জিডিপির ঋণাত্মক গতি: নির্মলা সীতারামনের ভূমিকা কতখানি?

0
4792

সুদীপ্ত গুহ

কয়েকবছর আগে একটি ছেলেকে CBSC দশমশ্রেণীর ফল জিজ্ঞাসা করায় সে বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল, খুব খারাপ হয়েছে। মাত্র ৯৭% পেয়েছি। ওকে পরের প্রশ্ন করলাম অঙ্কে কত পেয়েছো? উত্তর, ‘মাত্র ৯৮ ‘। এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,  ২৪, ৩৬,  ৪৮ এর লসাগু ( LCM ) বলো তো। উত্তর এলো, ‘কাকু একটা পেপার হবে?’ এবার জিজ্ঞাসা করলাম 24 এর লঘিষ্ঠ গুণিতক ( Lowest Multiple ) কত জানো? উত্তর, ‘কাকু আমাদের সিলেবাসে গুণিতক (Multiple) ছিল না। ছোটবেলায় পড়েছি ভুলে গেছি’।

আমাদের দেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা অঙ্কে খুব ভালো তাঁরা নিজেরাও কোন দিন দাবী করেন না। কিন্তু জিডিপির সংজ্ঞাটা তো মনে রাখার কথা? যে সমাজে বাস করেন, সেই সমাজটা তো চিনবেন? সংজ্ঞা মনে না রেখে পড়াশুনা করলে তো সেই ‘Two states’ ছবির অর্থনীতিতে MSc করা অনন‍্যাকে যেমন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ মালহোত্রা প্রথম সেমিস্টারে ইকোনমিক্সে হারিয়ে দিয়েছিল, সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি চলতে থাকবে। সেই সঙ্গে,  সাধারণ মানুষ যেমন জগৎবিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের ২০১৯এর সাধারণ নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেই প্রবণতা চলতে থাকবে।

এবার প্রশ্ন, কে বলেছিল লকডাউন করতে? অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, জয়তী ঘোষ থেকে আই।আই।এম আহমেদাবাদের অধ্যাপক সেবাস্তিয়ান  মরিস  বলেছিলেন জিডিপির স্বার্থে সবকিছু সচল রাখতে। সচল রাখলেন না কেন মোদীজি? তাহলে তো এই ক্ষতি হত না?  উত্তর হল, এটা লাভ ক্ষতির ব্যাপার না। এটা অতিমারী।

এবার সংজ্ঞায় আসি। জিডিপির চলতি ভাষায় মানে হল, একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাবধানে উৎপাদিত মোট পণ্য ও পরিষেবার পরিমাণ। এখন অর্থনীতিবিদদের কাছে সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রশ্ন, লকডাউনের এই তিনমাসে আপনারা কত বার রেস্টুরেন্টে খেতে গেছেন? কতবার মিষ্টির দোকানে গেছেন? কতবার পেট্রোল কিনেছেন? কতবার মেট্রো রেল বা বিমানে চড়েছেন? জামাকাপড় কিনেছেন একবারও? সিনেমা হলে গেছেন কতবার গেছেন? টিভিতে বক্তৃতা করেছেন তো বাড়িতে বসেই। ছেলেমেয়ের গৃহশিক্ষককে কতজন পুরো মাইনে দিয়েছেন? গানের স্কুল, নাচের স্কুল কিংবা সাঁতারের কোচকে মাইনে দিয়েছেন? এমনকি দাঁতের ব্যাথা হলেও ডাক্তারখানায় গেছেন? তাহলে নির্মলাজি জিডিপির সংখ্যা আনবেন কোথা থেকে? নির্মালজি একটা ভুল নিশ্চই বলেছেন। ‘Act of God’ না বলে এটাকে ‘Act of Karl Marx’ বলা উচিৎ ছিল। আপনারা ঘরে বসে থেকে কোন প্রকার পণ্য ও পরিষেবা না কিনলে, উনি কি চীনের মত তথ্য উৎপাদন করে জিডিপিকে ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক করে দেবেন?

