আনন্দবাজারের হিন্দুবিহীন ভারতীয়ত্বের অমর কল্পকথা

আনন্দবাজারের রোহন ইসলাম অমর চিত্র কথা সিরিজের উপর  লিখেছেন। তাতে বক্তব্যের অস্পষ্টতা ছাড়া আছে তথ্যের ভুলও। শ্রী নারায়ণ গুরু ছিলেন এঢ়াওয়া জাতির মানুষ যা বর্তমানে ওবিসির অন্তর্গত। তাঁকে তফসিলি জনজাতি বলা হল কেন বুঝলুম না।

পরিশেষে তিনি লিখেছেন,

ফলে দুটি ভারতীয় প্রজন্মের ভুলতে না পারা, শৈশবের মায়া-জড়ানো এই সিরিজে ‘হিন্দু’ এবং ‘ভারতীয়ত্ব’র মধ্যেকার সীমারেখা শেষমেশ অস্পষ্টই রয়ে গিয়েছে। বরং প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, গৈরিক বাহিনীর রাজনৈতিক মতাদর্শের ঐতিহ্যের নির্মাণকেই তা আরও পুষ্ট করেছে। তাই আশ্চর্যজনক ভাবে কিছু দেশবাসীর কাছে আজও ইতিহাস আর অমর চিত্র কথা একাকার হয়ে যায়!

আমি তাঁর ভাষাতেই বলি, আনন্দবাজারের কাছে হিন্দু শব্দটি এতই আতঙ্কের যে তাদের সর্বদাই প্রচেষ্টা হিন্দুকে ভারতে থেকে বহিষ্কারের। সে কারণে জনাব রোহনের লেখায় দেখি, হিন্দুদের যে কোন উল্লেখই গৈরিক বাহিনীর রাজনৈতিক মতাদর্শকে স্মরণ করায়। আনন্দবাজারের কাছে ইতিহাস আর রূপকথা একাকার হয়ে যায়।

হিন্দু আর ভারতীয়ত্বের সীমারেখা কোথায়? যেমন ধরুন পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি ভারতের অংশ ছিল। কিন্তু হিন্দুশাসনের তীব্র বিরোধী বলে তারা পৃথক হয়ে গেছে। তাহলে তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই হিন্দুবিহীন ভারতীয়ত্ব প্রস্ফুটিত। আবার সাদা চোখে দেখি, তারা ইসলামীয় রাষ্ট্র। তাহলে কি বলতে পারি, ভারতীয়ত্ব – হিন্দু = ইসলামীয় সংস্কৃতি?

জনাব রোহন হয়ত তা অস্বীকার করবেন। কিন্তু তাঁর লেখায় সেরকমটাই ফুটে উঠছে। তিনি দুঃখ করেছেন যে

এই সিরিজে স্থান পাননি তেমন মুসলিম ব্যক্তিত্বও। নেই জাকির হোসেন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গফফর খান, সৈয়দ আহমেদ খান।

এই ব্যক্তিত্বরা সবাই কি ছিলেন ভারতীয়ত্বের প্রতীক। দেখা যাক ইতিহাস কি বলে?

সৈয়দ আহমেদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ছিলেন এক অভিজাত মুসলমান। তিনি ছিলেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা (তদানীন্তন নাম অ্যাংলো-মহামেডান কলেজ। তিনি ছিলেন বৃটিশ শাসনের সমর্থক। এই ভদ্রলোক মনে  করতেন যে কেবল শিক্ষা বা যোগ্যতার জন্য কোন নিম্ন জাতির মানুষের উচ্চপদে আসা অসমীচীন। উচ্চপদ উচ্চবংশস্থ জাতির অধিকার।

খানসাহেব ছিলেন বাঙালি বিরোধী। তাঁর লেখায় ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে বাঙালি বিদ্বেষ। একটু উদ্ধৃত করি,

“I believe that the Bengalis have never at any period held sway over a particle of land. They are altogether ignorant of the method by which a foreign race can maintain its rule over other races.”

(One Country, Two Nations, Meerut March 1888)

অর্থাৎ বাঙালিরা অপদার্থ কারণ তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী নন। খানসাহেব তৎকালীন কংগ্রেসেরও ছিলেন তীব্র বিরোধী কারণ তাঁর কাছে তা ছিল বাঙালিদের প্রতিষ্ঠান। তাঁর মতে বাঙালিরা তাঁর জাতির বা রাষ্ট্রের বিরোধী। তাঁর জাতি বা রাষ্ট্র কোনটি?

