সরলা দেবী চৌধুরাণী – এক বৈপ্লবিক আলোকবর্তিকা

শ্রীচরণেষু, 

শ্রীমতী সরলা দেবী চৌধুরাণী, আপনি সময়ের ঠিক কতটা আগে জন্মেছিলেন?

আপনার কথা যত পড়ছি, অবাক হচ্ছি। আচ্ছা, আপনিও কি সেই উনিশ শতকেরই মেয়ে, যে শতকের প্রথমভাগেও মেয়েদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হত? সেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাতনি, যে বাড়ির বৌ মেয়েদের ঝুপ করে পালকিশুদ্ধু গঙ্গা থেকে চুবিয়ে আনা হত, আপনার মেজমামি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী স্বামীর সঙ্গে ইংরেজ বাড়ি নেমন্তন্নে যাওয়ায় ঝরঝরিয়ে কেঁদেছিল বাড়ির পুরনো চাকরবাকররা?

জোড়াসাঁকোর বাড়ির মেয়েদের স্বামীদের ঘরজামাই রাখার রীতি ছিল। কোনও মেয়ে স্কুলে যেত, কেউ সুযোগই পেত না লেখাপড়া শেখার। আপনার মা শিক্ষিত ছিলেন, সাহিত্য রচনা করতেন। অপরিসীম দেমাকে নিজের সন্তানদেরও ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না তিনি, নিজের মহলে থাকতেন স্বতন্ত্র, একা। চাকরবাকরদের দুনিয়ায় বড় হয়ে ওঠা আপনার। তিন ভাইবোনের সবথেকে ছোট, হয়তো একটু অবাঞ্ছিতও। পান থেকে চুন খসলে কপালে জুটত নিজের ঝি আর পণ্ডিতমশাইয়ের প্রচণ্ড মারধর। তারপরেও আপনি আকাশে ডানা মেলার সাহস দেখালেন কী করে?

শুধু তো নিজে নন, গোটা বাংলাদেশকে আপনি উড়তে শিখিয়েছিলেন সরলা দেবী চৌধুরাণী। আপনার ডানায় ভর করে বাঙালি আত্মপ্রত্যয় খুঁজে পেয়েছিল সেদিন। আপনার হাত ধরে পড়েছিল ভুলে যাওয়া শৌর্যের পাঠ। ভারতীর পাতায় সেদিন যে রুদ্রবীণা বেজে উঠেছিল, তা আচমকা ঘটে যায়নি, ঘটানো হয়েছিল। নির্জীব, হেরে যাওয়া, আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে নিজের ইতিহাস খুঁড়ে দেখার জোর দিয়েছিলেন আপনি। অথচ তখনও বঙ্গভঙ্গ হয়নি, সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিজের দাবির কথা বলতে শেখেনি বাঙালি। মজফফরপুরে ফাটেনি বোমা।কিন্তু আপনি, ঠাকুরবাড়ির মেয়ের পরিবারের ছোট মেয়ে তখন থেকেই অস্ত্র তুলে নিতে বলছেন বাঙালি যুবককে। শুধু মুখে বলছেন না, অস্ত্র কেনার টাকা জোগাচ্ছেন, নিজের বাড়িতে গড়ে দিয়েছেন আখড়া, বসে থেকে নিজে দেখছেন সমস্ত কিছু।

দেবাঃ দুর্বলঘাতকাঃ। যে দুর্বল, দেবতারাও তাকে রক্ষা করেন না। প্রতাপাদিত্য উৎসবে লাঠি, বক্সিং, তলোয়ার প্রতিযোগিতায় জয়ীদের মেডেল দিতেন আপনি, তার এক ধারে লেখা থাকত এ কথা। ছেলেরা গোরাদের কাছ থেকে মার খেয়ে ফিরলে তাদের ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন, আবার যদি হেরে ফিরে আস, আর এখানে এস না। তারা আপনাকে প্রণাম করে বলে গিয়েছিল, মা, এবার দেখা হবে ৬ মাস পর, ইংরেজদের পিটিয়ে জেল খেটে ফিরে আসব। ২২-২৩ বছরের আপনাকে তারা ডাকত মা বলে। কোথাও খোঁচা লাগেনি, কোনও অসুবিধে হয়নি।

