মা, মাতৃভূমি ও ভারত মাতা: ভারতীয় জীবনধারায় একসূত্রে বাঁধা

0
4655

ডঃ সুজিৎ রায়

 

“অপি স্বর্ণমণি লঙ্কা ন মে লক্ষ্মণা রোচতে,

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী”

(স্বর্ণলঙ্কা জয়ের পর শ্রীরাম বললেন লক্ষ্মণকে।)

মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে মায়ের কোল থেকেই আমরা কথা বলা শিখি, হাঁটা শিখি, চলতে শিখি; আর আস্তে আস্তে গোষ্ঠী, বৃহত্তর সমাজ ও সংসারের জীবনধারার অংশ হয়ে উঠি। এই জীবনধারার মধ্যে দিয়ে আমাদের এক সাংস্কৃতিক চেতনা ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যার প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের জন্মদাত্রী, জন্মভূমি ও বিশ্বপ্রকৃতিকে বিশেষ ভাবে দেখি। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ভাষা, ভাবনা ও জীবনাচরণ বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে; যার প্রকাশ আমরা দেখি জন্মদাত্রী মা ও জন্মভূমির প্রতি ব্যক্তিমানুষ ও গোষ্ঠীমানুষের আবেগে-আচরণে।

ভূমি ও মাতা

এখানেই কিছু প্রশ্ন: আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মা এবং জন্মভূমিকে কি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি? এই ভারতভূমিকে কিভাবে দেখি? ভূমি ও মাতা সম্বন্ধে আমাদের অনুভব কি রকম?

প্রতিটি জাতির সংস্কৃতি ও জীবনধারাই অনন্য, যার মাধ্যমে সেই জাতি তথা গোষ্ঠীর মানুষরা এক বিশিষ্টতা পায় এবং তার জন্যই তারা জীবন-জগতকে এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিচার করে। ভারত ভূমিতে হাজার হাজার বছর ধরে যে জীবনধারা বয়ে চলেছে, তা এক অনন্য ভারতীয় ধার্মিক সাংস্কৃতিক জীবনধারা।

এই ধার্মিক সংস্কৃতিতে আমরা মাকে বলি সংস্কৃত ভাষাতে মাতা/মাতৃ, যা ইংলিশে মাদার। আমরা মাকে জননী/অম্বাও বলি। আবার দক্ষিণ ভারতে এই মা হচ্ছেন আম্মা। আমরা অপরিচিত বয়স্ক মহিলাকে ‘মাতাজী’ বলে সম্বোধন করি, যেখানে ‘-জী’ হচ্ছে সম্মানমূলক সম্বোধন। কারণ, এই ধার্মিক সংস্কৃতিতে স্ত্রী ছাড়া অন্য সব নারীই মাতৃসমা।

এই ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মই হচ্ছে ভারতীয় সমাজের ভিত্তিস্বরূপ, যার উপর ভিত্তি করেই প্রাচীন কাল থেকে সনাতন ধর্ম- হিন্দুইজম, জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও অন্যান্য উপজাতীয় ধর্মবিশ্বাস, আর মধ্যযুগ থেকে শিখ ধর্ম বহমান। ভারতীয় জীবনধারা তথা সংস্কৃতি এইসব ধার্মিক ধর্মবিশ্বাসের এক সমন্বিত রূপ। আবহমানকাল থেকেই এই জীবনধারার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাতৃত্বের স্বীকৃতি। এই ভারতভূমিতে উদ্ভূত সব ধর্মবিশ্বাসই মাতা ও মাতৃত্বকে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি, তাকে বন্দনা করেছে, দেবী হিসাবে পূজা করেছে এবং মাতা ও প্রকৃতিকে এক হিসাবে দেখেছে। একই ভাবে ভূমি-প্রকৃতিকে ‘ভূমি-দেবী’ হিসাবে পূজা করে এসেছে। সেই ভাবেই জন্মভূমিকে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুভব করেছে।

সনাতন হিন্দু ধার্মিক শাস্ত্র ও পরম্পরায় মহাবিশ্বের পাঁচটি প্রধান উপাদানের অর্থাৎ ‘পঞ্চভূতের’ অন্যতম হলো ‘ক্ষিতি’ অর্থাৎ ভূমি। এই ক্ষিতি/ভূমি হচ্ছেন নারী, তিনি ‘ভূমিদেবী’ হিসেবে প্রকৃতি বা পৃথিবী। এই ভূমিদেবী একজন হিন্দু দেবী, যাকে আরো অনেক নামে আমরা পেয়েছি। যেমন, পৃথ্বী, বসুন্ধরা, ভূদেবী, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই ভূমিদেবীর সন্তান। এই ভূমিদেবীকে আবার ‘ভারতী’ নামেও আমরা পূজা করছি।

