“হিন্দু পাকিস্তান” : সোনার পাথরবাটি, অথবা উড়ন্ত একশৃঙ্গী

0
479

যাঁহারা বলিয়া থাকেন যে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন-পরবর্তী কালে (অথবা অন্য যেকোনো সময়ে) কোনো এক বিশেষ রাজনৈতিক নেতা তথা তাঁহার দল জিতিলে পরে প্রজাতন্ত্রী ভারত রাষ্ট্র একটি “হিন্দু পাকিস্তান”-এ পরিণত হইবে, তাঁহারা হিন্দু অথবা পাকিস্তান কোনোটিরই অর্থ বুঝেন নাই। অনেকেই ঘন ঘন আলটপকা মন্তব্য করিয়া সরল-জটিল নানাবিধ বিষয়ে নিজ অজ্ঞতার পরিচয় দিতে উৎসাহী হয়েন, বিশেষতঃ তাহাঁরা যদি রাজনীতি-ব্যবসায়ে যুক্ত থাকেন। আর নির্বাচন দোরগোড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলে তো কথাই নাই, অনর্গল অর্থহীন বাক্যের ঘনঘটায় দূরদর্শনের পর্দা, সামাজিক মাধ্যম (social media) তথা খবরের কাগজের পাতাগুলি আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে, কাহার বচন কতদূর মূর্খতা-অজ্ঞতা-মিথ্যা প্রদর্শন করিতে পারে সেইরূপ কোনো এক অলিখিত প্রতিযোগিতায় জিতিবার লাগিয়া একেবারে হুড়াহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়।

কাজেই শুদ্ধমাত্র নির্বাচনযুদ্ধে আপন উপস্থিতি জাহির করিবার উদ্দেশ্যে কৃত এরূপ প্রগলভতাকে পাগলের প্রলাপ বলিয়াই উড়াইয়া দিতাম, যদি তাহা দেশশুদ্ধ লোকের মনোযোগ আকর্ষণ না করিত। আর করিবে নাই বা কেন? এহেন ‘হিন্দু পাকিস্তান’-জাতীয় অমৃতবচনের বক্তা আখেরে বাগ্মী এবং সুলেখক বলিয়া পরিচিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের গণসংযোগ বিভাগে অধীনস্থ মহাসচিবের পদে কর্মরত থাকিবার সুবাদে পরিপক্ক কূটনীতিবিদ হিসাবে তাঁহার খ্যাতি সুবিদিত, পেঙ্গুইন প্রকাশনা সংস্থা তাঁহার এক ডজনাধিক বই ছাপিয়াছে, সেগুলির মধ্যে একাধিক আবার দেশিবিদেশি পত্রপত্রিকার বিচারে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছে; বৈদেশিক নীতি, রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ভারতবর্ষ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার বক্তব্য শুনিতে আল জাজিরা হইতে শুরু করিয়া বিবিসি অবধি সকল ‘প্রথম শ্রেণিভুক্ত’ বৈদেশিক ইংরাজি গণমাধ্যম সদা উদগ্রীব; এবং স্বয়ং অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাস্থল তাঁহার কুইন্স ইংলিশ-শোভিত বক্তৃতার নিনাদে গুঞ্জরিত, ইংরাজিভাষী বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-পণ্ডিতবর্গ-গণমাধ্যমগুলির তিনি নয়নের মণি, অতএব তাঁহার শ্রীমুখ হইতে যাহা নির্গত হইয়া থাকে – তা সে ঠিক, ভুল, অথবা আজগুবি যাহাই হউক না কেন – এ ধরাধামে (এবং বিশেষ করিয়া এই পোড়া দেশে) এমন বহু লোক আছেন, যাঁহারা ঐ কথাগুলিকে বেদবাক্য বলিয়া ঠাউরাইবেন। ইঁহাদের জ্ঞাতার্থে কলম, থুড়ি, কীবোর্ড ধরিতে হইল।

