রাষ্ট্রভাষা সংস্কৃত ও পন্ডিত লক্ষীকান্ত মৈত্র

অনুবাদক – সদানন্দ

[ভারতের প্রস্তাবিত শিক্ষা নীতিতে হিন্দি ভাষাকে অহিন্দিভাষী রাজ্যে তৃতীয় ভাষারূপে রাখার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্য়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ইতিমধ্য়েই জানিয়েছে যে এই প্রস্তাবটি কখনই চাপিয়ে দেওয়া হবে না। নাগরিকদের এবং রাজ্য়ের মতামত গ্রহণ করেই এগুনো হবে। কিন্তু এই প্রস্তাবের মূল কোথায়? এর মূল নিহিত আছে সংবিধানে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার মধ্য়ে। যদিও ডঃ আম্বেদকর ব্য়ক্তিগত ভাবে চেয়েছিলেন সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করতে, কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব হিন্দির কাছে মাত্র একটি ভোটে হেরে যায়। সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তৎকালীন কংগ্রেসের পন্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের ভাষণের বঙ্গানুবাদ নীচে ঐতিহাসিক কারণে প্রদত্ত হল।]

সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংবিধান সভায় পন্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের প্রস্তাব – সেপ্টেম্বর ১৩, ১৯৪৯

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। সত্যিই অবাক লাগছে দেখে যে, আপনি এভাবে এত ভাল মানের বক্তৃতা দিতে এসেছেন দেখে। মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি এই জন্য যে, যেদিন আপনি ভাষণ দিয়েছিলেন, সেদিন অনিবার্য কারণবশত আমি এখানে উপস্থিত থাকতে পারি নি। অথচ সেখানে আমার উপস্থিত থাকার কথা ছিল আমারই সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করাবার জন্য, কিন্তু আসতে পারিনি। ভারত সরকারের তরফে আয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে আমি অনেক দিনের জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম, এই দিনের জন্য; যেখানে আমি আমার বক্তব্য রাখতে পারব। দুর্ভাগ্যবশত সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

স্যার আমি স্বীকার করছি যে, আমি এমন একটি সংশোধনী প্রস্তাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক; যার বিস্তারিত বিবরণ শুনলে পার্লামেন্টের সদস্য এবং ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত বিস্মিত হবেন। যদি এটা সবার কাছে পৌঁছে থাকে, সেক্ষেত্রে দেশের মানুষের মধ্যে দুই রকমের অনুভূতি হবে। আমি ইতোমধ্যে যে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতেই বুঝেছি যে, অনেকের মনে হয়েছে আমি ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছি। আবার অনেকের মনে হয়েছে যে, আমি নাকি ভারতকে কয়েক শতাব্দী পেছনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি : সংস্কৃত ভাষাকে ভারতের সরকারী ও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রস্তাব দিয়ে। এবার আমাকে বলতে দেওয়া হোক — ঠিক কি কারণে আমি এমন প্রস্তাবে পক্ষে কথা বলছি, কেনই বা সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা কোর্টে চাইছি। একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন : যদি কোনও ভারতীয় ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে, সে নিঃসন্দেহে সংস্কৃত।

আমি তাদের মনে বেদনা দিতে চাইছি না, যারা অন্ধের মত বিশ্বাস করেন যে, হিন্দিই ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। আমি তাদের সাথে তর্কে যেতে আগ্রহী নই। কিন্তু তাই বলে তাদের হিন্দিই রাষ্ট্রভাষা এমন তৃপ্তিতে যেমন ভাসতে দেব না, তেমনই তাদের একতরফা তর্কে জিততেও দেব না। মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি আবার শুরু করছি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। আমি আমার বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রাখছি যে, সংস্কৃত ভাষাকে ভারতের জাতীয় ও সরকারী ভাষা রূপে স্বীকৃতির জন্য আনা আমার সংশোধনী প্রস্তাবকে পাশ করিয়ে দিন। আমার আশঙ্কা আছে যে, আমার সংশোধনী প্রস্তাব নিশ্চিতভাবে দুই সভার মধ্যে কোনও একটিতে আটকে যেতে পারে; যেটা আমি চাইব না। লোকসভা হোক বা রাজ্যসভা — আমি জানি যে, কোথাও না কোথাও আমার বিরোধিতাও আসবেই। কিন্তু আমি আশা রাখি যে, হিন্দির পাশাপাশি সংস্কৃতও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবেন এমন একটা ফর্মুলায় আসতে আইনসভার দুই কক্ষের সদস্যরা রাজি থাকবেন। যদিও আমি মনে মনে অনুভব করতে পারছি যে, সংস্কৃত ভাষাকে এইভাবে ‘প্রোমোট’ করাটা হয়ত দুই কক্ষের সদস্যদের একাংশের পছন্দ হচ্ছে না। আমার ব্যক্তিগত মত হল, আমি এমন কিছু চাইব না যাতে পুরো সমঝোতা মাঝপথে ভেস্তে যাক। কিন্তু সবকিছু যে আমার মনের মত হবে; তা নাও হতে পারে।

