সপ্তম অধ্যায়: সামরিক অভ্যুত্থান

0
781

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দ্বিতীয় দিন, আচার্য চন্দ্রকৌশিক খানিকটা ব্যস্ততার সাথে শুরু করলেন। রাজা পরবর্তী পূর্ণিমার আগেই পূর্বপক্ষের সমাপন চান। অস্তি, প্রাপ্তি এবং মহারাণী সৌদামিনী ঋষির চারিদিক বেষ্টন করে বসে আছেন। অনুষ্ঠানের সূচনার সময় ছিল দ্বিপ্রহর। রাত্রির আগেই তার সমাপ্তির কথা। কাউকে অনুরোধ-উপরোধে অতীব কার্যকরী মহামন্ত্রী মগধশর্মনের উপরোধে কুলগুরু সময় পরিবর্তনে রাজী হয়েছেন।

আগের দিনের মতই আচার্য সূচনা করলেন ব্রহ্ম এবং কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে সেই একই মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা।

‘কুটিল মুনির কথা মতো, তোমাদের বাবা জরাসন্ধ প্রবলের নেতৃত্বে তাঁর সর্বোত্তম বাহিনীকে মথুরায় প্রেরণ করেন। তারা মথুরার বাইরে শিবির করে কয়েকদিন যাপন করে। তারপর কার্তিক পূর্ণিমায় নগরীতে প্রবেশ করে। প্রচুর তীর্থযাত্রীরা আসার কারণে এইসময় নগরীর সুরক্ষা তেমন আঁটোসাঁটো থাকে না।

‘মগধনরেশ যে সর্বশ্রেষ্ঠ অধার্মিক শক্তির সাথে মিত্রতাসূত্রে বদ্ধ, এ কথা আজও তেমন কেউ জানে না। যদিও রাজা বহিরঙ্গে ধর্মাচারী এবং তপস্যাপ্রিয়, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য অভিমানের প্রতিষ্ঠা,পার্থিব ক্ষমতা এবং সম্পদ। তাই অধার্মিক শক্তির সাথে মিত্রতা তাঁকে করতেই হবে। আমাদের রাজা কুটিল মুনির সাথে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ যদিও তিনি কুটিল মুনির সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে একনিষ্ঠ লড়াইয়ের ব্যাপারে অনবগত নন। মুনির জন্ম আরবস্থানে, তিনি জন্মস্থান থেকে যাত্রা করে পার্শ্বভূমি অতিক্রমের মাধ্যমে আর্যাবর্তে এসেছেন এবং গান্ধারের পুষ্কলাবতীতে একটি আশ্রম নির্মাণ করেছেন।

জরাসন্ধের কাছে এই মুহূর্ত কয়টি অস্বস্তিতে পূর্ণ। আচার্য চন্দ্রকৌশিকের এ রকম বর্ণনার জন্য তিনি ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। আচার্য বলতে থাকলেন।

‘নিঃসন্দেহে মগধনরেশ শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত নামে খ্যাত। এই শিবভক্তির উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এই শিবভক্তি কি জ্ঞানের উদ্দেশ্যে? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শিবকে আবিষ্কারের মাধ্যমে নির্গুণ ব্রহ্মকে অনুভব করার প্রেরণায়? না কি এই ভক্তি সুবিধাবাদিতা এবং অহংমত্ততার ক্রিয়া মাত্র? মগধনরেশ ক্রিয়া এবং কর্মের উপর আমার শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছে। ক্ষাত্রধর্ম বিষয়ে আমার উপদেশ সে বিস্মৃত হয়েছে। যাদবরা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় শূদ্র ছিল। গর্গাচার্য নিয়ত পরিবর্তনশীল বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় ক্ষত্রিয় হিসাবে তাদের প্রতিষ্ঠা দেন। কারণ কি? কারণ এটাই যে শূরসেন তাঁর উপদেশানুসারে এক ন্যায়রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জরাসন্ধ ত্রিলোকপতি হতে চায় কিন্তু কেন তা হতে চায়, তা তার জানা নেই। এই জগতে সমস্ত পদই আপেক্ষিক মাত্র।”

