ইতিহাসের আহ্বান: স্যার যদুনাথ সরকার এবং তাঁর সত্যের সাম্রাজ্য 

0
2161

পুস্তক পর্যালোচনা

The Calling of History. Sir Jadunath Sarkar and His Empire of Truth (Permanent Black in association with Ashoka University, 2015), Dipesh Chakrabarty.

বেশ কয়েক বছর আগের কথা,  জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর হিস্টোরিকাল স্টাডিজ’ এর পি এইচ ডি প্রার্থী হিসাবে বার দুয়েক আমাকে কলকাতায় আসতে হয়েছিল, এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগার এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে সূত্র সংগ্রহই ছিল আমার প্রধান উদ্দেশ্য। একজন ছাত্র হওয়ার দরুন, সবথেকে সস্তা বাসস্থানের খোঁজেই ছিলাম আমি, বিশেষ করে দুবারই আমাকে প্রায় এক পক্ষকাল থাকতে হয়েছিল কলকাতায়। আমি আশ্রয় পেলাম ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ সোশাল সাইন্সেস'(CSSS) দ্বারা পরিচালিত গেস্ট হাউসে।

“যদুনাথ সরকার ভবন”

১০, লেক টেরাস, কলকাতা ২৯

আমার সামর্থ্যানুযায়ী, বেশ কম ভাড়াতে বাসা পেয়ে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম। জানতে পারলাম, এই পান্থশালাটি আসলে অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের ব্যক্তিগত বাসভবন, তিনি তাঁর জীবনের(১৮৭০- ১৯৫৮) শেষকাল, প্রায় বিশ বছর অতিবাহিত করেছিলেন এই বাড়িতেই। তাঁর দেহাবসানের পরে, ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশাল সাইন্স রিসার্চ’ বাড়িটি ক্রয় করে ‘সি এস এস এস’ এর জন্যে এবং সেই প্রতিষ্ঠান নতুন ঠিকানায় স্থানান্তরিত হলে, বাড়িটি এক অতিথিশালায় রূপান্তরিত হয়।

আমার বসবাসকালীন, সেখানে  যদুনাথ সরকারের বিশেষ কোনও স্মৃতি চিহ্ন আমি দেখতে পাইনি, কেবল দেওয়ালে ঝোলানো তাঁর কয়েকটি ছবি ছাড়া। সংস্থাটি যাঁরা চালাতেন, তাঁরাও যদুনাথ বাবুর ব্যাপারে যত্নশীল ছিলেন না। সংক্ষেপে বলা যায়,  যদুনাথ সরকার এবং তাঁর কর্মকাণ্ডের ওপরে আলোকপাত করার মতো এমন কিছুই ছিল না সেখানে, যা এক যুবক শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, সেই মহান ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আগ্রহী হতে।

ব্যাপারটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যেহেতু, বছর বাইশ- তেইশের ইতিহাসের গবেষক হিসাবে, তাঁর মূল্যবান জীবন সম্বন্ধে আমি প্রায় কিছুই জানতাম না। আমার জ্ঞানের সীমা ছিল ১৯৩০- ৪০ এর দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার এবং শিবাজি মহারাজ ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ওপরে তাঁর বিশাল লেখনী। তাঁর জীবন সম্বন্ধে আমার কোনরকম জ্ঞানই ছিল না, না পড়া ছিল তাঁর রচিত বইগুলি।

সেই বিদ্রোহী যৌবনে তাঁর প্রাবন্ধিক সৃষ্টি আমার নজরে ছিল পুরনো ধাঁচে লেখা ইতিহাস, বীরের বীরত্ব ও শাসকদের বিবরণী মাত্র যা তখন আমাকে মোটেই আকর্ষিত করেনি। সি এইচ এস(সেন্টার ফর হিস্টোরিকাল স্টাডিজ)এ পড়াশোনা করার সময়, আমার মধ্যে এক ধরনের অবজ্ঞা জন্ম নিয়েছিল, নিছক ঐতিহাসিক বিবরণের বিষয়ে, শ্রদ্ধা জাগিয়েছিল শুধুমাত্র নিখুঁত ইতিহাস ভিত্তিক রচনার প্রতি, যে লেখনীতে  সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিত্রগুলিও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