গণপরিষদের পক্ষে আজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন। এখানে স্থির হবে যে, সংস্কৃত ভাষা আদৌ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে কি না। আমি গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যে কিরকম উত্তেজনা হচ্ছে, সেটা এতদূরে বসেও বুঝতে পারছি। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি দেখে যে, গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্য হিন্দির স্বপক্ষে প্রস্তাব দিয়েছেন; তাদের মতে হিন্দি লেখা হবে দেবনাগরী হরফে এবং অক্ষর লেখা হবে আন্তর্জাতিক অর্থাৎ রোম্যান হরফে। এই প্রস্তাব আমার সম্মানীয় বন্ধু গোপালাস্বামী আয়েঙ্গার লিখিত ভাবে খসড়ার আকারে মুসাবিদা সমিতিতে পেশ করেছেন। যারা ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে শুধু হিন্দিকে দেখতে চান, তারা এতক্ষণে সম্ভাব্য পরাজয়ের গন্ধ পাচ্ছেন; ফলে তাদের মধ্যে অধৈর্যের ভাব ফুটে উঠছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই বিষয়ে (শুধুমাত্র হিন্দিই হোক ভারতের রাষ্ট্রভাষা) তাদের যুক্তির মধ্যে তিক্ততা ও অর্থহীন প্রলাপের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। আমি এখানে এসেছি, আমার বক্তব্য জানাতে, সেইজন্য কোনও হঠকারিতা করতে চাই না। আমি শুধু সংসদকে জানাতে চাই যে — আমি হিন্দি বা অন্য কোনও ভাষার বদলে সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চাইছি না, আমি সংস্কৃতকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে দেখতে চাই। আমি এই কথা আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু গোপালাস্বামী আয়েঙ্গারকে জানিয়েছি, যিনি ভাষাসংক্রান্ত বিষয়ে খসড়া নির্মাণে ব্যস্ত আছেন।
সে যাই হোক, আমি এটাই বলতে চাই যে, আমি আমার সংশোধনীতে অন্যান্য ভাষার সাথে সংস্কৃতকেও রেখেছি। তখন আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, আমি ছাড়া আর কেউই ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে সংস্কৃতের কথা ভাবেন নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের কতখানি অধঃপতন হয়েছে। আমি সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা রূপে বরণ করার জন্য আপনাদের ওপর চাপ দিচ্ছি না। এখানে প্রশ্ন একটাই — ভারতের মধ্যে এমন কে আছে যে, অস্বীকার করতে পারে সংস্কৃতই ভারতের প্রাণের ভাষা? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি যে, তর্কের সময়ে দাবি উঠছে সংস্কৃত নাকি শুধু ভারতীয় ভাষাই নয়; আন্তর্জাতিক ভাষাও বটে। গুরুত্বের কথা বিবেচনা করলে নিঃসন্দেহে সংস্কৃত একটা আন্তর্জাতিক ভাষা। কেননা শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরে এশিয়ার মধ্যে বহু দেশের ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে পড়েছে। সংস্কৃতকে অনায়াসে ভারতের সংস্কৃতির আত্মা বলা চলে। সংসদের মধ্যে এমন কু আছেন নাকি, যে এই কথাকে অস্বীকার করতে পারবেন? ভারত কি বিশ্বের কাছে তার ভৌগলিক আয়তনের জন্য কিংবা ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার জন্য সম্মান পায়? যেসব বিদেশীরা ভারতে এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই বলেছেন যে; ভারতের বুকে অসংখ্য ভাষা ও সংস্কৃতি দেখেছেন এবং ভারতের ঐক্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাহীন হয়ে পড়েছেন। তারপরেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংস্কৃত ভাষার মধ্যেই ভারতের ঐক্য নিহিত আছে।

স্যর, মনে রাখতে হবে সংস্কৃত নিঃসংশয়ে বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচাইতে অভিজাত ও সম্মানীয় ভাষা রূপে বিশ্বে পরিচিত। চাইলে আমি এখানে এমন অনেক প্রাচ্যবাদী (orientalist) পণ্ডিতের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যারা সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে মতামত রেখেছেন। আমি এদের কয়েকজনের নামোল্লেখ করছি — ম্যাক্সমুয়েলার (Maxmuller), কেইথ (Keith), টেলর (Taylor), স্যর উইলিয়াম হান্টার (Sir William Hunter), স্যার উইলিয়াম গোলেবুক (Sir William Golebuk), সেলেইগম্যান (Seleigman), আর্থার শোপেনহাউয়ের (Arthur Schopenhauer), গথের (Goether), এছাড়া আরও অনেকের নামই করলাম না, যার মধ্যে ম্যাকডোনেল (Macdonell) এবং ডুবৈস (Dubois) রয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই সংস্কৃত ভাষাকে অত্যন্ত উচ্চাসনে বসিয়েছেন। তারা আমাদের খুশি করার জন্য নিশ্চয়ই এমন কথা বলেন নি। কেননা আমরা ঐ সময়ে বিদেশী শক্তির কাছে পদানত ছিলাম, ফলে আমাদের উচ্চ চক্ষে দেখবার কোনও কারণে ছিল না। ভুললে চলবে না, মিস মেয়ো যিনি ‘মাদার ইন্ডিয়া’ স্লোগান তৈরি করেছিলেন, তিনিই গান্ধীর কাছে ‘নর্দমা পরীক্ষকের প্রতিবেদনের’ বেশি কিছু না বলে অপমানিত হয়েছিলেন। ভারতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ও কয়েকটি পশ্চিমি দেশ মিথ্যা প্রোপ্যাগান্ডা চালিয়ে গেছে, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয় নি। প্রাচ্যবাদী পণ্ডিতদের জন্য, যারা সারা জীবন ধরে সংস্কৃত ভাষার চর্চা করেছেন সংস্কৃত সাহিত্যের মাধ্যমে ভারতকে চিনতে চেয়েছেন। তারাই বিনা সঙ্কোচে, বিনা দ্বিধার সাথে এই সত্য স্বীকার করেছেন : সংস্কৃত হচ্ছে “বিশ্বের প্রাচীনতম এবং ঐশ্বর্যশালী ভাষা”, “বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম ভাষা” এবং “বিশ্বের প্রায় সব ভাষার জননী” ইত্যাদি।

এখন যদি ভারত কয়েক হাজার বছর বাদে নিজের ভাগ্যকে গড়ার সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতেই চায়, আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে চাই যে : ভারত কেনই বা সংস্কৃতকে স্বীকৃতি দিতে লজ্জা পাবে, যা ইতোমধ্যে বিশ্বের সব ভাষার জননী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে; সংস্কৃতের জীবনীশক্তি বলুন বা ওজস্বিতা বলুন অদ্যাবধি পুরোদমে রয়েছে। এটাই সেই প্রশ্ন, যার সঠিক উত্তর আমি চাইছি। আমি জানি আপনারা বলবেন, সংস্কৃত এই মুহূর্তে একটি মৃত ভাষা। হ্যাঁ। কিন্তু কার কাছে মৃত? মৃত আপনাদের কাছে, কেননা আপনারাও এক প্রকার মৃতই, কেননা আপনাদের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে, নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতাও আপনাদের নেই। আপনারা অন্যের ছায়ার পেছনে দৌড়তে এমন ব্যস্ত, যে নিজেদের সাহিত্যে কি ধনঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে; খুঁজে বের করতেও পারছেন না। যদি সংস্কৃত মৃত ভাষাই হয়, তবে প্রশ্ন হল : সে কি সমাধিতে শায়িত অবস্থাতেই আমাদের রাজত্ব করে চলেছে? ভারতে কোনও ভাষাই সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত নয়। এমনকি যে হিন্দিকে আপনারা রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন সেটাও সংস্কৃতের দুহিতা বলা চলে। আপনারা একটা ভাষা খুঁজে বের করে দেখান তো, যার শব্দভাণ্ডারে কোনও সংস্কৃত শব্দ নেই? পারবেন না। এইভাবে আপনি অপ্রত্যক্ষ ভাবে সংস্কৃত ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রোমোট করছেন। কেননা সংস্কৃতের সাহায্য ছাড়া আপনি অসহায় এবং দুর্বল!