‘ক্রিয়া তো আর কর্ম নয়। কিন্তু রাজন্ তুমি শিবভক্তির ক্রিয়াতে রত কেবল জাগতিক ক্ষমতার জন্য, আর সঙ্গে সঙ্গে সর্বনিকৃষ্ট শিবদ্রোহীকে নিজের মিত্র হিসাবে গ্রহণ করেছ। এই অহংকারই তোমাকে কংসের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধেছিল, আমি এ সবই বলতে চলেছি। জরাসন্ধ, তুমি এক বিপজ্জনক রাস্তায় চলেছ। সমস্ত জীবের মধ্যেই শিবের অধিষ্ঠান। শিবকে পেতে হবে নিজের অন্তরে। তুমি যে মহাদেবকে নরমেধ যজ্ঞের দ্বারা তুষ্ট করার পরিকল্পনা করেছ, তা তোমাকে মোটেই অপরাজেয় করবে না। উপরন্তু এই পরিকল্পনাই তোমার পতনকে ত্বরান্বিত করবে।’

জরাসন্ধ ঋষির বর্ণনার সময় এই আকস্মিক তিরস্কারে বিস্ময়ান্বিত হলেন। তাঁর দৃষ্টিতে ফুটে উঠল তীব্র হতাশা। তাঁর বাড়ির নারীদের সম্মুখে তাঁর অধার্মিক শক্তির সাথে মিত্রতা উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি আচার্যের সামনে প্রণতি জানিয়ে প্রার্থনা করলেন যে পূর্বপক্ষ যেন চলতে থাকে। নারীরা ঋষির বর্ণনার আকস্মিকতায় পাষাণবৎ হয়ে গেছেন। তাঁরা জরাসন্ধকে আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসাবে কল্পনা করতেন। আজ কুলগুরু তাঁর এক সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র তুলে ধরছেন।

ঋষিবর গভীর প্রশ্বাস গ্রহণ করলেন, এক বিঘটিকার জন্য নয়ন মুদ্রিত করলেন, তারপর কথা শুরু করলেন।

‘কংস প্রবলের নেতৃত্বাধীন সৈন্যের আগমনের পর চক্রান্ত শুরু করল। তাকে যে করে হো’ক, সুধর্মসভায় উপস্থিত থাকতেই হবে যাতে সে সভার কর্তৃত্ব স্বয়ং করায়ত্ত করতে পারে।

‘কংসের অকস্মাৎ মনে পড়ে গেল মথুরার মহামাত্য বিপ্রথুর কথা। এই ব্যক্তিটিই কংসকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। যা হো’ক, কংস দশ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হল। প্রত্যেক তিন বৎসর পর পর ছয় মাসের জন্য সে শর্তাধীনে মুক্তি পাবে, আর তার আচার আচরণ অতীব সন্তোষজনক থাকলে সাড়ে সাত বৎসরের পর দণ্ড সমাপ্ত হবে। এরপর বিপ্রথু কংসের কাছে এসেছিলেন। স্নেহভরে তাঁর হাত কংসের মাথায় রেখে তাকে বলেছিলেন, “বৎস, আমরা সকলেই সময়ে সময়ে ভুল করে বসি। যে ব্যক্তি আপন ত্রুটির থেকে প্রভূত শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাঁকে দুঃখের অগ্নি স্বর্ণের মত নির্মল করে। তাঁর মধ্যস্থ পুরীষ সেই অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়। স্বর্ণের মতই মূল্যবান, নমনীয়, উজ্জ্বল এবং বিকিরণশীল হন তিনি। আমার সাথে প্রথমবার শর্তাধীনে মুক্তি পাবার পর দেখা কোরো। আমি প্রয়াস করব যাতে তোমার বাকী কারাদণ্ড ক্ষমা করা হয়। অবশ্যই এজন্য তোমাকে আপন আচরণের দ্বারা কারা কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকতে হবে।”

‘কংস বিপ্রথুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। ক্ষমাশীল বিপ্রথু কংসকে দেখে আনন্দিত হলেন। “এস, বাছা, এস। তোমাকে দেখে আজ আমার ভিতরে সুখসঞ্চার হচ্ছে। আশা করি, কারাগারে তুমি কোন দুর্নাম অর্জন কর নি।”

‘“না, আমাত্য। আমি গত তিন বছরে সেখানে একবারও শাস্তি পাই নি।”

‘বিপ্রথু রাজকুমারের প্রতি স্নেহপূর্ণ প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখছিলেন। কুমার তাঁর যুবরাজ আখ্যা খুইয়েছে দণ্ডভাগী হবার পর এবং যাদবদের দণ্ডব্যবস্থা অনুসারে। আর এক পক্ষের মধ্যেই সুধর্মসভার বৈঠক হবার কথা। বিপ্রথু কথা দিলেন যে তিনি কংসের বিষয়টি সভায় উপস্থাপন করবেন।

