রামাবতী লক্ষণাবতী : বঙ্গদেশের সংস্কৃতিতে ৺রঘুবীর শ্রীরামচন্দ্র

 

– বিতান চক্রবর্তী

“ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি, রাম লক্ষণ বুকে আছে, ভয়টা আমার কি?” – এই ছড়া শোনেন নি বা বলেন নি এরকম বাঙালি প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটবেলায় যখন লোডশেডিং হয়ে যেতো অথবা একা একা ফিরতে হতো কোনো নির্জন রাস্তা দিয়ে তখন প্রায়ই ছোটরা, অদৃশ্য ভয়ের সামনে নিজের মনে সাহস আনার জন্য এই ছড়াটা বলতো মনে মনে। তখন আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গ ছিল না, খণ্ডিত বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের অংশ ছিল। সেই ভারতের গঙ্গার মোহনায় ছোটোদের কাছে সূর্য চন্দ্র পৃথিবীর মতো রাম নামেও ছিলো সরলতার ধারা । রাজনীতির বিভেদ তখন সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে চেপে ধরেনি। রামের যে আদর্শ তা ছিলো ভাগীরথী পদ্মার পলিমাটির মতোই সহজ। সেসময় মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামেও শ্রীরাম ও রামায়ণের পূজা হত। এখনও সেসব দেশের সংস্কৃতিতে রাম ও ভগবান বিষ্ণুর বিভিন্ন কাহিনী ওতঃপ্রোতোভাবে জড়িত আছে । রামের প্রতি এই অনুরাগ ভারত থেকে শত শত কিলোমিটার পেরিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সেই দেশগুলিতে দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো । কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়ার সময় যে হঠাৎ বঙ্গ প্রদেশকে ডজ করে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল তা তো হতে পারে না । হয়ও নি।

রামায়ণের ওপর ভিত্তি করেই বাংলায় প্রচলিত হয়েছিল দেবী দুর্গার অকাল বোধন। রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময়ে রামকে বলা হয়েছিলো শরতকালে দেবী দুর্গার অকালবোধন করতে। কারণ রাবণ ও লঙ্কাপুরী তখন ভদ্রকালীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সুরক্ষিত ছিল। তাছাড়া রাবণ, দেবীর আরাধনা করে তার রথকে দেবীর আশীর্বাদে সুরক্ষিত করেন। তাই রাবণকে ধ্বংস করতে হলে আগে তাকে দেবী ভদ্রকালীর সুরক্ষা থেকে বের করে আনতে হত। তাই রাম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। কিন্তু, দেবী কিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছেন না দেখে বিভীষণ রামকে পরামর্শ দেন, ১০৮ টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবীর পুজো করতে। রামের আদেশে মহাবীর হনুমান দেবীদহে গেলেন, যেখানে একমাত্র নীল পদ্ম পাওয়া সম্ভব। পদ্ম আনার পর পুজো করতে করতে রাম দেখেন একটি পদ্ম নেই। তখন রাম নিজের পদ্মফুলের মতো নীল চোখ দেবীকে দান করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন দেবী প্রসন্ন হয়ে তার সামনে আবির্ভূত হন ও তাকে বিরত করেন। তাঁকে এই বর দেন যে তিনি রাবণের থেকে নিজের সুরক্ষা সরিয়ে নেবেন। শ্রীরামচন্দ্র তার দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন ষষ্ঠীতে। দেবী অষ্টমী ও নবমী তিথির মাঝে রামের অস্ত্রে প্রবেশ করলেন। দশমীর দিন রাবণের বধ হল। তখন থেকেই শারদীয়া নামটির প্রচলন হয়। শরৎকালে শ্রীরামের পরম্পরা অনুযায়ী সমগ্র ভারতে দুর্গামন্দিরে এই দুর্গাপূজা করা হয়ে থাকে। পূর্ব ভারতে এই পূজার প্রতিপত্তি বেশী, আলাদা মণ্ডপ গঠন করে এই পূজা হয় । কিন্তু ইসলামিক বাংলাদেশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বাংলাদেশে এই দুর্গাপূজা বাধাপ্রাপ্ত ও বিরল হয়ে পড়েছে ।