কিন্তু আমি একটা কথা নির্ভয়ে বলতে পারি সংস্কৃত আদৌ মৃত ভাষা নয়। আমি যেখান যেখানে যাই, সেখানে যখন আমি দেখি সেখানকার ভাষা বুঝতে পারছি না বা বলতে পারছি না। তখন আমি সংস্কৃতেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করি এবং দেখি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হই। দুই দশক আগে, আমি যখন আমি মাদ্রাস প্রদেশে ছিলাম; তখন মাদুরৈ, রামেশ্বরম, তিরুপতির মত বড় বড় মন্দিরে ভ্রমণ করার সময়ে — যখন দেখতাম ইংরেজি বা অন্য কোনও ভাষায় যোগাযোগ করতে পারছি না, আমি তখন সংস্কৃত ভাষাতেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করতাম এবং লক্ষ্য করেছিলাম সাধারণ মানুষ ঠিকই সংস্কৃত বুঝতে পারছে এবং পালটা জবাবও দিচ্ছে। আমি মাদ্রাস ঘুরে এটুকু বুঝেছি যে, সেখানে সংস্কৃত ভাষার চর্চা আছে এবং ভালভাবেই আছে। এছাড়া দক্ষিণ ভারতের মধ্যে চারটে প্রধান ভাষা — তেলুগু, তামিল, মালয়ালম এবং কন্নড় থাকলেও কোনও সংযোগকারী ভাষা নেই, যেম্ন উত্তর ভারতে হিন্দি বা উর্দু রয়েছে। ফলে সংস্কৃত সেখানে খুব ভালভাবে সংযোগকারীর ভূমিকা পালন করে।

আমাদের ধারণা সংস্কৃত অত্যন্ত নীরস, কাঠখোট্টা ভাষা। আমাদের ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সংস্কৃত অত্যন্ত বড়, আড়ম্বরপূর্ণ বাক্য, কয়েক ফুট লম্বা শব্দবন্ধনী দিয়ে বোধহয় তৈরি। আমাদের এই ধারণা তৈরি হয়েছে বাণের কাদম্বরী বা হর্ষচরিত বা দশকুমার চরিত্রম পড়ে। কিন্তু আমি এখানে একটি সংস্কৃত কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি, যা অত্যন্ত বিখ্যাত একজন কবির লেখা।

সাহিত্য সুকুমারবস্তুনি
ধীর-নব-গ্রহ-গ্রন্থিলা
তর্ক বা ময়ূর সংবিধাতরি
সমাঁ লীলায়ত ভারতী।

আপনাদের কি ধারণা আমি চাইলে সরল সংস্কৃতে একটি সহজ সরল বাক্য বা কবিতা রচনা করতে পারব না? সংস্কৃত হচ্ছে এমন একটা ভাষা, যে ভাষায় কবিতা অত্যন্ত সুন্দর মোলায়েম শব্দবন্ধনী দিয়ে গড়া চলে, আবার যখন দর্শন বা কোনও অ্যাকাডেমিক বিষয়ে আলোচনা চলবে, সংস্কৃত সেভাবেই বদলে যাবে। সংস্কৃত এমন একটি ভাষা, প্রকৃতি অনুসারে নিজেকে বদলাতে সক্ষম। সে কবিতা থেকে বিজ্ঞান, দর্শন বা রাজনীতি; যাই হোক না বাহন হিসাবে সংস্কৃত অসাধারণ। আমি জানি এখানে যারা সংস্কৃত জানেন, তারা আমার প্রত্যেকটা শব্দের সাথে একমত হবেন। [একজন সম্মানীয় সাংসদ : আপনি এখানে দয়া করে সংস্কৃতে ভাষণ দিতে পারবেন, যা বুঝতে কারুর অসুবিধা হবে না?] আমি এখানে আমার সংস্কৃত জ্ঞানের প্রদর্শন করাতে আসি নি। আমি এখানে আমার বন্ধুদের মত ভাষাগত ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে আসি নি — তারা অন্যদের অনুরোধ মেনে অভ্যাস আনা থাকা সত্ত্বেও এখানে ইংরেজিতে ভাষণ দিতে গেছে যাতে অন্যরা বুঝতে পারে। আমি এখানে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে আসিনি। আমি এখানে প্রত্যেক সম্মানীয় সদস্য বুঝতে পারেন আমি কি বলতে চাই, সে চেষ্টাই আমি করছি। এখানে যদি আমি সুবোধ্য সংস্কৃত বলি, তার জন্য কোনও বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করব না। আমি এখানে সংস্কৃত বলতে গিয়ে যদি ব্যর্থ হই, তবে আমি বুঝব যে আমি নিজের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। আপনারা আমাকে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের মত ব্যবহার করবেন না, এটুকু অনুরোধ জানালাম। আমি এই মুহূর্তে সংস্কৃতে ভাষণ রাখতে যাচ্ছি, আশা করি কোনও সাংসদ আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে আসবেন না। আমি এখানে একটা প্রশ্ন রাখছি, প্রত্যেক প্রদেশ থেকে আসা সাংসদদের প্রতি — “আপনারা কি নিজের প্রপিতামহীকে অস্বীকার করেন”।

স্যর, আমরা এদেশের ভাষাগত বৈচিত্র্যের উপস্থিতির জন্য গর্ববোধ করি — বাংলা, গুজরাতি, মারাঠি, হিন্দি, তামিল, মালয়ালম, তেলুগু, কন্নড় ও অন্যান্য। এই গণপরিষদ ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতীক হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করছে। এই ভাষাগুলো শুধুমাত্র প্রদেশের সম্পত্তি নহে। ভাষাগুলো নিঃসন্দেহে জাতীয় সম্পত্তি বলা চলে। কিন্তু যে কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তা হল — সব ভাষাই সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত হয়েছে। এমনকি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রেও সংস্কৃত ভাষাকে জননী ভাষার সম্মান দেওয়া চলে। ভুললে চলবে না চারটে প্রধান দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাতেই শব্দভাণ্ডারে প্রায় অর্ধেক শব্দই সংস্কৃত নয় সংস্কৃত থেকে কিছু পরিবর্তিত রূপে এসেছে। অতএব, আমি বলতে পারি যে, আমরা সবাই এক হয়ে কাজ করলে, আমরা সহজ সরল, বলিষ্ঠ, নিরলঙ্কার, সুমিষ্ট সংস্কৃত ভাষার জন্ম দিতে পারি; যা সবাই সমস্বরে বলতে পারবে।