‘সুধর্ম সভা পূর্ণিমায় আহ্বান করা হল। যদিও কর্ণের শাস্তির লাঘবের বিষয়টি সভায় আনা হল, কিন্তু সভা সময়াভাবে তা আলোচনার জন্য গ্রহণ করতে অসমর্থ হল। সিদ্ধান্ত হল যে পরের সভায় এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। কংসকে সেইদিন উপস্থিত থাকার কথাও বলা হল। পরের সভা বসবে এক মাসের ব্যবধানে। সভার তিনদিনের মধ্যেই কংসের শর্তাধীন মুক্তিকালও সমাপ্ত হবে।

‘ইতোমধ্যে, কংস মগধের সেনাকে গুপ্ত রাখার জন্য ভীষণ সমস্যায় পড়ল। এরা ছিল মগধের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। কাজেই তাদের শারীরিক গড়ণ-বৈশিষ্ট্যের কারণেই তারা যে মথুরা নগরীতে সুচিহ্নিত হবে, তাতে আর সন্দেহ কি? মগধের সেনারা এক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল। তারা সমর বিষয়ে উত্তম প্রশিক্ষিত। তাদের নিযুক্তির সময় শারীরিক সক্ষমতার দিকে ধ্যান দেওয়া হয়। মথুরায় ব্যবস্থা সেরকম নয়। তাদের সৈন্যের কোন নিযুক্তি হয় না, বরং বিভিন্ন গোষ্ঠীর থেকে সংগৃহীত হয়। এক মাস এক সুদীর্ঘ সময়। যদি তাদের নগরীর বাইরে মৎস্য বা পাঞ্চালের জঙ্গলে রাখা হয়, তবে আবার এরকম সমস্যা হতে পারে যে তারা ঠিক দিনটিতে মথুরায় এসে পৌঁছাতেই পারল না।

‘কংস এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। এই অনুষ্ঠানে ১০৮ জন পুরোহিতের প্রয়োজন। অর্ধেক সৈন্য পুরোহিতদের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হলেন, বাকী অর্ধেক হলেন পরিচারক। অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে থেকে পুরোহিত এবং পরিচারক আনা ছিল বেশ সাধারণ ব্যাপার। এইভাবে কংস আপন পরিকল্পনা গুপ্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

‘সুধর্ম সভা নির্ধারিত দিনে বসল। কংস ঐদিন প্রভাতে পূর্ণাহুতি দিলেন। নগরীর উত্তরে আপন বাসস্থান থেকে নির্গত হয়ে দক্ষিণে প্রাসাদের দিকে চললেন। এইখানে প্রধান ঘাটে যাদবকুল স্নান-তর্পণাদি করে থাকেন। কংসের সঙ্গে ছিল তার সৈন্যরা, অবশ্যই পুরোহিত আর পরিচারকের পোশাকে। তাদের বস্ত্রাঞ্চলে গুপ্ত ছিল তাদের অস্ত্রশস্ত্র। যাদব ঘাটের দিকে তারা সবাই গেল। তারপর নগরীর পূর্বদ্বারের কাছে তারা সুধর্ম সভাস্থলের দিকে রওনা দিল। পূর্ব দ্বারের নাম ছিল যমুনা দ্বার। কংসকে সামনে নিয়ে পুরোহিত-পরিচারকের ছদ্মবেশে পরিচারকেরা সভাস্থলে গেল। ছয়জন প্রহরী যমুনাদ্বার পাহারা দিচ্ছিল। তারা কংসকে একাকী সভাস্থলে প্রবেশ করতে দিল। চানুরের শরীরে যে অস্ত্র নেই সেই সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার পর তাকেও প্রহরীরা ভিতরে প্রবেশ করতে দিল। চানুর এমন এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকল যাতে তার দৃষ্টি একদিকে সুধর্ম সভার দিকে থাকে, অন্যদিকে থাকে বাইরে দণ্ডায়মান তার সৈন্যদলের উপর।

‘সভার সূচনায় আমাত্য বিপ্রথু দণ্ডায়মান হলেন এবং তাঁর ধর্মদণ্ডটি অধোমুখী করে সভাকে স্থিত হতে বললেন।

‘“মহারাজ উগ্রসেনের অনুমতিসাপেক্ষে আমরা আজকের সভার কার্যপ্রণালী সূচনা করছি,” বিপ্রথু ঘোষণা করলেন।