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কোন্‌ দল জিতিবে অথবা কে শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী হইবেন সে আলোচনা এই রচনার উপপাদ্য নহে। এখানে আমরা কেবলমাত্র ইহাই বিচার করিতে বসিয়াছি যে বক্তার কথামতো ‘হিন্দু পাকিস্তান’ নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কি না। ইহা বুঝিতে গেলে প্রথমেই দেখিতে হয় শব্দবন্ধটির ব্যাকরণগত গঠন কীরূপ। ব্যাকরণের প্রাথমিক জ্ঞান যাঁহাদের আছে, তাঁহাদের পক্ষে ইহা বুঝা কঠিন নহে যে শব্দবন্ধটি দুটি পদের সমন্বয়ে গঠিত : একটি বিশেষণ (হিন্দু) এবং অপরটি স্থান-নামবাচক বিশেষ্য (পাকিস্তান)। এমত পরিভাষা গঠন করিবার পিছনে বক্তার সর্বাপেক্ষা দুইখানি সম্ভাব্য উদ্দেশ্য থাকিতে পারে। একটি উদ্দেশ্য হইতে পারে এইরূপ : পাকিস্তান নামক স্থানের বর্ণনা দিতেই ‘হিন্দু’ এই বিশেষণ প্রয়োগ করা হইয়াছে – যেন পাকিস্তান একখানি হিন্দু-অধ্যুষিত অথবা ন্যূনপক্ষে হিন্দু-শাসিত দেশ[1]। এই সম্ভাবনাটিকে পত্রপাঠ খারিজ করিয়া দিলে কাহারও কিছু বলিবার থাকে না। অপর যে সম্ভাবনাটি পড়িয়া থাকে – এবং আমাদিগের বোধ হয় যে বাকচাতুর্যে যারপরনাই পটু বক্তা মহোদয় ইহাই লক্ষ্য করিয়া শব্দবন্ধটি গঠন করিয়াছেন – তাহা হইল রূপকার্থে ঐস্লামিক পাকিস্তানের নৈরাজ্য এবং সংখ্যালঘুপীড়নের দুর্নাম হিন্দুবহুল ভারত রাষ্ট্রের উপর আরোপ করা। ইহাই যদি আমাদিগের স্বনামধন্য বক্তার উক্তির তাৎপর্য হইয়া থাকে তাহলে বুঝিতে হইবে যে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস[2] গোপন করিয়া যাইতে চাহেন। তিনি এই ইতিহাস জানেন না এমন হওয়া অসম্ভব, কারণ তিনি এদেশে এবং বিদেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি হইতে ইতিহাস বিষয়ে ডিগ্রিলাভ করিয়াছেন। ফলে আমাদের মনে সন্দেহ জাগে যে তিনি সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হইয়াও জনগণের সম্মুখে তাহা চাপিয়া যাইতেছেন। আখেরে ইতিহাসকে আবৃত করিয়া রাখা কিংবা তাহাকে বিকৃত করা রাজনীতি করিবার একখানি সুবিদিত কৌশল। তবে এমনও হইতে পারে, তিনি হয়তো মনেপ্রাণে ইহা বিশ্বাস করেন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নৈরাজ্য এবং সেদেশের ইসলাম ব্যতীত অপরাপর ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়গুলির গণহত্যা-বিতাড়ণের ‘সংস্কৃতি’ ভারতবর্ষে আমদানি হইবে, যদি এদেশে আর্য হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মশাস্ত্র অনুসারী শাসনপ্রণালী প্রবর্তিত হয়। ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান সংবিধান উহার নানান দোষত্রুটি সত্ত্বেও ব্যক্তির মুক্ত চিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকাংশে দিয়া থাকে এবং তাহা রক্ষা করিবার প্রতিশ্রুতিও দিয়া থাকে। কাজেই ভারতীয় সংবিধান-নির্দিষ্ট ব্যক্তির এক্তিয়ারের মধ্যে থাকিয়া বক্তা মহাশয় যাহা ইচ্ছা তাহা বলিতেই পারেন। তাই বলিয়া তিনি যাহা বলিবেন তাহাই বেদবাক্যসুলভ ধ্রুবসত্য হইবে, এমন মনে করিবার প্রয়োজন নাই। আমরা শুদ্ধমাত্র রূপে গুণে মুগ্ধ হইয়া পল্লবগ্রাহিতা, প্রলাপ ও মিথ্যাবাদন বিনাবাক্যে মানিয়া লইবার পাত্র নহি। যাহা ভুল, তাহাকে ভুল বলিয়া চিহ্নিত করিতে হইবে বৈকি। এখন বক্তার “হিন্দু পাকিস্তান” বক্তব্যের অযৌক্তিকতা আমরা যুক্তিসহকারে ইতিহাস পর্যালোচনা করতঃ দেখাইব।

তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক যে বর্তমান শাসনব্যবস্থা এবং সংবিধান রদ করিয়া, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রানুসারী শাসনপ্রণালী প্রবর্তন করিয়া আধুনিক ভারত রাষ্ট্র অদূর ভবিষ্যতে একখানি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হইল। তাহা হইলেই কি উহা পাকিস্তানের ন্যায় মাৎস্যন্যায়ে পর্যবসিত হইবে? দেখা যাউক। আমাদিগের ভাগ্য ভালো যে আমরা নিজ ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হই নাই। যেসময় এই পুণ্যভূমিতে বেদবিহিত শাসনব্যবস্থা চালু ছিল, যখন রাষ্ট্র ও সমাজের আইনকানুন মনু-আপস্তম্ব-গৌতম-বৌধায়ন প্রমুখ ঋষিগণের ধর্ম ও গৃহ্যসূত্রের দ্বারা চালিত হইত, সেই সময়কার ঘটনাবলী কিয়ৎ পরিমাণে এখনো আমাদিগের স্মরণে রহিয়াছে। অতঃপর সেই ইতিহাস ঘাঁটিয়া দেখা যাইতেছে যে ইসলাম প্রবর্তনের অনতিকাল পরে (৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে) আরব কর্তৃক প্রাচীন পারস্য অথবা ইরান দখল হইলে অগ্নি উপাসক জরাথুস্ট্রিয় পারসীকগণ যখন আরবী নব্য মুসলমানগণের তাড়া খাইয়া আপন দেশ, আপন ভিটেমাটি-পবিত্র মন্দিরসকল ত্যজিয়া প্রাণ ও পূর্বপুরুষের ধর্ম-পরিচয় রক্ষার্থে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে আসিয়া উঠিলেন, এবং সেখানকার বাসিন্দাদের শরণাপন্ন হইলেন, তখন এক হিন্দু রাজাই তাঁহাদিগকে গুজরাটের সমুদ্রতীরে উদভাডা নামক গ্রামে জমিজমা দিয়া বসতি স্থাপন করিতে সাহায্য করিয়াছিলেন। যাহাতে সেই গ্রামে তাঁহাদের নিজস্ব ধর্মাচরণের কোনোরূপ অসুবিধা না ঘটে সেই কারণে পারসীকগণের পবিত্র অগ্নি স্থাপন করিবার ‘আতশগাহ্‌’ (পারসীক শব্দ, সংস্কৃত ‘হুতাশন-গৃহ’র সহিত তুলনীয়) অর্থাৎ অগ্নিমন্দির নির্মাণেও হিন্দু রাজা সহায়তা করিয়াছিলেন। সেই গ্রামে আজ অবধি পারসীকগণ সুখে বাস করিতেছেন, সেই গ্রাম ও সেই অগ্নিমন্দির আজ সমগ্র বিশ্বের সকল জরাথুস্ট্রিয়গণের পূত তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। যখন নব্য খ্রিষ্টান এবং আরবীগণের দ্বারা নির্যাতিত নিপীড়িত হইয়া নিজভূমি ইস্রায়েল হইতে ইহুদীগণ পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তখন কেরল ও গুজরাটের হিন্দু রাজারানীগণই তাঁহাদিগকে সসম্মানে বসবাস ও আপন ধর্মমতে উপাসনা করিবার সুরক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন। কুখ্যাত আলহাম্ব্রা ডিক্রি জারি করিয়া স্পেনের ক্যাথলিক খ্রিষ্টীয় রাজা যখন সেদেশের ইহুদীদের দেশ হইতে বিতাড়িত করেন, তখন তাঁহারা ভারতবর্ষের উপকূলে আসিয়াই প্রাণ ও ধর্ম রক্ষা করিয়াছিলেন। যখন পর্তুগালে খ্রিষ্টান ইনকুইজিশন খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেদেশের ইহুদীদের ধরপাকড় করিয়া, বিচারের নামে প্রহসন ঘটাইয়া উহাদের শূলে চড়াইতে উদ্যত হইল, তখন তাঁহারা প্রাণ হাতে করিয়া ভারতবর্ষেরই গোয়া উপকূলে আসিয়া জীবন ও আপন কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষা করিয়াছিলেন। এমনকী অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে (অর্থাৎ আজ হইতে দুই শতাব্দীর সামান্য অধিক সময় পূর্বে) বাগদাদ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য কিছু অংশ হইতে মুসলমান শাসকদের তাড়া খাইয়া বনেদী সদাগর ইহুদীরা ভারতবর্ষেই কলিকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাইয়ের মত মহানগরে আসিয়া পুনরায় ধর্মজীবন এবং ব্যবসাবাণিজ্য আরম্ভ করেন। এই অঞ্চলগুলির প্রত্যেকটি বাস্তবে হিন্দুবহুল হওয়া সত্ত্বেও ওই বিদেশিগণ কখনও কোনোরূপ বৈষম্য অথবা অত্যাচারের শিকার হইয়াছেন বলিয়া শুনা যায় না। কলিকাতা এবং বোম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ ও সুপ্রাচীন ইহুদী উপাসনাস্থল সিনাগগ-গুলির এযাবৎকাল অবধি সক্রিয় অস্তিত্ব এই সত্যের সাক্ষ্য দিবে। এই প্রকারে সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য হইতে নিপীড়িত ধর্মজাতিসকল দলে দলে ভারতবর্ষে আসিয়া সম্মানপূর্বক শরণ পাইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, ভারতের নিষ্ঠাবান বৈদিক হিন্দু রাজন্যবর্গ বিদেশি জাতি এবং ধর্মাবলম্বীদিগকে আপনাপন ধর্মপালন এবং প্রচারের স্বাধীনতা অবধি দান করিয়াছেন। এরূপ দৃষ্টান্ত শুধু সমগ্র মধ্যযুগ কেন, বর্তমান যুগে অবধি বিরল। আজো সৌদি আরবের কোনো কোনো শহরে অ-মুসলমান ব্যক্তির প্রবেশাধিকার অবধি নাই। মজার কথা হইল, মুসলমানগণের সর্বাধিক প্রাচীন মসজিদগুলির অন্যতম চেরমন জুমা মসজিদ ভারতের কেরালায় নির্মিত হইয়াছিল। আরব হইতে আগত নব্য মুসলমানগণ সেই প্রদেশে বাণিজ্য করিতে আসিয়া বসবাস করিতে লাগিয়াছিলেন এবং ওই স্থলে চের বংশের হিন্দু রাজাদের নিকট হইতে জমি এবং লোকবল প্রাপ্ত হইয়া ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত মসজিদটি নির্মাণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্যণীয় যে ইসলামের প্রবক্তার মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। মসজিদটি এখনো বহাল তবিয়তে ওই একই স্থলে বিদ্যমান। ভারতের পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডঃ আবদুল কালাম উহা পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলেন। হিন্দুগণ প্রায়শঃই ওই মসজিদের প্রাচীনত্ব এবং উহার সঙ্গে জড়িত নানাবিধ কিংবদন্তীর আকর্ষণে উহা দর্শন করিতে যান। এই সেদিনও ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী – যিনি পুনর্নির্বাচিত হলে এই প্রবন্ধের আলোচ্য বক্তা ভারত রাষ্ট্র ‘হিন্দু পাকিস্তানে’ পরিণত হইবে বলিয়া দাবী করিয়াছেন – উক্ত মসজিদের একটি সুবর্ণ-প্রতিরূপ সৌদি আরবের সুলতানকে উপহার দিয়াছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস হইতে হিন্দু শাসনের উদারতার এমন অজস্র উদাহরণ উপস্থিত করা যায়।