আমি বলতে চাইছি না যে, এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা প্রত্যেকেই নির্ভুল সংস্কৃত বলতে পারবেন। সেই জন্যই আমি এই সংশোধনী আনছি না। আমার এই সংশোধনী অনুসারে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ইংরেজিই লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসাবে থাকুক, সাথে সংস্কৃতও চলুক। কেননা ইংরেজি যত সহজে বর্তমান ভারতের মানুষ বোঝেন, ততটা অন্য কোনও ভাষা বোঝেন না। তাই ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষাও রাষ্ট্রভাষা রূপে থাকবে। ১৫ বছরের পর আশা করি সংস্কৃত স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজির জায়গা নেবে। এটাই আমি সংশোধনী প্রস্তাবে বলতে চাইছি। এবার আমি বলতে চাই যে, ভারতের প্রত্যেক স্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংস্কৃত ভাষা বাধ্যতামূলক ভাবে শেখানো হোক। আমার মত মানুষ, যারা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার পর্যায়ে ব্যবহার করতে চেয়েছেন বিভিন্ন প্রদেশে, তারা লক্ষ্য করেছেন বাংলা বা ওড়িশার মত রাজ্যে কোনও ভাল হিন্দি জানা শিক্ষক নেই বললেই চলে। এরফলে হিন্দি শেখানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আপনারাও জানেন এটা একটা বড় সমস্যা। এরপরেও যদি আপনি লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে হিন্দি শেখাতে চান, তবে কি পরিমাণ খরচ হবে কোনও ধারণা আছে? কত সংখ্যক সাহিত্য লাগেব, প্রিন্টিং প্রেস লাগবে, বই লাগবে, পাঠ্যপুস্তক লাগবে, প্রাথমিক শিক্ষক লাগবে, এছাড়া অনেক কিছুই লাগবে। তারপরেও অনেক বাধা আছে। এছাড়া হিন্দির মত তুলনামূলক নবীন ভাষাকে অহিন্দিভাষী রাজ্যের লোকেরা কতটা সহজে গ্রহণ করবেন, সে নিয়েও প্রশ্ন আছে। এতগুলো সমস্যা সহজে মিটবে বলে আমার মনে হয় না। তার ওপর একজন হিন্দিভাষীকে অন্যান্য রাজ্যে শিক্ষক রূপে নিয়োগ করলে জাতিগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে, সবচেয়ে বড় কথা — হিন্দিভাষী অঞ্চলে তেমন ভাল পণ্ডিত নেই, যারা হিন্দি ভালভাবে সেখাবার জন্য বই লিখতে পারবেন। আবার অন্যদিকে আপনারা যদি সংস্কৃত ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেন, সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না; কেননা ভারতের প্রায় সব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই সংস্কৃতের চর্চা আছে। সেখানে নির্দিষ্ট মানদণ্ডের বই ও শিক্ষকের যোগানও আছে। ঠিক এই কারণে সংস্কৃত শেখানোতে বিশেষ সমস্যা হয় না। [শ্রী বি.এন. মুনাবল্লি (বোম্বে রাজ্য) : সংস্কৃতের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা উদ্ভুত হবে]। আমি বুঝতে পারছি যে, মুনাবল্লির বয়সের জন্যই এই সমস্যা হচ্ছে। আমি আশা করি এই কথাটা বললে তিনি আহত হবে না —“আমি বলছি, তার বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে নতুন ভাষা শেখাটা সত্যিই বড় সমস্যা। কিন্তু মিস্টার মুনাবল্লি যদি মনে করেন তিনি সংস্কৃতের চেয়ে হিন্দি আরও সহজে শিখতে পারবেন, সেক্ষেত্রে আমি কোনও তর্কে যাব না। তাকে তার মত চলতে দিন”।

আমি যা বলছিলাম, এখানে শুধুমাত্র ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করে রাখার পক্ষে যারা, তাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা ঈর্ষার ভাব লক্ষ্য করছি। তাদের এমন হাবভাবের কারণ কি, জানা নেই। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করতে পারছি। অনেকের মনোভাব হচ্ছে এরকম —“এতগুলো ভাষার মধ্যে কেনই বা শুধু হিন্দিকেই বা রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছে? হিন্দি তো একটা ছোট প্রদেশের ভাষার বেশি কিছুই নয়!”। ঠিকই, হিন্দু যে সামান্য প্রাদেশিক ভাষা সেটা কেউই অস্বীকার করবে না। আপনারা একটি প্রাদেশিক ভাষাকে গায়ের জোরে রাষ্ট্রভাষা বানাবার মত গুরুতর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন? বাংলা, তামিল, গুজরাতি, মালয়ালম, কন্নড়ের মত ভাষাকে কে অস্বীকার করতে পারবে; যা অতি উন্নত সাহিত্যের জন্য ইতোমধ্যে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ এবং আমরা গর্বিত বোধ করি।

কিন্তু কোনও অহিন্দিভাষী রাজ্যের সাংসদ তাদের রাজ্যের ভাষাকে প্রোমোট করছে না রাষ্ট্রভাষার জন্য। আপনারা কি চাইলেও তাদের এই আত্মত্যাগকে অস্বীকার করতে পারবেন? আমি কোনও বাঙালি সাংসদকে এখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার জন্য আবেদন করতে দেখিনি। আমি নিজেও দাবি তুলি নি, অথচ আমি অনুভব করি যে আমি অত্যন্ত উন্ন ও ধনঐশ্বর্যে ভরতি একটা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহার করি। এই ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতেন এবং একে আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মানিত ভাষায় পরিণত করেছেন। কিন্তু দেশের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের মনে হয়েছে যে ভাষাকে উন্নত করে রাষ্ট্রভাষার স্তরে আনা দরকার সে হল হিন্দি। কিন্তু তার জন্য সবার সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক।

