নৈরাশ্যবাদী ভাষা-গোঁড়ামি ও মেকলের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত

0
1299

যাঁরা সদ্যপ্রকাশিত জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯)-এর ভাষাশিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশগুলির ঘনঘোর বিরোধিতায় হইহইক’রে নেমে পড়েছেন, সেইসব বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলির (যাদের বেশিরভাগেরই চরিত্র রাজনৈতিক) বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ করলে অন্ততঃ একটা ব্যাপার স্পষ্ট ফুটে ওঠে– এঁদের কেউই জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়াটি মন দিয়ে পড়েননি। হয়তো পড়বার প্রয়োজন মনে করেননি। কেননা খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা হ’তে দেখা যায় যে বাম-মনস্ক তথা তথাকথিত উদারপন্থী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের আদর্শগত চৌহদ্দির বাইরে অবস্থানকারী অন্য কোনো স্বরকে শোনবার অথবা অনুধাবন করবার প্রয়োজন বোধ করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা অন্যদের, বিশেষতঃ মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকেদের যুক্তি বা বক্তব্যকে নিজেদের স্বভাবসিদ্ধ উন্নাসিকতার কারণে তাচ্ছিল্যভ’রে বাতিল ক’রে দেন।জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯)-এর ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি।

আমাদের বামপন্থী বন্ধুরা নিত্যনতুন শব্দবন্ধ উদ্ভাবন করাতে বেশ দড়। পারিভাষিক শব্দের অভিনব এবং অত্যধিক ব্যবহারেরদ্বারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও কোনো চলমান বিতর্কের মোদ্দা বিষয়বস্তুটিকে গুলিয়ে দেওয়াএঁদের অনেক গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম। জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯) প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এঁরা আবারও একখানা শব্দবন্ধ উদ্ভাবন করেছেন, এবং সেটি হচ্ছে “ভাষাসন্ত্রাস”! প্রশ্ন তুলতে হয়, ঠিক কোন্‌ ভাষাটি আপনাদের সন্ত্রস্ত ক’রে তুলল, কমরেড? হিন্দি নাকি? তা হাজার হোক হিন্দি তো তবু একটা স্বদেশীয় ভাষা। কই, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটে যাবার পরেও ভারতের শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার যে অপ্রতিহত বিস্তার ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে– যা আসলে সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নের আগ্রাসনেরইএকটি চোখে পড়ার মতো দিক মাত্র–তা বামপন্থী এবং তথাকথিত উদারপন্থীদের ভীত-সন্ত্রস্ত ক’রে তোলে না কেন? ব্যাপারটাআপাতবিরোধী ঠেকছে না কি? বামপন্থী বন্ধুগণ তো আবার বিশ্বায়নের জাতশত্রু, পশ্চিমী (পড়ুন মার্কিন) বিশ্বায়নের কর্পোরেট প্রকল্পের “কালো হাত” ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার লক্ষ্যে অবতীর্ণ স্বঘোষিত অবতার – তা সেই বিশ্বায়নেরই একখানি নগ্ন প্রকাশ, যা হচ্ছে এই ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের বর্ণময় বৈচিত্র্যময় বহুভাষিক চরিত্রটিকে নষ্ট ক’রে এই গ্রহের প্রতিটি জাতির সংস্কৃতিকে এক (মার্কিন) ছাঁচে ঢেলে সাজানো, সেই ষড়যন্ত্র রুখতে ভারত রাষ্ট্র যদি অবশেষেআজ, প্রশাসনিক স্বাধীনতা লাভের সত্তর বছরেরও বেশি সময় বাদে, নিজভূমিতে উদ্ভূত ও সুললিত শক্তিমান সাহিত্যকর্মের দ্বারা ঋদ্ধ, ঋজু একখানি ভাষার মাধ্যমেদৃঢ়ভাবে নিজের জাতিসত্তাটিকে প্রকাশ করতে চায়, সেই প্রচেষ্টাকে তো অন্ততঃ আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের সমর্থন করবার কথা। কিন্তু কাজের বেলায় ঠিক তার উল্টোটা করা ভণ্ডামি হয়ে যাচ্ছে না কি, কমরেড?

