নির্মল হৃদয়

0
1332

সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে মিশনরিজ অফ চ্যারিটির কয়েকজন নান্ গ্রেফতার হয়েছেন শিশুপাচারের অভিযোগে। স্বাভাবিকভাবে বহু মানুষ হতচকিত হয়ে গিয়েছেন এই ঘটনায়। আইনকে আইনের পথে চলতে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করা গুণীজনও এর মধ্যে রাজনৈতিক রঙ খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়া একে মাদার টেরেজার স্মৃতির উপর আঘাত হিসাবে দেখে মাঠে নেমে পড়েছেন স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কী এই ঐতিহ্য বা স্মৃতি? বাংলার তথা বাঙালির গর্ব করার বিন্দুমাত্র উপাদান কি তাতে কখনো উপস্থিত ছিল? বহু বছর যাবৎ প্রবাসী বাঙালি ডাক্তার অরূপ চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়ে পৃথিবীবাসীকে এই মিশনারিজ অফ চ্যারিটি সম্পর্কে অবহিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই হেলস অ্যাঞ্জেল তথ্যচিত্র সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু বাঙালি, তথা ভারতবাসী, বা বৃহৎ আকারে পৃথিবীবাসী থেকে গিয়েছে সেই অজ্ঞানতায়। তিমিরবিদারী কোন অলখবিহারীর রূপে তাঁরা জনগণের সম্মুখে আসতে সক্ষম হননি। হয়তো এবারো তাঁর অন্যথা হওয়ার নয়। যিনি বিশ্বশান্তির মূল অন্তরায় হিসাবে দেখে এসেছেন গর্ভপাতকে, তাঁর সত্য উন্মোচনের জন্য আলাদা কোন উদ্যমের প্রয়োজন থাকার কথা নয় নারীবাদের তৃতীয় যুগের পরে। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে তাঁর তথাকথিত মাতৃত্বের কাছে বুঝি সমস্ত প্রগতিশীলতা হার মেনে যায়।

টেরেজা নিজে অবশ্য স্পষ্টবাদী ছিলেন তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে, যেমন তাঁরা হয়ে থাকেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, আর্তদের বিনা শর্তে নিঃস্বার্থ সেবা ইত্যাদি মহতী প্রচেষ্টার দাবী যে তিনি নিজ মুখে করেছেন এমন নয়। তাঁর ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি মহৎ এবং সত্যনিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই সেই ধর্মবিশ্বাস থেকে উদ্বুদ্ধ আদর্শগুলির চোখেও তিনি মহৎ। তাই প্রগতিশীলতায় তাঁর স্বাভাবিক দাবী।

একটি হিসেব দেওয়া হয় যে তাঁদের আবাসিকদের মধ্যে ৯০ শতাংশ নাকি খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী নয়। খুবই আনন্দের কথা । কিন্তু প্রশ্ন হল এই বাকি ১০ শতাংশের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি এই ধর্মপরিবর্তনের মাধ্যমে এখানে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছেন? যদি সে প্রশ্নের উত্তর সম্মতিসূচক হয় তবে এই ৯০ শতাংশের হিসাব পুরোপুরি মূল্যহীন হয়ে যায় । বরঞ্চ আবাসিকদের সাথে সমব্যবহার না করার জন্য তাঁদের আরও কিছু নিন্দা প্রাপ্য ।

অঙ্কের একটা সহজ নিয়ম হল একটি উপপ্রমেয়কে (hypothesis) উপপাদ্য (Theorem) হিসাবে পরিবেশিত করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ প্রমাণের, উদাহরণ দিয়ে তা প্রমাণ করা কখনোই সম্ভব নয় । কিন্তু উল্টোদিকে সেই উপপ্রমেয়কে বাতিল করতে হলে একটি অভ্যুদাহরণ (counter-example) ই যথেষ্ট। এবং অঙ্কশাস্ত্র যে যুক্তির নিরিখে একটি নির্ভুল শাস্ত্র সে নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে কি?