‘প্রলম্ব দণ্ডায়মান হয়ে কংসের কারাদণ্ডের সম্পূর্ণ নিলম্বিতকরণের প্রস্তাব আনল। কংসকে সামনে আসতে আদেশ দেওয়া হল।

‘“মহারাজ, আমাত্য বিপ্রথু কংসের অবশিষ্ট কারাদণ্ডের পূর্ণভাবে নিলম্বিতকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। কারাগারাধিপতি তাঁর বক্তব্যও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে তিন বৎসরের কারাবাসকালে কংসের আচরণ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। তার শ্রমদান ছিল অন্য সাধারণ বন্দিদের গড়পরতা শ্রমসাধনের অষ্টগুণাধিক। আমাত্যের বক্তব্য হল এই যে কংসের অসাধারণ কারাবাসকালীন কর্ম-আচরণ আমাদের এই ধারণাই দেয় যে কুমার কংস যে কেবল অনুতপ্ত তাই নয়, সে সংশোধিতও হয়েছে। সে এখন রাজ্যের এক সাধারণ প্রজা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।”

‘সাধারণ প্রজা এই শব্দদ্বয় কংসের কাণে কেমন কেমন ঠেকল। কিন্তু তার সমস্তরকম আবেগশূন্য মুখমণ্ডল থেকে সে কথা কেউ বুঝতে পারল না।

‘মহারাজ উগ্রসেন কংসের উপর আগ্রহের সাথে দৃষ্টি রাখছিলেন।

‘“কংস নিজের বক্তব্য নিজেই জানাক,” মহারাজ উগ্রসেন বললেন।

‘কংসকে মহারাজের দক্ষিণ দিকে মঞ্চোপরি দণ্ডায়মান হতে বলা হল। মঞ্চটি ছিল তিন হস্তের অধিক উঁচু, তার উপরে সমাসীন ছিল সিংহাসন। সম্মুখে ছিল না কোন সিঁড়ি। রাজা পশ্চাৎভাগ থেকে মঞ্চে আসীন হতেন।

‘কংস যথেষ্ট উদ্ধতস্বরে এবং রাজোচিত অহংকারের সাথে বলল, “আমাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।”

‘বিপ্রথু অতীব বিস্মিত হলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে কংস আপন কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এইরকম ধৃষ্টতামূলক আচরণের ফলে সমস্ত সভাই তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। তিনি কংসের দৃষ্টিতে আপন দৃষ্টি মিলিয়ে তাকে সূক্ষ্ম কোন বার্তা দেবার ব্যর্থ চেষ্টাই করলেন। কংস তাঁর দিকে তাকালই না। সে রক্তচক্ষে উগ্রসেনের দিকে দৃষ্টিপাত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে এক উচ্চ স্থানে দণ্ডায়মান। চারিদিকে কাষ্ঠনির্মিত এক ব্যবধান। সাধারণভাবে মৃদুভাষী উগ্রসেন এই অসভ্য আচরণে বিরক্ত।

‘“স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে আবেদনকারীর অনুতাপ নামক কোন অনুভূতি নেই। সে তো সুধর্ম সভাকে আপন ঘৃণ্য কার্যের জন্য দোষী ধার্য করছে,” উগ্রসেন বললেন।

‘কংস ভীষণ গর্জন করে উঠল, কাষ্ঠনির্মিত ব্যবধানটি আপন অতুলনীয় শক্তিতে ভঙ্গ করে মহারাজের আসনে সন্নিকটে উপস্থিত হল এক নিমিষেই, সুশিক্ষিত যোদ্ধার ক্ষিপ্রতায়। কেউ কিছু অনুধাবন করার পূর্বেই সে আপন দক্ষিণ হস্তে মহারাজ উগ্রসেনের গ্রীবা ধারণ করল। মহারাজকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা তার পক্ষে এখন জলবৎ তরলম্।

‘সমগ্র সুধর্ম সভা ভয়ভীত। তারা জানে সমরে কংসের দক্ষতা। বৃদ্ধ রাজা তো দূরঅস্ত, একশত যোদ্ধাও কংসের কাছে সমরে দুর্বল। কংস উচ্চঃস্বরে বলল, “সকলে নিজের জায়গায় স্থির থাক, নতুবা মহারাজ উগ্রসেনকে আমি গলা টিপে হত্যা করব।”

