আচার্য যদুনাথ সরকার – একজন পদ্ধতিতন্ত্রের নিগড়ে গড়া মানুষের কাহিনী

0
4432

ভূমিকা

ভারতবর্ষে যখন আধুনিক নবজাগরণ ঘটে, তখন শুধু উন্নত জ্ঞনচর্চা করেই ভারতীয়রা সন্তুষ্ট ছিল না, সাথে সাথেই সেই জ্ঞানচর্চার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির জন্য তারা উদগ্রীব ছিল।  আচার্য যদুনাথ সরকার ছিলেন এরকমই একজন মহান মানুষ যিনি মৌলিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব এনেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে যদুনাথ সরকার শুধু যে অসাধারণ ইতিহাসবিদ ছিলেন তা নয়, সাথে তিনি সাংস্কৃতিক দিক থেকেও নজরকাড়া নাম ছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাস পণ্ডিত ঈ. শ্রীধরণের মতে,

“the greatest Indian historian of his time [whose works] have established a tradition of honest and scholarly historiography.”

“যদুনাথ সরকার ছিলেন তাঁর সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ এবং তাঁর কাজ থেকে বোঝা যায় একজন ইতিহাসবিদ কতখানি সততার সাথে ইতিহাস রচনা করতে পারেন।”

মনে রাখতে হবে শ্রীধরণ একবিংশ শতকের মানুষ। তার এহেন সশ্রদ্ধ মন্তব্য থেকে বোঝা যায় একজন সৎ ইতিহাসবিদদের চোখে যদুনাথ সরকার কিভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেন। তিনি যার সাথে কাজ করেছিলেন, সেই ডঃ গোবিন্দ সখারাম সরদেসাই তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন –

“Jadunath as a historian is not an accident, not a fortunate child of opportunities, but the consummation of a life of preparation, planning, hard industry and ascetic devotion to a great mission.”

“যদুনাথ সরকার হঠাৎ করে ইতিহাসবিদ হন নি, তিনি সৌভাগ্যের অধিকারী বলেই ইতিহাসবিদ হয়ে যান নি। তার সমগ্র জীবন ছিল এক কথায় – প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, কঠিন পরিশ্রম এবং প্রায় ঐশ্বরিক ভক্তিতুল্য কাজের প্রতি নিষ্ঠা। যা একটি মিশন সফল করতে মানুষকে সাহায্য করবে।”

এর চেয়ে অধিকতর সত্য বচন কখনও উচ্চারিত হয়নি। এখানে যে কথাটা না বললেই নয় তা হল – যদুনাথ সরকার প্রায় একক হস্তে ভারতের ইতিহাস লিখবার শৈলী, পদ্ধতি পালটে দিতে পেরেছিলেন। তার আগে ভারতের ইতিহাস ছিল কেবল নম্বর তোলার বিষয়, সেটা যদুনাথ সরকারের পর হয়ে দাঁড়ায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য পাঠের মত আনন্দদায়ক বিষয়।

  • ১০ ডিসেম্বর ১৮৭০ সালে রাজশাহী জেলার করচমারিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন, যেটা বর্তমানে বাংলাদেশের অঙ্গ।
  • খুব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, স্কুলে তিনি কখনও কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন নি।
  • ১৮৯১ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরেজি ও ইতিহাসে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন।
  • ১৮৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম হয়ে এম.এ. পাশ করেন।
  • ১৮৯৭ সালে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি পান।
  • ১৮৯৮ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
  • ১৮৯৯ সালে পাটনা কলেজে বদলী হন এবং ১৯২৬ সাল পর্যন্ত সেখানেই কার্যরত ছিলেন।
  • মাঝে কিছুদিন ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পদে কার্যরত ছিলেন।
  • ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত কটক কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন।
  • ৪ আগস্ট ১৯২৬ সালে যদুনাথ সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন। তিনিই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ভাইস চ্যান্সেলর।
  • ঐতিহাসিক গবেষণার স্বার্থে যদুনাথ সরকার বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি ও ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন।
  • ১৯০১ সালে তার লেখা হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব প্রকাশ হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫, সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২। তার দ্বারা রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দ্য ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’, ‘শিবাজি (বাংলা)’, ‘মিলিটারি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’, ‘দ্য রাণী অফ ঝাঁসি’, ‘ফেমাস ব্যাটলস অফ দ্য ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’, ‘ক্রোনোলজি অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’, সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
  • ১৯২৩ সালে যদুনাথ সরকার প্রথমতম ভারতীয় হিসাবে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য হন।
  • ১৯২৯ সালে যদুনাথ সরকার নাইটহুড উপাধি পান। ১৯৫৮ সালে এই মহান ইতিহাসবিদের মৃত্যু হয়।