আসলে হিন্দি অথবা সংস্কৃতকে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে ভাষাশিক্ষার অঙ্গ ক’রে তোলবার প্রস্তাবটির মাধ্যমে যে জায়গাটিতে প্রবল ধাক্কা দেওয়া গিয়েছে তা হ’ল বামমনস্ক তথা তথাকথিত উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদ্‌দের মস্তিস্ক-সঞ্জাতএকটা ঠুন্‌কো ভাষাগত আভিজাত্যবোধ, যে অভিজাততন্ত্রের কল্পিত শ্রেণিবিভাজনে ইংরেজির স্থান অবধারিতভাবেই যেকোনো ভারতীয় ভাষার অনেক ধাপ উপরে – তা সে হিন্দিই হোক অথবা বাংলা, তামিল হোক অথবা সংস্কৃত, প্রাচীন ভাষাই হোক অথবা অর্বাচীন। নিজ দেশ, স্বদেশীয় ভাষা ও স্ব-সংস্কৃতির প্রতি বাম-উদারপন্থী বন্ধুদের হীনমন্যতা-প্রসূত এই ঘৃণার মূলকথাটি হচ্ছেএই: বিদেশী ভাষা, বিশেষ ক’রে যে ভাষায় আধুনিক বামপন্থার উপকেন্দ্র আমেরিকা-কানাডা এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ কথা কয়, লেখালেখি করে,সে ভাষা যেকোনো ভারতীয় ভাষার চাইতে শতগুণে শ্রেয়ঃ। দুনিয়াশুদ্ধ লোকের ভাবনাচিন্তার কাঠামো তথা তাদের ব্যক্তিগত ভাষার জগতটিকে (এবং সেই সূত্রে তাদের সংস্কৃতিকে)একটিমাত্র একঘেয়ে ছাঁচে ঢেলে গড়বার দেদার ছুট দেবার বেলায় কাউকে বিশেষ আপত্তি তুলতে দেখা বা শোনা যায় না। কেবল দেশীয় ভাষায় যোগাযোগের এবং চিন্তাভাবনা আদানপ্রদানের একটি সাধারণ মাধ্যম, সাধারণ অবকাশ গড়ে তোলবার সরকারি/অ-সরকারি চেষ্টা করতে গেলেই ওঠে দেশব্যাপী গগনভেদী আর্তনাদ – “চাপিয়ে দিল র‍্যা!”

সম্প্রতি এই গোছের আর্তনাদ তুলতে দেখা গেল কয়েকজন সুপরিচিত বাম-মনস্ক পণ্ডিতদ্বয়ের লেখনীতে। এঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ডঃ পবিত্র সরকার, এবং অপরজন শ্রীমতী মালিনী ভট্টাচার্য।

