বিধাতার হাতে লেখা গান – ১৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ষোড়শ পর্বের পর)

পর্ব – ১৭

আমরা হাঁড়িতে জল গরম করতে বসাই। মাঝেমধ্যে সেই হাঁড়ি এমন তেতে যায় যে তাকে আঁচ থেকে আর নামানোই যায় না। কেনেডি যখন সংসদে পা-রাখলেন, তখন শীতযুদ্ধের হাঁড়ি চড়ছিল। রাষ্ট্রপতি হতে – হতে সেই হাঁড়িটাই এত উত্তপ্ত হয়ে উঠল যে নামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।

সাম্যবাদ অনেকটা করোনার মতো৷ সহজে ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটা আদর্শ একটা চিন্তাধারা, যাকে ছড়াতে গেলে কয়েকটা মাত্র মাথা, ক’খানা চটি চটি বইপত্তর, কাগজের লিফলেট হলেই চলে। আর এর ঠিক বিপরীতে পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটাতে একটাই জিনিস অনেক বড় পরিমাণে দরকার — অর্থ। গাদা গাদা টাকা। চিন্তাধারার কোনো লিমিট নেই, কিন্তু অর্থ যে সীমিতই।

হিটলার বা স্তালিন বিশ্বের চোখে যাই হন না কেন, নিজের নিজের দেশকে কিন্তু সমৃদ্ধই করছিলেন। ইতালির সব মাফিয়া গ্যাংস্টার তখন ফাটকে। মুসোলিনির পতন হতে – না – হতেই চারিদিকে হাহাকার শুরু হল। আরম্ভ হয়ে লুটতরাজ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কমরেডরা যখন গণসঙ্গীত গাইতে – গাইতে মার্চ করত, তখন জনগণ তাদের মধ্যেই আশার আলো দেখতে পেল। কমিউনিস্ট পার্টিই ইতালির সবথেকে বড় দল হিসেবে উঠে আসছিল। স্তালিনের এলাকার বাইরেও ফুটে উঠছিল লাল ফুল।

এটাই সাম্যবাদের শক্তি। একটা টাকাও খরচ করার দরকার ছিল না, অথচ যে কোনো দেশের মানুষের চিন্তাধারায় ঢুকে পড়ে সেখানে রাজত্ব করো।

আমেরিকা প্রমাদ গণল। কোল্ড ওয়ারের কমান্ড দিল জেনারেল মার্শালকে। তৈরি হল ‘মার্শাল প্ল্যান’।

প্ল্যান বিরাট জটিল কিছু নয় কো। ইউরোপকে কোটি – অর্বূদ ডলার পাঠিয়ে আবার খাড়া করো, তারপর সেখানেই নিজেদের মাল বেচে সেই টাকা উসুল করো। একবার কোড়া নোটের নেশা লেগে গেলে সাম্যবাদের তেরি – কি – মেরি করে ছেড়ে দেওয়া যাবে। কে আর সাম্যবাদের নামে নিজের সম্পত্তি সরকারের হাতে তুলে দিতে চাইবে?

আমেরিকা ইউরোপে এই পরিকল্পনা রূপায়নের সময়ে নিজেকে দাতাকর্ণ রূপে মেলে ধরল। তারা শুধু সোভিয়েত ক্ষেত্রে থাকা ইউরোপকেই নয়, টাকা দেওয়ার কথা সরাসরি সোভিয়েতকেও বলল। স্তালিন আবার আরেক জিনিস, তিনি ব্যাপারটাকে সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্য নিজের বিদেশমন্ত্রীকে প্যারিসে পাঠালেন। গুপ্তচরদের সক্রিয় করে তুললেন দিকে – দিকে। সোভিয়েতের গুপ্তচরদের তখন এত ক্ষমতা যে বিশ্বের যে কোনো বড় দেশের রাষ্ট্রনায়কদের চেম্বার থেকে তারা খবর বের করে আনতে পারে। স্তালিন সব তথ্য পেয়ে গেলেন। বুঝে গেলেন যে, আমেরিকা কীভাবে সবাইকে বোকা বানাতে চাইছে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের বিদেশমন্ত্রীকে ফিরে আসার হুকুম দিলেন। পূর্ব ইউরোপের সব দেশকে হুশিয়ারি দেওয়া হল — আমেরিকার থেকে একটা পয়সা নিলে আর রক্ষে থাকবে না।

বিশেষত চেকোস্লোভাকিয়া দারুণ ভাবে বকুনি খেল। সেখানকার কমিউনিস্টরাও আমেরিকার সমর্থন করছিল। স্তালিন তাদের মস্কোতে ডেকে পাঠালেন। চেক বিদেশমন্ত্রী মাজারিক স্তালিনের কাছ থেকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন–‘স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হয়ে স্তালিনের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম, গোলাম হয়ে ফিরছি।’

মাজারিকের বাবা স্বাধীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। স্বাধীনচেতনা ছিল মাজারিকের রক্তে। সম্ভবত এই অপমান সহ্য করতে পারেননি। বাথরুমের জানলা দিয়ে নীচে পড়ে তাঁর অপমৃত্যু হয়। সবাই বলে, মাজারিক জানলা দিয়ে নীচে লাফ মেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। চেকোস্লোভাকিয়াতে লাল পতাকা উড়ছিল। কমিউনিস্ট একনায়করা বলছিল, লাল সেলাম… লাল সেলাম।

গ্রিসে আমেরিকা জাহাজ পাঠাল। জাহাজে গেল পাল – পাল খচ্চর। গ্রিসের চাষীদের সে কী আনন্দ! মিসৌরির খচ্চর, তাগড়াই চেহারা, বিনামূল্যে পেলে কে না খুশি হবে? আর ধরাবাঁধা নেই, যটা লাগে নাও। এভাবেই কৃষির সরঞ্জাম, উপকরণ পাঠিয়ে ইউরোপকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছিল। যাদের কাছে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার মতো অন্ন ছিল ন, তাদের কাছে আমেরিকানদের পাঠানো সাহায্য ছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো। সমগ্র গ্রিস থেকে সমস্ত কৃষক সমস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল — লং লিভ আমেরিকা!

আমেরিকার গ্রিস-বিজয় ছিল কোল্ড ওয়ারের জমানায় স্তালিনের প্রথম পরাজয়। এর পরই স্তালিন দুটো উইং বানালেন — কমিনফর্ম এবং কমিকন। প্রথমটার কাজ ছিল সারা বিশ্ব জিড়ে সাম্যবাদী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, আর দ্বিতীয়টার কাজ ছিল টাকা পাঠানো। সোভিয়েত এবার চেকাস্লোভাকিয়ার চাষীদের সাহায্য পাঠাতে শুরু করল। স্লোগানে ফলাফল মিল আশানুরূপ – সোভিয়েতের জয় হোক।

অর্ধেক বিশ্ব জুড়ে আমেরিকার, আর আদ্ধেকটা জুড়ে সোভিয়েতের জয় জয়কার শুরু হল। দুটো দেশই বিশ্বকে শাসন করার জন্য নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির খেলা শুরু করে দিয়েছিল।

(ক্রমশঃ)