এবার প্রশ্ন, কে বলেছিল লকডাউন করতে? অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, জয়তী ঘোষ থেকে আই।আই।এম আহমেদাবাদের অধ্যাপক সেবাস্তিয়ান  মরিস  বলেছিলেন জিডিপির স্বার্থে সবকিছু সচল রাখতে। সচল রাখলেন না কেন মোদীজি? তাহলে তো এই ক্ষতি হত না?  উত্তর হল, এটা লাভ ক্ষতির ব্যাপার না। এটা অতিমারী। সংকটে সরকারের তরফ থেকে নাগরিক সমাজকে দেওয়া একটা জীবন বীমার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম। স্বাস্থ্যবীমার ক্ষেত্রে যেসব রুগীর অতীতে রোগের লম্বা ফিরিস্তি থাকে তার প্রিমিয়াম বেশী দিতে হয়। তাই বলে কি স্বাস্থ্য বীমা বন্ধ করে দেন? ক্যান্সারের জন্য আলাদা পলিসি করতে হয়। আমাদের.বাবা মার পলিসি প্রিমিয়াম বেশী বলে কি আমরা বীমা বন্ধ করে দিই? ঠিক তেমনি, এই অতিমারীর সময়ে এই এগারো ট্রিলিয়ান টাকা জিডিপি ক্ষতি সেই অতিরিক্ত প্রিমিয়াম মাত্র। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চাণক্য পণ্ডিত বলে গেছেন, যে কোন মূল্যে প্রজা রক্ষাই রাজার কর্তব্য। আর সেই কাজই করেছেন, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।

এখন আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা কালো টাকাকে মূলধন হিসেবে ব্যাবহার করে, শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার বেশী রাখবো, নাকি কালো টাকা সিস্টেমে থেকে বের করে টেলিকমের মত আবাসন ও অটোমোবাইল শিল্পকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসব?

এই প্রসঙ্গে, বামপন্থী ও কংগ্রেসি অর্থনীতিবিদরা কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, যার উত্তর দেওয়াটা খুবই জরুরি। প্রথমতঃ, অতিমারীর আগের আটটি ত্রৈমাসিকেও এই ফল কেন? এখানে উল্লেখ্য, আমাদের জিডিপির একটা বড় অংশ আমাদের দেশে আসে পরিষেবা রফতানি করে অর্থাৎ IT /ITES শিল্প থেকে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিষেবা আমদানিতে কিছু শর্ত আরোপ করেছে ২০১৭ থেকে l ফলে, ভারতের ওই দেশে রফতানি কমেছে। (ঠিক এই কাজ আমরা ইলেকট্রিক, সিমেন্ট এবং ইস্পাত শিল্পেও করেছি।) এই সমস্যা সম্মুখীন  মার্কিন মুলুকে পণ্য সরবরাহকারী সব দেশকেই হতে হয়েছে। জার্মানি, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান সবাইকে। ২০১৯-২০ তে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের জিডিপি বৃদ্ধির হার এতো কম ছিল যে ভারত এদের ছাড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সপ্তম থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে l

ওঁদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, নোটবন্দি ও GST কি এর জন্য দায়ী? বিরোধীরা যাই বলুন, নোটবন্দির ও GSTর ফলে বাজারে যে কালো টাকার লেনদেন কমে গেছে সেটা আবাসন এবং গাড়ির বাজারে গেলেই টের পাওয়া যাবে। ২০১৪ থেকে ২০২০তে বাড়ি ও গাড়ির দাম বাড়েনি বললেই চলে। বহু ক্ষেত্রে দাম কমেছে। এর কারণ এ ইদুই ব্যবসায় কালো টাকার লেনদেন ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা কমেছে। এধরণের বহু ব্যবসা যা কালো টাকায় চলতো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা কালো টাকাকে মূলধন হিসেবে ব্যাবহার করে, শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার বেশী রাখবো, নাকি কালো টাকা সিস্টেমে থেকে বের করে টেলিকমের মত আবাসন ও অটোমোবাইল শিল্পকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসব?