“ভাষা-সন্ত্রাস” নামক জুজুটিকে উত্থাপন ক’রে সে সংক্রান্ত নানান কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের বিষয়ে পাঠকদের সাবধান ক’রে নিজের লেখায় ভাষা-অভিজাততন্ত্রজাত উন্নাসিকতার একখানি মোক্ষম পরিচয় ছেড়ে গিয়েছেন ডঃ সরকার। সংবাদ প্রতিদিন দৈনিকের গত ৯ই জুন ২০১৯ সংস্করণেনিজের“ভাষাবাদী আশাবাদী” শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় কলামেযেখানে যেখানে তিনি জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯) থেকে উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন, সেইসব জায়গায় উদ্ধৃতিগুলি চমকপ্রদভাবে হিন্দি ভাষায় লেখা– তাও আবার হাস্যাস্পদ ধরণের ভুল হিন্দিতে। অথচ জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯)-এর গোটা খসড়া প্রস্তাবটি আদ্যন্ত ইংরিজিতে লেখা একখানি দলিল, তার কোথাও কোনোখানেহিন্দির লেশমাত্র তো নেইই, এমনকী ভারত সরকারের যে ওয়েবসাইটে এই দলিলটি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও একমাত্র ইংরেজি ভাষাতেই সেটি লভ্য – হিন্দি অথবা অন্য কোনো ভারতীয় ভাষায় নয়। এখানে সতর্ক পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি জাগে, সেটি হচ্ছে – লেখক আগ বাড়িয়ে নিজেই জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০১৯)-এর প্রস্তাবিত খসড়াটি থেকে উদ্ধৃত অংশগুলি হিন্দিতে অনুবাদ ক’রে ছাপালেন কেন? এর একমাত্র সম্ভাব্য যে উত্তরটি পড়ে থাকে, তা হ’ল – খসড়া প্রস্তাবটি পড়তে পড়তে এবং তার সমালোচনা করতে গিয়ে লেখকের নিজের ভাষা-আভিজাত্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; তিনি নিজের অপর্যাপ্ত হিন্দি ভাষাজ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রবল উন্নাসিকের ন্যায় ভুল হিন্দিতেই ঐ আসলে ইংরেজি দলিলটির অংশবিশেষ অনুবাদ ক’রে দিয়েছেন – হয়তো এই আশায় যে ঐ ভাঙা ভাঙা হিন্দি প’ড়ে পাঠক কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গরস আস্বাদন করতে সমর্থ হবেন। একটি সমৃদ্ধ ভারতীয় ভাষা নিয়ে এই ধরণেরবালখিল্য ব্যাঙ্গাত্মক আক্রমণ কেবল তিন প্রকারের মানুষ করতে পারেন। প্রথম প্রকারটি হচ্ছে উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মানুষেরা– যারা নিজের ভাষাকে অন্যেরটির চাইতে শ্রেষ্ঠজ্ঞানে সেই অন্য ভাষা ও অন্য ভাষাভাষী মানুষকে হেয় ক’রে থাকে। দু’নম্বর প্রকারটি হ’ল ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার খাঁচায় আপাদমস্তক পুরে থাকা মানুষেরা, যারা নিজের মতো ক’রে ভাবতেই শেখেনি অথবা স্বকীয় ভাবনার চাইতে উপনিবেশবাদী প্রভুর ভাববার ধরণটিকেই যারা শ্রেষ্ঠতর মনে ক’রে থাকে। আর তিন নম্বর হচ্ছে সেইসবক্ষুদ্র প্রাদেশিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষজনেরা, যারা অন্য প্রদেশের ভাষা ও সেই ভাষায় কথা বলবার ধরণকে মজার খোরাক বানিয়ে তাই দিয়েচুটকী শুনিয়ে স্তাবকবর্গের বিনোদন ক’রে থাকেন। এই ধরণের আচরণ আর যাই হোক, একজন ভাষাতত্ত্ববিদের কাছে প্রত্যাশিত নয়।

ডঃ সরকার আরও বলেছেন যে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ক’রে স্কুলপড়ুয়াদের কোনো বাড়তি লাভ হবে না। তাঁর মতে, সংস্কৃতের শব্দভাণ্ডার থেকে ধার ক’রে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির সমৃদ্ধতর হবার যুক্তিটি নাকি একেবারেই ভিত্তিহীন। নিজের বক্তব্যের সপক্ষে ভদ্রলোক যে যুক্তিটি খাড়া করেছেন তা হচ্ছে আধুনিক তামিল থেকে বেছে বেছে সংস্কৃত শব্দ তাড়িয়েই দ্রাবিড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। প্রশ্ন হ’ল, সেই দ্রাবিড় আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে তামিল সাহিত্য কি তার স্বর্ণযুগের মহাকাব্য শিলাপ্পদিকরম কি মণিমেকলাই অথবা সঙ্গম কাব্যযুগের সমতুল্য একটিও উৎকৃষ্টসাহিত্যকীর্তি সৃষ্টি করতে পেরেছে? পেরেছে কি আরেকজন তিরুভাল্লুভার বা নিদেনপক্ষে একজন অন্ততঃ সুব্রহ্মণ্য ভারতীর জন্ম দিতে? উল্লেখ্য, এখানে তামিল সাহিত্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসেযেসব কাব্যকৃতি ও কবি-সাহিত্যিকদের নাম করলাম, তাঁরা একেবারে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু ক’রেএই সেদিনকার ঊনবিংশ শতকের ইতিহাসের অংশ। এরপরই বিংশ শতাব্দীতে তামিqaলনাড়ুতে দ্রাবিড় আন্দোলনের শুরু হয়, এবং সেই থেকে তামিল সাহিত্যের স্বর্ণিম ইতিহাসের শেষের শুরু। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্যের ছবিটিও মোটামুটি এক। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের পরবর্তী কোনো সাহিত্যিক বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রে আঁচড়টুকুও ফেলতে পারেননি।আমরা জিজ্ঞাসা করি, সংস্কৃত ভাষা চর্চার প্রসারনা হ’লেআধুনিক ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের এই যে দৈন্যদশাই কি ডঃ সরকারের কাঙ্ক্ষিত? বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃত ভাষার প্রভাবের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী এবং আলাওল ও দৌলত কাজীর কাব্যকৃতিগুলির নাম করেছেন। ক’রে প্রশ্ন তুলেছেন – “[এসব কাব্যে] যে প্রচুর সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার হয়েছে তাতে কি স্কুলে সংস্কৃত শেখানোর পটভূমি ছিল?” কিমাশ্চর্যম্‌! এই প্রশ্ন তুলে ডঃ সরকার কি নিজের অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন, নাকি ইচ্ছে ক’রে পাঠকদের কাছে ভুল তথ্য পরিবেশন ক’রে তাঁদের বিভ্রান্ত করতে চাইছেন? এই অর্বাচীন প্রশ্নটির সোজাসাপটা উত্তর হচ্ছে – হ্যাঁ, ছিল বৈকি। বঙ্গদেশেব্রিটিশ যুগ আরম্ভ হবার পূর্বে, এমনকী আফগান-ইসলামী উপনিবেশ স্থাপিত হবার পরেও টোলগুলির মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার ব্যাপক প্রসার গোটা অবিভক্ত বঙ্গের সবখানেই ছিল; অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ছোটবড় শাসকদের অনেকেই সেইসব টোলগুলিকে ভূমি ও অর্থ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ব্রিটিশরা তাদের রাজত্ব কায়েম করবার পরেও এক বঙ্গদেশেই সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থানটোলগুলির সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক।