এখন যেটা প্রশ্ন উঠতে পারে তা হল আমরা এখনও একটা অনির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছি কেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে একে দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাজনক ব্যাপার বলে মনে করি। আমার কয়েকজন বন্ধু সমালোচনার ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন —“একটা আস্ত উট গিলে ফেলার পর একটা সামান্য ডাঁশ নিয়ে চিন্তা করছ কেন?”। তারা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কেন আমি দেবনাগরী হরফে হিন্দি লেখার ব্যাপারে একমত হলেও কেন দেবনাগরী হরফে সংখ্যা লেখার ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছি? এখানে আপনারা বলতেই পারেন, ভারতের স্বাধীনতা পেয়েই বা কি লাভ হল, যদি সবকিছু তার নিজস্ব না হয়? হিন্দিতে কি সবকিছুই আছে? কেউ কি এ নিয়ে সত্যিই ভালভাবে চন্তা করেছেন? যদি করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই কারুর মধ্যে রসবোধের এত অভাব কেন যে; তারা অন্য ভাষাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না? স্যর, প্রশ্নটা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ একবার বলেছিলেন, “আমরা অহিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দি চাপাব না”। মনে রাখতে ভারতের সবচেয়ে বড় হিন্দিভাষী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে এই ভাষ্য এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমি সেই প্রদেশের বাসিন্দা নই। আর সেটাই হয়েছে সমস্যার মূল। বিতর্কটা শুরু হয়েছে হিন্দি ও উর্দু ভাষা একই, কিন্তু হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরী হরফে। এবং রোম্যান হরফে সংখ্যা লেখা হবে এই ইস্যুতে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যখন আমরা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার ইস্যুতে এক হতে পারছিলাম না, তখন লোকসভার অধ্যক্ষ একটা ঐক্যমতে পৌঁছাবার জন্য একটা বিন্দু পর্যন্ত কিছু ছাড় দেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন; তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “না না। আমরা কিছুতেই আপনাদের ওপর হিন্দি চাপাতে চাই না। ঐক্যমতে পৌঁছাবার জন্য আলাদা ফর্মুলা দরকার”। এখন যদি হিন্দি লেখা হবে দেবনাগরী হরফে এবং সংখ্যাটাও লেখা হবে দেবনাগরী হরফেই — এটা চাপানো না হয়, তাহলে কোনটা চাপানো মনে হচ্ছে? এখানে আপনারা চাইলে বলতে পারে, আমরা হিন্দি চাপিয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু একই সময়ে হিন্দিকেই ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়ার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন, এর মানে কি নয় আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আত্মসমর্পণ করতেই হবে? আমি বুঝি এই পথে ভাষার সমস্যা কিছুতে মিটবে না, হওয়া উচিতও না। এক একটা জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষা রক্তের মত জরুরি উপাদান। আমি বিশ্বাস করি না, এভাবে কোনও ভাষাকে দরজির দোকানে কাপড় কাটা, কাপড় সেলাইয়ের মত করে জামা তৈরি দেওয়ার মত করে একটি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জোরজার করে ভারতের রাষ্ট্রভাষার মত গুরুতর ইস্যুর সমাধান করা যাবে। এভাবে হয় না।

এইবার যদি আপনারা কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চিহ্নিত করতে চান, তবে প্রশ্ন হচ্ছে কোন ভাষাকে অগ্রাধিকার দেবেন? গণতন্ত্রে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতার মূল্য সর্বাধিক, তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সেক্ষেত্রে হিন্দিকে সবচেয়ে বড় দাবিদার বলতে পারি। এই ভাষায় ১৪ কোটি মানুষ কথা বলেন। কাজেই তাদের দাবি জোরালো লাগছে। সমস্যা হচ্ছে হিন্দিতে অনেকগুলি উপভাষা রয়েছে। তাই এর মধ্যে কোনটা বাছাই সঠিক কাজ হবে, সেটা নিরূপণ করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। ১৯৩১ সালের জনগণনা সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর নেওয়া দরকার, সেখান থেকেই সংযুক্ত প্রদেশের (আজকের উত্তর প্রদেশ) মানুষের মধ্যে ঠিক কতজন বিশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলেন জানা যাবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে সবসময়ে সংখ্যাগুরুর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। যদি কোনও রাজ্যে অধিকাংশ মানুষ একটি ভাষায় কথা বলেন, তার মানে কিন্তু এই নয় — সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা।

এখন যেটা প্রশ্ন উঠতে পারে তা হল আমরা এখনও একটা অনির্দিষ্ট জায়গায় আটকে আছি কেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে একে দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাজনক ব্যাপার বলে মনে করি। আমার কয়েকজন বন্ধু সমালোচনার ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন —“একটা আস্ত উট গিলে ফেলার পর একটা সামান্য ডাঁশ নিয়ে চিন্তা করছ কেন?”। তারা আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কেন আমি দেবনাগরী হরফে হিন্দি লেখার ব্যাপারে একমত হলেও কেন দেবনাগরী হরফে সংখ্যা লেখার ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছি? এখানে আপনারা বলতেই পারেন, ভারতের স্বাধীনতা পেয়েই বা কি লাভ হল, যদি সবকিছু তার নিজস্ব না হয়? হিন্দিতে কি সবকিছুই আছে? কেউ কি এ নিয়ে সত্যিই ভালভাবে চন্তা করেছেন? যদি করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই কারুর মধ্যে রসবোধের এত অভাব কেন যে; তারা অন্য ভাষাকে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না? স্যর, প্রশ্নটা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গোবিন্দ বল্লভ পন্থ একবার বলেছিলেন, “আমরা অহিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দি চাপাব না”। মনে রাখতে ভারতের সবচেয়ে বড় হিন্দিভাষী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে এই ভাষ্য এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমি সেই প্রদেশের বাসিন্দা নই। আর সেটাই হয়েছে সমস্যার মূল। বিতর্কটা শুরু হয়েছে হিন্দি ও উর্দু ভাষা একই, কিন্তু হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরী হরফে। এবং রোম্যান হরফে সংখ্যা লেখা হবে এই ইস্যুতে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যখন আমরা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার ইস্যুতে এক হতে পারছিলাম না, তখন লোকসভার অধ্যক্ষ একটা ঐক্যমতে পৌঁছাবার জন্য একটা বিন্দু পর্যন্ত কিছু ছাড় দেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন; তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “না না। আমরা কিছুতেই আপনাদের ওপর হিন্দি চাপাতে চাই না। ঐক্যমতে পৌঁছাবার জন্য আলাদা ফর্মুলা দরকার”। এখন যদি হিন্দি লেখা হবে দেবনাগরী হরফে এবং সংখ্যাটাও লেখা হবে দেবনাগরী হরফেই — এটা চাপানো না হয়, তাহলে কোনটা চাপানো মনে হচ্ছে? এখানে আপনারা চাইলে বলতে পারে, আমরা হিন্দি চাপিয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু একই সময়ে হিন্দিকেই ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়ার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন, এর মানে কি নয় আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আত্মসমর্পণ করতেই হবে? আমি বুঝি এই পথে ভাষার সমস্যা কিছুতে মিটবে না, হওয়া উচিতও না। এক একটা জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষা রক্তের মত জরুরি উপাদান। আমি বিশ্বাস করি না, এভাবে কোনও ভাষাকে দরজির দোকানে কাপড় কাটা, কাপড় সেলাইয়ের মত করে জামা তৈরি দেওয়ার মত করে একটি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জোরজার করে ভারতের রাষ্ট্রভাষার মত গুরুতর ইস্যুর সমাধান করা যাবে। এভাবে হয় না।

