ষষ্ঠ অধ্যায়: বৃষ্ণি

0
1666

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঋষি চন্দ্রকৌশিক ধ্যানমগ্ন হলেন। সুদীর্ঘ সময় সমাধিস্থ থাকার পর তিনি নয়ন উন্মোচন করলেন এবং তাঁর বর্ণনা শুরু করলেন।

‘যাদবরা ক্ষত্রিদের শাখা কিন্তু সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয়রা তাদের কোনদিন সমকক্ষ বলে স্বীকার করে নি বরং তাদের শূদ্রের কোঠায়ই মনে করে। যদিও শূরসেন, বিদর্ভ এবং চেদি ইত্যাদি শক্তিশালী রাজ্য তাদেরই রচনা। প্রধানতঃ বৃষ্ণি এবং ভোজ গোষ্ঠীর প্রেরণায় সবগুলি গোষ্ঠী সংযুক্ত হয়ে গঠন করে মথুরা গণরাজ্য। সংযুক্ত মণ্ডলী কুকুরা গোষ্ঠীর উগ্রসেনকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করে। গণরাজ্যের নীতি নির্ধারণ করত বিশিষ্ট নাগরিকদের এক সভা যার নাম ছিল সুধর্ম সভা। রাজাকে রাজধর্ম নির্বাহে সহায়তাও করত এই সুধর্ম সভাই। বৃষ্ণি শূরসেনের উত্তরাধিকারী হবেন উগ্রসেনই এই মর্মে  সিদ্ধান্ত নেয় সুধর্ম সভা। ক্ষাত্রধর্মে তাদের পারদর্শিতা দেখে, আঙ্গিরস, গর্গাচার্য আর আমি তাদের ক্ষত্রিয়ের উপাধি দিয়েছিলাম। সনাতন ধর্ম কখনই বলে না যে বর্ণ জন্মসূত্রে নির্ণীত হবে। নিঃসন্দেহে অভিজাতশ্রেণীর মাঝে জন্মভিত্তিতে বর্ণব্যবস্থা চালু করার রীতি দেখা যায়। সেই রীতি তাদের সন্তানদের পক্ষে উচ্চপদে আরোহণের সহায়ক। ঋষিরা সর্বথা এইরকম রীতির বিপক্ষে, কিন্তু রাজারা এবং তাঁদের অর্থভোগী পুরোহিতরা প্রায়শই বর্ণব্যবস্থাকে জন্মভিত্তিতে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত থাকেন। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মাঝে বহু অবতার এসেছেন, যেমন পরশুরাম, রাম, এবং অধুনা হয়ত কৃষ্ণ। এইরকম অবতাররা এক যুগে একবারই আসেন এবং অধর্মের উৎপাটন করে ধর্মসংস্থাপন করে থাকেন।

‘বৃষ্ণি রাজ্যকে আংশিক গণরাজ্য হিসাবেই শূরসেন পত্তন করেন। এই রাজ্যে সুধর্ম সভা ছিল সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান এবং রাজা সুধর্ম সভার প্রতিনিধি হিসাবে শাসনের দায়িত্বে বহাল থাকতেন। পরবর্তী রাজার নিযুক্তিও ছিল সভার এক্তিয়ারের মধ্যেই। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পরবর্তী রাজারূপে স্বতঃনিযুক্তি নিষিদ্ধ ছিল। মহারাজ উগ্রসেন প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন। সুধর্ম সভা মথুরার জনসাধারণ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে নিয়মিত সংযোগ বজায় রাখত এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আবেগ-অনুভূতিকে জানতে চাইত। শূরসেনের পুত্র বসুদেব স্বেচ্ছায় উগ্রসেনকে রাজারূপে অভিষিক্ত করেন। উগ্রসেন ছিলেন কুকুরা গোষ্ঠীর, কিন্তু রাজ্যকে সবাই বৃষ্ণি রাজ্য বলেই জানত।

‘তোমার জামাতা কংস উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিল। শৈশব থেকেই সে ছিল অবাধ্যতার মূর্তি। কৈশোরে এবং তরুণাবস্থায় সে মহাকায় এবং মহাশক্তিশালী হয়। সে ছিল মল্লযুদ্ধ এবং অন্যান্য সব আগ্রাসী ক্রীড়ায় দক্ষ। পশুপক্ষীর প্রতি পারুষ্য তার চরিত্রে পরিলক্ষিত হত মৃগয়ার সময়।