পৃথিবীর সমস্ত ধরনের সম্পর্কের মধ্যে প্রধানতম সম্পর্কই হচ্ছে ‘মা-সন্তান সম্পর্ক’, যা ভারতীয় জীবনধারায় এক অনন্য রূপ পেয়েছে। যেহেতু ধার্মিক বিশ্বাসধারায় ভূমি তথা প্রকৃতিকে দেবী-মা হিসাবে পূজা করা হয়, তাই জন্মভূমিও ভারতীয়দের কাছে পূজার্হ- ভারতভূমিই ‘ভারতী’।

 

মাতা ভারতী

ভারতীয় সমাজে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে জন্মদাত্রী মার স্থান অদ্বিতীয়। ভারতভূমির সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান ধারা হচ্ছে শাক্তধারা, যা প্রাচীন কাল থেকেই বহমান; যেখানে ‘শক্তি’ই মূল ধর্মতত্ত্ব। এই শক্তিকে পরমা নারীপ্রকৃতি সৃজনীশক্তি হিসাবে দেখা হয়েছে, যাকে হিন্দু ধারায় ‘পরমা মাতৃশক্তি’ বলা হয়েছে। এই পরমাপ্রকৃতি মাতৃশক্তিই বিশ্বের সবকিছুর সৃজন ও পরিবর্তনের কারণস্বরূপ, যাকে তন্ত্রশাস্ত্র ধারায় ‘কুন্ডলিনী শক্তি’ রূপে আরাধনা করা হয়েছে।

দক্ষিণ ভারতে এই শক্তিদেবী হলেন ‘আম্মা’, যিনি গ্রামের তথা গ্রামবাসীর রক্ষাকর্তী। দেবী হিসাবে মাতৃপূজা হরপ্পা সভ্যতা থেকেই এই ভারতীয় উপমহাদেশের পরম্পরা। এই পরম্পরাই পরবর্তীতে বৈদিক কাল হয়ে ক্লাসিকাল, পুরাণ যুগ, ধার্মিক কাল পেরিয়ে আধুনিক কালেও বহমান। সেই ধারায় প্রকৃতি-মা ভারতী আর জন্মদাত্রী-মা দেবী হিসাবে একাকার হয়ে গিয়েছেন।

 

ভারত মাতা

এখানেই কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: ভারতে ভূমির বা প্রকৃতির এই ব্যক্তিকরণ বা পারসনিফিকেশন কি নতুন? আবহমানকালের ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে জন্মভূমিকে মাতৃরূপে দেখা কি অভিনব? ভারতবর্ষের ধার্মিক জীবনধারায় জন্মভূমিকে পূজা করা কি একেবারেই অর্বাচীন, না কি তা ধার্মিক পরম্পরায় ঋদ্ধ?

মানব সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে বস্তু তথা ভাব-ভাবনাকে ব্যক্তিকরণ করা অতি প্রাচীন। আমরা যেমন অনুভব করি, তেমনিই তা ব্যক্তিরূপে প্রকাশ করতে চেষ্টা করি। প্রতিটি গোষ্ঠী তথা ব্যক্তিমানুষ গোষ্ঠীগত জীবনধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বস্তু তথা ভাবনাকে ব্যক্তিগত রূপে প্রকাশ করে। ভারতীয় জীবনধারাও তার ব্যতিক্রম নয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে ‘ধর্ম’ যেমন ‘রিলিজন’ থেকে অধিক ব্যঞ্জনাময়; ‘পুরাণ’ ঠিক তেমনই ‘হিস্ট্রি’ থেকে বেশি অর্থবহ। তাই ইউরোপীয় মানসিকতায় পুষ্ট ঐতিহাসিকরা ভারতীয় বিভিন্ন পুরাণে যে ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটি পেয়েছেন, তার ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট বিচলিত বোধ করেন। কারণ, তারা ব্যাখ্যা করতে পারেন না, কিভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এই ধার্মিক জীবনধারা এই উপমহাদেশে বয়ে চলেছে। ঐতিহাসিক ভাবে সাধারণ পূর্বাব্দ প্রথম শতকে উড়িষ্যা সম্রাট খারবেলের শিলালিপিতে আমরা ভারতবর্ষ শব্দটির উল্লেখ পাই। আবার, বিভিন্ন পুরাণ এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে এই ভারতীয় ভূখণ্ডকে ‘জম্মুদ্বীপ’ বলা হয়েছে, তা এই পৃথ্বী বা ভূমির নয়টি খন্ডের মধ্যে প্রধান কেন্দ্র রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এই জম্মুদ্বীপ পবিত্র দেবভূমি তথা জন্মভূমি হিসাবে শাস্ত্রে পরিগণিত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটেই বলা যায়, কিছু ইতিহাসবিদ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন যে ‘ভারতমাতা’ উনবিংশ শতাব্দীর এক ‘নির্মাণ’। কিন্তু, তা ধার্মিক পরম্পরায় ঠিক ব্যাখ্যা নয়। তারা চেষ্টা করেন, ভারতভূমিকে মাতা হিসাবে গণ্য করা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক নির্মাণ’ হিসাবে ব্যাখ্যা করার, যা শুরু হয়েছিল ১৮৬৬ সালে এক অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘উনবিংশপুরাণ’ দিয়ে যা আসলে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের লিখিত, পরে ১৮৭৩ সালে কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত মাতা’ নাটকে এবং ১৮৮০ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। বিংশ শতাব্দীর ১৯৩৬ সালে বারাণসীতে শিবপ্রসাদ গুপ্ত ভারতের রিলিফ ম্যাপ দিয়ে ভারত মাতা মন্দির নির্মাণ করেন, যার উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এইসব বিদ্বজ্জন উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন, এই ভারতবর্ষের বহমান জীবনধারায় ধার্মিক শাস্ত্রগুলির এক সূক্ষ্ম অথচ অমোঘ প্রভাব যেখানে বিভিন্ন পুরাণে ভারতবর্ষকে ভূমিমাতা রূপে দেখা হয়েছে। একই ধরনের আখ্যান আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন পুরাণে যেখানে ভূমিদেবী ‘কামধেনু/সুরভী’ হিসাবে অত্যাচারী অসুরদের হাত থেকে তার সন্তানদের রক্ষা করতে আকুল প্রার্থনা করছেন।