১৮৩৫ সালে একজন ব্রিটিশ আধিকারিক ডব্লিউ. অ্যাডামতাঁর করা সরকারি শুমারির রেকর্ডে নথিবদ্ধ ক’রে গেছেন যে ঐ বছর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে কমবেশি এক লক্ষ টোল ছিল, যে হিসেবে প্রতি পাঁচশোজন ছাত্র পিছু একটি ক’রে টোল দাঁড়ায়। টোলগুলি ছিল দেশের আপামর জনসাধারণের শিক্ষালাভের মাধ্যম (অবশ্যই সেই ব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের আধিপত্য ছিল); এবং সংস্কৃতে সকলেই কমবেশি ব্যুৎপত্তি লাভ করত ব’লেই বাংলা সাহিত্যের আকাশে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী এবং আলাওল-দৌলত কাজীদের উদয় সম্ভব হয়েছিল। সংস্কৃতের সঙ্গে বঙ্গজীবনের সেই নাড়ির যোগ এখন ছিন্ন হয়েছে (বা বলা ভালো ডঃ সরকারের মতো প্রথিতযশা বাম-মনস্ক পণ্ডিতদের বদান্যতায় পূর্বতন বাম সরকার সে সংযোগ জোর ক’রে ছিন্ন করেছেন), তাই এখন বাংলার সাহিত্যাকাশে ধোঁয়া আর ধোঁয়াশা ছাড়া অন্যকিছুর উদ্ভব হয় না।এখানে উল্লেখ করা দরকার যে অ্যাডাম সাহেবের দেওয়া হিসেবটি ছিল সেই বিশেষ বছরের (১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)পরিসংখ্যান, যে বছর লর্ড মেকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ভারতের শিক্ষা নীতি-সংক্রান্ত নিজের ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন। ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় আগ্রাসীঔপনিবেশিক নীতির সর্বনাশা প্রভাব বিস্তারের সেই শুরু। বাকিটুকু ইতিহাস।

এবার আসা যাক শ্রীমতী মালিনী ভট্টাচার্য মহাশয়ার সমালোচনার প্রসঙ্গে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে শ্রীমতী ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে অধুনা লুপ্তপ্রায় কিন্তু একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র টিকিটে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে জিতে পার্লামেন্ট গিয়েছিলেন।এহেন মহাশয়া সিপিআই(এম)-এর মুখপত্র গণশক্তি-র ১৩ই জুন, ২০১৯ দৈনিক সংস্করণে বিশেষ কলামে আবারো একবার বামপন্থীদের বস্তাপচা স্লোগান “গৈরিকীকরণ”-এর ধুয়ো তুলেছেন। এই স্লোগানটি আর কিছু না হোক, আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের অল্পবিদ্যার পরিচায়ক, এবং তাঁদের সর্বজনবিদিত হিন্দুবিদ্বেষের তো বটেই।আজ অব্দি ভারতের সরকারি শিক্ষা নীতি এদেশের ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমে সনাতন ভারতীয় জ্ঞানচর্চার সুফলগুলির এক ছটাকও প্রবেশ করতে দেয়নি। এখন যখন জাতীয় শিক্ষা নীতির মাধ্যমে সেই প্রস্তাবটি তোলাহচ্ছে, তখন তার মধ্যে অশনিসঙ্কেত দেখতে বোধহয় একমাত্র বামপন্থী ও ঔপনিবেশিক চিন্তাধারায় লালিত তথাকথিত উদারপন্থীরাই পারেন।

