সেক্যুলারিজম — ভারতীয় সংবিধানে ঔপনিবেশিক ধারণার প্রতীক

0
1757

 

—আবীর রায়গাঙ্গুলী

 

“যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তাঁরা ‘ধর্ম’ এবং ‘নিরপেক্ষতা’ কোনটারই অর্থ বোঝেন না”

—অটল বিহারি বাজপেয়ী

 

অবশেষে তিনি গত হলেন। গত ৫ই অগাস্ট, রাম মন্দিরের ভুমিপুজোর পুণ্য তিথিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডেথ সার্টিফিকেট লিখলেন ছোট, বড়, মাঝারি মাপের লেফট-লিবারেল ও সর্বজনবিদিত ইসলামিস্টরা। মৃত্যুকালে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন, এই কি তার শেষ মৃত্যু? কারণ ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বহুবার তার মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি, ডেথ-সার্টিফিকেট লিখেছেন এই শহুরে-নকশাল ও ইসলামিস্টরাই। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে, ৩৭০ ধারা বিলোপ হওয়ার পরে, তিন-তালাক বেআইনি ঘোষিত হওয়ার পরে, UAPA ২০১৯ আইন সংশোধিত হওয়ার পরেও তারা এই একই কথা বলেছিলেন। বারবার আগের মৃত্যুর খবরকে ভুয়ো প্রমাণ করে যিনি হয়তো শেষবারের মতো অনুরাগীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কাঁদিয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন, তিনি সেক্যুলারিজম। প্রিয় সেক্যুলারিজমের তথাকথিত মৃত্যুদিনে তারা ভারতীয়ত্বের ধারণার বিনাশ হয়েছে বলে দাবি করেছেন। যদি ধরে নিই, এই তার শেষ মৃত্যু এবং ভারতে সেক্যুলারিজম আর উঠে দাঁড়াবেন না তাহলে মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর। কিন্তু এখানেই একটা খটকা লাগে। ২০২০ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ তার ৭৪ বছরের স্বাধীনতা দিবস পালন করল, আর তার সেক্যুলারিজম-র বয়স কিনা মাত্র ৪৪ বছর, তা কি করে হয়? তাহলে কি স্বাধীনতার সময় থেকে ভারতবর্ষ একটি ‘থিওক্রেটিক’ রাষ্ট্র ছিল, অর্থাৎ যে দেশে রিলিজিয়ন রাষ্ট্রব্যাবস্থার সাথে সম্পৃক্ত?

 

সেকুলার ও ভারতীয় সংবিধান

ভারতের সংবিধান ও সেক্যুলারিজম-র বয়সের তারতম্য কি করে হয় বোঝার জন্য আমাদের একটু ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাসে চোখ দেওয়া প্রয়োজন। ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি বি আর আম্বেদকর এর নের্তৃত্বে গণপরিষদ যে সংবিধান রচনা করে তার প্রস্তাবনায় ‘সেক্যুলার’ শব্দটিই ছিলনা। নেহেরু, আম্বেদকর, রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো ভারতের তাবড় মনীষীরা এমন এক সংবিধানের প্রস্তাবনা তৈরি করলেন যা ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করল এবং ‘সেক্যুলার’ শব্দবন্ধ ছাড়াই ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট হল। কে. টি. শাহ গণপরিষদে এই প্রস্তাব পেশ করেন যে ‘সেক্যুলার’ শব্দ ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংযোজন করা হোক, প্রত্যুত্তরে গণপরিষদ সচেতন ও সর্বসম্মতভাবে এই প্রস্তাবকে খারিজ করে। এই ব্যবস্থা চলল প্রায় ২৫ বছর ধরে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিনেও এই নিদারুণ ‘টোটকা’ কারোর মাথায় আসেনি। বলাবাহুল্য, এই শব্দবন্ধ জুড়ে ভারতে দাঙ্গা আটকায়নি । তবে এটাও সত্যি যে ভারতে দাঙ্গা আটকানোর জন্য এর সংযোজন হয়নি।