ঐতিহাসিকভাবে, বাংলার বৈষ্ণবধর্মের ঐতিহ্য ছিল আদি শঙ্করের যুগেরও আগে থেকে । বাংলায় বৌদ্ধ গুহাগুলিতে খোদাই করা ছিল শিল্পকার্য যেগুলিতে শ্রীরামকে দেখানো হয়েছিল। বাংলায় প্রাচীন বিষ্ণু মন্দিরগুলি রাম ও বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে দেখিয়েছিল । নবম শতাব্দীর প্রথমদিকে দক্ষিণ গঙ্গা এবং রাঢ় বাংলায় (মল্লরাজ্যের অধীনে ছিল) বৈষ্ণব সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল । উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নগরী পুণ্ড্রবর্ধনের বৃহদ্বটু গ্রামে (এখন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জের বটুনগ্রামে) বাংলার পাল শাসনামলের একজন প্রাচীন কবি সন্ধ্যাকর নন্দী জন্মগ্রহণ করেন । তিনি আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে “রামচরিতমানস” (রামচরিতম্) নামে একটি মহাকাব্য রাচনা করেন।  চারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত সংস্কৃতভাষায় রচিত এই কাব্যে যুগপৎ হিন্দু ধর্মের অবতার রামচন্দ্র এবং গৌড়ের রাজা রামপালের প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে। রামপাল ও রামচন্দ্রের যৌথ নামানুসারেই তার রাজধানী গৌড় নগরের একাংশের নামকরণ করা হয়েছিলো রামাবতী। এরপর মহান বৈষ্ণব কবি জয়দেবের আমলে বঙ্গদেশের স্বাধীন সম্রাট লক্ষণ সেন ছিলেন বৈষ্ণব। আবার তার নিজের নামই ছিল লক্ষণ (রামায়ণে রামের এক ভাইয়ের নাম লক্ষণ)। তিনি গৌড়ের একাংশের ওপর নগরের নাম রাখেন লক্ষণাবতী। অর্থাৎ গৌড়ে রামাবতী ও লক্ষণাবতী নামে দুই ঐতিহাসিক নগর ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, দুটিই ছিল দুই সময়ে সমগ্র বঙ্গদেশের রাজধানী। এর পরে, মাধবের দ্বৈত বৈষ্ণব ধর্মের পন্থা ১৩তম শতাব্দীতে খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং মাধবেন্দ্রপুরী, ঈশ্বরতীর্থ এবং শ্রীচৈতন্যের মতো প্রবীণদের নেতৃত্বে উদুপী থেকে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং রাম ও কৃষ্ণ উভয়েরই উপাসনা করেছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভু বাংলার বৈষ্ণব সাধক পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে রামায়ণের প্রচারও করতেন এবং তাঁর বক্তৃতায় মর্যাদা পুরুষোত্তম হিসাবে শ্রী রামের গুণাবলীর প্রশংসা করতেন।

উনিশ শতকের মহান সাধক বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়, যিনি বামা খেপা নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন মা তারার (দেবী কালী) এর এক উৎসাহী ভক্ত। “তবে তিনি শ্রী রামের উপাসনাও করতেন এবং রাম নবমী উদযাপনে খুব উৎসাহী হয়ে অংশ দিতেন।”

অন্যদিকে যাকে স্বয়ং রাম এবং কৃষ্ণের অবতার বলা হয় সেই শ্রীরামকৃষ্ণ অর্থাৎ গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের গৃহদেবতা ছিলেন স্বয়ং রঘুবীর । গ্রামের জমিদার লাহাবাবুদের পাঠশালায় প্রবেশ করেন। নয় বৎসর বয়সে তার উপনয়ন ও পাঠশালার শিক্ষা শেষ হলে তিনি গৃহদেবতা ৺রঘুবীর বিগ্রহের পূজাভার প্রাপ্ত হন। বাড়ির পাশে লাহাবাবুদের অতিথিশালায় প্রায়ই সাধু-সন্ন্যাসীদের সমাগম হত। গদাধর সেখানে সাধুদের শাস্ত্রপাঠ, পূজা ও ভজন একাগ্রচিত্তে শুনতেন; তাদের সাহায্য করতেন। কথকদের পুরাণ পাঠ তিনি একমনে শুনে রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত কথা সমস্ত হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বলে জানা যায় । অন্যদিকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রানী রাসমণিরও গৃহদেবতা ছিলেন ৺রঘুবীর ।