পি এইচ ডি অর্জন করার পরে অনেক সময় কেটে গেছে, আমি এখন ইতিহাসের অধ্যাপক। আমার যৌবন আর আমার সেই বিদ্রোহী মানসিকতার দরুন গড়ে ওঠা অশ্রদ্ধার মনোভাব সবই হারিয়ে গেছে, আমার জীবন থেকে। ‘নিছক বিবরণের’ প্রতি আর কোনরকম অভক্তি উদয় হয় না আমার মনে। আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি যে চলিত ব্যবহারিক জীবনের বিবরণী লেখা কতটা কষ্টসাধ্য। গল্প বলার ক্ষমতা যা এ-যুগে বিরল, যখন লোকে শুধুমাত্র দু’শো আশি চরিত্র নিয়ে হিমসিম খায় আর ইমোজির ভাষায় যোগাযোগ স্থাপনা করে, কতখানি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় এই বিশালাকৃতির তথ্য সংগ্রহ এবং সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য।

যদুনাথ সরকার, আর সি মজুমদার, আর্নল্ড টয়োন্বি এবং জি এম ট্রেভেলিয়ানের মতো ভারতীয় ও ইংরেজ বর্ণনামূলক রচনাকারদের সম্বন্ধে ভাবতে বসলে, এখন শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে আমার। তবে আমি সততার সঙ্গেই স্বীকার করি যে আমি এখনও সরকারের কোনও রচনাই পড়ে উঠতে পারিনি আর  সেই কারণেই শেষের দিকের ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানও নেই আমার।

আমি যখন যদুনাথ সরকারের ওপরে লেখা, দীপেশ চক্রবর্তীর ‘দ্য কলিং অফ হিস্ট্রিঃ স্যার যদুনাথ সরকার আ্যান্ড হিজ এম্পায়ার অফ ট্রুথ’ বইটি হাতে পেলাম, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়ে ফেললাম আর বইটির পর্যালোচনা করার ধৃষ্টতার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না।

বইয়ের শুরুর দিকে, ভূমিকার এক পর্যায়ে, চক্রবর্তী ঘোষণা করেছেন যে তিনি সরকারের জীবনী রচনা করেননি, পরিবর্তে ইতিহাসে আবদ্ধ, কেতাবী জীবনকে কীভাবে জনজীবনে রুপান্তরিত করেছিলেন সরকার, তাইই বোঝাবার চেষ্টা করেছেন মাত্র। চক্রবর্তী বলতে চেয়েছেন উন্মুক্ত জনজীবনে, বিভিন্ন তর্ক- বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে, সরকারের ইতিহাস রচনার বিষয়ে। পুরো বই জুড়ে, ঐতিহাসিক দুটি চরিত্রের মধ্যে কথোপকথনের দ্বারা চক্রবর্তী, সরকার সম্বন্ধে আমাদের যা জানাতে চেষ্টা করেছেন তারই প্রসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে তাঁর লেখা।

জনগণের প্রচেষ্টা, বর্ণনা এবং বিতর্কের একটি হিসেব দিয়েছেন চক্রবর্তী যার মাধ্যমে সরকারের প্রতিক্রিয়া, বিবরণের প্রতি তাঁর পক্ষপাতদুষ্টতা এবং ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে এই সব ধরনের পরিস্থিতি যা তাঁকে তিনি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে, আকার দিয়েছে তাঁর রচনাকে।

অধ্যাপক যদুনাথ সরকার তাঁর জীবিকা শুরু করেন কলকাতার রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনায়। চক্রবর্তী তাঁর বইয়ের মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন, ইতিহাসবিদ স্যার সরকার উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জনপ্রিয় হওয়া ইতিহাস- উৎসাহের ফসল। অসংখ্য ইতিহাস- গবেষক ও স্ব-শিক্ষিত, অপেশাদার ঐতিহাসিক তৈরি করেছিল শতাব্দীর এই ভাগ। গবেষকের উদাহরণস্বরূপ রাজশাহীর (অধুনা বাংলাদেশ) ‘বারেন্দ্র অনুসন্ধান ​​সমিতি’ এবং পুনার ‘ভারত ইতিহাস সংশোধক  মণ্ডল’এর নাম পাওয়া যায়। জানা যায়, যদুনাথ বাবু তাঁর সারা জীবন ধরে ‘ভারত ইতিহাস সংশোধক মণ্ডলের’ সদস্য ছিলেন। চক্রবর্তীর মনে হয়েছিল, সরকারের প্রথম ঐতিহাসিক রচনা হয়তো ওই দলের হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ অথবা তার অঞ্চল সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়েই রচিত হয়েছিল। চক্রবর্তী, পরে এই তর্কের অবতারণা করেন যে গবেষক হিসেবে দলের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন যদুনাথ কেননা সরকারি নথি পত্র অবধি পৌঁছবার অধিকার তখন দেওয়া হতো না, ভারতীয়দের আর ব্রিটিশ শিক্ষা মাধ্যমে, ভারতীয় ইতিহাস ছিল ব্রাত্য, সেই কারণই হয়তো ইতিহাসবিদ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল সরকারকে।