‘কংসের রাজসিংহাসনের নিকট উপস্থিতিই ছিল চানুরের প্রতি সংকেত। সেই সংকেত পাওয়া মাত্র চানুরের ইঙ্গিতে যমুনাদ্বারের বাহিরে উপস্থিত সমস্ত মাগধীয় সৈন্য সুধর্ম সভার দখল নিল। দুইজন দ্বাররক্ষীদের নিকেশ করল, বাকিরা দুই বিঘটিকার মধ্যেই (এক মিনিটেরও কম) সমস্ত সভাসদদের বন্দী করল। চানুর ধর্মদণ্ড বিপ্রথুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। সে উচ্চঃস্বরে ঘোষণা করল, “জয় মহারাজ কংসের জয়।”

‘সুধর্ম সভায় তখন আকস্মিকতার ধাক্কা আর অর্থবহুল নীরবতা। আঠারটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা, বয়স্ক আমাত্যরা সবাই উপস্থিত। কিন্তু কারুর কথা বলবার শক্তিটুকু নেই। সুধর্ম সভার পঞ্চাশ জনই অস্ত্রধারী, কারণ তাঁরা অস্ত্রধারণের অধিকারী। উপরন্তু প্রায় দুইশত প্রাসাদ রক্ষী উপস্থিত। কিন্তু মগধের একশত যোদ্ধা সকলকে নীরব করে রেখেছে।  উগ্রসেনের ভ্রাতা দেবক, ধর্মাধিকারী বসুদেব, সেনাপতি প্রদ্যোৎ, গণনায়ক প্রলম্ব, রাজার আত্মীয় অক্রূর, প্রসিদ্ধ যোদ্ধা সত্যক, প্রসেনজিৎ, সত্রাজিৎ, সকলেই উপস্থিত, আবার সকলেই বাক্যহীন।

‘কংস নিজেই উগ্রসেনকে আসন থেকে ওঠালো এবং একজন মাগধ সৈন্যকে মহারাজকে ধরে থাকতে বলল। ইত্যবসরে সে তরোয়াল দিয়ে মহারাজ উগ্রসেনের দুই দেহরক্ষীর মস্তক কর্তন করল। এই দুই দেহরক্ষীর অপরাধ এটাই ছিল যে তারা তাদের প্রভুকে স্বাধীন করার চেষ্টা করেছিল যদিও তারা কোন অস্ত্রের উপযোগ করেনি। তাদের মনে হয়েছিল যে রাজাকে হয়ত কেউ পণবন্দী বানানোর চেষ্টা করছে।

‘সুধর্ম সভা আতঙ্কের করাল গ্রাসে পতিত। শারীরিক ক্ষতি বা সম্মানহানির ভয়ে সমস্ত মহাযোদ্ধা এবং বিদগ্ধ জ্ঞানীগণ নিশ্চুপ। কংস উগ্রসেনের শির থেকে তাঁর মুকুট বিমোচন করল, তারপর তা আপন শিরে রাখল। তারপর সে সিংহাসনের অধিকার করায়ত্ত করল। আসুরিক সংখ্যালঘুর পক্ষে দুর্বল, শান্তিপ্রিয় সংখ্যাগুরুকে জয় করা অনায়াসসাধ্য।

‘সুধর্ম সভা এখন ঘটনার আকস্মিকতায় হবাক। তারা মথুরার উপর বিভীষিকার করালগ্রাসকে মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। আগে কখনই হয় নি যে এক রাজা অন্য রাজাকে সিংহাসন থেকে হঠিয়ে দিয়েছে। কোন রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান ব্যতীত রাজমুকুট পরিধানও এই প্রথম।

‘ধর্মাধিকারী বসুদেব উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রতিবাদ করলেন, “কংস, এ তো অধর্ম। যাদব গোষ্ঠীতে এরকম ভাবে তো কখনও কেউ রাজা হয় নি। আমাদের ধর্মশাস্ত্রেও তো এরকম কথা বলে না।”

‘বসুদেব শূরসেন বৃষ্ণির পুত্র। যাদবদের প্রধান গোষ্ঠীটিই বৃষ্ণি। তার ভাই নন্দ ঐ গোষ্ঠীর প্রধান। যদি রাজার জ্যেষ্ঠপুত্রের রাজা হবার রীতি থাকত, তবে বসুদেবই রাজপদের অধিকারী হত। যাদবরা যদিও এই রীতি পালন করে না। জ্ঞানী বসুদেব নিজেই কুকুরা গোষ্ঠীর উগ্রসেনকে রাজা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন। বসুদেব বীর যোদ্ধা, ধর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রীতি বিষয়ে অবগত এবং ভীষণ সাহসী। তিনি দেখতেই পাচ্ছেন যে মাগধ যোদ্ধারা সুধর্ম সভার দখল নিয়েছে। তাও তিনি কথা বললেন। তিনি কংসের মিত্রও, যদিও কংসের চেয়ে কয়েক বৎসরের বড়।