অতএব দেখা যাইতেছে যে প্রাচীন এবং অর্বাচীন উভয়প্রকার হিন্দু শাসকদেরই অপরাপর ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি যথাযথ সম্মান ও সুরক্ষা প্রদর্শনের একখানি সুদীর্ঘ ইতিহাস রহিয়াছে। ভারতবর্ষের যেকোনো প্রান্তে যখনই কোনো হিন্দু রাজা অথবা রানী শাসন করিতেছিলেন, তখনই সেই স্থলে নানাবিধ জনগোষ্ঠীকে তাহাদিগের বৈচিত্র্যময় ধর্মমতের প্রচার, প্রকাশ এবং ধর্মাচরণের অবকাশ ও স্বাধীনতা দান করিয়া হিন্দু শাসকগণ সুশাসন ও ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা স্থাপন করিয়াছেন। এইসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে কখনও হয় নাই, তাহা কেহ দাবী করিবে না; কারণ ভারতবর্ষের ন্যায় সুবিশাল ভূখণ্ডে এবং তাহার সুপ্রাচীন ইতিহাসব্যাপী সকলেই সর্বকালে যে ন্যায়বিচার এবং প্রজাপালনের রাজধর্ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছেন এমন নহে। কয়েকজন রাবণ, হিরণ্যকশিপু, কালাপাহাড়, খিলজি, ঔরঙ্গজেব, সুহ্‌রাবর্দী নানান সময়ে প্রকট হইয়া এই দেশকে কলঙ্কিত করিয়াছে, এই দেশের মানুষজন ও তাহাদিগের ধর্মকে পদদলিত ধ্বংস করিবার চেষ্টা করিয়াছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই নিয়মের প্রমাণ নহে। সুখের কথা এই যে, রাবণ কিংবা ঔরঙ্গজেব নহে, বরং আপামর ভারতবাসী সুশাসন বলিতে স্মরণাতীত আদিকাল হইতে এখনো রামরাজ্যই বুঝিয়া থাকে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুগণ অযোধ্যাপতি রাজা শ্রীরামচন্দ্রকেই এখনো পূজা করিতেছেন। যতদিন এইরূপ চলিতেছে, ততদিন ভারতবর্ষের পাকিস্তানে পরিণত হইবার ভয় নাই। ভারতবর্ষের যদি কাহাকেও ভয় করিবার থাকে, তবে সে হইল মিথ্যার বেসাতি সেইসকল সুযোগসন্ধানী রাজনীতিককুল, যাহারা নানাপ্রকার জুজু দেখাইয়া নির্বাচন জিতিবার জন্য হাস্যকর অযৌক্তিক এবং অবাস্তব সব তুলনা এবং প্রতিতুলনা টানিয়া থাকে। আমাদিগের আলোচ্য সুদর্শন বাগ্মী সুলেখক এম.পি. বক্তা মহাশয়ের স্বকপোলকল্পিত “হিন্দু পাকিস্তান”-এর জুজুটিও তেমনই একখানি অবাস্তব প্রতিতুলনা, একখানি বিপরীতালঙ্কার, ‘সোনার পাথরবাটি’র মতন একখানি বিরোধাভাস। এইরূপ কল্পনা বাস্তবায়িত হইবার সম্ভাবনা ততখানিই, যতখানি উড়ন্ত একশৃঙ্গীর মতো রূপকথার প্রাণীর প্রকৃতির ক্রোড়ে জন্ম লইবার সম্ভাবনা। এইরূপ শব্দবন্ধ রচনা বিধায় এবং অবাস্তব তুলনা টানায় হিন্দুর ধর্ম-সংস্কৃতি-ইতিহাস তথা সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষজনের প্রতি যে ঘৃণা অপমান এবং অবজ্ঞা প্রদর্শিত হইয়াছে, তাহার বিচার নাহয় এখানে না-ই করিলাম। আমরা বক্তার বক্তব্যের অবাস্তবতা প্রতিপন্ন করিয়াই আপাততঃ ক্ষান্ত হইব। হ্যাঁ, তবে যদি কেহ এমন দাবী করেন যে ভারতবর্ষের জনমানসে সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কারজাত উদারতার ঐতিহ্য এখনো অনেকাংশে বিদ্যমান, এবং এই দেশের হিন্দুগণ এখনো লোকসংখ্যায় গরিষ্ঠ বলিয়াই আধুনিক ভারত রাষ্ট্র নিজ সংবিধান ও আচার-আচরণে ধর্মনিরপেক্ষতার উদারতা রক্ষা করিতে পারিয়াছে, তবে তাঁহার দাবী উড়াইয়া দেওয়া কঠিন হয় বটে।