বঙ্গদেশের এক কবি কৃত্তিবাস ওঝা  ১৪ ম শতাব্দীতে “শ্রীরাম পাঁচালী” নামে পরিচিত রামায়ণের বাংলা সংস্করণ রচনা করেছিলেন । বাংলায় যদি কোনও রাম সংস্কৃতি না থাকত কেন বাঙ্গালা ভাষায় রামায়ণ করতেন কেন ? কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণের, তৎকালীন বাংলার সামাজিক জীবন এবং তার মূল্যবোধের প্রাণবন্ত বর্ণনা রয়েছে । কৃত্তিবাস ওঝা ছাড়াও এখানে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন ৫১ জন ও কবি ও লেখক তার বর্ণনা পাওয়া যায় । ঘনরাম চক্রবর্তী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধর্মমঙ্গল শাখার এক অন্যতম কবি। তাঁর সুবৃহৎ “ধর্মমঙ্গলকাব্য” টি তিনি ১৭১১ সালে রচনা করেন। কবি যে রামভক্ত ছিলেন তার পরিচয় মেলে তাঁর অনেক “ভণিতা”র মধ্যে। তাঁর কাব্যভাষায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায় । আরেকজন বিখ্যাত লেখক শ্রী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির (নোবেলজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ) লেখা “ছেলেদের রামায়ণ” বইটি শিশু মহলে খুব জনপ্রিয় ।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দে “মেঘনাদবধ কাব্য” রচনার সময়, বাংলায় রামায়ণের যে প্রবল গুরুত্ব ও চর্চা ছিলো এই ইঙ্গিতই বহন করে। মেঘনাদবধ কাব্যের বিষয়বস্তু রামায়ণ থেকেই গৃহীত, যদিও তার উপস্থাপনা বিপরীতধর্মী । তার সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

“মেঘনাদবধ কাব্যের কোন পাত্র আমাদের সুখদুঃখের সহচর হইতে পারেন না, আমাদের কার্য্যের প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তক হইতে পারেন না। কখনো কোন অবস্থায় মেঘনাদবধ কাব্যের পাত্রগণ আমাদের স্মরণপথে পড়িবে না আমি মেঘনাদবধের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ লইয়া সমালোচনা করিলাম না- আমি তাহার মূল লইয়া তাহার প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়।“

আবার রামায়ণ নিয়ে আরেক উপস্থাপনা দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়নী কথা’র ভুমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

“রামায়ণ-মহাভারতকে মনে হয় যেন জাহ্নবী ও হিমাচলের ন্যায় তাহারা ভারতেরই, ব্যাস-বাল্মীকি উপলক্ষমাত্র । রামায়ণ, এবং মহাভারতকে আমি বিশেষত এই ভাবে দেখি। ইহার সরল অনুষ্টুপ্‌ ছন্দে ভারতবর্ষের সহস্রবৎসরের হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া আসিয়াছে।”

নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো লিখছেন বঙ্গদেশে রামভক্তি সম্পর্কে , তিনি বলছেন,

“বাঙ্গলা দেশে যে এক সময়ে সমস্ত জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করিয়া তুলিতেছিল; সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী মূর্খ, ধনী দরিদ্র, সকলেই, এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল – বাঙ্গলা রামায়ণ, বিশেষভাবে, বাঙ্গলাদেশের সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি। বাঙ্গলাদেশে সেই যে, এক সময়ে, একটি নবোৎসাহের নব-বসন্ত আসিয়াছিল, সেই উৎসবকালের কাব্যগুলি বাঙ্গালির ছেলে যদি শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ করে, তবে দেশের যথার্থ ইতিহাসকে সজীবভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবে।”

ভারতের আরেক মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং, ভারতে মহাবীর হনুমান এবং শ্রীরামচন্দ্রের পূজার আরো বেশী প্রচলন করার জন্য নির্দেশ দিয়ে গিযেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, “দেশে শ্রীরামচন্দ্র ও মহাবীরের পূজা চালিয়ে দে দিকি। … ধনুর্ধারী রাম, মহাবীর, মা- কালী এদের পূজা চাই। মায়ের পূজায় রক্ত চাই- নরবলি চাই। … মহাবীরকে দ্যাখ, কেমন রামের জন্য একলাফে পাহাড় ডিঙিয়ে চলে গেল । … মহারজোগুণের উদ্দীপনা ভিন্ন না আছে তোদের ইহকাল- না আছে তোদের পরকাল। দেশ ঘোর তম:তে ছেয়ে ফেলেছে। তাই ইহজীবনে দাসত্ব- পরলোকে অনন্ত নরক।”

পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ-নাচের সংস্কৃতিতে রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রকে দেখা যায় । রাম রাবণের যুদ্ধের এক গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায় ও শিল্পকলা । লোকশ্রুতি অনুযায়ী রাম এবং সীতা অযোধ্যা পাহাড়ে এসেছিলেন এবং প্রবাসকালীন সময়ে অবস্থান করেছিলেন। সীতা তৃষ্ণার্ত ছিলেন এবং রামচন্দ্র পৃথিবীর মাটির ভূত্বকের মধ্য দিয়ে একটি তীর বিঁধেছিলেন এবং সেই স্থান থেকে জল বেরিয়ে এসেছিল। সীতা তার তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন । জায়গাটি সীতা-কুণ্ড নামে পরিচিত। প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত পটচিত্রতে (স্ক্রোল পেইন্টিং) রামায়ণের দৃশ্য ব্যাপকভাবে চিত্রিত হয়েছে । বাংলার জাঙ্গলমহলে আদিবাসীরা এবং তাদের বিখ্যাত ছৌ নাচেতে রামায়ণ থেকে বহুল দৃশ্যের প্রয়োগ দেখা যায় । বাংলার যাত্রাপালাতেও (লোকনাট্য) রামায়ণ ও মহাভারতের বহু কাহিনী চিত্রিত হয়েছে । পদ্মা পুরাণের পটল খন্ডে বর্ণিত রামায়ণ বঙ্গদেশের গ্রামেগঞ্জে প্রায়ই পঠিত হয় এবং তা খুবই জনপ্রিয়। আবার চট্টগ্রামে (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি সীতা কুণ্ড রয়েছে । বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত পোড়ামাটির মন্দিরগুলিতে শ্রী রাম সহ বিষ্ণুর দশ অবতারের চিত্রায়ণ রয়েছে। অন্যদিকে বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর রাম নবমীর মেলা এবং বাউল আখড়া একটি ঐতিহ্যবাহী উত্সব । রাম নবমীর দিনে সেখানে বাউলদের একটি সমাবেশ বসে, ভ্রাম্যমান কবি এবং বাংলার গায়ক, এবং দর্শকরা উপস্থিত হন। সোনামুখির রাম নবমীর মেলাটি পুরনো বঙ্গীয় বৈষ্ণব প্রবাহের সাথে সাঁওতালি ও রাজওয়ারি সংস্কৃতির একটি অনন্য সমন্বয়।

বঙ্গদেশের (ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই) পূজার পরিচালিত হয়  নিত্যকর্ম পদ্ধতি নামে পরিচিতগ্রন্থগুলি থেকে । এই গ্রন্থগুলি পুরাণিক পাশাপাশি তন্ত্র-আগাম ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে রচিত । এর মধ্যে ১৬ শতকে রচিত  কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের  বৃহৎ-তন্ত্রসার বইটিই হলো বাংলার স্থানীয় পূজা পদ্ধতির সবচেয়ে প্রামাণ্য বই। এই বইটিতেও রামের পুজা পদ্ধতির বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। আবার পুরোহিতদর্পণ বইগুলিতেও রামের পূজা পদ্ধতির বিবরণ রয়েছে এমনকি আধুনিক নিত্যকর্ম গ্রন্থে সরস্বতী, লক্ষ্মী, শীতলা, দক্ষিণাকালী, জগদ্ধাত্রী, গঙ্গা, তুলসি , কৃষ্ণা, এবং মার্কণ্ডেয় ইত্যাদির সঙ্গে চিরকালই রয়েছে রামের বর্ণনা ধ্যান এবং প্রণাম , রাম-সীতার মন্ত্রোচ্চারণের বিবরণ ।

এবার আমরা দেখি ৮০০ বছরের আরব সাম্রাজ্যবাদের মন্দির ও মূর্তিধ্বংসের পরেও আমরা কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে কতটা বাঙালি স্থাপত্য পাচ্ছি যেখানে রামচন্দ্রের নিত্য পূজাপাঠ হতো বহু প্রাচীনকাল থেকে।