‘যখন সে ষোল বৎসরের তরুণ, কংস এক হস্তীকে মল্লযুদ্ধে বধ করে। তার খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি এতে বহুগুণে পরিবর্ধিত হয়। আঠারো বৎসরের সময় তার সামরিক কুশলতা প্রখ্যাতি লাভ করে। প্রদ্যোৎ এবং প্রলম্বের সাহায্যে সে যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। সে যুবরাজ থাকাকালীনই তাকে তোমার দুই কন্যাদান করেছিলে, হে রাজন্ জরাসন্ধ।

‘কিছুদিন পরের কথা। সে পথে এক ব্যক্তিকে মুষ্ট্যাঘাতে হত্যা করে। ব্যক্তিটির অপরাধ ছিল যে, সে কংসকে মথুরার রাস্তায় অশ্বারোহণ কালে রাস্তা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেছিল। বিষয়টি সুধর্ম সভায় উপস্থাপিত হয়।

‘কংস ভেবেছিল যে সে যুবরাজ এবং রাজপুত্র বলে ন্যায়ালয়ের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তার ধারণা ছিল ভুল, সে দশ বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এটি ছিল অপেক্ষাকৃত মৃদুদণ্ড। তার তরুণ বয়সের কথা মাথায় রেখেই দণ্ডকে মৃদু রাখা হয়। যৌবরাজ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য কোন বিশেষ সুবিধাই সে পায় নি। সুধর্ম সভায় শাস্তির মাত্রা নিয়ে বিশেষ বিতর্ক হয়। মহামাত্য বিপ্রথু কংসের জন্য মৃত্যুদণ্ডের দাবী করেছিলেন। বৃষ্ণিরাজ্যে হত্যা ছিল বিরল। গণনায়ক প্রলম্ব সেদিন কংসের পক্ষে সরব হয়। সে শাস্ত্রবিধি থেকে বহু শ্লোক উদ্ধৃত করে সুধর্ম সভাকে বোঝায় যে তরুণ অপরাধীর শাস্তি কখনই বয়স্কজনের সমান হতে পারে না। যুক্তি দেওয়া হয় যে পল্লীতে হাঙ্গামা বাধানোর জন্য এক বাঁদরকে তো কোন শাস্তি দেওয়া হয় নি। মথুরার বাঁদর তো অতি প্রসিদ্ধ। এরকমও হয়েছে যে বাঁদরের আক্রমণে বহুলোক গভীরভাবে আহত হয়েছে, এমনকি বাঁদরের আক্রমণে মৃত্যুও সেখানে বিরল নয়। প্রলম্ব যুক্তি দেয় যে মানব শিশুকে বাঁদরের থেকে সমধিক শাস্তি দেওয়া অবিধেয় কারণ আঠারো বৎসর বয়সে তার বিবেক তো পূর্ণবিকশিত হয়নি। তার বক্তব্য ছিল যে পূর্ণশাস্তি তাদেরই প্রাপ্য যারা পূর্ণভাবে মানসিকভাবে বিকশিত এবং যাদের বিবেকের পূর্ণবৃদ্ধি হয়েছে। কংস যেহেতু কেবল আঠারো বৎসর বয়সের, তার মৃদু শাস্তিই প্রাপ্য।

‘এগারো সদস্যের এক বিচারকমণ্ডলী গঠিত হয় সুধর্মসভার নির্দেশে। তারা সেদিন কংসকে রাজকারাগারে দশ বৎসরের জন্য সশ্রম দণ্ডেই দণ্ডিত করে। তার পিতামহারাজ এই ব্যাপারে একবারও কথা বলেন নি। তিনি শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ডের মতই নীরব ছিলেন এবং পরিশেষে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের কারাগারে গমনের মার্গ প্রশস্তই করেন। কংস তার পিতার এই আচরণের কথা ভোলেনি।

‘কারাগারে, তার সাথে বাণকণ্টকের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বাণকণ্টক সময়ে অসময়ে কংসের জন্য নির্দিষ্ট কর্মও করে দিত। বাণকণ্টক ব্যবসার সময় শাঠ্যবৃত্তির জন্য এক বৎসরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। কারাগারে শ্রমপ্রদান করা তার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না।

‘বাণকণ্টক যখন কংসের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে, তার সাথে কংসের সখ্যতা গাঢ় হয়। সে বুঝতে পারে কংসের মথুরার শাসকশ্রেণীর উপর অন্তরের গভীর ঘৃণার কথা।

