নেই।

জরাসন্ধ রাগে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর সেনাপতি মগধমাদনকে ডেকে পাঠালেন।

জরাসন্ধ সেনাপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মথুরার উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে আপনার কত সময় লাগবে?”

“মহারাজ তা নির্ভর করছে কিরকম আক্রমণের কথা আমরা ভাবছি তার উপর। যদি শুধু অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বারা আক্রমণ করি, তবে আক্রমণ তেমন জোরালো হবে না, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই করা যাবে। পূর্ণশক্তির আক্রমণে লাগবে অশ্বারোহী আর নৌবাহিনী। আর সঠিক বাতাসের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।”

জরাসন্ধের ধৈর্য কম।

“যদি আমরা কেবল দাঁড় টানা নৌকা ব্যবহার করি?”

মগধমাদন তাঁর প্রভুর তীক্ষ্ণ মেজাজের সাথে অপরিচিত ছিলেন না।

“রাজন্, দাঁড় টানা নৌকায় পালতোলা নৌকার তিনগুণ সময় তো লাগবেই। তার উপর এখন বরফ গলার সময়। গঙ্গা আর যমুনায় স্রোতের তীব্রতা বাড়ছে। আমাদের বর্ষাকাল শেষ হবার আগে আক্রমণে যাওয়া ঠিক হবে না। আরেকটি পন্থা আছে যে আমরা অশ্বারোহী বাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আর চেদিদেশের সাহায্য নিলাম। সেক্ষেত্রে আমরা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারি আর চেদির বেত্রবতী নামের নৌবাহিনীর সাহায্যে সব দিক থেকে মথুরাকে আক্রমণ করতে পারি।”

জরাসন্ধ সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়লেন। তিনি বর্ষার শেষ হবার জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করতে চান না। তাঁকে তাঁর জামাই শক্তিশালী কংসের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। এখনই।

“আমার ঘোড়া বীরবাহনকে নিয়ে আসুন, আমাত্য। আমাকে এখনই কুলগুরু চন্দ্রকৌশিকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। মনে হয় তিনি গৃদ্ধকূট পর্বতে আছেন। তাড়াতাড়ি।”

এক ঘটিকার (২৪ মিনিট) মধ্যে জরাসন্ধ চন্দ্রকৌশিকের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে গেলেন। আর একমুহূর্তের মধ্যে তিনি কুলগুরুর আশ্রমে উপস্থিত হলেন।

“তুমি এখানে হঠাৎ উপস্থিত হলে যে, রাজন্? আমার তো গিরিব্রজে একপক্ষের মধ্যেই যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে বিষয় গম্ভীর,” চন্দ্রকৌশিক জিজ্ঞাসা করলেন।

জরাসন্ধ ঋষিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। তিনি তাঁর জন্মের জন্যও এই ঋষির কাছেই ঋণী। তিনি কখনও গুরুর সাথে কথা না বলে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি। চন্দ্রকৌশিক কখনও তাঁকে কিছু উপদেশ দেন না। তিনি কেবল কোন ধেয় কর্মের লাভ ক্ষতি সম্বন্ধে অবগত করান। তিনি জরাসন্ধের বুদ্ধি এবং বিবেকের উপর বাকীটুকু সমর্পণ করেন। এই কারণে এরকম অপূর্ব পরামর্শদাতা থাকা সত্ত্বেও জরাসন্ধ বহু অকথ্য নিপীড়ণের দায়ে দুষ্ট। শিবভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধর্মের দ্বারা বিজয়প্রাপ্তিতে এবং ঐভাবে কর আদায়েও পিছপা হন নাই।

চন্দ্রকৌশিক স্মিতহাস্যে বললেন, “কি হয়েছে? কংসকে কেউ বধ করেছে নাকি?”

জরাসন্ধ বিদ্যুৎপৃষ্টবৎ হলেন। “সমস্ত সন্ন্যাসীরা আমার আর কংসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে রত নাকি? নতুবা কেমন করে তারা জানল কংসবধের সম্ভাবনার ব্যাপারে,” জরাসন্ধ চিন্তা করলেন।

“হ্যাঁ মহাত্মন্। আমি মথুরা আক্রমণ করে ওই গোপালক কৃষ্ণকে হত্যা করতে চাই।”

“রাজন্, বোঝাই যাচ্ছে যে তুমি আমার কাছে অনুমতির জন্যে আস নি।”

“আপনার আশীর্বাদ চাই মহাত্মন্।”

“তুমি আমাকে সম্যকভাবে জানো রাজন্। আমার আশীর্বাদ সর্বদা ধর্মের সাথেই আছে। সাধারণতঃ তোমার অভিযানগুলি আপন অহংকে তৃপ্ত করার জন্যই হয়, ধর্মের জন্য নয়।”

“মহাত্মন্, আমার জামাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বধর্ম কি প্রতিশোধ নেওয়া নয়?”