১। রামচন্দ্র মন্দির গুপ্তিপাড়া হুগলি,

২। রঘুনাথ মন্দির চন্দ্রকোনা মেদিনীপুর,

৩। রাম মন্দির রামরাজাতলা হাওড়া,

৪। রামজীউ দেউল মন্দির, তমলুক,

৫। রামচন্দ্র মন্দিরচিরুলিয়া মেদিনীপুর,

৬। রঘুনাথ মন্দির, নশিপুর আখড়া মুর্শিদাবাদ,

৭। সীতা রামজীউমন্দির, রৌতারা মেদিনীপুর,

৮। রামসীতা মন্দির, শ্রীরামপুর, হুগলি,

৯। মাটিয়ারি রাম সীতা মন্দির,

১০। নারাজোল রাজপরিবারের রামচন্দ্র মন্দির এবং

১১। নদিয়ারকৃষ্ণগঞ্জের রাম সীতা মন্দির প্রভৃতি ।

এবার দেখি রাম শব্দটির সঙ্গে এবং নামের আমাদের পরিচিতি কতটা । বঙ্গে এবং বাংলাদেশে বহুস্থান রয়েছে যেগুলির নাম রাম দিয়ে । গুনে শেষ করা যায় না দার্জিলিং থেকে চট্টগ্রাম, কতগুলি শ্রীরামপুর, সীতাপুর, লক্ষণপুর, মহাবীরতলা, রঘুনাথপুরবা রামনগর, রামজীবনপুর, রাজারামপুর, রাজারামবাটি, রামহাটিতলা, রামপুরহাট, রামসাগর রয়েছে।

আবার, যে কোনো মানুষের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় জিনিস হলো তার সন্তান । যখন কেউ তার সন্তানের নাম রাখেন রাম বা রামচন্দ্র, এর মাধ্যমে রামের প্রতি তার গভীর অনুরাগের প্রকাশ ঘটে বইকি । যেমন- বিখ্যাত শ্যামা সাধক, কবি, গায়ক রামপ্রসাদ সেন, মধ্যযুগের বাঙালি বৌদ্ধ পুস্তক ‘শূণ্যপুরাণ’ এর রচয়িতা রামাই পণ্ডিত, বিখ্যাত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, বিখ্যাত টপ্পা গায়ক রামনিধি গুপ্ত, শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য । বাঙালির একেবারে বুকের কাছে বাজে যে সহজ পাঠ, এবং বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, তাতেও, বেশ কয়েকবার রাম নামের উল্লেখ রয়েছে- যেমন “রাম তুমি হাসিতেছ কেন” । “রাম বনে ফুল পাড়ে” – ইত্যাদি । এই থেকে জানা যায় যে সেময় রাম ছিল অত্যন্ত প্রচলিত একটি নাম । এছাড়া শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “রামের সুমতি” তো বিখ্যাত উপন্যাস । আবার যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের দাদার নাম ছিল মানিকরাম চট্টোপাধ্যায়, তাঁর বাবার নাম ক্ষুদিরাম এবং তাঁর ভাইরা ছিলেন রামেশ্বর এবং রামকুমার।

বঙ্গদেশের সংস্কৃতিতে বাংলার ঘরে শ্রীরামচন্দ্রের চিরকালীন, আদি ও অমলিন এক উপস্তিতি । তা যেন কাঁচের মতো স্বচ্ছ, গঙ্গাজলের মতো পবিত্র এবং প্রাণ শান্ত করা এক মন্ত্র । আবার পরম্পরা এবং দৃঢ় আত্মপরিচয়ের প্রতীকও বটে । ঠিক যেভাবে মহাবীর হনুমান শ্রীরামের নাম নিয়ে একা লঙ্কা ছারখার করে দিয়েছিলেন তেমনই একজন শিশুও এক-বিশ্ব অজানা বিপদের সামনে একাই বলিয়ান উঠে চলতে শেখে রাম নামেই । স্বনামধন্য বাঙালি সংগীত শিল্পী শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়তো সেজন্যেই হয়তো ছড়াটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বঙ্গদেশের আপামর শিশুকিশোরদের জন্য রেকর্ড করে রেখে যান একটি গান “ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি …” ।