এখানে যে না বললেই নয়, তিনি ইতিহাস সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি রাখতেন, অথচ শেষ পর্যন্ত ইতিহাসবিদ হয়ে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য – যদুনাথ সরকার ইতিহাসের অধ্যাপনার পাশাপাশি বহু বছর ধরে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছিলেন।

যদুনাথ সরকার : একজন পদ্ধতির নিগড়ে গড়া মানুষের কাহিনী

আচার্য যদুনাথের কার্যকলাপ ভাল করে বুঝতে গেলে ইতিহাস রচনা সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি আগে ভাল করে জানতে হবে। তা না হলে ‘ব্যক্তি’ যদুনাথ সরকার সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হবে। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম যদুনাথ সরকারের কাছে ইতিহাস কেবল একটি বৌদ্ধিক চর্চা বা মিথ্যা প্রচারণা শেখানোর মত ব্যাপার ছিল না। তার কাছে ইতিহাস চর্চা ‘দেশপ্রেম প্রচার’, ‘জাতীয়তাবাদ প্রসার’ বা ‘তথ্য মারফৎ ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর’ মত ব্যাপার ছিল না। এমনকি তা কেবল বৃত্তি পাওয়ার জন্য মুখস্থবিদ্যার নামান্তরও ছিল না। তার কাছে ইতিহাস চর্চা প্রায় ঈশ্বরকে পাওয়ার সাধনার মত গুরুতর বিষয় ছিল। একজন যথার্থ সনাতন ধর্মের সন্তান হিসাবে বরাবর গর্ব বোধ করে আসা যদুনাথ সরকার যেভাবে ইতিহাস চর্চা করে এসেছে, তা অনেকটা ব্রহ্মজ্ঞানের খোঁজে বেরোনো একজন সন্ন্যাসীর মতই লাগা স্বাভাবিক, বিশেষ করে যারা সত্য ইতিহাস খুঁজতে চান। তিনি ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বরাবরই আত্মসম্মান বজায় রেখেছেন, শাসক দলের অনুগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে কোনও প্রকার ‘সমঝোতায়’ যান নি। ইতিহাস রচনা তার কাছে ‘তপস্যার’ চেয়ে কিছু কম ছিল না। সে কথা তিনি নিজেই ইতিহাস বইতে লিখেছেন – ‘একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদকে অবশ্যই তপস্বী হতে হবে, তাকে এমন ভাবে ইতিহাস চর্চা করতে হবে, যেন তপস্যা করছেন।’ সাম্প্রতিক কালে আরেকজন নামী ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘দ্য কলিং অফ হিস্ট্রি’ বইতে যদুনাথ সরকারের সম্বন্ধে লিখেছেন। সেখানে যদুনাথ সরকারের ‘তপশ্চর্যার’ প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন –

a certain cultivation of self-denying ethics in the personhood of the historian, a practice of a sense of ascesis, was therefore essential, for without that, the historian could not receive the truths the facts told…a way of preparing oneself for a truth that was beyond partisan interests. A self-denying quality he willingly imposed on himself…It was an inextricable part of his historical method; the man was the method.