কংস অট্টহাসে ফেটে পড়ল। “বসুদেব, আমার ধর্ম আমাকে বলে যে একমাত্র শক্তিশালীরই এই রাজ সিংহাসন প্রাপ্য, শক্তিহীনের তাতে অধিকার নেই। তাই আমি নিজেই এই সিংহাসনের দখল নিলাম। তুমি তো ধর্মাধিকারী, আমার মিত্রও, আমি তোমাকে এই পদে পুনর্বহাল করলাম। এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেবার জন্য যা প্রয়োজন, তাই কর। সেনাপতি প্রদ্যোৎ আর গণনায়ক প্রলম্ব কোথায়?”

‘এই দুই ব্যক্তিই সুধর্ম সভার উপর খুব খুশি ছিল না। কারণ সুধর্ম সভার তাদের প্রতিদিনকার কার্যপদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করত। তারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলীকে প্রতিরোধ করার কোন চেষ্টাই করে নি।

‘“সেনাপতি, আমি আমার পিতা উগ্রসেনের এক্ষণেই কারাদণ্ডের বিধান দিলাম। আমি যে কুঠুরিতে ছিলাম, সেখানেই ওনাকে ন্যস্ত করা হো’ক। তবে ওনার বৃদ্ধ বয়সের কথা স্মরণ করে ওনাকে শ্রমদানে বাধ্য করলাম না।”

‘বসুদেব পুনঃ দণ্ডায়মান হলেন। “কংস, যাদব কুলে এইরকম শাসনের রীতি নেই। মহারাজেরও কাউকে দণ্ডবিধানের অদিকার নেই। সুধর্ম সভা সে জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অধর্মের পথে কেউই যেতে পারে না।”

‘“তাই তো দেখছি,” কংস বলল। “ঠিক আছে, আমি এইক্ষণেই আদেশ দিচ্ছি যে সুধর্ম সভার সমস্ত কার্যাবলী এবার থেকে আমার অধিকারভুক্ত হল। আমিই মথুরার সার্বভৌম রাজা। ধর্মকে এখন থেকে আমার কথাতেই চলতে হবে। অন্যথা ধর্ম বন্দীজীবনে যাক। মথুরার ধর্ম আজ থেকে সনাতন ধর্ম নয়, যে কেউ যা কিছু রকম ধর্ম পালন করতে চায়, মথুরায় সবই স্বাগত।”

‘সভা হল নিস্তব্ধ। কংস যে কুটিল মুনির সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, এ নিয়ে ফিসফিসানি শোনা গিয়েছিল। এই মুনির মথুরায় গুটিকয়েক ভক্ত আছে, কিন্তু মুনি বেশি কিছু করে উঠতে পারেন নি। কুটিল মুনির ছায়া আজ মথুরার সিংহাসনে আসীন, তাঁর অসহিষ্ণু কুটিল ধর্ম আজ রাজতিলকে অভিষিক্ত।

‘“আজ সভা মুলতুবি করা হল। পরের পূর্ণিমায় সভা বসবে। সমস্ত আধিকারিক আপন আপন পদে বহাল থাকবেন। চানুর আমার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হলেন। সেনাপতি প্রদ্যোৎ আমার শ্বশুরমশাই জরাসন্ধের কাছে আরও পাঁচ হাজার সৈন্যের দরখাস্ত করুন। প্রাসাদের সভাকক্ষগুলিতে প্রধান সিংহাসনের দুইপাশে আমার দুই স্ত্রী, দুই মগধতনয়ার জন্য দু’টি সিংহাসন স্থাপন করা হো’ক। সেনাপতি আমার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানের আজ্ঞাবহ থাকবেন,” কংস ঘোষণা করলেন। সুধর্ম সভার পরিসমাপ্তি হল। উগ্রসেনকে কারাগারে প্রেরণ করা হল, যেন কারাগার গমন এক ক্রীড়া মাত্র। বসুদেব ভিন্ন কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। যাদব গোষ্ঠীগুলির তথাকথিত মহানায়কদের কাপুরুষতাকে আজ উন্মুক্ত করে দিল এক অসহিষ্ণু স্বৈরাচারী।’

(চলবে)

ষষ্ঠ অধ্যায় – বৃষ্ণি

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রী জয়জিৎ কর

সৌজন্য: Bloomsbury India