ভাষাগুলিকে কেন্দ্র ক’রেএই যে অভিজাততন্ত্র, তার উপাদান এবং কাঠামোটি কিন্তু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতাবাদী চিন্তাধারারই সন্তান। এই অভিজাততন্ত্র বিদেশীর ভাষাকে দেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর সাধারণ মাধ্যম হিসেবে, শিক্ষালাভের সাধারণ মাধ্যম হিসেবে এবং সর্বোপরি গুরুতর বিষয়সকলের মনন তথা ভাবের প্রকাশ ও বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। এই অভিজাততন্ত্রই আবার ঐসব প্রয়োজন সাধনের খাতিরেস্বদেশীয় ভাষাকে সাধারণ মাধ্যম হিসেবে মানতে নারাজ হয়। এই অভিজাততন্ত্রের ধ্বজাধারীরালর্ড মেকলে সাহেবের মানসসন্তান – এঁরা সেই বিশেষ শ্রেণিভুক্ত যেটি রচনা করবার স্বপ্ন মেকলে সাহেব প্রায় দুশো বছর আগেই দেখে (এবং দেখিয়ে) গিয়েছেন : “…a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.”[১] আর মেকলে সাহেব এই বক্তব্যটি কোন্‌ পরিপ্রেক্ষিতে রেখেছিলেন তা আন্দাজ করতে পারেন কি? কী আবার – ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে কোন্‌ভাষা ব্যবহৃত হবে, সেই প্রসঙ্গ!

মেকলে সাহেবের নিজের জবানিতেই শুনুন, কী অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি স্বকপোলকল্পিত ঐদিশি-রক্ত-বর্ণ-কিন্তু-বিলিতি-রুচি-বুদ্ধি-সম্পন্ন বিশেষ হাঁসজারু শ্রেণিটির হাতে আগামী দিনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের স্বঘোষিত মহান দায়ভারের (অর্থাৎ অ-শ্বেতাঙ্গ হিদেনগোষ্ঠীকে ইউরোপীয় ‘সভ্যতার আলো’তে উত্তীর্ণ করা) উত্তরাধিকারসঁপে গিয়েছেন –“To that class we may leave it to refine the vernacular dialects of the country, to enrich those dialects with terms of science borrowed from the Western nomenclature, and to render them by degrees fit vehicles for conveying knowledge to the great mass of the population.”[২] এহ বাহ্য। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মেকলেসাহেবের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় পুষ্টঐ ভাষাকেন্দ্রিক অভিজাততন্ত্রের নাম আমরা ‘মেকলেতন্ত্র’ রাখলে সাহেবের স্বর্গতঃ আত্মার কাছে এই পোড়া দেশের যে অশেষ ঋণ জমা হয়ে রয়েছে – হয়তো তার কিঞ্চিৎ শোধ হলেও হ’তে পারে।এই নামকরণ কতখানি উপযুক্ত, তার চূড়ান্ত বিচার পাঠকেরাই করবেন।