প্রতাপাদিত্য উৎসব ঘিরে রবীন্দ্রনাথের তীব্র আপত্তি ছিল, যেমন ছিল কাশী বিশ্বনাথে আপনার পুজো দেওয়া নিয়ে। বেনারসে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিয়েছে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, রেগেমেগে কবি বলেছিলেন, “ছিঃ অসত্যচারিণী হলি”। রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকে কালী মূর্তি ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েছিলেন, সেই কালীর ছবি নিজের ঘরে প্রকাশ্যে রেখেছিলেন আপনি। কবি তখন বোঝেননি, আপনি ফিরছেন মূলে, পিরিলির আবরণ সরিয়ে করছেন কোন গভীরে প্রোথিত বাঙালিত্বের শেকড় সন্ধান।

প্রতাপাদিত্য উৎসব নিয়ে দীনেশ সেনকে দিয়ে আপত্তির কথা বলে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বরাবরের গোঁয়ার মেয়ে আপনি শোনেননি।বলেছিলেন, পিতৃব্যঘাতী প্রতাপাদিত্য নন, যে প্রতাপাদিত্য মোগলের বিরুদ্ধে দুঃসাহসে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন, তাঁকে স্মরণ করছেন তিনি, বাঙালির স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনছেন নিজের নামে সিক্কা টাকা চালানো যশোররাজকুলাধীপকে। করছেন উদয়াদিত্য উৎসব, প্রশ্ন তুলছেন, রাজপুতদের গোরা, বাদলকে নিয়ে মাতামাতি করার বদলে আমরা কেন মোগলের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া বাঙালি যুবরাজের দিকে তাকাব না!

অবশ্য এই প্রথম তো নয়। সেই ছোট্টবেলায় দুই মামাতো ভাইবোন বিবি ও সুরেন যখন সাহেবি সার্কাসে যেতে চেয়েছিল, আপনি জেদ ধরেছিলেন, বাঙালির সার্কাসে যাবেন।বলেছিলেন, কত কষ্ট করে বাঙালিরা নিজেদের একটু কিছু করেছে, তাদেরটা দেখব না? শেষমেষ জিতেছিলেন আপনিই, আজকের জেদি মেয়েদের পথিকৃৎ।

বঙ্কিমকে ভুল বোঝা আজকের নয়। আনন্দমঠ নিয়ে এখন যেমন মুসলমানদের, সমাজের এক শ্রেণির তীব্র আপত্তি রয়েছে, তখনও ছিল। ময়মনসিংহে সুহৃদ সমিতির অনুষ্ঠানে কংগ্রেসের হোমড়াচোমড়ারা আপনাকে চাপ দেন, ছেলেছোকরাদের বলে আনন্দমঠ নাটক বন্ধ করতে হবে। কারণ, তা না হলে মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেবে না, খোদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গাঁটের টাকা খরচ করে তাদের ট্রেনের টিকিট কেটে পাঠিয়েছেন। সরলা, আপনি পরিষ্কার বলে দেন, সভায় যোগ দেবে না বলে তারা যদি ভয় দেখায়, তবে আমি ছেলেদের বলব, সেই হুমকির সামনে মাথা নত কর না, লড়তে হলে লড়, মরতে হলে মর। যুক্তির পথ ধরে ভয়ডরহীন এই একলা চলা আজকের যুগেও বড় দুর্লভ সরলা দেবী।

যে রবীন্দ্রনাথ বিপ্লব আন্দোলন বিরোধী ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় লিখেছেন, তাঁর ভাগ্নি টাকা জোগাচ্ছেন বিপ্লবীদের, অনুশীলন সমিতির পুলিনবিহারী দাশ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তাঁর সঙ্গে, নিচ্ছেন অর্থ সাহায্য। আবার আপনিই খুলছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বাঙালি মেয়েদের হাতে তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে। তখনও শুরু হয়নি স্বদেশি আন্দোলন, হয়নি বঙ্গভঙ্গ। অথচ দেশি হলুদ তুলোট কাগজে তৈরি হচ্ছে ভারতীর মলাট, লোকে হাসছে, বলছে, আপনার উনপঞ্চাশ বায়ুগ্রস্ততার আর একটা উদাহরণ। কিন্তু লোকের কথায় কবে আর কান দিয়েছেন আপনি!