এইবার যদি আপনারা কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চিহ্নিত করতে চান, তবে প্রশ্ন হচ্ছে কোন ভাষাকে অগ্রাধিকার দেবেন? গণতন্ত্রে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতার মূল্য সর্বাধিক, তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সেক্ষেত্রে হিন্দিকে সবচেয়ে বড় দাবিদার বলতে পারি। এই ভাষায় ১৪ কোটি মানুষ কথা বলেন। কাজেই তাদের দাবি জোরালো লাগছে। সমস্যা হচ্ছে হিন্দিতে অনেকগুলি উপভাষা রয়েছে। তাই এর মধ্যে কোনটা বাছাই সঠিক কাজ হবে, সেটা নিরূপণ করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। ১৯৩১ সালের জনগণনা সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর নেওয়া দরকার, সেখান থেকেই সংযুক্ত প্রদেশের (আজকের উত্তর প্রদেশ) মানুষের মধ্যে ঠিক কতজন বিশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলেন জানা যাবে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে সবসময়ে সংখ্যাগুরুর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। যদি কোনও রাজ্যে অধিকাংশ মানুষ একটি ভাষায় কথা বলেন, তার মানে কিন্তু এই নয় — সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা।

এই ভাষা সমস্যার ইস্যুতে আমি আপনাদের একটি বিষয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার মনে করছি। আপনারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন আগের বছরে পূর্ব পাকিস্তানে কি হয়েছিল? বাংলার বিভাজনের পর পাকিস্তানের জনক জিন্নাহ দাবি করেছিলেন যে, উর্দুই দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। আপনারা কি জানেন এই উক্তির প্রতিক্রিয়া হয়ে হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে? পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায় এতে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়েছিল এবং চিৎকার করে বলেছিল —“আপনারা কি বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে চাইছেন? আমরা পাকিস্তান গঠনের সময়ে পুরো হৃদয় দিয়ে আপনাদের সমর্থন করেছিলাম। আপনাদের কি করে এত সাহস হয় আমাদের ভাষাকে ধ্বংস করার?” পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ভাষা ইস্যুতে বিরাট গণ্ডগোল বাধে, সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন, মিছিল বের হয়েছিল। যা থামাতে পাকিস্তান সরকার টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার মনে করেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায় এই সঙ্কটের পেছনে উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু যখন তারা দেখতে পায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা ভাষা ইস্যুতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন; সরকারের সমালোচনা করে বিবৃতি দিচ্ছেন; তখন চুপ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সমস্বরে বলেছিল —“তোমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাকে টুটি চেপে ধরে মেরে ফেলতে চাইছ! তোমাদের সাহস তো কম নয়!”। বহু মানুষ বিক্ষোভ দেখাবার অপরাধে মার খেয়েছিল, জেল খেটেছিল ভাষার প্রশ্নে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলি অধ্যাপকের সামনে যখন মহম্মদ আলি জিন্নাহ বিবৃতি দেন, “উর্দু হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা, এবং তা লেখা হবে আরবী হরফে”। তখন অধ্যাপকরা বিদ্রোহের সুরে বলেন —“না, আমাদের পক্ষে এই দাবি মানা সম্ভব নয়”। তাদের দাবির সাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকা মানুষগুলিও একই সুরে উর্দুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। বলা বাহুল্য রাষ্ট্রের চাপে মিডিয়া সে সংবাদ চেপে গিয়েছিল। সাত দিন ধরে ব্যর্থ চেষ্টার পর জিন্নাহ হতাশ মনে করাচিতে ফিরে যান। সেখানে একটি প্রেস বিবৃতিতে সরকার জানায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবেই থাকবে। বাংলাভাষী মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মানতে রাজি ছিল, বাংলাকেও দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেও বাংলা ভাষা চলবে। বাংলাভাষী মুসলিমরা সাফ জানিয়েছিলেন তারা করাচি সহ পুরো পাকিস্তান ঘুরে যখন দেখবেন সব সাইনবোর্ডে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও আছে; তবেই পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চলতে দেবেন। পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিল সমস্যাটা কতটা গভীরে চলে গিয়েছে। তারা অতঃপর বাংলা ভাষাকে রোম্যান হরফে চালাবার কথা তুললেও তা অচিরেই খারিজ হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক কালে বাংলা ভাষা আরবী হরফে লেখার একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পাকিস্তান সরকারের তরফে, কিন্তু এবারেও সে প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ঘৃণাভরে খারিজ করে দিয়েছেন। তারা বঙ্গলিপির বাইরে যেতে রাজি নন।

আমি বলতে চাইছি, আমাদের উচিত সেখানকার পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়া। আমি জানি এখানে অনেকেই আছেন; যারা কোনও অবস্থাতেই হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মানতে চাইবেন না। তারা বাংলাভাষী মুসলমানদের মত আচরণ করবেন না, তার গ্যারান্টি নেই। ফলে দেশজুড়ে ভাষাগত বিবাদ দেখা দেবেই। আমি নিজেকে নৈরাশ্যবাদী বলতে চাই না, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ঐক্যমতে পৌঁছাবার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব আছে। ভাষাগত ব্যাপারে চোট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান উচিত নয় বলে মনে হচ্ছে। আমি সম্মানীয় মিত্র শ্রী গোপালাস্বামী আয়েঙ্গারের সবদিক থেকে ভেবেচিন্তে তৈরি ভাষণ শুনেছি। তার ভাষণ অনবদ্য, কিন্তু কোথাও যেন একটা নৈরাশ্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। যেন তিনি জানেন তিনি ঠিক কি চাইছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। তারপরেও এগিয়ে যাচ্ছেন। যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছেন, আমি তার বলা পয়েন্টগুলো লক্ষ্য করছিলাম।

“স্যর, এটা কি আপনার পরিকল্পনা যে, আমরা পুরো খসড়া গ্রহণ করতে পারি, নাকি ভাগ ভাগ করে নিতে পারি?”