আর ভাষাকে শুদ্ধমাত্র শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবেই বা দেখবো কেন? একটি ভাষা শিক্ষা করবার এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য কি তাকে স্রেফ বাহন হিসেবে ব্যবহার ক’রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-কারিগরি শিক্ষা, অথবা সোজা কথায় অর্থকরী শিক্ষা তথা বস্তুবাদী প্রয়োজন মেটাবার শিক্ষাটুকু হাসিল করা? ভাষার কি অন্তর্নিহিত, নিজস্ব, স্বকীয় কোনো মূল্যই নেই? ভাষা কি স্রেফ যোগাযোগের এবং তথ্য আহরণের মাধ্যমেই পর্যবসিত? এই প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্‌কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক ও লেখক শ্রীবংশী জুলুরি মহাশয়। অনলাইন পত্রিকা প্রাজ্ঞতা-য় নিজের কলামে অধ্যাপক জুলুরি ভাষার বিভিন্ন ভূমিকার কথা পর্যালোচনা করেছেন। ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভাষার ভূমিকা ও স্থান সম্পর্কে তাঁর এই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণাটির নির্যাস হচ্ছে এই যে ভাষার ভূমিকা শুধুমাত্র শিক্ষার মাধ্যমটুকুর মধ্যেসীমাবদ্ধ ক’রে দিয়ে আমাদের নীতিপ্রণেতারা এবং শিক্ষাবিদ্‌রাও ভাষার জীবনদায়ী ভূমিকাটিকে তাচ্ছিল্যভ’রে উপেক্ষা করেছেন। ভাষা ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করাটা যে স্রেফ পেটের খিদে নয় – বরং হৃদয়-মনের স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা মেটাতে, এমনকী আত্মার তৃপ্তি সাধনের জন্যেও অপরিহার্য, এই সহজ সত্যিটির প্রতি এঁরা দৃক্‌পাত করতে ভুলে গেছেন – এ যাবৎ যতগুলি শিক্ষানীতি প্রস্তাবিত বা প্রণীত হয়েছে তার প্রায় সবগুলিকেই এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা চলে। কোনো একটি বা একাধিক প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষা নীতি – তা সে যতই নিরপেক্ষ এবং দক্ষ সমিতি কর্তৃক রচিত হোক্‌ না কেন – দেশের সার্বিক উন্নয়নের কাজে লাগতে ব্যর্থ হবে যদি না সে শিক্ষার দ্বারা ভারতের সন্তান ভারতের চরিত্রটি (যা একমাত্র ভারতীয় ভাষাগুলির শব্দভাণ্ডারের মাধ্যমেই তুলে ধরা সম্ভব) ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে না পারে।এইখানে নিজ নিজ দেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় শিক্ষার দিক নির্দেশিকা কী হবে এবং তাতে ভাষার স্থানটি কোথায় থাকবে এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন এমন দু’জন চিন্তাবিদের নাম মনে প’ড়ে যায় – একজন ভারতীয়, অন্যজন আফ্রিকান (কেনিয়া)। প্রথমজন অর্থাৎ শ্রীগণেশ দেবী মাত্র দু’বছর আগে প্রকাশিততাঁর বইদ্য ক্রাইসিস উইদিন  -এ পরিতাপ করেছেন ঔপনিবেশিকতার কবলে প’ড়ে ভারতের নিজস্ব জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি ও ঐতিহ্যের ক্রম-অবসান বিষয়ে। ভারতীয়দের পক্ষে গভীর পরিতাপেরই কথা বটে।

কিন্তু ভারতীয় হিসেবে শুধু শোক-পরিতাপ ব্যক্ত করবার মধ্যেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, সেসব লুপ্তপ্রায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে সুবিশাল ও নিবিড় কর্মযজ্ঞের আয়োজন করা একান্ত আবশ্যক, সেই কর্মযজ্ঞে ভারতের তরুণ পণ্ডিতবর্গ তথা বৃহত্তর ভারতীয় বিদ্বৎসমাজকে সক্রিয় যোগদান করতে হবে বৈকি।দ্বিতীয়জন অর্থাৎ কেনিয়ার অগ্রগণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এনগুগি ওয়া থিওং-ও, যিনি একাধারে শক্তিশালী লেখনীশক্তির অধিকারী এবং মার্কিন মুলুকে তুলনামূলক সাহিত্য ও পারফর্মেন্স স্টাডিজের অধ্যাপকও বটে, তিনি নিজের দেশ তথা সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের মানুষকে ঔপনিবেশিকতাবাদী চিন্তার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসবার ডাক দিয়েছিলেন তাঁর রচিতডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ডনামক বইতে। সে ডাক লেখকের নিজের দেশ ও মহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এসে প্রতিধ্বনিত হয় প্রত্যেক প্রাক্তন উপনিবেশে – যেখানেই ঔপনিবেশিকতাবাদ নিজের সূক্ষ্ম অথচ গভীর দাগ ফেলে গেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রশাসনে, শিক্ষায়, সর্বোপরি সেই সকল দেশগুলির বিদ্বজ্জনেদের চিন্তায় ও মননে, সেখানেই চিন্তাকে উপনিবেশের দাসত্ব ভেঙে বেরিয়ে আসবার জন্যে এনগুগির যুক্তিযুক্ত পথনির্দেশ এবং উদাত্ত আহ্বান আজো প্রাসঙ্গিক। তাঁর বইটি সমস্ত আফ্রিকান ভাষার লেখকদের উৎসর্গ করতে গিয়ে এনগুগি লিখেছেন : “এই বইটি কৃতজ্ঞতাভ’রে তাঁদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত যাঁরা লেখেন আফ্রিকান ভাষায়, এবং তাঁদের উদ্দেশ্যেও যাঁরা বছরের পর বছর আফ্রিকান ভাষাগুলির মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন এবং অন্যান্য সম্পদরাজির মর্যাদা বজায় রেখে চলেছেন।”[৩]

ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে যে দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রবাহিত হয়ে চলেছে, ভবিষ্যতে তার মর্যাদা, তার গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখবার ভারকে নেবে? ঠিক কোন্‌ ধরণের ভাবী ভারতীয় নাগরিকের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব সম্পাদন করা সম্ভব? যিনি একাধিক ভারতীয় ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ না হলেও নিজের ভারতীয় মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের পাশাপাশি অপরাপর ভারতীয় ভাষার সঙ্গে অন্ততঃ যাঁর সাক্ষাৎ পরিচয়টুকু ঘটেছে – তিনি, নাকি যিনি নিজের মাতৃভাষা-ভাষী অঞ্চলটি বাদে ভারতের বাকি সবটুকুর সঙ্গে কেবল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই যোগাযোগ করে থাকেন – এমন কেউ? পাঠক ভেবে দেখবেন। উদাহরণ হিসেবে আমাদের ক্ষয়িষ্ণু বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিই তো হাতের কাছে রয়েছে।বাংলা ভাষায় গত দু’দশকে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, যে বিনোদন প্রযোজিত হয়েছে, তার গুণগত মান ঠিক কতটুকু? বাংলাভাষায় আজকাল যেসব জনপ্রিয় গান ও চলচ্চিত্র তৈরি হয়, দূরদর্শনে বাংলাভাষায় যেসব অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়, তাদের কতটা মৌলিক সৃজন আর কতটা অন্য ভাষাভাষী (পড়ুন হিন্দি, ইংরেজি এবং দক্ষিণের প্রদেশগুলির) গান/চলচ্চিত্র/অনুষ্ঠানের বাংলা অবতার? বাংলা ভাষায় মৌলিক সৃজনের – সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ইত্যাদির – তা সে উচ্চমানেরই হোক অথবা সস্তা জনপ্রিয় মাধ্যমই হোক– এমন আকাল কেন? পশ্চিমবঙ্গে নতুন চিন্তা এবং অভিনবত্বের এই খরার পেছনে যেবাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষণের পড়ন্ত রেখাচিত্র এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষার (বিশেষ ক’রে সংস্কৃত এবং হিন্দি, যারা বাংলাভাষার জননী এবং সহোদরাপ্রতিম) চর্চার অভাব নেই – এমনটা বুক ঠুকে বলা যাবে কি?

ঋণস্বীকার :

[১] ও [২] Minute by the Hon’ble T. B. Macaulay, dated the 2nd February 1835.

[৩] এই প্রবন্ধটির জন্য এনগুগি রচিতডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড–এর উৎসর্গপত্রটির বঙ্গানুবাদ করেছেন শ্রীজিৎ দত্ত।

Previous articleপরিবেশ রক্ষার্থে বড় গাছ ও পরিবেশবান্ধব সাইকেল অপরিহার্য
Next articleবখাটে চাই
শ্রীজিৎ দত্ত
শ্রীজিৎ দত্ত ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ে গবেষণারত। পড়াশোনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও পড়াশোনা করেছেন। ইন্ডিয়াফ্যাক্টস, প্রাজ্ঞতা, স্বরাজ্য, মাইইন্ডমেকার্স, টপইয়াপ্স ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত ভারততত্ত্ব বিষয়ে লেখালেখি করেন। পেশা অধ্যাপনা, ধ্যানজ্ঞান সঙ্গীত। যোগাযোগ – sreejit.datta@gmail.com