‘একদিন সে সাহস করে এই বিষয়ে কথা পাড়ে, “কুমার, মথুরা এক অদ্ভূত রাজ্য। এখানে রাজপরিবারের প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই।”

‘কুমার সরবে গর্জে উঠল। যেন তার গর্জনেই মথুরা ধ্বংস হয়ে যাবে। “আমি কখনও কোন রাজকুমারের কথা শুনিনি যাকে তার বাবা কারান্তরিত করেছে। আমার তো লজ্জা হয় এই ভেবে যে আমার বাবা মথুরার মহারাজ।”

‘বাণকণ্টক এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে আর এক ধাপ এগুলো, “মথুরার সুধর্ম সভা এক অধর্ম সভা মাত্র। আমার গুরুদেব বলেন যে রাজা শুধুই রাজ্যের শাসক নন, বরং তিনি এই পৃথিবীতে বিধাতারই প্রতিনিধি। সুধর্ম সভা তো বলে রাজা সভার প্রতিনিধি মাত্র, বিধাতার প্রতিনিধি নন।”

‘“কেই বা বিধাতাকে জানে? আমি তো তাঁকে ঈশ্বর বলি। ঈশ্বর তো আমাদের সকলের মাঝেই আছেন,” কংস জবাব দিল।

‘“না, মহাশয়। আমার গুরুদেব বলেন, বিধাতা ঈশ্বর নন। বিধাতা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেবল মানুষের জন্যই সৃজন করেছেন। মহাশক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন রূপে বিকশিত হয়ে প্রকাশমান, এ সব একেবারেই বাজে কথা,” বাণকণ্টক বলল।

‘কংস অন্যমনস্কভাবে সায় দিল। প্রতিশোধের অগ্নি তার মাঝে প্রজ্জ্বলিত। তার মন বিদ্বেষ এবং অপমানের বিষে জর্জরিত।

‘কংস বৃষ্ণি কুলগুরু গর্গাচার্যের আশ্রমে শিক্ষাগ্রহণ করেছিল, কিন্তু সমরবিদ্যা এবং যুদ্ধনীতি ছাড়া কোন বিষয়েই সে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে নি। সে মুষ্টিক্রীড়া, মল্লযুদ্ধ এবং নিযুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। সে তার বহু গুরুভাইকেই নিযুদ্ধ বা মল্লযুদ্ধে প্ররোচিত করত এবং তাদের পরাস্ত করে, শারীরিকভাবে নিগৃহীত করে বিশেষ আনন্দ পেত। গর্গাচার্য বহু অভিযোগ পেয়েছিলেন কংসের আচরণ নিয়ে। তিনি মহারাজ উগ্রসেনকে কংসের যৌবরাজ্যে অভিষিক্তকরণের বিরুদ্ধে পরামর্শ দেন। কংস রাজা হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না। যাদব বিধি অনুসারে রাজাকে কেবল যুদ্ধবিদ্যাতেই নয়, ষোড়শ বিদ্যায় এবং চতুঃষষ্ঠী (৬৪) কলায় রীতিমত পারদর্শী হতে হবে।

‘উপরন্তু ধর্মানুসারে রাজ্যশাসনের প্রয়োজনীয় বিবেক রাজার থাকা প্রয়োজন। রাজা নন বরং ধর্মই বৃষ্ণি রাজ্যের অভিষিক্ত শাসক বলে পরিগণিত হতেন। ঋষি গর্গাচার্য কংসকে ৪৭টি কলায় অনুপযুক্ত বলে ধারণা করেছিলেন। রাজপুত্রকে যুবরাজ হবার জন্য ৫২টি কলায় পারদর্শী হতে হত। গর্গাচার্য কংসকে বহু বিষয়ে চূড়ান্ত অনুপযুক্ত বলে ধারণা করেন, যেমন শাস্ত্রার্থের মর্মোদ্ঘাটন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আপেক্ষিকতা, ধর্মাধর্মের নির্ণয়। ধর্মনীতি নিয়ে সে ছিল দারুণ উদাসীন। গর্গাচার্যের বক্তব্য ছিল, এরকম কোন ব্যক্তি নিষ্ঠুর এবং শোষক শাসক হিসাবেই সমাসীন হবে, ইন্দ্রিয়সুখ এবং অপচয়ে হবে মগ্ন, পরিণামে রাজ্য সর্বনাশের সম্মুখীন হবে। গর্গাচার্যের এই অনুভূতি কংসের বিচারকমণ্ডলীকে জ্ঞাত করা হয়েছিল। যদি গর্গাচার্যের অনুভূতি কংসের দিকে অপেক্ষাকৃত শ্রদ্ধাশীল হত, তবে হয়ত কংসের কারাবাসের কাল কম হত, হয়ত সে মুক্তিও পেয়ে যেত যদি তার অপরাধ নিয়ে সংশয় গভীরতর হত। মথুরার রীতি ছিল এই যে উচ্চতর বর্ণের জন্য গভীরতর দায়িত্ব। তাই কোন উচ্চপদস্থ বা উচ্চবৃত্তির মানুষের কাছে অধিকতর নীতিবোধ আশা করা হত।