বন্দেমাতরমকে গোটা দেশে জনপ্রিয় করেন আপনি, নিজে গেয়ে। প্রথম দুটো স্তবক বাদ দিয়ে সপ্তকোটিকণ্ঠ থেকে সুর আপনার দেওয়া। আপনাকে স্টেশন থেকে নিতে আসা ময়মনসিংহ সুহৃদ সমিতির ছেলেরা প্রথম দিয়েছিল এই স্লোগান। সেই শুরু। বন্দে মাতরম ঢুকে গিয়েছিল সদ্য জেগে ওঠা জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

সরলা দেবী, আপনি আজও এক বিস্ময়। ভিড়ভাট্টায় যেতে অস্বস্তি হত যে আপনার, সেই আপনিই একা একা চলে গিয়েছিলেন পুনে, বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে দেখা করতে। যতীন বাঁড়ুজ্যে আপনাকে বলেছেন, বিপ্লবের টাকা জোগাতে ডায়মন্ডহারবারের এক নিঃসহায় বুড়িকে খুন করে তার মাটিতে পোঁতা টাকা নেবেন বলে ঠিক করেছেন তাঁরা। আপনার প্রবল আপত্তির মুখে যতীন বলেন, তিলক মহারাজের সম্মতি আছে এতে। সে কথা সত্যি কিনা জানতে আপনি একাই চলে যান পুনে, তার আগে যতীনকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেন, আপনি ফেরার আগে তাঁরা কিছু করবেন না। সেই কথা তাঁরা রেখেছিলেন। তিলক মহারাজ আপনাকে বলেন, বিপ্লবের অর্থ জোগাড়ে দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার কখনও সমর্থন করেন না তিনি, এতে মানুষের আস্থা বিপ্লবীদের ওপর থেকে উঠে যাবে।

আচমকা বিয়ে করেছিলেন। প্রায় ঝড়ের গতিতে। সাংসারিক জীবনে সুখী যে ছিলেন না আপনার জীবনী পড়লে বোঝা যায়। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি সুদূর পাঞ্জাবেও, বিপ্লবের কাজ, মেয়েদের কাজ। একদিন সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিলেন এই কলকাতায়। যে তরুণীর প্রবল মেধা আর অপরিসীম সাহসে ভর করে বাংলায় অগ্নিযুগ শুরু হয়েছিল, পরিণত বয়সে তিনি দেখেছিলেন, দিশা পেয়েছে তাঁর জাতি। পাঞ্জাবি, বিহারি শক্তিশালী কুলিদের তুলনায় দুর্বল, টোকা মারলে পড়ে যাওয়া বাঙালি কুলিদের কথা ভেবে লজ্জার পরিসীমা ছিল না আপনার।কিন্তু বুঝেছিলেন, প্রকৃত জোর থাকে মনে, গায়ে নয়, না হলে চেহারায় শক্তিশালী ভিন জাতের লোকেরা ইংরেজ দেখে পালাত না। রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের লেখায় অপমানিত হয়ে চিঠি লিখেছিলেন, ৫ বছর পরে এসে সে যে কোনও বাঙালি যুবকের সঙ্গে তলোয়ার বা পিস্তল দিয়ে লড়ে যাক। সে চিঠি কিপলিংয়ের কাছে পৌঁছয়নি।কিন্তু আপনি নেমে পড়েন বাঙালিকে রণসাজে সজ্জিত করতে। গলা দিয়ে স্বর না বার হওয়া, ইংরেজের লাথিতে পিলে ফেটে মরা বাঙালি বেরিয়ে পড়েছিল বোমা, পিস্তল নিয়ে, সেই ইংরেজকেই শিক্ষা দিতে। যৌবন এসেছিল বাংলার, শুরু হয়েছিল স্বর্ণযুগ।

বড় অবাক লাগে আপনাকে দেখে সরলা দেবী। মহীশূরে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া, সময়ের থেকে অত এগিয়ে থাকা সেই আপনিই আবার পুরুষের বহু বিবাহের পক্ষে ছিলেন।বলেছিলেন, এতে আর যাই হোক, সংসার ভাঙে না, ব্যাভিচারিতা হয় না। পরে মত পাল্টেছিল কিনা জানা যায়নি। অবশ্য সমাজ সংস্কার নিয়ে কোনওদিনই খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না আপনার, সব থেকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতাকে।

আজ এতদিন পরে পিছনে ফিরে আপনাকে দেখতে গিয়ে খুঁজে পাই না সরলা দেবী। সামনে তাকিয়ে দেখি, আপনি এগিয়ে রয়েছেন অনেক। নিজের সময়ের হাজার হাজার আলোকবর্ষ আগে জন্মানো আপনার মতো এক মহিয়সী নারীর অভাব আজ বড়ই বোধ করি, জানেন! জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কি সেই সময়ের ফসল, যা বাংলায় নবজাগরণ এনেছিল, নাকি আপনার মত মানুষের সংখ্যা সমাজে যখন বেড়ে যায় তখনই নবজাগরণ ঘটে!

ইতি,

এই সময়ের এক মেয়ে যে আপনার ছায়া হাত দিয়ে ছুঁতে চায়।