প্রামাণিক কাগজ পত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ভারতীয় ইতিহাসবিদদের উৎসাহী করে তুলেছিল, শিক্ষিত ঔপনিবেশিক- প্রশাসক যাঁরা ভারতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে আগ্রহী তাঁদের কাছে ইতিহাস রচনার পাঠ নিতে। চক্রবর্তী লিখেছেন, যদুনাথের শিক্ষাগুরু ছিলেন আই সি এস কর্মকর্তা উইলিয়াম আরভিন (১৮৪০-১৯১১) সরকার ও আরভিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, আরভিন মুঘল সাম্রাজ্যের ওপরে লেখালেখি করছিলেন ও সরকারের মুঘল ইতিহাসের ওপরে লেখা প্রথম বই ‘ইন্ডিয়া অফ আওরঙ্গজেব'(১৯০১) এর পর্যালোচনাও করেছিলেন।

চক্রবর্তীর মতে, এক ইংরেজের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায়, ইওরোপকেই সরকার পাণ্ডিত্যের মাপকাঠি মনে করতেন, তাঁর ধারণা হয়েছিল জার্মানরাই গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী। জার্মান ইতিহাসবিদ লিওপোল্ড ভন র‍্যাংকের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ছিল যদুনাথ বাবুর। পরে, ১৯৩০ এর দিকে যদুনাথ সরকার তাঁর প্রাণ মন সমর্পণ করে দিলেন, ভারতীয় গবেষকদের পথপ্রদর্শক হিসেবে, গবেষণার সামগ্রী সংগ্রহে। যদুনাথ সরকার ও তাঁর মহারাষ্ট্রি- ইতিহাসবিদ বন্ধু রাও বাহাদুর গোবিন্দরাও সখারাম সারদেসাই (১৮৬৫- ১৯৫৯) ইতিহাস গবেষণার প্রাথমিক চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পত্র যোগান দেওয়ার ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা পালন করলেন। কাজের প্রতি তাঁদের অন্ধভক্তি, তাঁদের এগিয়ে নিয়ে গেছিল অনেকখানি, সাফল্যের পথে।

চক্রবর্তীর আঁকা ছবিতে আমরা সরকারকে পাই অতি নিয়মানুবর্তী এক ঐতিহাসিক সাধক হিসেবে যিনি ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করার জন্যে জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, তাঁর মতে ইতিহাসবিদদের কাজ হলো চাক্ষুষ সাক্ষীর প্রমাণ পত্রের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা। তাঁর লেখার মাধ্যমে চক্রবর্তী দেখাতে চাইলেন, যেভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন সরকার ঐতিহাসিক সত্যের আবিষ্কারে, অত্যন্ত অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী বীর- পূজার নেশায়। ১৭ শতাব্দীর যশোর- জমিদার, প্রতাপাদিত্যর বীরত্বের পরিচয়কে দৃঢ়ভাবে মুছে দিয়েছিলেন সরকার তাঁর বাংলার ইতিহাস- ‘হিস্ট্রি অফ বেংগলের’ তথ্য থেকে। সমকালীন বাঙালি সমাজ মুঘল বিরোধী, জাতীয়তাবাদের প্রেরণাদাতার আসনে বসাতে চেয়েছিলেন প্রতাপাদিত্যকে। অপরদিকে ছিলেন, শিবাজি মহারাষ্ট্রীয় স্বাদেশিকতায় পূজ্য।

সরকার অবলম্বন করলেন মধ্যপন্থা। সরকারের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে চক্রবর্তী দেখাতে চাইলেন, জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ও তার দ্বারা সৃষ্ট বীরগণ ছিলেন সর্বজনীন আখ্যানে যা প্ররোচিত করল, ইতিহাসবিদ সরকারকে তাঁর মতামত জানাতে আর বদলও আনতে থাকল তাঁর মধ্যে। এই বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে তিনি বিতর্কিত হতে থাকলেন। অব্রাহ্মণ ইতিহাসবিদেরা তাঁকে ইসলাম- প্রভাবিত তকমায় ভূষিত করলেন কেননা ব্রহ্মণ্য ধর্মের প্রাধান্যের যুগে, শিবাজি- রূপে তাঁরা পেয়েছিলেন এক অব্রাহ্মণ বীরপুরুষকে আর শিবাজির মূল্যায়নে, যদুনাথ সরকার দেখালেন তাঁর পরিমিতিবোধ।