“নিঃসন্দেহে। যদি না এই হত্যা সমাজধর্ম বা রাষ্ট্রধর্মকে চরিতার্থ করার জন্য না হয়। তোমার স্বধর্ম নিশ্চয়ই উচ্চতর কোন উদ্দেশ্যের উপরে নয়।”

জরাসন্ধ নির্বাক হলেন। মহাত্মা চন্দ্রকৌশিক এতটা স্পষ্টভাবে তাঁকে কোনদিন বিরত হতে বলেন নি। তাঁর আরও বেশি জানা প্রয়োজন।

“আমিই আর্যাবর্তের সবচেয়ে বড় ধার্মিক। গুরুদেব, আপনিই বলেছেন যে আর্যাবর্তে আমার চেয়ে বড় শিবভক্ত আর কেউ নেই। আমার ক্ষত্রিয় ধর্ম কি দাবি করে না যে আমি আমার মিত্র এবং জামাইয়ের পরিবারের সাহায্যর জন্য এগিয়ে যাই?”

ঋষি চন্দ্রকৌশিক হাসছিলেন। “রাজন্, যদি এক কুটিল ধর্মীকে এক সনাতনী হত্যা করে জনতাকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে, মথুরায় ন্যায়ের যুগ ফিরিয়ে আনে, তবে তা কি করে অধর্ম হয়? অহংকারের জন্য এ হত্যা হয় নি, বরং জনতাকে উদ্ধার করার মহৎ উদ্দেশ্যেই হয়েছে। কৃষ্ণ মথুরায় ধর্মকে রক্ষা করেছেন।”

জরাসন্ধের চক্ষু বিস্ফারিত থেকে বিস্ফারিততর হচ্ছিল কিন্তু দৃষ্টি হয়ে আসছিল ক্ষীণতর। ঝাপসা কিছু তিনি দেখছিলেন।

ঋষি বলতে লাগলেন, ”রাজন্, তোমাকে উপদেশ দেওয়া আমার কাজ নয়। তুমি আমার কাছে যখন জিজ্ঞাসা করতে এসেছো, আমি তোমার কাজের ভাল-মন্দ তোমাকে জানাতে পারি মাত্র। আপন কর্মফল মানুষ ভোগ করে। কর্মফলের জন্য সবসময় ক্রিয়া আবশ্যকও নয়, আর ক্রিয়া থেকে কর্মফলের সৃজনও সবসময় হয় না। কৃষ্ণ হচ্ছেন মোহবিহীন কর্মের মূর্তরূপ। ধর্মস্থাপনাই তাঁর কাজ। এবার তোমার ব্যাপার।”

“ঋষিবর, আমার স্বধর্ম বলে যে জামাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ আমার কর্তব্য।”

“তাহলে তোমার নিজ শত্রু সম্পর্কে পূর্বপক্ষ করা কর্তব্য। আর্যাবর্তের সমগ্র সাধুসমাজ কৃষ্ণ নামের এই অলৌকিক বালককে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। আমরা সবাই তাঁকে আমাদের আশ্রমে পাবার জন্য অধীর। এরকম একজনকে শিষ্য হিসাবে পাবার চেয়ে বড় কর্মফল গুরুর কাছে আর কিছু থাকতে পারে না।”

ঋষি বলে চললেন, “আমি দশমীতে গিরিব্রজে ফিরে আসব। তুমি একাদশীতে আমার কাছে আসতে পারো কৃষ্ণ সম্বন্ধে জানতে। তিনি কিন্তু প্রবল প্রতিপক্ষ। অভিযান শুরু করার আগে তাঁকে ভালো করে জানো। আমার এটুকুই বলার আছে।”

জরাসন্ধ দীর্ঘ এক প্রশ্বাস নিলেন। তিনি ঋষিকে অভিবাদন করে বিদায় নিলেন।

পরদিবস তৃতীয় প্রহরে তিনি রাজদরবারে মগধমাদনকে বললেন, “আমরা কৃষ্ণকে বন্দী করতে এবং মথুরাকে ধ্বংস করতে অভিযান শুরু করব, ঠিক পূর্ণিমাতে। প্রস্তুতি শুরু করে দিন।”

(ক্রমশ)

 

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিত কর

সৌজন্য: Bloomsbury India