তাই ভূমি ও মাতা হিসাবে ভারতের প্রাচীনতা ঊনবিংশ শতাব্দীর নির্মাণ নয়, বরং তা ধার্মিক জীবনধারার এক অন্যতম প্রথাগত পরিণাম তথা পরিচয়। সেই ধারাতেই ‘বঙ্গভঙ্গ’ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্বদেশী আদর্শে ১৯০৫ সালে চিত্রিত হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’। আবার সেই ধারাতেই ১৯০৯ সালে তামিল পত্রিকা ‘বিজয়া’তে ভারতীয় জনগণের কন্ঠে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিসহ ভারতমাতা চিত্রিত হয়েছেন; ভারতমাতা যেন সন্তানদের কাছে তার শৃঙ্খল-মোচনের জন্য আহ্বান করছেন।

তাই ভারতবর্ষে ভারতভূমিকে ভারতমাতা রূপে জাতীয়তার প্রতীক হিসাবে আরাধনা করা সেই ভূমিদেবীকে পূজা করারই এক পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা। তবে আধুনিক কালে ব্রিটিশ শাসনে ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণের ব্যবস্থা জাতীয়তাবাদীদের আবেগ ও কল্পনাকে প্রভাবিত করেছিল। তাই বৈপ্লবিক চিন্তাধারার উদগাতা হিসাবে পরিচিত ‘লাল-বাল-পাল’ ত্রয়ীর অন্যতম বিপিনচন্দ্র পাল ‘পূর্ণ স্বরাজের’ জন্য হিন্দু ধার্মিক দর্শন ও পূজাচারের নিয়মে ভারতমাতার শৃঙ্খল-মোচনের জন্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই আহ্বান ছিল মায়ের প্রতি সন্তানদের ‘পরম কর্তব্য’ পালন।

 

দেবভূমির প্রতি কর্তব্য

যেহেতু ভারতভূমি আমাদের জন্মভূমি তথা পূণ্যভূমি এবং ধার্মিক ধারায় এই ভূমিদেবীকে মাতৃশক্তি রূপে আমরা পূজা করি; তাই ভারতমাতার দেবত্বকে স্বীকার করে তার মহিমাকে তুলে ধরা প্রত্যেক ভারতীয়র পরম কর্তব্য। সেই কর্তব্য-বোধেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতোই ভারতমাতাকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনী ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনি দিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পৃথিবীর অনেক জাতিরাষ্ট্রই নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য ‘গডের’ মাহাত্ম্য তুলে ধরে। কিন্তু, ভারতীয়রা জন্মভূমিকে নিজের মায়ের মতোই, যে মা প্রকৃতি-মাতার মতো ধারণ-পালন করে, মাতৃভূমিকে পূজা করে। তাই, ‘ধর্মবিশ্বাস’ আমাদের যাই থাক, প্রত্যেক ভারতীয় ‘ধার্মিক হয়ে’ মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে শ্রীরামচন্দ্রের মতোই, যিনি স্বর্ণলঙ্কা জয়ের পরেও লঙ্কার বৈভবের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করেননি; যার কাছে জন্মদাত্রী মা ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও বেশি আদরণীয়। সেই ভাবেই জন্মভূমি হিসাবে ভারত মাতা ভারতীয়দের কাছে পরম আদরণীয়; ভারত মাতা ভারতরাষ্ট্রের প্রতিভূ।