[…]

Historians (of Jadunath Sarkar’s time) who criticized Sarkar’s emphasis on “character” never stopped to ask why someone of Sarkar’s erudition, intelligence and sense of engagement with the politics of his time would be so obsessed with the role of character in political history.

সত্যি বলতে কি, যে কোনও ইতিহাসবিদ ‘ইতিহাস গ্রন্থ’ রচনা করতে গিয়ে যা হতে হবে, সেটা সবার পক্ষে হওয়া সহজ কাজ নয় – ‘তাকে অবশ্যই একজন সন্ন্যাসী হতে হবে, তাকে ঈশ্বরকে খোঁজার মত করে সত্য খুঁজতে হবে। তাকে রাজনৈতিক পক্ষপাত’ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। তাকে ইতিহাসে লুকিয়ে থাকা গোপন সত্য খুঁজে বের করতে হলে ‘নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে’ খুঁজে বের করতে হবে। যদুনাথ সরকার ছিলেন এই রকমই একজন মানুষ, যিনি নির্ভুল পদ্ধতিতে ইতিহাস রচনা করে গেছেন।

যদুনাথ সরকারের সমকালীন যেসব ইতিহাসবিদরা তার সমালোচনা করেছেন, তারা কোনও দিনই বুঝতে চাইবে না, যদুনাথ সরকার কি পরিশ্রমের সাথে রাজনৈতিক পক্ষপাতহীনতা, সততা, বিষয়টার সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার মর্ম কি, তারা নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে এতটাই অন্ধ হয়ে আছে।

যদুনাথ সরকার ‘সত্যকারের’ ইতিহাস খোঁজার ব্যাপারে প্রায় উন্মাদ ছিলেন। তার সত্যান্বেষণের ‘বাতিক’ ছিল প্রবাদপ্রতিম। তিনি তপশ্চর্যার ন্যায় সারা জীবন ধরেই সত্যকারের ইতিহাস রচনার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ইতিহাসকে কেবল ঘটনাবলী, নাম, তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোনও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নি। এখানে মনে রাখা দরকার, যে সময়ে যদুনাথ সরকার ইতিহাস রচনার ভার নিয়েছিলেন, সে সময়ে ইতিহাস রচনা ছিল অপেশাদার, খামখেয়ালের ওপর নির্ভর করা একটি বিষয়। সত্যি বলতে কি, ভারতের ইতিহাস রচনা যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা সম্ভব তা কারুর পক্ষে ভাবাই সম্ভব ছিল না। তিনি যেভাবে এই কঠিন কাজটা (বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিহাস রচনার উদ্ভাবনা) করেছেন তার জন্য কোনও প্রশংসা যথেষ্ট নয়; অথচ আমরা তার পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দিইনি, এমনকি তাকে উপেক্ষা করে গেছি পর্যন্ত। নিচের মৌলিক প্রশ্নগুলি দেখলেই বোঝা যায় কেন যদুনাথ সরকারকে আধুনিক ইতিহাস রচনার জনক বলা যায়। তিনি নিম্নলিখিত প্রশ্নের ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা করেছিলেন।

  • ইতিহাস কাকে বলে?
  • কিভাবে ইতিহাস রচনার জন্য নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য সূত্র পাওয়া যাবে?
  • ইতিহাস ও সত্যের মধ্যে কি সম্পর্ক রয়েছে?
  • ইতিহাসের ভাষ্য লিখতে হলে কি কি যুক্তি, কারণ ও তর্ক সাজিয়ে লিখতে হবে?