‘কংসের বাণকণ্টককে বেশ পছন্দ হয়ে গেল। সে সেই সব কথাই বলে যা কংসের নিজেরই সময় সময় মাথায় আসে। ধর্মীয় নীতিবোধপ্রসূত সৌজন্যের জন্য প্রয়োজনীয় ধৈর্য এই রাজপুত্রটির ছিল না। বৃষ্ণি রাজ্যের সামাজিক রীতিনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা এতটাই ন্যায়নিষ্ঠ ছিল যে কংসের ঐস্থান শ্বাসরুদ্ধকর মনে হত। বাণকণ্টকের যুক্তিগুলি কংসের কাছে ছিল উন্মুক্ত বাতায়নের মতই, এমনটি সে মথুরায় কখনও কারুর কাছেই শোনে নি।

‘একদিন সে বাণকণ্টককে জিজ্ঞাসা করল যে তার গুরুদেবের সঙ্গে কি কংসের দেখা হতে পারে? শুনে বাণকণ্টকের শরীরের প্রতিটি রোম রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। তার গুরু তার সাথে ধর্মান্তরিত করার সুফলাবলী নিয়ে আলোচনা বহুবার করেছেন। আর্যাবর্তের গুরুকুলগুলিতে যে সব ধার্মিক নীতির কথা সদা আলোচিত হয়, তার গুরু সে সবকেই খণ্ডন করেছেন। মানুষ এবং পশুপক্ষী উভয়েরই এই জগতে আপন অধিকারাদি আছে, এই কথাকে তার গুরুদেব হাস্যকর মনে করেন। শক্তির বিবর্তন, ইচ্ছা-শক্তি, ক্রিয়া-শক্তি এবং জ্ঞান-শক্তি রূপে এক আদ্যাশক্তির প্রকাশ, এই সব বৈদান্তিক তত্ত্বকে তার গুরুদেব হাস্যকর মনে করেন। তার গুরুদেবের প্রিয় আপনার রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব।

‘বাণকণ্টক তার গুরুদেবের আপন সম্প্রদায়ের সংখ্যার প্রসারের মাধ্যমে পুণ্যার্জনের তত্ত্বকে খুব পছন্দ করত। সে ছিল কঠোর হৃদয় পুরুষ আর বৃষ্ণিদের কার্যকলাপ তার কাছে মেয়েলি মনে হত।

‘এক মাসের ব্যবধানে বাণকণ্টক এবং কংসকে মুক্ত করা হল। বাণকণ্টকের কারাগারের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কংস মুক্তি পেল তরুণ বন্দীদের জন্য নির্দিষ্ট শর্তাধীনে ছয় মাসের জন্য মুক্তজীবন যাপনের এক বিশেষ যোজনায়।

‘কংস এখন কুড়ি বৎসরের এবং ক্রোধে সন্তপ্ত।

‘ছাড়া পাওয়া মাত্র সে বাণকণ্টককে ডেকে পাঠাল। “আমি তোমার গুরুর সাথে দেখা করতে চাই।”

‘বাণকণ্টক আনন্দে আত্মহারা। সে তাহলে মথুরা রাজপুত্রের প্রিয় বন্ধু হতে পেরেছে এখন।

‘“আমার গুরুদেব বর্তমানে আরবস্থানে। যখন আমি কারারুদ্ধ ছিলাম তখনই সেখানে গেছেন। শীঘ্রই ফিরবার কথা। তিনি কুরু রাজ্যে প্রায়শই যান। সেখানে এক রাজপুত্রকে তিনি শিক্ষাদান করেন। আমি এক অশ্বারোহী বার্তাবহকে পাঠাচ্ছি খবর নিতে যে তিনি হস্তিনাপুরে আছেন কিনা। যদি তিনি সেখানে থাকেন, তাহলে আমরা সেখানেই যাব।”

