প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন সেই বাঙালী সত্তাকে যাকে মুছে ফেলার প্রয়াস চলছে

0
2584

সুমন দেবরায়

 

রাষ্ট্রপ্রধানের বা সরকারের প্রধানের কোন মহোৎসবের প্রারম্ভে ভাষণ বা শুভেচ্ছাবার্তা প্রদান করা কোন নতুন বিষয় কিছু নয়। অনুষ্ঠান আলাদা মাত্রা তখনই লাভ করে যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর হয়ে, একটি বিশেষ রাজ্যের মানুষকে, সেই রাজ্যের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে স্বাগত জানানোর কথা ভাবতে পারেন। যখন প্রধানমন্ত্রী সহজ ভাষায় বলেন যে বাঙলার দুর্গাপূজা সমগ্র ভারতের পূর্ণতার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অভূতপূর্ব তাৎপর্য বহন করে যে মুহূর্তে তিনি “বাঙালির উৎসব” বলে পরিচিত দুর্গাপূজার সাথে ভারতবর্ষের আত্মার যোগাযোগ স্থাপিত করেন, যখন দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করেন যে বাঙলার সাথে সাথে ভারত জেগে ওঠে এই পুণ্য মুহূর্তে। ভারতের অন্য অংশের থেকে পশ্চিমবঙ্গ যে বিচ্ছিন্ন নয়,বরং নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক যোগসূত্র রয়েছে প্রধানমন্ত্রী তা স্পষ্ট করেছেন ভাষণের মাধ্যমে । নতুন এক জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ চেতনার সূত্রপাত হল পবিত্র মহাষষ্ঠীতে।

মুছে ফেলা বিপ্লবী আন্দোলন

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বলে যা অধিকাংশ মানুষ জানে তা অহিংস আন্দোলনের ইতিহাস । প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় সহিংস বিপ্লবীদের বিপথগামী, এমনকী সন্ত্রাসবাদী বলেও পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমেই মূলতঃ স্বাধীনতা এসেছে, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করাই যেন তথাকথিত অফিসিয়াল ঐতিহাসিকদের লক্ষ্য এদেশে । প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে কুঠারাঘাত করেছেন এই ‘পোষিত’ ধারণার শিকড়ে, যখন উনি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন ‘শাস্ত্র ‘ আর ‘ শস্ত্র ‘ নিয়ে ভারতমাতার সেবায় নিবেদিত বাঙালি জ্যোতিষ্কদের প্রতি । ক্ষুদিরাম বোস, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার –অগ্নিযুগের এই বিপ্লবীদের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন প্রধানমন্ত্রী। সহিংস আন্দোলনকে অচ্ছুত করে রাখার সুপরিকল্পিত এক প্রচেষ্টাকে এক লহমায় যেন নস্যাৎ করে দিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।

স্বাদেশিকতার আবহে বাঙলা তার চিন্তনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছিল সমগ্র ভারতকে। বাঙলার মনীষীরা তাদের স্বদেশ চেতনার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষকে । বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ ‘, ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র, দেশকে মাতৃরুপে বন্দনা করে জাতীয়তাবোধের এক নবনির্মাণ যেন সূচিত করে। বাঙলার মনীষীগণ বৌদ্ধিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে যে চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন তা পথ দেখিয়েছিল ভারতের অন্যান্য অংশকে। অখণ্ড ভারতের রূপ,সংহত রাষ্ট্রের রূপ কেমন হতে পারে বাঙলার মনীষীদের সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিল।এই একবিংশ শতাব্দীতেও কোন রাষ্ট্রবাদী চেতনা সম্পূর্ণ হতে পারে না স্বামী বিবেকানন্দ আর ঋষি অরবিন্দকে নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চা না করলে। বাঙলার সৃষ্টিশীল মানুষদের নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে এই একসূত্রে দেশকে গেঁথে ফেলার প্রচেষ্টা করতে হয় নি, আবার কোন সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার ধারণাও আচ্ছন্ন করেনি সেই সুতীব্র স্বদেশিয়ানার যুগের বাঙলার মননকে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মহাষষ্ঠীর ভাষণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন সেই বাঙলার উদ্দেশ্যে যেই বাঙলা পরাধীনতার পরিবেশে এক রাষ্ট্রীয় ভাবধারার জন্ম দিয়েছিল। প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কই এভাবে ভাবতে সক্ষম,ভাবাতে সক্ষম। এভাবে ভাবতে শেখানো তার সর্বাঙ্গীন রাষ্ট্রচেতনার প্রতিফলন।