এবার চোখ ফেরানো যাক তাঁর তথাকথিত সেবামূলক কাজের ফিরিস্তিতে। মৃত্যুপথযাত্রী অসংখ্য মানুষকে, যাদের মধ্যে অনেকেই ক্যান্সার আক্রান্ত, কেবলমাত্র আস্পিরিন অথবা সমগোত্রীয় ব্যথানিরোধক ঔষধ দেওয়াকে আমরা কোন সংজ্ঞায় মানবতার পর্যায়ে ফেলবো সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাঁর নির্মল হৃদয় আশ্রমের চিত্র যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসি ক্যাম্পের সাথে তুলনীয় এমন কথাও অনেকের মুখেই শোনা যায়। এছাড়া, ইনজেকশন ইত্যাদি সামগ্রীর ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে প্রবল অনীহা কোন নির্মল হৃদয়ের প্রতিফলন এমন দাবি আশাকরি কোন সজ্জন করবেন না। এছাড়া বেশ কিছু ক্ষেত্রেই তাঁর পরিচালিত চিকিৎসাকেন্দ্রে, কেবলমাত্র সমুপযুক্ত চিকিৎসা ও ঔষধের অভাবে অনেক রোগীর মৃত্যুর উদাহরণও মেলে। (সূত্র : তথ্যচিত্র হেলস এঞ্জেল, গ্রন্থ: মাদার টেরিজা : দ্য ফাইনাল ভার্ডিক্ট) মাদার তাঁর নিজের জবানবন্দিতেই জানিয়েছেন তাঁর মূল উদেশ্য় হচ্ছে তাঁর ঈশ্বরের হয়ে কাজ করা। সেই আদর্শ অনুযায়ী যেহেতু যন্ত্রণা, এবং তার মাধ্যমে মৃত্যু হল ঈশ্বরের নিকটে পৌঁছানোর এক অন্যতম সোপান, তাই এই সব ঘটনার মধ্যে আর আশ্চর্যের কি থাকে।

তাঁর প্রতিষ্ঠানের অর্থভান্ডারের উৎসও যে প্রশ্নাতীত এমনও নয়। তাঁর সাথে এস এণ্ড এল ক্রাইসিস খ্যাত বিতর্কিত আমেরিকান ব্যবসায়ী চার্লস কিটিং, এবং হাইতির একনায়ক ডুভালিয়ের এবং তার স্ত্রীর সখ্যতার কথাও সর্বজনবিদিত ( সূত্র: মাদার টেরিজা : এ কমিউনিস্ট ভিউ) এই সূত্রে আরো জানা যায় ভোপাল দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরে সেই স্থলে পৌঁছিয়ে ইউনিয়ন কারবাইডকে ক্ষমা করার জন্য তার কাতর মিনতি দুর্ঘটনাকবলিত জনগণের কাছে। আজ এই প্রসঙ্গে সেই কমিউনিস্টদের কাছে প্রশ্ন রইলো, তাদের নীতি তো হল মানুষের দয়াদাক্ষিণ্যের বদলে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে তাদের উন্নতি সাধন, যাতে তারা নিজেই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আজ তারা টেরিজার পক্ষে?

অনেকেই হয়তো এই প্রশ্ন করবেন যে এই সম্বন্ধে তো পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা ইত্যাদি চলতে পারতো, এই বর্তমান ঘটনাবলীর বদলে। তাঁদের এটাই জানাই যে বহুদিন যাবৎ এই সম্বন্ধে বহু লেখালেখি হওয়া সত্ত্বেও কিছু যখন হয়ে ওঠেনি, তখন সেই একই পন্থা অবলম্বন করে ভবিষ্যতে কিছু হত এমন ধারণা করার পিছনে বিশেষ যুক্তি আমি দেখিনা। বরঞ্চ এই মৌমাছির চাকে ঢিল ছোঁড়ার মাধ্যমে এই সম্বন্ধে আলোচনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া আমার পক্ষে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমাদের পূজনীয় হল কেবলমাত্র সত্য, এবং সেই সত্যের পথে ব্রতী হতে আশাকরি মানুষ এই ধরণের কিছু ঠুনকো ধ্যানধারণা বা আবেগকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসতে পারবেন।

“অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।”

 

ফীচার: Patheos এবং The Avenue Mail