জন্ম লগ্ন থেকে ভারতের সংবিধান ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি ছাড়াই ভারতের বিবিধের সংস্কৃতির ও বহুধা সম্প্রীতির ধারক ও বাহক হয়ে কাজ চালিয়ে ছিল। ভারতের বহুত্ববাদ কে টিকিয়ে রাখার জন্য সোভিয়েতের এবং তাদের ভারতীয় এজেন্ট দের চাপে পড়ে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি ধার করতে হয়নি ইউরোপ থেকে। ভারতে সেক্যুলারিজমের ‘জন্ম’ ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, আপদকালীন অবস্থায় চরম রাষ্ট্রীয় সর্বময়তার দিনে এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থতার উদ্দেশ্যে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার সময় ভাসিলিক মিত্রোখিন কমিউনিস্ট পার্টির যে সমস্ত নথি নিয়ে রাশিয়া ছাড়েন, পরবর্তীতে তা প্রকাশ করেন বই হিসেবে, যাতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ নীতির চিঠিপত্র প্রমাণ করে ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ বিষয় তাদের নাক গলানোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

 

ধর্ম কি রিলিজন?

ভারতে সেক্যুলারিজমের এই অকাল মৃত্যুতে মূর্ছা গিয়েছেন অনেকেই। তবে তার পুরোটাই ভণ্ডামি বা অমূলক নয়। এই মূর্ছা যাওয়ার একটা বড় কারণ অজ্ঞানতা ও ভাষান্তর। ক্লার্ক তৈরির ম্যাকলে-বাদী শিক্ষাব্যবস্থায়, গত ৭০ বছরে বুদ্ধিমত্তার সাথে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যে রিলিজিয়ান ও ধর্ম সমান এবং বহুত্ববাদ ও সহনশীলতা সেক্যুলারিজমের সমার্থক। আমরা খুব সহজেই অনুবাদের খাতিরে কিছু শব্দবন্ধের প্রতিবিম্ব হিসেবে অন্য কিছু শব্দবন্ধ কে হাজির করি এবং দাবি করি যে উভয় শব্দবন্ধ একে অপরের অর্থবহ। ঠিক এই কারণেই, রবীন্দ্রনাথ বিদেশী শব্দের ভাষান্তরের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁর ‘নেশন কী?’ প্রবন্ধে। তাঁর বক্তব্য ছিল, যে শব্দের ভাব আমাদের ভাষায় অনুপস্থিত, তাকে কখনোই অনুবাদ করা সম্ভব নয়।

আসলে আমরা ভুলে যাই, ভাষান্তরে ধর্মান্তর হয়। এখানে ধর্মান্তর বলতে পাঠক যদি ব্যাপটিশম বা ‘সাহাদা’ বোঝেন তাহলে ভারতবর্ষের অবস্থা করুণ, কারণ আমাদের কাছে ধর্ম হল আমাদের অন্তর্নিহিত সত্ত্বা, একান্ত কর্তব্য। এর সাথে রিলিজিয়ন বা সম্প্রদায়ের যোগ নেই। কাজেই ভাষান্তরে ধর্মান্তর হওয়ার অর্থ হলো ভাষার পরিবর্তনের সাথে একটি বিকৃত অর্থ জন্মানো। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য, কিভাবে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি ভারতীয় সংবিধানে অযাচিতভাবে অনুপ্রবেশে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে তার দিকে আলোকপাত করা এবং কেন সেক্যুলারিজমের ধারণাটি ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে অচল সেইদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ‘সর্বধর্ম সমভাব’-র ধারণা ভারতীয়ত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যার দরুন জরাথ্রুস্টিয়, ইহুদি, থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বহু ঘরছাড়া মানুষের আশ্রয় হয়েছে ভারতবর্ষ। কোনরকম পশ্চিমী রাজনৈতিক ধারণা ভারতীয়দের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মানে ভারতীয়ত্বের মূল ভিত্তিতে আক্রমণ করা এবং তার থেকেও ভয়ঙ্কর, রাজনৈতিক স্বার্থে সেক্যুলারিজম এবং সর্বধর্ম সমভাবের ধারণাকে সমান বলে দাবি করা।

 