তিনি বলেন —“না না, পুরো খসড়া সাথে করে নিতে হবে।”। তার পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম — হয় সবকটা সংশোধনী মেনে নিতে হবে, অথবা সব বাতিল করতে হবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তাতে কোনও পরিবর্তন আনা যাবে না। কিন্তু যদি এমন হয়, তা অগ্রহণযোগ্য হবে — যদি আমরা এভাবে দেখি; ‘হিন্দি দেবনাগরী হরফে লেখা হবে’ এবং বাকি কথাগুলো বাতিল করা হবে। হিন্দিকে গ্রহণ করা হবে, যদি বাকি আঞ্চলিক ভাষাকেও মেনে নেওয়া হয় তবেই।

এখানে আমার অবস্থান পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি। স্যর, আমরা যদি প্রাদেশিক ভাষা গোষ্ঠীর তরফ থেকে ঈর্ষা এবং তা থেকে ভাষার ভিত্তিতে গৃহযুদ্ধ এড়াতে চাই, তবে আমাদের উচিত হবে সংস্কৃত ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া। সংস্কৃত সব ভারতীয় ভাষার জননী হবার সুবাদে আমার মতামত হল ১৫ বছরের মধ্যে সংস্কৃত ভাষাকে ভারতের একমাত্র লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসাবে বেছেন নেওয়া তত কঠিন হবে না। কারণ সংস্কৃত ভাষা নিয়ে ইতোমধ্যেই সব ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো তৈরিই আছে বলে একে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ব্যবহার করার সুবিধা আছে। যেটা বাকি ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে বলা যায় না। যদিও আমার ধারণা ১৫ বছরের মধ্যে ইংরেজিকে সরিয়ে সংস্কৃত কেন, যে কোনও ভারতীয় ভাষার পক্ষে সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া বেশ কঠিন। এই প্রজন্মে তো হবেই না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে সংস্কৃতকে ইংরেজির জায়গায় বেছে নেওয়া ও শেখা তেমন শক্ত হবে না।

আমি মোটেও চাই না ভাষার ইস্যুতে আমাদের প্রশাসনে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হোক। সেই জন্য আমি চাইব শুধু ঐ ১৫ বছর নয়, এরপরেও ইংরেজি সরকারী ভাষা হিসাবে চালু থাকুক  আমি নিজেই অন্য একটা জায়গায় এই বিষয়ের ওপর যখন ভাষণ দিয়েছিলাম, আমি সবার কাছে নিদারুণ ভাবে সমালোচিত হয়েছিলাম। একটি হিন্দি বলয় থেকে আসা আমারই একটা বন্ধু আমার কাছে এসে বলেছিল —“এদিকে তাকাও মৈত্র! তুমি গভীরভাবে চাইছ ইংরেজিই যেন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে থাকে। কিন্তু তার পর? তুমি কি ব্রিটিশদের আবার প্রত্যাবর্তনের আশায় থেকে এই কথা বলছ?”। আমি তখন তাকে বলছিলাম যে, আমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছি, ভারতের বুকে ব্রিটিশদের আধিপত্য মোটেও দেখতে চাইনি বলে। কিন্তু তার অর্থ এই না, আমরা ইংরেজি ভাষা কিংবা ব্রিটিশ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। যখন উবনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের শাসক হয়ে বসল, তখন ভারতের কেউই ইংরেজি বুঝত না। ভারতিয়রা কয়েকটা শব্দ জানত মাত্র। এখানে একটি বাঙালি বাবুর গল্প বলে নিই। সেই বাঙালি বাবু একটা মারকেন্টাইল ফার্মে বেয়ারার চাকরি করত। একদিন ঐ ফার্মের বসের কাছে গেল, তার কাছে আবেদন জানাল, “আজ রথ যাত্রা স্যর, আমাকে ছুটি দিলে কৃতার্থ হই”। তখন বস জিজ্ঞাসা করল, “রথ যাত্রা কি বস্তু?” যেটুকু ইংরেজি জানা ছিল; তা থেকে বাঙালি বাবু রথের প্রতিশব্দ কি হবে জানা না থাকায় বললেন, “চার্চ, স্যর। উডেন চার্চ। জগন্নাথ সিটিং। রোপ অ্যান্ড পুল”। বলা বাহুল্য ঐ ইউরোপীয় বস হতভম্ব হয়ে বসে রইল। এই ছিল ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের অবস্থা। কিন্তু এরপর রাজা রাম মোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশ চন্দ্র দত্ত, এবং অন্যান্যরা ইংরেজি শিখে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয়রাও কম যায় না। কয়েক দশক বাদে কুমারী তরু দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এবং আরও অনেকেই অসাধারণ ইংরেজি গদ্য ও পদ্য লিখে ইংরেজি সাহিত্যকে উন্নত করেছেন। কিন্তু এটা মেনে নেওয়াই ভাল যে, ইংরেজি শিখতে শুরুর দিকে বেশ বেগ পেতে হয়; কেননা ইহা ভারতীয় ভাষা নয়। কিন্তু সংস্কৃত শিখতে তেমন সময়ও লাগে না। তবে এটা সত্যি যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা বা বিচার বিভাগীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে ইংরেজি এখনও একমাত্র ভাষা হিসাবে ভারতে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।

স্যর, আমি একজন ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষাপ্রেমিক এবং আমি জানি যে, ব্রিটিশ শাসনে আমরা সব রকম বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও কষ্ট সহ্য করেছি তাদের অপরিসীম লোভের জন্য। আমার সম্মানীয় মিত্র গোপালাস্বামী আয়েঙ্গার, বোঝাচ্ছিলেন যে, আমরা কিভাবে কোন পথে স্বাধীনতা অর্জন করলাম। তার ‘আবিষ্কার’ দেখে আমি হাসি সামলাতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল আমাদের কি সত্যিই ভারত থেকে ইংরেজি ভাষা মুছে দেওয়া উচিত? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে এই ভাষা শিখতে না পারে, সে জন্য সর্বত্র ইংরেজি ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত? ধরুন আগামীকাল মিস্টার কৃষ্ণমাচারি, বা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বা পণ্ডিত বালকৃষ্ণ শর্মা আমার সাথে দেখা করতে চায়, এবং আমরা যদি নিজের নিজের মাতৃভাষায় বলতে যাই; সেক্ষেত্রে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে। এ থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই ইংরেজির সাহায্য নিতেই হবে। যদি এখানে ইংরেজি ভাষা গায়ের জোরে তুলে দেওয়া হয়, ভারত তৎক্ষণাৎ একটি বর্বর দেশে পরিণত হবে। ভারতের জনতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক ভাষার অত্যন্ত প্রয়োজন, যা দেশের ভেতরে ও বাইরে ভাষাগত যোগাযোগের সমস্যা মেটাতে সাহায্য করবে। ইংরেজি এখন আর শুধুমাত্র ব্রিটেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়; আন্তর্জাতিক সম্পত্তি, সারা পৃথিবীতে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভারতের ভাইসরয়দের মধ্যে একজন ভারতীয়দের ইংরেজি নিয়ে একটি অসাধারণ মজার বই লিখেছিলেন —“বাবু’জ ইংলিশ”। ব্রিটিশরা জানত, ভারতীয়রা কিভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করে, কেন করে। তারা কতখানি কষ্ট করে ঐ বিজাতীয় ভাষা শিখতে হয়েছে সেটাও তারা বুঝেছিল। এইভাবে আমরা তিল তিল করে সম্মান অর্জন করেছি। এই ব্যাপারে আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। দেড় দশক পূর্বে আমি ব্রিটিশ সার্কেলে ছিলাম, সেখানে গিয়ে আমি দেখেছি আইনসভার ইউরোপীয় সদস্যরা আমাদের ইংরেজি বলা দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হতেন। তারা এমনও বলেছিলেন —“আমরা অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, তোমরা আইনসভায় বসে রেলওয়ে মন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ভাষণ শোনো, তারপর উঠে দাঁড়াও; তারপর উক্ত ভাষণে কি কি ভুল আছে ধরিয়ে দাও। আমরা এমনটা করার কথা ভাবতেই পারি না। সমালোচনা করতে গেলেও আমাদের প্রস্তুতি নিতে হয় ”। তাই আমরা বলতেই পারি যে, আমরা তাদের মাঠে তাদেরকেই পরাজিত করার মত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে আমরা যে জ্ঞান ভাণ্ডার ও বুদ্ধিমত্তার জগতে পৌঁছেছি, তা হারাতে ইচ্ছুক নই। এখানে ইংরেজি জানা সাথে সাথে হিন্দি এবং অন্যান্য স্থানীয় ভাষাও উন্নত হবে কালের নিয়মে। আমরা চাই প্রত্যেক স্থানীয় ভাষাই নিজের মত করে উন্নত হোক, সে কাজে সেই ভাষার পণ্ডিতরা সাহায্য করুক। ইংরেজির পাশাপাশি আরেকটা ভাষাও এই কাজে সাহায্য করতে পারে — সংস্কৃত।