নির্বাচন, বিশেষতঃ কেন্দ্রের লোকসভা নির্বাচন যতই আসন্ন হয়, ততই ইঁহাদের মত বাক্‌চাতুর্যসর্বস্ব লোকেদের বাগাড়ম্বর চাগাইয়া উঠে। আমরা আশা করিব, নির্বাচন যথাসময়ে যত শীঘ্র সম্ভব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হউক, উহাতে ভারতবর্ষের বুদ্ধিমান সাবালক নির্বাচক জনসাধারণ আপন অধিকার প্রয়োগ করুন, এবং তাহা করিবার কালে এইরূপ অবমাননাকর উক্তির বক্তা ও তাঁহার রাজনীতিকে স্মরণে রাখুন।

 

পাদটীকা

[1] যদিচ ইহা বর্তমানে সত্য নহে, কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে যদি এমন দিন আগত হয় যে পাকিস্তানের জনসাধারণ তাঁহাদের পিতৃপুরুষগণের ধর্মে ফিরিয়া যান, তাহলে তাহা কী বর্তমান পাকিস্তানের অবস্থার তুলনায় খুব মন্দ হইবে? বক্তা এইরূপ প্রতর্কমূলক প্রশ্নের কী উত্তর দিবেন জানিতে ভারী লোভ হয়!

[2] ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন করিয়া মুসলমানদিগের হেতু একখানি আলাদা মুসলমানশাসিত মুসলমানপ্রধান ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করাই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তানের মূল প্রবক্তা মহম্মদ আলি জিন্নার ঘোষিত উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধিত হয় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষকে তিন টুকরো করিয়া উহার দুইভাগ ভূখণ্ডকে ‘পাকিস্তান’ (‘পাক’ অর্থাৎ পবিত্র স্থান, বিশুদ্ধ ইসলামী ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র বাসস্থান) স্থাপন করিবার মাধ্যমে।

 

ফীচার: চিত্র প্রতীকী