একইসাথে এও স্বীকার করতে হবে যে, যদুনাথ সরকারের কর্মদক্ষতা ছিল প্রায় ঐশ্বরিক পর্যায়ের। এখানে তার তরফে তোলা প্রশ্নগুলি দেখলেই বোঝা যাবে, কি পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়েছে বস্তুনির্ভর ও বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে। আমাদের কাছে তার ইতিহাস রচনা করতে যাওয়াটা যেন মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার মতই কঠিন মনে হতে পারে। নিচের প্রশ্নগুলির দিকে একবার তাকানো যাক।

  • কোথায় যুদ্ধটা সত্যিই হয়েছিল?
  • কোন গ্রামে, কোন শহরে, কোন গঞ্জে? কারণ যেসব অঞ্চলের নাম লেখা হয়েছিল, সেই নামের অঞ্চলগুলো এখনও রয়েছে গেছে।
  • যুদ্ধক্ষেত্রের আয়তন কত ছিল?
  • কুচকাওয়াজ কতক্ষন ধরে চলেছিল?
  • সেখানে কি ধরণের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল? কত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছিল? কারাই বা সেগুলো বানাতো, আমদানি হত কোথা থেকে?
  • যদুনাথ সরকার যেসব জায়গায় যুদ্ধ বা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়েছিল, সেসব জায়গায় নিজে গিয়েছেন, গাইড সহযোগে। সেখানে বসে মানচিত্র বানিয়েছেন, ফোটো তুলেছেন।
  • তিনি ইতিহাস রচনা লিখতে যত রকম উপাদান সম্ভব সবই ব্যবহার করেছেন যেমন – পুঁথি, সরকারী নথিপত্র, শিলালিপি, মুদ্রা, মৌখিক ইতিহাস, বংশতালিকা ইত্যাদি।

সংক্ষেপে বলতে গেলে যদুনাথ সরকারের একক প্রচেষ্টায় অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সাথে ইতিহাসের অধ্যায়গুলো যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন, তা অভাবনীয়।

যদি একে তপস্যা না বলা যায়, জানি না সেক্ষেত্রে কাকে তপস্যা বলা যাবে?

 

রচনাবলী

যদুনাথ সরকারের দ্বারা রচিত গ্রন্থপঞ্জীর তালিকা নিম্নে দেওয়া হল। তিনি কোনও বিশয়ের ওপর একটাই মাত্র বই লেখেন নি, বেশ কয়েকটা খণ্ডে লিখেছেন। এখানে তার তালিকা দেওয়া হল।

  • দ্য হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব (পাঁচ খণ্ড)
  • দ্য ফল অফ মুঘল এম্পায়ার (চার খণ্ড)
  • হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল (দুই খণ্ড)
  • শিবাজি (দুই খণ্ড)

এতেই শেষ নয়, আরও কয়েকটা বইয়ের তালিকা দেওয়া হল।

  • ইকোনমিক্স অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া
  • চৈতন্য’স পিলগ্রিমেজ অ্যান্ড টিচিংস
  • নাদির শাহ ইন ইন্ডিয়া
  • ইন্ডিয়া থ্রু দ্য এজেস
  • মিলিটারি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া

এই বইগুলি ছাড়াও আরও শখানেক প্রবন্ধও, গবেষণাপত্র, মনোগ্রাফ তিনি রচনা করেছেন। সেগুলো বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

যদুনাথ সরকারের কাজ এতই নিখুঁত ও নিষ্কলঙ্ক যে, মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাঁর ঘোর বিরোধী হিসাবে গণ্য ইতিহাসবিদদেরও তাঁর বই থেকে রেফারেন্স হিসাবে গ্রহণ করতেই হয়। যেসব ইতিহাসবিদরা তাঁকে গুরু হিসাবে মেনেছেন, তার মধ্যে রমেশচন্দ্র মজুমদার সর্বাগ্রে থাকবেন। এছাড়া ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জে এফ রিচার্ডস যদুনাথ সরকারের সম্বন্ধে প্রশংসা করে লিখেছেন,

“তিনি মোটামুটি একক হাতেই নিখুঁত ও তথ্যনির্ভর মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস রচনা করেছেন এবং তা আমরা অনুসরণ করে চলেছি।”

 