চক্রবর্তীর মতে, সরকার কিন্তু ইতিহাসে বর্ণিত বীরত্ব অথবা বীরপূজার বিরোধী ছিলেন না। তাঁর ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা এগিয়ে চলত পারস্পরিক নির্ভরতায় তবে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা অনুপ্রাণিত ছিল ভিকটোরিয়ান এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের প্রচার ছিল আড়ম্বরপূর্ণ। সরকারও সামরিক বীরত্বের গুণগান করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না কিন্তু তাঁর হিসেবে সেই বীরতার যথাযোগ্য উদাহরণ আহরণের প্রয়োজন ছিল মুখ্য। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা বীর সদাশিব রাওয়ের বীর্যের সম্বন্ধে লিখতে কিন্তু কার্পণ্য করেননি সরকার। একইভাবে, তিনি দূরদর্শিতা ও চরিত্রের বিচারে এগিয়ে রাখলেন ঐতিহাসিক বীরদের। চক্রবর্তী সেখানেও ইংরেজি প্রভাব লক্ষ্য করলেন। দূরদর্শিতা ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি খ্রিষ্টধর্ম থেকে পাওয়া আর চরিত্রের ওপরে প্রাধান্য ছিল ইংরেজি ঐতিহাসিক বিবরণে, ১৭ শতক থেকেই যেখানে রাজকীয় ব্যক্তিত্বের বিচার করা হতো তাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য়ের মাধ্যমে। চক্রবর্তী তাঁকে ‘সাম্রাজ্য- শিশু’ নাম দিতে পিছপা হন নি। চক্রবর্তী মনে করেন, মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে নীতিবোধের উন্নতির যে আশা যদুনাথ সরকার করেছিলেন, তা বাহ্যত ইংরেজ সাম্রাজ্যের দান, শিক্ষনীয় অবশ্য আরও অনেক কিছুই ছিল প্রশাসনিক, আর্থিক, বিজ্ঞান ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন  এবং আপামর জনসাধারণের কল্যান।

ইন্ডিয়ান হিস্টোরিকাল রেকর্ডস কমিশন থেকে সরকারের অপসারণের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হলো, তার বিশদ বিবরণের সাথে সাথেই চক্রবর্তী তাঁর রচনা শেষ করলেন। সরকার এবং তাঁর দুই সহকর্মী, এস এন সেন ও দত্ত বামন পোতদারের মধ্যে মতান্তর হয় কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে। সরকারের ধারণা ছিল কমিশনটি মূলতঃ গঠন করা হয়েছিল ইতিহাসবিদদের প্রাথমিক স্তরের তথ্য সরবরাহ করে তাদের উৎসাহিত করার জন্য, অন্যদিকে সেন আর পোতদারের মতে কমিশনের প্রধান কাজ হলো ঐতিহাসিক নথি পত্রের সংরক্ষণ। জীবনের গোধূলিবেলায়, যদুনাথ সরকারকে কমিশন ছেড়ে সরে যেতে হলো, সেন এবং পোতদারের চক্রান্তে।

চক্রবর্তীর বইটি এখানেই শেষ হয়নি, বইয়ের শেষ অনুচ্ছেদে তিনি তাঁর এবং সরকারের মধ্যের এক কাল্পনিক কথোপকথন লিপিবদ্ধ করেছেন। চক্রবর্তীর মত একজন নামজাদা পণ্ডিত হলে কোন মৃতের সাথে কথোপকথনও বইতে লিপিবদ্ধ করা যায়। ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে এরকম ব্য়াপার আকছারই হয়ে থাকে।

চক্রবর্তীর এই প্রচেষ্টা কতখানি সফল হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করা যাক। আচ্ছাদনের ভেতরের ইতিহাসকে প্রকাশ্যে এনেছিলেন যে ইতিহাসবিদ তাঁর জীবনের জলছবি যেন বিশদভাবে এঁকে আমাদের সামনে রেখে দিয়েছেন চক্রবর্তী। বইটা পড়ে, বন্ধ করে ভাবতে বসলে কিন্তু অনেক প্রশ্ন জাগে পাঠকের মনে। প্রত্যেকটি ইতিহাসবিদের জীবনই কী কোনও না কোনও সময়ে উন্মুক্ত ইতিহাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি? ভারতীয় মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের লেখনীতে যেমন তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়, সরকারের সম্বন্ধে লেখার সময়ে চক্রবর্তীর কী মনে হয়নি, সরকার ব্যতীত আরও অনেক ইতিহাসবিদেরই লেখনী রূপ পেয়েছে উন্মুক্ত এবং গুপ্ত ইতিহাসের পারষ্পরিক ক্রিয়ায়! প্রশ্ন জাগে  যদি মনে না হয়ে থাকে তার কারণ কী? আরও বলতে চাই যে ঔপনিবেশিক ভারতে ইতিহাসের উন্মুক্ত রূপের কথা বিশেষ আলোচনা করেননি চক্রবর্তী।