ইজরায়েল কি করছে? ইহুদিরা তাদের হোমল্যান্ড পাওয়ার সাথে সাথে নানান অসুবিধা সত্ত্বেও হিব্রু ভাষাকেই তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মনোনীত করেছে। এইভাবে তারা তাদের মাতৃভাষাকে কতখানি শ্রদ্ধা করে, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, তাদের সভ্যতা, তাদের ঐতিহ্যকে কতখানি সম্মান করে তা দেখিয়েছে। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, আমি ঠিক এটাই বলতে চাইছিলাম, আমি এই সংশোধনীর মাধ্যমে আমি আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি, সভ্যতা, ঐতিহ্য ইত্যাদির পুনরুদ্ধার করতে চাইছি; যা সংস্কৃত ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করলে সম্ভব নয়। আমরা এইভাবে পাশ্চাত্যের প্রতি বার্তা পাঠাতে চাই। পাশ্চাত্য ধীরে ধীরে বস্তুবাদী সভ্যতায় পরিণত হচ্ছে। গীতা, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, তন্ত্র, চরক এবং সুশ্রুতের বার্তা পাশ্চাত্যের দিকে পৌঁছে দিতে হলে এছাড়া আর উপায় নেই। এবং সে কাজটা একমাত্র ভারত ছাড়া কেউ করতে পারবে না। এই কাজটা আমাদের মধ্যে হওয়া রাজনৈতিক তর্কের মাধ্যমে নয়, আমাদের দ্বারা আবিষ্কৃত কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমে নয়, বা তাদের দ্বারা পৌঁছে যাওয়া কোনও উন্নতির মাধ্যমে নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত পাশ্চাত্য এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে, কখন আমরা তাদের কাছে আধ্যাত্মিক বাণী শুনিয়ে তাদের অতৃপ্ত, হতাশাময় জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দেব।

এইরকম পরিস্থিতিতে, সারা দুনিয়া আপনাদের কাছ থেকে সঠিক বার্তা চাইছে। এখন প্রশ্ন হল, আপনারা দূতাবাসের মাধ্যমে ঠিক কি রকম বার্তা পাঠাতে চাইবেন? তারা তো আর আপনাদের জাতীয় কবি কে, আপনাদের মাতৃভাষা কি, আপনার সাহিত্য বা আপনাদের পূর্বপুরুষ কোন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিল; তা তো জানতে পারবে না।

আমি এবার সংখ্যার বিষয়ে আসি। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম দেখে যে, খুব কম ভারতীয় জানে গাণিতিক বিষয়ে প্রাচীন ভারতের অবদান কতখানি বিস্ময়কর। শুধু সংখ্যা নয় — বীজগণিত (আলজেব্রা), দশমিক পদ্ধতি, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি এবং আরও অনেক গাণিতিক শাখায় ভারতের অবদান অকল্পনীয়। আমি এখানে মাদ্রাস থেকে আসা এক বর্ণময় চরিত্রের বন্ধুর কথা বলতে পারি, যিনি ইউনিভার্সিটি কমিশনের সভাপতি ছিলেন এবং বর্তমানে মস্কোর রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছিলেন, এমনকি কিছুদিন ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সাপ্লাই মিনিস্ট্রিতে কর্মরত ছিলেন সেই প্রয়াত শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে কি গুপ্তধন লুকিয়ে আছে তা সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। যদি আপনারা না জানেন সংস্কৃত ভাষা, যদি না জানেন ঐ ভাষায় আপনার পূর্বপুরুষ কি কি অবদান রেখেছেন; তবে আপনাদের সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ভাষার ভূমিকা কতখানি গভীর, তাহলে বিশ্বের কাছে কি দেখাতে চাইবেন? কিছুই ত দেখাতে পারবেন না।

আমি শুধু জানতে চাই আমার আবেদন কি উত্তর ও দক্ষিণ ভারত থেকে আসা বন্ধুর হৃদয় পরিবর্তনে সাহায্য করেছে? আমি মনে করি আপনার পূর্বপুরুষের মাতৃভাষা যা ছিল, সেই সংস্কৃতের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বরাদ্দ রাখা উচিত আপনাদের মনের মধ্যে। যদি আপনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে চান, তবে সংস্কৃতকে প্রোমোট করা উচিত। আসুন আমরা আমাদের মধ্যে যা মতভেদ আছে, তা মুছে দিই এবং স্বাধিন ভারতের রাষ্ট্রভাষা রূপে সংস্কৃতকে মনোনীত করি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে, যদি আমরা সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করি, তবে আমাদের মধ্যে যে তিক্ততা আছে, ঈর্ষা আছে, মনস্তত্ত্বঘটিত সমস্যা আছে; তা কয়েক বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবেই। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও প্রকার ভাষাগত আধিপত্যকামী মনোভাব কাজ করা উচিত নয়। সংস্কৃত মোটেই সামান্য একটা আঞ্চলিক ভাষা নয়। তাই আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, যদি আপনাদের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, যার জন্য আমরা আজও গর্ববোধ করি; তবে আমার সংশোধনী প্রস্তাবে একমত হন। আমরা বিশ্বের কাছে এইভাবেই জানাতে চাইব যে, আমরা ইহুদিদের মতই নিজেদের ধনী ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারি।