নিজের বাক্য সংযত করুন ধর্মাবতার!

0
721
মাদ্রাজ হাই কোর্ট
  • কোভিডের সময় আদালতগুলি মানুষকে সাহায্য করার জন্য এবং তাদের জীবন-জীবিকার চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন।

  • কিন্তু অন্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলির কর্তৃত্ব হ্রাস করার বিনিময়ে আদালতগুলি তা করতে পারেননি।

একটি সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ নিজের ঊর্ধ্বতন ক্ষমতার ব্যবহার করে অন্য আরেকটি কর্তৃপক্ষকে রূঢ় ও অসংযমী ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে অসম্মানিত করবে, এর থেকে বেশি অশ্লীল আর কিছু হয় না। পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন সময় কোভিড স্বাস্থ্যবিধি উল্লঙ্ঘনের জন্য কড়া পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে নির্বাচন কমিশনের দোষের একটি বড় অংশ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া উচিত, কিন্তু নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলিকে ও তার প্রার্থীদের কোভিড স্বাস্থ্যবিধি উল্লঙ্ঘন করার অনুমতি দেওয়ার জন্য তাদের খুনের জন্য দায়ী করা হতে পারে, এটি বলে অবশ্যই মাদ্রাজ উচ্চ আদালত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

বেঞ্চে ছিলেন বিচারক সঞ্জীব ব্যানার্জী ও সেন্থিল রমামূর্থি। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় দেখা গেছে, তাঁরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছেন : “আজ আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, তার জন্য একমাত্র দায়ী সংস্থা হল আপনাদের সংস্থা। আপনি এককভাবে আপনার কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন। ভাঙা রেকর্ডের মত আদালতের প্রতিটি আদেশে ‘কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন’ বলা সত্ত্বেও আপনারা রাজনৈতিক দলের শোভাযাত্রাগুলির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা করেননি। বেঞ্চ আরো বলেছিল যে নির্বাচন কমিশনকে সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানশূন্য সংস্থা হওয়ার জন্য খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত”।

বেঞ্চ হুমকি দিয়েছে যে যদি নির্বাচন কমিশন কোভিড স্বাস্থ্যবিধির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বহাল করার জন্য একটি যথার্থ পরিকল্পনা পেশ করতে না পারেন, তবে ২রা মে তারিখে ভোটগণনা পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

এটি নির্বাচন কমিশনের বৈধতাকে নপুংসক ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেওয়ার জন্য গৃহীত একটি নিকৃষ্টতম পদক্ষেপ- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই একইভাবে কমিশনকে কটাক্ষ করেছিলেন।

বেঞ্চের পর্যবেক্ষণের উপরিউক্ত ইটালিক করা শব্দগুলি ভাল করে দেখুন। খুন? সত্যি? সত্যিকারেই আদালতের দেরি করার কারণে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে এবং মানুষের দুর্দশা ঘটেছে? আর নির্বাচন কমিশনই কেবল এইসব ব্যর্থতার জন্য দায়ী? আর যে রাজনৈতিক দলগুলি ভোটাররা মাস্ক পরতে চান না, তাঁরা কি বেকসুর খালাস পাবেন? আর নির্বাচন কমিশন কি সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিষ্ঠান? যে আদালতগুলি একটি অন্যতম প্রধান সাংবিধানিক সংস্থার বিরুদ্ধে এমন অসংযমী মন্তব্য করেন, তাঁদেরও কি একই কথা বলা যায় না?

অনেকেই আশা করেন যে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় বেঞ্চকে এরূপ মন্তব্য করার জন্য প্রশ্ন করবে। নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচনের দুর্বল নীতি নির্ধারণের জন্য দোষী- এবং সম্পূর্ণভাবে দোষী, তা ভাবাও অন্যায্য কাজ। কিন্তু কীভাবে শক্তিশালী উকিলরা তাঁদের বিচারকদের রাজ্য আদালতগুলির ঘটনা বিবেচনা করতে বাধা দিচ্ছেন! এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের এই ঘটনার মধ্যে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি।

গত সপ্তাহে বয়োজ্যেষ্ঠ উকিল দুশ্যন্ত ডেভ, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের বিদায়ী মুখ্য বিচারক, এস এ বোবদেকে তাঁদের মধ্যে কারো জারি করা আদেশের ভিত্তিতে কোভিড সংক্রান্ত কেসগুলিকে রাজ্য উচ্চ ন্যায়ালয় থেকে এতে স্থানান্তরিত করতে চাওয়ার জন্য তিরস্কার করেছিলেন।