সরকার যখন ইতিহাস রচনায় ব্যস্ত ছিলেন এই বাংলায় তখন এই প্রভাব বাংলার মাটিতে এল কীভাবে, তার উত্তর পাওয়া যায় না। তৎকালীন বাংলা এবং বাকী ভারতের ইতিহাসের কোন্ বিষয়গুলি তর্ক ও আলোচ্য ছিল এই বাংলায়, আর সেই বিষয়ে সরকারের মতামতই বা কী ছিল বা প্রতাপাদিত্যকে বাংলার বীরের উপাধি দিতে কেনই বা রাজী ছিলেন না তিনি? চক্রবর্তীর লেখায় কিন্তু তার কোনও উল্লেখ নেই। একইভাবে, চক্রবর্তীর বর্ণনায় পাওয়া যায় না, বাঙালি ভদ্রলোক সরকারের প্রকৃত পরিচয়।

যদুনাথ সরকার এমন এক বাঙালি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যিনি তাঁর ইংরেজিয়ানার অন্তরালেও তাঁর বিশুদ্ধ বাঙালিত্ব যত্ন সহকারে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমি যতটা জ্ঞান আহরণ করতে সমর্থ হয়েছি, বাংলাভাষাতেও সরকার ছিলেন এক দক্ষ প্রাবন্ধিক। তাহলে, কেমন ছিল তাঁর বাঙালিয়ানা? ইংরেজির মতোই তাঁর বাংলা লেখাতেও কী ভিক্টোরিয়ান এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব ছিল নাকি তিনি যখন বাংলায় লিখতেন, সেই লেখনী ছিল সম্পূর্ণ পৃথক? উদাহরণস্বরূপ, নীরদ সি চৌধুরীর কথা উল্লেখ করা যায়, যিনি ছিলেন মনে প্রাণে এক ইংরেজপন্থী, তাঁর ইংরেজি লেখাকে সুখপাঠ্য করতে যেমন তিনি ল্যাটিন ভাষার উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন আবার তাঁর বাংলা লেখনীও ছিল অতি উচ্চ সাহিত্যিক মানের। বাংলা এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের জগতে তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। চক্রবর্তীর বই থেকে আমরা কিন্তু জানতে পারি না, সরকারের লেখনীতেও একই ধরনের গুণবত্তার প্রকাশ ছিল কী না। মনে এক খুঁতখুঁতুনি নিয়ে বইটা নামিয়ে রাখলাম আমি, মনে ভাবনা জাগল, সরকারের বুদ্ধিজীবী জীবনের এক ছোট অংশই ভাগ করে নিয়েছেন চক্রবর্তী, তাঁর পাঠকদের সঙ্গে। আরও একটি কাঁটা আমার গলায় খচখচ করতে থাকল, ওই ধরনের বুদ্ধিমত্তা এবং আত্মোন্নতির লক্ষ্যে যে জীবন যাপন করেছিলেন যদুনাথ বাবু, চক্রবর্তীর লেখায় সেই নির্দেশ পাওয়া যায় না কীভাবে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন সরকার তাঁর প্রথম লেখনী ও শেষ কর্মের মাঝে, বৃহৎ ছিল সেই কাল।

আমার মনে হলো চক্রবর্তী যদি আমাদের আরও কিছু তথ্য দিতে পারতেন সরকারের স্বাদেশিকতার সম্বন্ধে কারণ বইয়ে উল্লেখ আছে যে গান্ধিজীর গণ স্বাদেশিকতার নীতিতে অস্বচ্ছন্দ ছিলেন সরকার। যাই হোক, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই চক্রবর্তীকে তাঁর নিজস্ব পীড়াদায়ক এবং দুর্বোধ্য গদ্য ব্যবহার না করে, সহজ ভাষার ব্যবহার করেছেন বইটিতে, যে কারণে ‘দ্য কলিং অফ হিস্ট্রি’ এক সুখপাঠ্যে পরিণত হয়েছে।

বাংলা ভাষা-সম্পাদনা করেছেন ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য।