শরীর অসুস্থ হলে চিকিৎসা প্রয়োজন। সেই সময় ব্যবসার লাভ ক্ষতি ভাবার সময় নয়। সরকার তাই লক-ডাউন করেছে l তার ফলে বহু পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা কমেছে। চাহিদা কমার জন্য জোগান কমেছে। কমেছে উৎপাদন। এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা।

খুব দায়িত্ব নিয়ে লিখছি, অতিমারীর পূর্বে মন্দার বাকি কারণও সরকারের সংস্কারমূলক কিছু কর্মসূচী যার মধ্যে সবার আগে আসে IBC 2016 ( ইনসল্ভেন্সি এন্ড ব্যাংকরাপসি কোড ) এবং RERA ( রিয়েল এস্টেটে রেগুলেটরি অথরিটি ) আইন। কিন্তু এই ধারণের সংস্কার অবশ্যম্ভাবী ছিল।এখানে প্রধানমন্ত্রী জিডিপির আগে গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষকে। কিন্তু, কেন আনা হল এই এক গুচ্ছ সংস্কার যদি জিডিপি বৃদ্ধিতে তা বাধা হয়ে যায়? উত্তর হল, গরু পাচার করার মত সহজ পথে বহু টাকা উপার্জন করা গেলেও, মানুষ এতো কষ্ট করে প্রাথমিক টেট পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয় কেন? ডাক্তারি না করে ডাকাতি করাকে জীবিকা হিসেবে নেয় না কেন সাধারণ ভদ্রসমাজের একজন মানুষ? ঠিক একই যুক্তিতে, কোন অসৎ ব্যবসায়ীরা কোম্পানি বন্ধ করে ব্যাংক, সাপ্লাইয়ার এবং শ্রমিককে ঠকানোর যে প্রথা স্বাধীনতার পর থেকে চালিয়ে যাচ্ছে, তা বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। তাই IBC আইন। তাতে যদি ব্যবসা কমে, সাময়িক ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু লাভ সুদূরপ্রসারী। মধ্যবিত্তকে ঠকিয়ে তাদের সারাজীবনের সঞ্চয়ের টাকা ঠকিয়ে প্রোমোটারি ব্যবসা করা বন্ধ করতেই RERA আইন প্রয়োজন।তাতে যদি জিডিপি কিছু কমে সমাজের কিছু আসে যায় না। এটা নিয়ে চিন্তা করবেন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সেই সব অর্থনীতিবিদরা, যাদের সেই অঙ্কের ছাত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায় যে LCM করতে জানে, কিন্তু মাল্টিপল বা গুণিতকের মানে জানে না।

শরীর অসুস্থ হলে চিকিৎসা প্রয়োজন। সেই সময় ব্যবসার লাভ ক্ষতি ভাবার সময় নয়। সরকার তাই লক-ডাউন করেছে l তার ফলে বহু পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা কমেছে। চাহিদা কমার জন্য জোগান কমেছে। কমেছে উৎপাদন। এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এরমধ্যে নির্মলা সীতারামনের কোন ভূমিকা নেই। বরং কোভিৎ পরবর্তী পৃথিবীর জন্য তিনি যে ব্যাঙ্কিং, MSME ও কৃষি সংস্কার করলেন, তার জন্য ইতিহাস তাকে মনে রাখবে। কুৎসার ফলে দেশবাসী নরসিমা রাওজি ও অটলজিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু আজ তাঁদের মাহাত্ম্য বুঝছে। ইতিহাসও নির্মলাজিকে হয়তো ঠিক সেই ভাবেই মূল্যায়ন করা হবে l

লেখক ইঞ্জিনিয়ার এবং চার্টার্ড ফিনান্সিয়াল এনালিষ্ট l বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্বব্যাংক ও এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অনূদিত প্রকল্পের পরামর্শদাতা।

(এই প্রবন্ধের মতামত লেখকের। বঙ্গদেশ দায়ী নয়।)