‘“ঠিক আছে। আমার এক বিশ্বস্ত অশ্বারোহী বার্তাবহকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তাকেই পাঠাও।”

‘হস্তিনাপুরে বাণকণ্টকের বার্তার সাথে এক অশ্বারোহী প্রেরিত হল।

‘ছয় দিন বাদ। বার্তা এল যে তারা হস্তিনাপুরে যেতে পারে। সেখানে গঙ্গার ধারে গুরুদেব শিবির খাটিয়ে অবস্থান করছেন।

‘তারা একদিন প্রভাতে নৌকা করে যমুনা পার হল। নৌকাতে আপনাদের অশ্বদুটিকেও তুলে নিল। রাত্রির আগেই তারা অশ্বারোহণে হস্তিনাপুর পৌঁছে গেল ও গুরুদেবের আশ্রমে আতিথ্য গ্রহণ করল। মধ্যরাত্রিতে গুরুদেব দেখা করবেন, তাদের জানানো হল।

‘ঠিক মধ্যরাত্রে তারা এক বৃহৎ কুঁড়েঘরে নীত হল। বাণকণ্টকের গুরুদেব সেখানে এক প্রকাণ্ড সিংহাসনে আরূঢ়। চারিদিক মূল্যবান ধাতু এবং রত্নের দীপ্তিতে দীপ্তমান।

‘গুরুদেব উঠে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাগত জানালেন। “কুটিল মুনি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে, হে কংস। আপনি এখন থেকে উপযুক্ত পরামর্শদাতার তত্ত্বাবধানে থাকবেন।”

‘কংস কুটিল মুনিকে তার প্রণাম জানাল। মুনি তাকে সামনে থাকা এক কেদারায় আসন গ্রহণের ইঙ্গিত করলেন। বাণকণ্টক দাঁড়িয়েই রইল।

‘মুনি কোন সৌজন্য বা শিষ্টাচারোদ্ভব মামুলি কথাবার্তায় গেলেন না। তিনি সরাসরি কাজের কথায় এলেন, “রাজকুমার, রাজ্যের কর্তৃত্ব তারই  প্রাপ্য যার বাহুবল, অস্ত্রবল এবং শস্ত্রবল আছে। আপনার এই তিনটিই আছে। তাহলে আপনি এত হতাশ কেন? আমরা কি সদাই বলি না, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা?”

‘“মুনিবর, মথুরায় রাজব্যবস্থা সর্বজনীন। যে কোন ব্যক্তি আপন যোগ্যতায় রাজা হতে পারেন। সুধর্ম সভা এবং গুরু গর্গাচার্য রাজার নিযুক্তিতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।”

‘“আরে এ কি হাস্যকর বিষয়। এরকম তো কোন রাজ্যেই হওয়া অনুচিত। মথুরা নিজেকে গণরাজ্য বলে। এই অভিধাটিই প্রমাণ করে তারা কতটা উপহাসাস্পদ। যখনই কোন যুদ্ধের সম্মুখীন হয় তারা, তখনই যুদ্ধক্ষেত্রে গমনের পরিবর্তে আলোচনাগারে আসন গ্রহণ করে আলোচনা করতেই থাকে! শত্রু ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্গ দখল করে নেয় এবং লুণ্ঠনদ্রব্য হাতিয়ে নেয়। যতক্ষণে ঐ তথাকথিত সুধর্ম সভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যুদ্ধ কার্যতঃ শেষ হয়ে গেছে। তারা তাদের বহু ভূমি এইভাবেই চেদি এবং মগধ রাজ্যের কাছে হারিয়েছে। আপনার কি মনে হয় না যে মথুরার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি দ্রুততর কর্মপদ্ধতি প্রয়োজন?”