ভারতবর্ষ?

মোটেই নয়। দ্বিজাতিত্ত্বের আদি প্রবক্তা ছিলেন সৈয়দ আহমদ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মুসলমান এবং হিন্দু পৃথক জাতি এবং তাদের পক্ষে একসাথে শাসন করা অসম্ভব। প্রয়োজন একজনের অন্যজনকে জয় করার। সাতশ বছরের মুসলিম শাসনের উত্তরাধিকারে যিনি ছিলেন গর্বিত, সেই সৈয়দ সাহেব বিশ্বাস করতেন তাঁর সম্প্রদায়ের শাসনের সম্ভাবনাতেই।

“Is it possible that under these circumstances two nations — the Mahomedans and the Hindus — could sit on the same throne and remain equal in power? Most certainly not. It is necessary that one of them should conquer the other and thrust it down. To hope that both could remain equal is to desire the impossible and the inconceivable.“

এই হচ্ছেন জনপ্রিয়তম বাংলা কাগজ আনন্দবাজারের আদর্শ ভারতীয় সৈয়দ আহমেদ।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নিয়ে আমি আর এতটা বিশদে যাচ্ছি না। সাংবাদিক তুফেইল আহমেদ এঁনার সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। আমি তাঁর কলিকাতায় ১৯১৪ সালের ২৭শে অক্টোবর দেওয়া বক্তৃতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করি যা দেখায় যে তাঁর কাছে ভারতীয়ত্ব অপেক্ষা অনেক বড় ছিল ইসলামীয় ভ্রাতৃত্ব। মাতাপুত্রের বন্ধনের চেয়েও দৃঢ় দেখাত তাঁর চোখে চীনা মুসলমান ও আফ্রিকার মুসলমানের বন্ধন।

“This biradri (community of Muslims) has been established by God…All relationships in the world can break down but this relationship can never be severed. It is possible a father turns against his son, not impossible that a mother separates her child from her lap, it is possible that one brother becomes the enemy of other brother…But the relationship that a Chinese Muslim has with an African Muslim, an Arab bedouin has with the Tatar shepherd, and which binds in one soul a neo-Muslim of India with the right-descendant Qureshi of Mecca, there is no power on earth to break it, to cut off this chain…”

কেন শুরু হয়েছিল অমর চিত্র কথা? দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষিত ভারতীয়রা আপন ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছেন  কারণ শিক্ষায় ভারতের দুই মহাগ্রন্থ নিয়ে কিছুই থাকে না। জনাব রোহন ইসলামের ভাষায়,

স্বাধীনতার পরেও এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কলোনিয়াল হ্যাংওভার দূর হয়নি। বাড়িতে, স্কুলে ভর্তি বিদেশি বই। রামায়ণ-মহাভারত নয়, এই প্রজন্ম তখন তোলপাড় ‘হার্ডি বয়েজ়’, ‘ন্যান্সি ড্রিউ’, ‘ববসি টুইন্‌স’-দের নিয়ে। দেশের শিকড়ের সঙ্গে জুড়ে নেই তাদের বেড়ে ওঠা।

তাহলে দেখাই যাচ্ছে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু শিক্ষায় বাদামী সাহেব নির্মাণের প্রকল্প বজায় রেখেছেন। তাহলে কি এটা আশা করা সঠিক যে যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চান তাঁরা সিরিজ শুরু করবেন নেহেরু, তাঁর পিতা বা তাঁর কন্যার চরিত্র চিত্রণে? জনাব রোহনের খেদ তাতেই। কেন অমর চিত্র কথা শুরু হল না জওহরলাল নেহরু, মতিলাল নেহরুর জীবনী দিয়ে? কেন ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী প্রকাশিত হল না?

তাহলে কি এটাই বুঝব যে হিন্দুবিহীন ভারতীয়ত্বের রূপ যদি ইসলামী সংস্কৃতি নাও হয় তা বাদামী সাহেবত্ব? সাদা বাংলায় আমরা একে  কলোনিয়াল হ্যাংওভারই বলব।

 

ফীচার: চিত্র প্রতীকী