বিধাতার হাতে লেখা গান – ১২

অভীক মুখোপাধ্যায়

(একাদশ পর্বের পর)

পর্ব – ১২

অ্যাটম বোমা। সভ্যতার বিনাশের চাবিকাঠি, যার একবার ব্যবহারেই বিশ্বযুদ্ধ অবধি থেমে যেতে বাধ্য হল।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের বীজ কিন্তু হিটলার বপন করেনি, ইউরোপ থেকে বহু দূরে, আমাদের এশিয়াতে বসেই বোনা হয়েছিল এর বীজ। তখন জাপানের সৈন্যরা চিনে ঢুকে ত্রাস সৃষ্টি করছিল। আর একই সময়ে ওদিকে জার্মান সায়েন্টিস্ট অটোহান নিজের ছাত্র স্ট্রসম্যানকে নিয়ে ইউরেনিয়ামের ওপর নিউট্রন চার্জ করে চলেছিলেন। এভাবে পরীক্ষা চালাতে – চালাতে একদিন ইউরেনিয়াম নিজের ধর্ম বদলে বেরিয়াম হয়ে গেল। দুই বিজ্ঞানীর তো দেখেই চক্ষু চড়কগাছ! এ কী হল!এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি লেডি লিজা বললেন, এ তো ফিশন। নেচার পত্রিকা এই গবেষণাটাকে ছেপেও দিল। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের চোখে পড়ল সেই জিনিস। সু্যোগের সন্ধানে থাকা মানুষগুলো ভাবল, এ যে যুদ্ধের মহা-আয়ূধ হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য এই গোটা থিওরির পেছনে আরেক জার্মান ইহুদির থিওরি ছিল — E=mc^2 -এর জনক মাননীয় অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।

হিটলার যখন ইহুদিদের মারছিল, তাড়াচ্ছিল, তখন অটোহান লিজাকে নিজের হিরের আংটিটা খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখান থেকে পালাও! যদি পথে কোথাও নাৎসি বাহিনীর হাতে পড়ো, তখন এই আংটিটা ঘুষ দিয়ে পালানোর চেষ্টা কোরো।’

লিজা পালিয়ে গেলেন সুইডেনে। চিঠিচাপাটি দিতেন। খবর লিক হতো। হোয়াইট হাউজ ভাবছিল, জার্মানি তলে – তলে অ্যাটম বোমা বানাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, বানাবে কোথথেকে? জার্মানদের মেধার ভাণ্ডার ইহুদিরাই তো পালাচ্ছিল জার্মানি ছেড়ে।

যখন জাপান আমেরিকার পার্ল হার্বারে বম্বিং করল, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে একটা টপ সিক্রেট প্রোজেক্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন –ম্যানহাটন প্রোজেক্ট।

সিক্রেট প্রোজেক্ট, কিন্তু কোনো গোপন স্থান নির্ধারিত হয়নি। নিউইয়র্কের ঘিঞ্জি এলাকায় ম্যানহাটনের ব্রডওয়েতে, একটা সুবিশাল বিল্ডিংয়ের আঠারো তলায় চলছিল বোমা বানানোর কাজ। কাজ তো নয়, শিল্প। এই মহা গবেষণার জন্য সারা পৃথিবী থেকে বেছে নেওয়া হল পাঁচ লক্ষ বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য কর্মীদের। তাদের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হলেন জেনারেল রিচার্ড গ্রোবস। হাতের কাছে গুগল করার সুবিধে থাকলে লোকটার নাড়িনক্ষত্র একটু ঘেঁটে দেখতেই পারেন। ইনি পেন্টাগন বানিয়েছিলেন। তা যাই হোক, রিচার্ড গ্রোবস মাত্র দুমাসের মধ্যে বারোশো টন ইউরেনিয়াম জোগাড় করে ফেললেন। ফ্যাক্টরি বানানো হয়ে গেল। সায়েন্টিস্ট রিক্রুটমেন্টের কাক শেষ। তখন আর খালি একটাই স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। একখানা অ্যাটম বম্ব। তখনও পর্যন্ত ওটা সায়েন্স ফিকশন।