যদুনাথ সরকারের ‘অপরাধ’ ও পতন

দুই তিন দশক ধরে যদুনাথ সরকার যে নিখুঁত ও তথ্যনির্ভর ইতিহাস রচনা করেছেন এবং ইতিহাস গবেষণা করেছেন তাতে তার আগে এবং পরে যেসব ইতিহাসবিদ ইতিহাস রচনা করে তার ভ্রান্তি ধরা পড়ে গেছেন। তিনি প্রচুর শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন তার কাজের দ্বারা, যারা তার কাজকে অস্বীকার করতে পারত না, এবং না করতে পেরেই তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে। মুখ্যত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সাথে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অধ্যাপকের একাংশও ছিল। চক্রান্তকারীদের মধ্যে অগ্রগণ্য দুজন হলেন মহম্মদ হাবিব ও শাফাত আহমেদ খান। এদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাকে টেনে নামানো ও পাবলিক লাইফ থেকে সম্পূর্ণ হঠানো। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য – মহম্মদ হাবিব সম্পর্কে ছিলেন জওয়াহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের পিতা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদুনাথ সরকারের অপরাধ ছিল ছিল? তিনি মুসলিম শাসনের ইতিহাসের ওপর যে ইতিহাস লিখেছিলেন, তার মধ্যে এক চুল মিথ্যা ছিল না। এখানে তিনটে উদাহরণ দেওয়া যাক।

ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব অনুসারে একজন বিশ্বাসী মুসলিমের প্রধান কর্তব্য হল আল্লাহের পথে জিহাদ করে যাওয়া, যতক্ষণ না একটি দারুলহারব (অবিশ্বাসী শাসিত রাষ্ট্র) দারুলইসলামে (শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্র) পরিণত হচ্ছে। ইসলাম বিজয়ের পর অবশ্যই একজন বিশ্বাসীর উচিত হবে সমস্ত অবিশ্বাসীকে ক্রীতদাসে পরিণত করা। পুরুষকে ক্রীতদাস করে বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হত, আর নারী ও শিশুদেরও ছাড়া হত না, তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করা হত। (দ্য হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৩-৬৪)

একজন বিশ্বাসী হবার প্রধান যোগ্যতা হল তাকে যেভাবেই হোক একজন অবিশ্বাসীকে হত্যা করতে হবে, এমনকি সে যদি নিরীহ, নির্দোষ, নিরস্ত্র হয়; তাহলেও। তার সবসময়েই অধিকার আছে অবিশ্বাসীদের হত্যা করার, তার সম্পত্তি লুট করার, তার জমি হাতিয়ে নেওয়ার; একমাত্র এই পথেই সে স্বর্গে (জন্নত) পেটে পারে। যে ধর্ম তার অনুসরণকারীদের কেবলমাত্র অন্যদের সম্পত্তি লুণ্ঠন করা বা হত্যা করা ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে শেখায়, তার পক্ষে বিশ্বে শান্তি আনা বা মানব সভ্যতাকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। (প্রাগুক্ত)

যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ কেবল নিজের ধর্ম পালনের কারণে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধীনে থাকার সময়ে প্রকাশ্যে নির্যাতনের, অপমানিত হতে বাধ্য হয়, তখন তারা নিজেদের পশুদের চেয়ে বেশী উন্নত বলে ভাবতে পারে না। মুসলিম শাসনে হিন্দুরা ঠিক এটাই ভাবত। (অ্যা শর্ট হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব, ১৫৩ পৃষ্ঠা)

আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, যদুনাথ সরকার শিবাজির সাহসের, শৌর্যের প্রশংসা করেছেন। এখানে তার নমুনা দেওয়া হল।

শিবাজির নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন, ভজন ও কীর্তন শুনিবার জন্য অধীর হইতেন। সাধু-সন্ন্যাসীর পদসেবা করিতেন, গোব্রাহ্মণের পালক ছিলেন। শিবাজির রাজ্য ছিল ‘হিন্দবি স্বরাজ’, অথচ অনেক মুসলমান তাঁহার অধীনে চাকরী পাইয়াছিল। (শিবাজী, ২২৯ পৃষ্ঠা)

শিবাজি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, বর্ত্তমান কালের হিন্দুরাও রাষ্ট্রের সব বিভাগে কাজ করিতে পারে; শাসন প্রণালী গড়িয়া তুলিতে, জলে-স্থলে যুদ্ধ করিতে, দেশে সাহিত্য ও শিল্প পুষ্টি করিতে, বাণিজ্য-পোত গঠন ও পরিচালনা করিতে, ধর্ম্ম রক্ষা করিতে তাঁহারা সমর্থ। জাতীয় দেহকে পূর্ণতা দান করিবার শক্তি আছে। (শিবাজী, ৪০৬ পৃষ্ঠা)

শিবাজির চরিত কথা আলোচনা কোরিয়া আমরা এই শিক্ষা পাই যে, প্রয়াগের অক্ষয় বটের মত হিন্দুজাতির প্রাণ মৃত্যুহীন, কত শত বৎসরের বাধা-বিপত্তির ভার ঠেলিয়া ফেলিয়া আবার মাথা তুলিবার, আবার শাখাপল্লব বিস্তার করিবার শক্তি তাঁহাদের মধ্যে নিহিত আছে। ধর্ম্ম রাজ্য স্থাপন করিলে, চরিত্রবলে বলীয়ান হইলে, নীতি ও নিয়মানুবর্তিতাকে অন্তরের সহিত মানিয়া লইলে, স্বার্থ অপেক্ষা জন্মভূমিকে বড় ভাবিলে, বাগাড়ম্বর অপেক্ষা নীরব কার্য্যকে সাধনার লক্ষ্য করিলে, – জাতি অমর অজেয় হয়। (শিবাজি, ২৩০ পৃষ্ঠা)

 

উপরোক্ত কারণে যদুনাথ সরকার প্রচুর শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে একদল ইতিহাসবিদ মাঠে নেমে পড়ে, জওয়াহরলাল নেহেরু ও গান্ধীর মদত পেয়ে। ১৯৪২-৪৩ সালে যদুনাথ সরকার স্বয়ং যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন, সেই ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন বা আই এইচ আর সি থেকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে বরখাস্ত হন। আন্দাজ করুন তো ১৯৪২ সালে ঐ সময়ে আইএইআরসি’র অন্যতম সদস্য কে ছিলেন, যাদের সৌজন্যে যদুনাথ সরকার নিজের হাতে গড়া থেকেই বরখাস্ত হয়েছিলেন?

উত্তর – ‘আলীগড়ের হাবিব’।

 

কিন্তু এসবই ছিল কেবল সূচনামাত্র। পরবর্তী দুই দশক ধরে যদুনাথ সরকারের নামে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল কয়েকজন ইতিহাসবিদদের দ্বারা। উদাহরণ হিসাবে ইরফান হাবিব যখন ১৯৫৮ সালে দ্য আগ্রারিয়ান সিস্টেম অফ মুঘল ইন্ডিয়া গ্রন্থ রচনা করেন, একবারের জন্যও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যদুনাথ সরকারের বইয়ের নামোল্লেখ করেন নি, যেখান থেকে তিনি তথ্যগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। অথচ উক্ত তথ্যগুলি সংগ্রহ করতে যে পরিশ্রম করেছিলেন যদুনাথ সরকার তার তুলনা একমাত্র তিনি নিজেই। মহম্মদ ও ইরফান হাবিব একের পর এক বই লিখে চলেন যদুনাথ সরকারের বই থেকে তথ্য জোগাড় করে, এবং তাতে প্রচুর বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন; যাতে ভারতীয়দের মধ্যে মুসলিম আমল সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়। এদের সহযোগিতা করেছিলেন সতীশ চন্দ্র, নুরুল হাসানের মত ‘ইতিহাসবিদরা’। মিত্রের ছদ্মবেশে এরা যেভাবে যদুনাথ সরকারের পিঠে ছুরি মেরেছিল, তা ইতিহাসে অতুলনীয়। ১৯৭০এর দশকে ভারতের অ্যাকাডেমিক জগতে যদুনাথ সরকারের বই মোটামুটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই সময় থেকে অদ্যাবধি কোনও ইতিহাসের ছাত্র চাইলেও ডিগ্রি পাবে না, যদি সে লেখার সূত্র হিসাবে যদুনাথ সরকারের বইয়ের নামোল্লেখ করে। এই হচ্ছে ভারতের অ্যাকাডেমিকদের ‘আসল’ চেহারা।