‘কংসের কাছে কুটিল মুনির এই কথাগুলি সুমিষ্ট সঙ্গীতের মূর্ছনা জাগাল। “আমি আপনার সাথে এক্কেবারে একমত, মুনিবর, কিন্তু ধর্মনীতির কারণে এই গণরাজ্যের ব্যবস্থার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না।”

‘“ধর্মকে কে দেখেছে, কংস? এইসব ব্যক্তি যারা সর্বভূতে ব্রহ্মকে দেখে থাকে, তাদের এই মানবজীবন নিয়ে কোন ধারণাই নেই। আমি বলছি, আমরা সবাই ঝঙ্কালের দ্বারা সৃষ্ট। ঝঙ্কাল একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, তিনিই বিধাতা। আমাদের মানুষের এই পৃথিবীর উপর রাজত্ব করার, এখানকার সমস্ত সম্পদ ভোগ করার এবং অন্য সব জীবের উপর আধিপত্য করার অধিকার আছে। একই রকম ভাবে, রাজা হচ্ছেন পৃথিবীতে ঝঙ্কালের প্রতিনিধি। রাজার ক্ষমতায় কোন বিধিনিষেধ থাকা অনুচিত।”

‘এইরকম যুক্তি কংসের কাছে অদ্ভূত প্রতিভাত হল। সে প্রতিযুক্তির চেষ্টা করল, “মুনিবর, কিভাবে আমরা একথা বলতে পারি? এই সৃষ্টিতত্ত্ব এবং এক সৃষ্টিকর্তার তো কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। অন্যদিকে দেখুন, সমস্ত প্রাণধারী জীবের, এমনকি উদ্ভিদেরও অস্তিত্বের প্রমাণ আছে। তারা তো স্পষ্টই বিকাশের বিভিন্ন ধাপে আছে। মানুষ তো বিকাশের শেষধাপে। অনুমানের দ্বারা বলা যায় যে মানুষের আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ আছে।”

‘কুটিল মুনির সর্বাঙ্গে ক্রোধের অভিব্যক্তি দৃশ্যতই ফুটে উঠল। “কংস, বলুন তো, আপনি মথুরার রাজা হতেন চান, না কি চান না?”

‘“হ্যাঁ, মুনিবর। আমি মথুরার রাজারূপে অভিষিক্ত হতে চাই।”

‘“তাহলে যান, সিংহাসন করায়ত্ত করুন। সুধর্ম সভাকে আপন শক্তির পরিচয় দিন। যতক্ষণে তারা তাদের দীর্ঘবৈঠকের পর সিদ্ধান্তে আসবে, ততক্ষণে সিংহাসন হবে আপনার করায়ত্ত। রাজকুমার, কুটিল ধর্ম পালন করুন। আমরা আমাদের বন্দীদের মানুষ বলে মনে করি না। তারা আমাদের সম্পত্তি মাত্র। এ নিয়ে আমরা পরে আলোচনায় বসব। মথুরার সিংহাসন করায়ত্ত করুন। আপনার কি সেই শক্তি আছে? আমি আপনাকে মগধনরেশ জরাসন্ধের সাহায্য এনে দিতে পারি। তিনি অত্যুত্তম বন্ধু, যদিও তিনি একজন শিব ভক্ত। তাঁর শিবভক্তি আমার উপদেশের বিরুদ্ধগামী, কিন্তু আমি এটাও মনে করি যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রতারণা একশবার সমর্থনীয়। তাই আমরা একসাথে চলতে পারি।” কুটিল মুনি আত্মপ্রশংসার দ্বারা আত্মগরিমা উপস্থাপনে কোন কার্পণ্য রাখছিলেন না।

‘কুটিল মুনি কংসের জন্য এক পরিকল্পনা করে দিলেন। মগধের একশত সর্বোত্তম যোদ্ধা ধবলপুরী দিয়ে মথুরা পৌঁছবে। কার্তিক পূর্ণিমার মধ্যে তারা সাধুরূপে মথুরায় পৌঁছবে। কংস তাদের মথুরায় থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। তারা কংসের আদেশের প্রতীক্ষা করবে। তিন মাস মধ্যে সময় আছে। যদি পরিকল্পনা সাফল্যমণ্ডিত হয়, তবে কংসকে আর কারাগমন করতে হবে না।

‘পরদিবস দ্বিপ্রহরের মধ্যে কংস মথুরায় প্রত্যাগমন করলেন।’

আচার্য চন্দ্রকৌশিক সেদিনকার মত সমাপ্ত করলেন। অস্তি এবং প্রাপ্তি তাদের পিতার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন। জরাসন্ধ বিব্রত হয়ে এই দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করছিলেন।

(ক্রমশ)

 

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিৎ কর

সৌজন্য: Bloomsbury India