আরেকটা সমস্যাও হচ্ছিল। কর্ম সংস্কৃতির ফারাক থেকে দ্বন্দ্ব বাঁধছিল। বিজ্ঞানীরা কেউই ফৌজের লোক নন যে আর্মির মতো সময়নিষ্ঠ হয়ে কাজ করবেন। বিজ্ঞানীদের কাছে জেনারেল এক অন্য গ্রহের জীবের মতো লাগছিলেন। জেনারেলও খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। আর তখনই তাঁর চোখ পড়ল এক বিজ্ঞানীর ওপরে — ওপেনহাইমার। বেশ সিস্টেমেটিক, পাংচুয়াল একটা লোক। সবই খাপে খাপ হচ্ছিল, কিন্তু এইসব কিছুকে ছাপিয়ে গেল ওপেনহাইমারের সঙ্গে জুড়ে থাকা একটা তথ্য — ভদ্রলোকের পরিবার ছিল কট্টর কমিউনিস্ট।
কিন্তু এই কমিউনিস্ট পরিবারের সন্তান হওয়াটাও ওপেনহাইমারের চয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল না। আর এখানেই আমেরিকার মহত্ত্ব, এটাই তার মহাশক্তি হয়ে ওঠার এক ও অদ্বিতীয় কারণ। জার্মান হোক, ইহুদি হোক, কমিউনিস্ট হোক, রাশিয়ান হোক, জাপানি হোক, চিনে হোক কিংনা শত্রু হোক, যোগ্য হলে তাকে দিয়ে কাজটা উদ্ধার করানোতে আমেরিকার জুড়ি মেলা ভার।

ওপেনহাইমার বললেন — ‘জেনারেল, আমি অ্যাটম বম্ব বানিয়ে দেব। কিন্তু যে জিনিস চাইব, যে লোককে লাগবে আর যত টাকা দরকার পড়বে তা বলামাত্র এনে দিতে হবে।’

জেনারেলও রাজি হলেন –‘যা চাইবে, যাকে চাইবে, আর যত চাইবে স-ব পাবে।’

ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ধীরে ধীরে নিজের করাল রূপ ধারণ করছিল। জার্মানি সমগ্র ইউরোপ দখল করে নিচ্ছিল ক্রমশঃ। জাপান তখন সদ্য ফিলিপিন্স দখল করে যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে ডেড মার্চ করাচ্ছে। মানে, হাঁটানো হবে, যে থেমে যাবে, পড়ে যাবে, হাঁটতে পারবে না, তার প্রাণ যাবে। প্রলয় চলছিল। আর কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই একটা প্রলয়কে থামাতে লাগে আরেকটা মহাপ্রলয়।

ম্যানহাটনের ওই ঘিঞ্জি এলাকা থেকে সরে একেবারে নিরালায়, লস আলামোসের অরণ্যের মধ্যে আণবিক বোমা বানানোর ল্যাবরেটরি খুলল আমেরিকা। কয়েক হাজার সায়েন্টিস্টকে সেই গুপ্ত-বনে নিয়ে গিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কাজে নিয়োগ করা হল। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। সত্যি বলতে গেলে, ম্যাপের বাইরেকার একটা জায়গা। বোমার কোডনেম ছিল ‘গ্যাজেট’। ওখানে নিয়োগ করার সময় কোথায়, কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কিছুই বলা হতো না।

১৯৪৫ সাল। বোমার একটা প্রোটোটাইপ রেডি হয়ে গেলেও সঠিক মাত্রায় ইউরেনিয়াম (ইউ-২৩৫) মিলছিল না। প্লুটোনিয়ামের দশাও তথৈবচ। হিটলারের অবনতি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। রেড আর্মি জার্মানির দিকে এগোচ্ছিল। ইত্যবসরে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের জীবনাবসান ঘটল।

তালেগোলে মিস্টার প্রেসিডেন্টের পদে বসলেন হ্যারি ট্রুম্যান। ভদ্রলোক আবার জানতেনই না অ্যাটম বম্ব জিনিসটা খায় না মাথায় দেয়। আসলে আণবিক বোমা নিয়ে যে চর্চা চলছিল, তা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নিজের ভাইস – প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকেও বলেননি। আর ট্রুম্যানও রুজভেল্টের ব্যাপার স্যাপার বোঝার চেষ্টা করতেন না, মদ আর থ্রিল এই দুটো নিয়েই মেতে থাকতেন।

বুঝতেই পারছেন যে, একজন অজ্ঞ এবং বেপরোয়া ব্যক্তির হাতে অ্যাটম বোমার দায়িত্ব এসে পড়তে চলেছিল, যার দ্বারা একটাই কাজ হতে পারত — মানব সভ্যতার বিনাশ!

(ক্রমশঃ)