কিন্তু যদুনাথ সরকারের ভাগ্যে আরও দুর্ভোগ লেখা ছিল। ১৯৭৩ সালে তার মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং ব্যক্তিগত জীবনে পরধর্মবিদ্বেষী হিসাবে কুখ্যাত নুরুল হাসান ইন্দিরা গান্ধীকে বিভিন্ন মিষ্টবাক্যে ভুলিয়ে ভালিয়ে যদুনাথ সরকারের বাড়ীকেই ‘দ্য সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস’ বানানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। কি ভয়ঙ্কর অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিকল্পনা করেছিলেন নুরুল হাসান, সেটা দীপেশ চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জেনে নেওয়া যাক –

আমরা তিনি বেঁচে থাকতেই কিভাবে তার বিরুদ্ধে মার্ক্সিস্ট চক্রান্ত চলছিল, তা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। তাঁর জীবদ্দশাতেই তার সারা জীবন ধরে সংগ্রহ করা অমূল্য সম্পদগুলি সোশ্যাল সায়েন্সেস বানানোর নামে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তিনি এই নিয়ে পুরনো ছাত্রদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেওছিলেন। তিনি একবার তারই পুরানো ছাত্র বিধান চন্দ্র রায়কে বলেছিলেন, ‘মাই ডিয়ার বিধান, তুমি আমার সংগ্রহ করা জিনিসগুলি সরিয়ে নিতে পার, কিন্তু ভারতের ইতিহাসে পাতা থেকে সেগুলো মুছতে পারবে?’

তার মৃত্যুর ষাট বছর বাদে আমরা জানতে পারছি, উত্তর হচ্ছে – একটি বড়সড় ‘না’। এই নুরুল হাসান, সতীশ চন্দ্র বা ইরফান হাবিবরা জীবদ্দশাতেই ‘লিভিং ফসিল’ হয়ে বেঁচে আছে, তাদের বই কেউ পড়তেও চায় না। কিন্তু আচার্য যদুনাথ সরকার এখনও প্রাসঙ্গিক এবং তার বইগুলি যত দিন যাচ্ছে স্বকীয় সত্যতার আলোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তার পরিশ্রম, উদ্যোগ আমাদের কাছে প্রেরণার স্রোত হয়ে উঠছে। আজ আমরা বুঝতে পারছি সততার সাথে কাজ করলে একদিন পুরস্কার মিলবেই।

এক্ষেত্রে একটি প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোক উক্ত(মহানারায়ণ উপনিষদ, ১১.১) হল, যা থেকে তাকে সম্যক ভাবে বোঝা যাবে।

যথা বৃক্ষস্য সংপুষ্পিতস্য দূরাদ্গন্ধো চাত্যেবং পুষ্পস্য কর্মণো দূরাদ্গন্ধো বাতি যথাসিধারাং কর্তেঽবহিতমবক্রামে যদ্যুবে যুবে হবা বিহ্বযিষ্যামি কর্তং পতিষ্যামীত্যেবমমৃতাদাত্মানং জুগুপ্সেত্।।

বাংলায় করলে শ্লোকের অর্থ এরকম হয় –

যদ্রুপ বিকশিত চম্পকাদি পুষ্পবৃক্ষের সুরভিগন্ধ বায়ুর সহিত দূর হইতে দূরদেশে গমন করে, তদ্রূপ জগৎহিতে কৃত পুণ্যকর্ম লোকলোকান্তরে বিস্তৃত হয়।

 

ইংরাজী মূল প্রবন্ধটি থেকে অনুবাদ করেছেন সদানন্দ গৌড়াপ্পা।