সেক্য়ুলারিজম খ্রীষ্টানবাদের জন্য প্রয়োজন

শুরুতেই বোঝা দরকার ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির উদ্ভবের ইতিহাস। সেক্যুলারিজমের কোন ভারতীয় অনুবাদ হয় না কারণ এর ভাব ভারতবর্ষে উপস্থিত নয়। এর প্রেক্ষিত পশ্চিমী ও এর উদ্দেশ্যের সাথে ভারতের কোন যোগ নেই। ‘সেমিটিক’ রিলিজিয়ানগুলো মূলত খ্রীষ্টানবাদ যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে ও পরবর্তীতে আমেরিকা যায় এবং ইউরোপীয় জীবনধারার সাথে একাত্ম হতে শুরু করে তখন চার্চ ও রাজনৈতিক নের্তৃত্ব, অর্থাৎ ‘স্টেট’ এর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। এই ক্ষমতার লড়াইয়ের সমাধান হিসেবেই সেক্যুলারিজমের জন্ম হয়। যার মূল বক্তব্য ছিল মানুষের ‘রিলিজিয়াস’ জীবন (যার বেশিরভাগটাই চার্চের তত্ত্বাবধানে বাইবেলীয় ইহজাগতিক নীতি অনুসরণ) নিয়ন্ত্রণ করবে চার্চ এবং মানুষের রাজনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে স্টেট। অর্থাৎ মানুষের রাজনৈতিক ও রিলিজিয়াস জীবনের যে বিভাজন তার ব্যবহারিক নামই হলো সেক্যুলারিজম।

পরবর্তীতে ম্যাকিয়াভেলি তাঁর সময়ে সেক্যুলারিজমের মূলগত ধারণা পুনরসংজ্ঞায়িত করেন। এরইমধ্যে, মানুষের রাজনৈতিক জীবন আর স্টেটের একচ্ছত্র আধিপত্যে ছিলনা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ পশ্চিমী জীবনচর্যার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরকম সময়ে, ম্যাকিয়াভেলি রাজনৈতিক জীবনকে ইহজাগতিক এবং রিলিজিয়াস জীবনকে অতিজাগতিক বা অধিবিদ্যাশ্রয়ী হওয়ার কারণে, বিভাজিত করার কথা বলেন। ম্যাকিয়াভেলির ধারণায়, সেকুলারিজম হল একটি ইহজাগতিক চিন্তা প্রণালী যার নির্মাণে তিনি ‘মরালিটি’-র ধারণাকে বাদ দিলেন কারণ তার উৎস, অন্ততঃ পশ্চিমে, রিলিজিয়ন। সেক্যুলারিজম হয়ে দাঁড়ালো এক কঠিন, কঠোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক পেশীসুলভ বাস্তববাদ যার ভিত্তি ছিল বস্তুবাদ। পশ্চিমী সমাজের বস্তুবাদের বাড়বাড়ন্তের সাথে এই সেক্যুলারিজমের ধারণা খুব সহজভাবে মিশে যেতে পেরেছিল। যার অর্থ দাঁড়ালো যা-ই  ইহজাগতিক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা-ই বস্তুবাদী  এবং তাই সেক্যুলার।

মোটের উপর এই ধারণাকে সামনে রেখেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমক্ষমতায়নের সাথে সাথে পশ্চিমী সমাজে সেক্যুলারিজমের ধারণা সর্বজনগ্রাহ্য হয়। তবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সেক্যুলারিজম বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। ফ্রান্সে যেমন রিলিজিয়ান (খ্রীষ্টানবাদ) নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়, অথচ ইংল্যান্ডের ব্যবস্থায় স্টেট-রিলিজিয়ন হিসেবে খ্রীষ্টানবাদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলির কোনোটিই সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর রিলিজিয়ান চর্চার অধিকার কেড়ে নেয় না আবার চাপিয়ে দেয়না, প্রকৃতপক্ষে রিলিজিয়ন যেখানে ব্যক্তিগত পছন্দমাত্র, সেখানে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর রিলিজিয়ন-ভিত্তিক বিভাজনটাই অসম্ভব। পশ্চিমী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সেক্যুলারিজমকে বামপন্থী কায়দায় পুনরসংজ্ঞায়িত করেছে। সেক্যুলারিজমের নামে মানুষ ধর্ম-চর্চার অধিকার হারিয়েছে। তিব্বতের প্রাচীন বৌদ্ধক্ষেত্র গুলো পার্টি অফিসে পরিণত হয়েছে, চীনের দাও বা কনফুসীয় মতবাদগুলোও বামপন্থার রোষে পড়েছে। তবে এ বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাদের সাম্যের নীতি বজায় রেখেছে। উইঘুর প্রদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার অনেকেরই জানা। শুধুমাত্র নাম ‘মহম্মদ’ হওয়ার ‘অপরাধে’ ৭ বছরের শিশুকে চীনে গ্রেপ্তার হতে হয়।