ডেভ নিন্দায় ফেটে পড়েন : “সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে আমি প্রশ্ন করতে চাই, আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিজিআই বোবদেকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি কী করেছেন? আমি টাটা ও সাইরাস মিস্ত্রির ব্যাপারটা অনেক মাস ধরে শুনে চলেছেন। কোভিড-১৯ এর সময় কি সেই কেসের শুনানি হওয়া প্রয়োজন ছিল এবং মিঃ (হরিশ) সালভে সঠিকভাবে বিতর্ক করে সফল হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে টাটার পক্ষে শুনানি দেওয়া হল? সেই ঘটনাটি বা আরো কিছু অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যেগুলির ক্ষেত্রে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আপনি তা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন? আপনি ৩৭০, সিএএ- নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাননি; হাজার হাজার নাগরিক যারা কারাগারে হতাশ হয়ে আছেন, তাঁদের জামিনের সিদ্ধান্ত আপনি নেন না। সরকারের কোভিড স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আপনি সিদ্ধান্ত নেন না। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন আপনি বিরাট কর্পোরেট জগতের মহারথীদের কথা শুনলেন এবং এখন আপনি বলছেন যে আপনি কিছু করতে চান (উচ্চ আদালতগুলি কোভিড কেসগুলি নিয়ে কী করছে সে সম্পর্কে)।

স্পষ্টত, কিছু শক্তিশালী উকিল বিচারব্যবস্থাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলবেন এবং হত্যা থেকে নিস্তার পাবেন, বোবদের অধীনে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে তাঁর ১৭ মাসের কর্মধারায় তাঁর বেশি কিছু দেখানোর নেই, এর সঙ্গে যদি কেউ সহমত হন, তবুও। কিন্তু ডেভ, বোবদের সময়কালে এই সকল অমীমাংসিত কেসগুলিতে এতটুকুও আগ্রহী নন।

তিনি অত্যন্ত ধূর্তভাবে উল্লেখ করেছেন যে যে কেসগুলিকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলে ভেবেছেন (সিএএ, ৩৭০ ধারা) এবং আরো বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলি যেমন- শবরীমালা ও প্রয়াত স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর সরকারি অধীনতা থেকে মন্দিরগুলিকে মুক্ত করার পিটিশনকে সহজেই বাদ দিয়েছিলেন।

শবরীমালার পুনর্বিবেচনার দাবিগুলি ২০১৮ সালের শেষদিকে এবং ২০১৯ সালের শুরুর দিকে করা হয়েছিল এবং মুক্ত মন্দিরের পিটিশন জমা দেওয়া হচ্ছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু ডেভের কাছে কেবল সিএএ ও ৩৭০ ধারা হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অপর প্রবীণ উকিল বিবেক তনখা কৃতজ্ঞতার সহিত ট্যুইটারে শীর্ষ আদালতকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে অক্সিজেনের ঘাটতি মোকাবিলায় মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন এবং বলেছিলেন, “রাজ্যের উচ্চ আদালতগুলিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। রাজ্যগুলি যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের নিয়ে কাজ করার মত সময় বা বিস্তারিত বিবরণ, কোনোটাই সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের কাছে নেই। রাজ্য উচ্চ আদালতগুলির উপর জনগণের আস্থা আছে…”।

তাই এই প্রবীণ উকিল সরাসরিভাবে উচ্চ আদালতকে নিজের চরকায় তেল ঢালতে বলতে পারেন এবং যখন তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হয়, তখন উচ্চ আদালতকে প্রশংসা করতেও পিছপা হন না।

এবং উচ্চ আদালতগুলি কোভিড নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কী কাজ করছে? এলাহাবাদ উচ্চ আদালত নিজে থেকে উত্তর প্রদেশের পাঁচটি শহরে লকডাউন জারি করেছে, এটি বিচারব্যবস্থার কাজ নয়। মহারাষ্ট্র, অর্থাৎ বোম্বাই উচ্চ আদালত বর্তমানের কোভিড সংক্রমণের উৎসস্থলকে নিয়ে কী করেছে?

রাজ্যের কারাগারগুলিতে কোভিডের ক্রমবর্ধমান মামলাগুলি সম্পর্কে একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই ঘটেছে। এটি রাজ্য, কেন্দ্র এবং বৃহন্মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশানকে কোভিড এর অব্যবস্থা সম্পর্কে জনস্বার্থ মামলায় ও রেমডিসিভিরের ঘাটতির ঘটনায় কোনো প্রশ্ন করতে বাধা দিচ্ছে, যখন মাদ্রাজ উচ্চ আদালত একে ‘খুন’ বলে অভিহিত করছেন! এবং তামিলনাড়ুর অন্ততপক্ষে এক মাস বা তার আগে মহারাষ্ট্রে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও এটি ঘটছে!

কোভিডের সময়ে আদালতগুলি অনেক মানুষের উন্নতিকল্পে এবং মানুষের জীবনের রুটি-রুজির চিন্তা দূরীকরণের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। কিন্তু অন্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলির কর্তৃত্ব হ্রাস করার বিনিময়ে আদালতগুলি তা করতে পারেননি।

এবং অবশ্যই! ধর্মাবতারদের নিজের ভাষা সংযত করা উচিত!

মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন আর জগন্নাথন। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।