রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রাবল্যে তটস্থ বঙ্গ

অতি সংক্ষেপে, প্রশাসনিক পেশাদারিত্ব সমস্ত দল-মত ও পথের উর্দ্ধে অবস্থিত এবং একটি সফল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ বিশেষ। নিঃসন্দেহে, এটি একটি সকর্মক ক্রিয়া এবং প্রশাসনের গতিশীলতার প্রাণভোমরাস্বরূপ। সমস্যা ঘনীভূত হয় যখন তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার করতলগত হয় বা তাকে আঘাত করার দুর্বার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাসংকুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বারংবার, শাসক-বিরোধীর সশস্ত্র সঙ্ঘর্ষে রক্তাক্ত হয়েছে বঙ্গের ভূমি কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে তান্ডব চলছে রাজ্যে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। রাজ্যের সংঘাতপূর্ণ রাজনীতিতে তা এক নতুন উপাদান সংযোগ করেছে। সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ অনুসারে, আজ অল্প কিছুক্ষণ আগেই কলকাতা পুলিশ দ্বারা একটি কোম্পানির দুটি প্রপার্টিতে হানা দেওয়া হয়। ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যুপুর্ণ – প্রথমত, কোম্পানিটি সিবিআইর ভূতপূর্ব অন্তর্বর্তী প্রধান শ্রী নাগেশ্বর রাওর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সংবাদসূত্রে প্রকাশিত হয়েছে; দ্বিতীয়, আগামীকাল অর্থাৎ ০৯/০২/২০১৯ তারিখে সিবিআইর সম্মুখীন হবেন শ্রী রাজীব কুমার, বর্তমান কলকাতা পুলিশ কমিশনার। এই পুলিশী হানা গত সপ্তাহের কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ হেতু সৃষ্ট উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করল বলেই মনে করা হচ্ছে।   যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে এটিকে একটি নিছক/রুটিন কাজ বলে অভিহিত করা হচ্ছে বলেই জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, এটি এক ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিহংসার প্রতিফলন। বিশেষত, গত সপ্তাহে কলকাতা শহরে অবস্থিত পুলিশ কমিশনার শ্রী রাজীব কুমারের গৃহে সিবিআইর এক দল অফিসারদের উপস্থিতিকালীন সিবিআই র প্রধান ছিলেন শ্রী নাগেশ্বর রাও। 

পুলিশী সূত্র অনুযায়ী, বৌবাজার থানায় গৃহীত এক অভিযোগ অনুসারে কলকাতা পুলিশ এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেড নামক কোম্পানিটির দুটি অফিসে, কলকাতা ও সল্টলেকে অবস্থিত, হানা দেয়। যদিও প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি শ্রী রাওর স্ত্রী শ্রীমতী মাননেম সন্ধ্যার, শ্রী রাও এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার দায় অস্বীকার করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, শ্রী রাও ৩০/১০/২০১৮ তে একটি প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে তাঁর আর্থিক লেনদেনের হিসাব জনসমক্ষে ব্যক্ত করেছিলেন।  

অক্টোবর মাসের বিবৃতি অনুযায়ী, শ্রী রাও এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেড নামক কোম্পানিটির সাথে তাঁর পরিবারের সম্পৃক্ততা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে, আজ কিছুক্ষণ আগে প্রচারিত তাঁর অপর এক প্রেস বিবৃতিতে শ্রী রাও তাঁর পরিবারের সাথে এই কোম্পানীর সম্পৃক্ততাকে একটি নিছক “প্রোপাগান্ডা” হিসেবে অভিহিত করেন। শ্রী রাওর আজকের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁর নিজস্ব ও তাঁর পরিবারের সম্পত্তিজনিত যাবতীয় তথ্য বার্ষিক সম্পত্তির বিবরণী অনুসারে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দেওয়া আছে এবং তা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত আছে। তাঁর সঙ্গে গত ৩০শে অক্টোবরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিও সংযুক্ত আছে। তিনি প্রেস ও মিডিয়াকে অনুরোধ করেছেন প্রেস বিজ্ঞপ্তি তৎসহ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া বাৎসরিক হিসেবের ওপর আলোকপাত করতে।

যদিও পুলিশী সূত্র অনুযায়ী, উক্ত কোম্পানী ও শ্রী রাওর স্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত  একাধিক আর্থিক লেনদেনের ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে তিনটি লেনদেন তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। ১) ২০১১-১৩ সালে কোম্পানী থেকে শ্রীমতী রাওর ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ; ২) ২০১২-১৩ সালে কোম্পানীকে ফেরত দেওয়া ১.৫ কোটি টাকা; ৩) শ্রীমতী রাওর কন্যাকে বেতন হিসাবে ১৪ লাখ টাকা প্রেরণ করা।

এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেড মূলত একটি নন-ব্যাঙ্কিং (ব্যাঙ্ক বহির্ভূত) আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ৫, ক্লাইভ রোতে (ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ স্মরণীতে) অবস্থিত। অক্টোবর ২০১৮ পর্যন্ত তার রেজিস্টার্ড (নিবোধযুক্ত) ঠিকানা ছিল সল্টলেকের সেক্টর – ১ র সিএ ব্লকে। রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানী থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানীটিকে ইনকর্পোরেট করা হয় ১৯৯৪ সালে। পুলিশের তদন্তের ধারা কোন দিকে বইছে? সূত্র অনুযায়ী, পুলিশ শ্রীমতী রাও দ্বারা বিপুল সংখ্যার ঋণ নেওয়ার কারণ, আর্থিক লেনদেনের চরিত্র ও এই সময়ে তাঁদের কন্যার একই কোম্পানীতে অবস্থান খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার শ্রী প্রবীণ আগরওয়াল কে আগামীকাল (শনিবার) কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানোর প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

আরও অগ্রসর হবার পূর্বে, শ্রী রাও দ্বারা জারী করা ৩০/১০/২০১৮ তে জারী করা প্রেস বিজ্ঞপ্তির কিয়দংশের ওপর মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন, ২৫ লক্ষ টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছিল এঞ্জেলা মার্কেন্টাইলস প্রাইভেট লিমিটেডের কর্নধার ও তাঁদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু শ্রী প্রবীণ আগরওয়ালের কাছ থেকে এবং অর্থ ব্যৱহৃত হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর অঞ্চলে সম্পত্তি ক্রয়ের জন্। (প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি দেওয়া হয়েছে।)

এখন এই ঘটনার ঘনঘটা? এই প্রশ্নটির উত্থাপন অত্যন্ত স্বাভাবিক যদিও যাঁরা গত সপ্তাহে কেন্দ্র ও রাজ্যের দ্বৈরথ ও তাকে ঘিরে তীব্র রাজনৈতিক চাপানউতোর প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁদের কাছে উত্তরটিও একইসাথে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। এক কথায়, বঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কদর্যতায় এটিই এক অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণতি। হয়তো এর ব্যাতিক্রমই এক অস্বাভাবিক বিস্ময় সৃষ্টি করতো। রাজনীতি এই মুহূর্তে বঙ্গে কোন গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার ভিত্তিভূমি নয় যেস্থানে নিরন্তর গবেষণা চলতে পারে, জনগণ তাঁর আপন ছন্দে নিজস্ব প্রতিনিধিকে সমর্থন দিতে পারে ও ক্রমশ গতি ও উন্নতিই হয়ে উঠতে পারে বলিষ্ঠ সমাজের একমাত্র পরিচয়। অতীব দুঃখের সাথে স্বীকার করতে হয়, বঙ্গ এক ব্যক্তিগত জমিদারীতে পরিণত হয়েছে যেখানে উন্নতি একান্তভাবেই দুর্নীতি ও নির্লজ্জ স্তুতি নির্ভর। সরকারী কর্মচারী থেকে শিক্ষক থেকে পুলিশকর্মী ও অন্যরা থাকেন প্রতিনিয়ত অবাঞ্চিত, বঞ্চিত ও শোষিত। তবুও উৎসব ও অর্থের জলাঞ্জলীর শেষ নেই। প্রশাসন থেকে ন্যায় অন্তর্হিত হয়েছিল পূর্বেই, এখন ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাও অস্তাচলে যাত্রা করেছে। শুধু বিরাজ করছে ব্যাক্তিগত লিপ্সা ও স্বৈরাচার। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই মাননীয়া শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ভবানীপুর পুলিশ ষ্টেশন থেকে দুজন দাগী অপরাধী ছড়িয়ে নিয়ে যান – ২০১৯ এ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রাবল্য – একটি বৃত্ত ক্রমশঃ সম্পূর্ণ হচ্ছে।     আজ সবই যে তাঁরই অঙ্গুলিলেহনে ঘটেছে তা বুঝতে নারদ ঠাকুরের মতো সংবাদদাতার প্রয়োজন নেই – তাঁর বিনীত, হতভাগ্য প্রজাদের।