প্রকৃত প্রগতিশীলতা

পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীলতার স্বর্গ, উদার ভাবধারার পৃষ্ঠপোষক। এখানে কোন উঁচু নীচু ভেদাভেদ নাকি নেই। পৃথিবীর প্রত্যন্ত প্রান্তের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য, অত্যাচারিত মানুষের জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবিদের পরাণ কেঁদে ওঠে। কিন্তু আমাদের অ্যাকাডেমী চত্বরে অভিনীত নাটকে বা বিবিধ পথনাটিকায়, কুলীন বা জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকায় কবে শ্রদ্ধেয় হরিচাদ ঠাকুর, শ্রদ্ধেয় গুরুচাদ ঠাকুর বা শ্রদ্ধেয় পঞ্চানন বর্মাকে স্মরণ করা হয়েছে, বলতে পারবেন কোন উদার চেতনায় বিশ্বাসী বিদ্বজ্জন ? কেন তথাকথিত এলিট -প্রগতিশীলতা প্রয়াত হরিচাদ ঠাকুর বা গুরুচাদ ঠাকুর এবং নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উত্তরণে তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে তুলে ধরতে পারে না? তাহলে কি সমানাধিকারের নামাবলী গায়ে দিয়ে থাকা এইসব মানুষগুলো মনেপ্রাণে ওই ‘নমঃ’ দের থেকে দুরত্ব রাখতেই পছন্দ করেন? বাঙালির Identity নিয়ে সোচ্চার হওয়া এই ‘দরদী ‘ মানুষেরা কি বাঙালিকে কলকাতা এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ দেখতে চান ? প্রয়াত পণ্চানন বর্মা যিনি রাজবংশী সম্প্রদায়ের উন্নতিকল্পে, তাদের মূলস্রোতে রাখতে প্রাণপাত করেছিলেন , তাঁকে নিয়ে কোন অ্যাকাডেমিক চর্চা কখনো সেভাবে হয়েছে এই আলোকপ্রাপ্ত, বাঙালির স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার মানুষদের উদ্যোগে ? শেষপর্যন্ত এক গুজরাতি প্রধানমন্ত্রীকে উচ্চারণ করতে হল ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার নাম।

তাহলে বাঙলার সামগ্রিক মঙ্গলচিন্তা কে করছেন ? বাঙলার প্রান্তিক মানুষদের কথা কে জাতীয় স্তরে তুলে ধরলেন ?

ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তা কখনোই এমন এক সর্বদা এক ক্রুদ্ধ দেবতার কল্পনায় আবর্তিত হয় না। এখানে সর্বশক্তিমান ভগবানের কাছে সব আত্মসমর্পণ করে প্রার্থনা যেমন করা হয়, তেমনি আবার ভগবানের কাছে আবদারও করা হয়ে থাকে। মা দুর্গার প্রতি বাঙলার মানুষের আবেগ বোঝাতে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ভাবে বলেছেন যে মাকে এখানে ঘরের মেয়ে হিসেবেও দেখা হয়। মা এর আগমনকে বাপের বাড়িতে উমার বেড়াতে আসা হিসেবে যেমন দেখা হয়, তেমনি মাকে দুর্গতিনাশিনী বলেও আহ্বান করা হয়, মাকে আরাধনা করে তাঁর কাছে রূপ-যশ-জয় প্রার্থনা করে ভক্তকুল। এখানেই ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বিশেষত্ব, এই ভাবধারা কাছে আনে, আবার তাঁকে পূজাও করে।

ভক্তি আর ভালোবাসা এক হয়ে যায়, ভক্তির শক্তি এমনই। মা দুর্গার দুর্গতিনাশিনী রূপ আমাদের ভক্তির উদ্রেক করে। মা দুর্গা আমাদের দুধ ভাতের অভাব রাখবেন না, এই আশা আর আকাঙ্খা বাঙলার ঘরে ঘরে প্রবাহিত হয়, শহর গ্রামের কৃত্রিম তফাত মুছে যায়। প্রধানমন্ত্রী তাই আবেদন করেন গরীবের দুর্গতি দূর করতে সচেষ্ট হতে। তিনি বলেন গরীবের দুঃখ দূর করার মধ্যে মায়ের আরাধনার সার্থকতা নিহিত, কারণ মা স্বয়ং যে দুর্গতিনাশিনী। এ যেন বিবেকানন্দের সেই শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ।

মা দুর্গা নারীশক্তির জয়ের প্রতীক । প্রধানমন্ত্রী অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্রিত নারীশক্তির অজেয় রূপের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি মেয়েকে দুর্গা রূপে সম্মান প্রদানের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মেয়েদের প্রতি দুরাচারের বিরুদ্ধে নিজের সরকারের কঠোরতম অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। মেয়েদের অবস্থার উন্নতিকল্পে তার সরকার কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার আলোচনা করেন। জনধন যোজনা, মুদ্রা ঋণ, গর্ভবতী নারীদের বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা, আভ্যন্তরীণ দূষণ রোধে জ্বালানি গ্যাসের বিশেষ ব্যবস্থা পিছিয়ে থাকা পরিবারের নারীদের জন্য, রাত্রিকালীন শিফটে মেয়েদের কাজের অনুমোদন দিয়ে কাজের সুযোগ তৈরি করা, প্রতিরক্ষা বাহিনীতে মেয়েদের সমান কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা – প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন এবং নারীশক্তির প্রতি তার সরকারের মনোভাব প্রতিফলিত হয়। বর্তমান সরকারকে চব্বিশ ঘন্টা “নারীবিরোধী” তকমা দেওয়া “প্রগতিশীল” মানুষদের অনেকটাই সহায়-সম্বলহীন করে দিয়ে গেলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বড্ড দুঃখী দুঃখী ব্যাপার।

নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় বৃহত্তম স্বার্থে বা জনস্বার্থে প্রয়োগ করতে হয়। যে আনন্দ হয় মায়ের আগমনকে কেন্দ্র করে,প্যান্ডাল দর্শন নিয়ন্ত্রিত বা বন্ধ হলেও সেই আনন্দে ভাটা পড়ে না। কারন এ নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই স্বনিয়ন্ত্রণ এবং এই আনন্দের উৎস হৃদয়ের গভীরে। প্রধানমন্ত্রী তাই বিশেষ ভাবে এই আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সকলকে, আহ্বান করেছেন দুর্গত মানুষের দুর্গতি দুর করে দুর্গতিনাশিনীর আরাধনা করবার। এই আধ্যাত্মিক-সামাজিক উৎসবের তাৎপর্য যে অসীম তা যেন নতুন রূপে প্রতিভাত হল।