 

ভারতবর্ষে সেক্যুলারিজম

ভারতবর্ষে সেক্যুলারিজমের চরিত্র পশ্চিম বা চীনের থেকে আলাদা। খাতায়-কলমে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের থেকে রাষ্ট্রের সমদুরত্বের কথা বলা সেক্যুলারিজম অধিকাংশ সময়ই হিন্দুদের থেকে দুরত্ব এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি নৈকট্য পালন করেছে। এই নীতি অনুসরণ করেই ভারতবর্ষের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং বলেছিলেন ভারতের সম্পদের উপর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সর্বাগ্রে। যে দেশ সত্যি সত্যি সেকুলার হবে তার চোখে ব্যক্তির সাম্প্রদায়িকসত্ত্বা অমূলক হওয়ার কথা। কাজেই সেই ভিত্তিতে সংখ্যালঘু/গুরু বিচার করার প্রশ্নই ওঠে না। ভারতে সংখ্যালঘু নির্ধারণের মানদণ্ড ন্যায় ও যুক্তির তোয়াক্কা করেনা। ভারতবর্ষে ১ শতাংশেরও কম পার্সীরা সংখ্যালঘু নয় অথচ কুড়ি শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। শিখ, খ্রিষ্টান, জৈনরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্বেও, সংখ্যালঘু কমিশন এবং সংখ্যালঘু রাজনীতি সবসময়ই সংখ্যালঘুদের মধ্যে যারা সংখ্যাগুরু অর্থাৎ মুসলমানদেরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। আরও মজার ব্যাপার হল কোন রাজ্যের সরকারি চাকরি এবং অন্যান্য সমস্ত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমগ্রদেশের বিচারে যারা সংখ্যালঘু কোন বিশেষ রাজ্যের ক্ষেত্রেও সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। সোজা  বাংলায়, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারি চাকরিতেই মুসলমান বা খ্রীষ্টান রাই সংখ্যালঘুর সুবিধা পাবেন। জম্মু-কাশ্মীর বা মিজোরাম এর মত রাজ্য, যেখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু সেখানেও হিন্দুরা কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা পাবে না। অথচ, ভাষাভিত্তিক সংখ্যাগুরু/লঘু নির্ধারিত হয় ওই বিশেষ রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে অর্থাৎ অবাঙালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গে যে সুযোগ-সুবিধা পায়, বিহারে বা গুজরাটে অ-বিহারি বা অ-গুজরাটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই সুযোগ-সুবিধা পাবে।

গত ৭০ বছরে কংগ্রেসের রাজনীতি এবং সেক্যুলারিজমের দয়ায় হিন্দুরা ভারতবর্ষের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন। প্রকাশ্যে ‘জয় শ্রী রাম’ বলা অপরাধ, নিজেকে হিন্দু বলে অভিহিত করা মানে সেক্যুলারিজম কে ‘আঘাত’ করা এবং পাঠক জানেন রাজনীতির উত্থান-পতনে বারবার মার খেতে হয়েছে হিন্দুদের, মূলত দলিত ও নারীদের। তবে, সেই বিবরণে না গিয়ে এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, যে কেন ভারতবর্ষীয় সমাজে এবং সংবিধানে ‘সেকুলারিজম’ শব্দটি বেমানান। আরো ভয়ঙ্কর হলো, সেক্যুলারিজমকে ‘সর্বধর্ম সমভাব’-এর সনাতনী ধারণার সাথে মিলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি।

আগেই বলেছি সেক্যুলারিজম একটি পশ্চিমী ধারণা এবং পশ্চিমী সমাজের দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ভোগবাদী, বাইনারি, নৈর্ব্যক্তিক ও বস্তুবাদী সমাজের ভিত্তি হলো পশ্চিমী সেক্যুলারিজম। এগুলো ভালো কি মন্দ সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে এগুলো ভারতবর্ষের জীবনদর্শন নয়। ভারতবর্ষ দ্বৈত-অদ্বৈত, বস্তুবাদ-ভাববাদ, নরম-চরম, আশাবাদ-নৈরাস্যবাদ; এই সমস্ত কিছুর বিবাদ এবং সমন্বয় অনুসন্ধানের দেশ। আস্তিক-নাস্তিক, নর-কিন্নর-বানর, গৌর-কৃষ্ণ, প্রত্যেকের দেশ ভারতবর্ষ। তবে, এই আপাত বৈপরীত্বের অনেক উর্ধে গিয়ে ভারতভূমি ধর্মের দেশ, একটি ধর্ম-সাপেক্ষ দেশ। এই ধর্মের ভিত্তি অটল কর্তব্যবোধ, আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে মুক্তির সংকল্প। শৈশবে ছাত্র ধর্ম, যৌবনে গার্হস্থ্য ধর্ম,  নাগরিকের প্রজাধর্ম, রাজার রাজধর্ম, পণ্ডিতের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, পিতার পিতৃ-ধর্ম সন্তানের সন্তানধর্ম আর সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে মনুষ্যধর্ম। ধর্মের অস্তিত্ব কে অস্বীকার করে ভারতীয় সমাজের অস্তিত্ব কল্পনা অসম্ভব। আর সেই ভারতবর্ষকেই ধর্মের বিষয়ে নিরপেক্ষ করে তোলার ষড়যন্ত্র ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। যে সমাজ থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয় সেই সমাজ ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রব্যবস্থা কি করে ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হতে পারে বা ধর্মের বিষয়ে তারা কি করে নিরপেক্ষ হতে পারে?

ভারতের সনাতন ধর্ম এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া সহস্রধারা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে বসুধৈব কুটুম্বকম যে আপ্তবাক্য কে সামনে রেখে আমরা পৃথিবীর জন্য নিজের দ্বার খুলে দিয়েছিলাম, তার ভিত্তি ছিল ‘সর্বধর্ম সমভাব’, ‘সেকুলারিজম’ নয়। তাই সেক্যুলারিজমের ভারতীয় তরজমা ধর্মনিরপেক্ষতা করে কংগ্রেস ও তার সহকারীরা সমাজকে ধর্মের থেকে নিরপেক্ষ হতে উৎসাহ দিয়েছে। যার ভারতীয় অনুবাদ হতে পারতো ‘পন্থ-নিরপেক্ষতা’ তা না করে কার স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়েছে? সেক্যুলারিজমের নামে ধর্মবোধ কে ভুলিয়ে দেওয়া এবং সেমিটিক রিলিজিয়ান এর ধারণার সাথে ভারতের ধর্মকে গুলিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক স্বার্থে শুরু করেছিল, বর্তমান প্রেক্ষিতে সেই ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ র ধারক ও বাহক হয়েছে বামপন্থী ও ইসলামিস্টরা।

এরই প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্টে ‘সেক্যুলার’ ও ‘সোশ্যালিস্ট’ শব্দবন্ধ সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য মামলা হয়েছে। যাকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা আক্রমণ করেছেন ভারতের সংবিধানের ‘মূল কাঠামোর’ ওপর আক্রমণ বলে। ‘রাজনীতি’টা একই রয়েছে—সত্যের অপলাপ করে সেক্যুলারিজমের সাথে সর্ব ধর্ম সমাভব ও বহুত্ববাদ কে অভিন্ন বলে দাবি করার রাজনীতি। তবে ভুললে চলবে না, আদি অনন্তকাল ধরে ভারতবর্ষের ধর্মই হলো সকলের প্রতি সম্মান এবং নিজের প্রতি সম্ভ্রম। ধর্ম বিষয়ে ‘নিরপেক্ষতা’ কেবল অপ্রয়োজনীয় বা অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, আত্মঘাতীও।

 

লেখক এক বিশিষ্ট কলেজের শিক্ষক। মতামত লেখকের। বঙ্গদেশ পত্রিকা তাঁর মতামতের জন্য দায়ী নয়।