বিধাতার হাতে লেখা গান – ২২

অভীক মুখোপাধ্যায়

(একবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২২

হ্যাঁ পাঠক, একেবারে ঠিক ধরেছেন। ভারতের কথাই বলছি। ভারত। আমাদের ভারতের জন্মও হয়েছে তখন। সদ্য – সদ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, শীতযুদ্ধ, সাম্যবাদ আর পুঁজিবাদের যুদ্ধ — এসবের মধ্যে অধিকাংশই খেয়ালই করলেন না যে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনসংখ্যা সম্পন্ন একটি স্বাধীন দেশ জন্ম নিল। আর এখানেই কেনেডি সবার থেকে আলাদা। তিনি ছিলেন একজন ল্যাটারাল থিংকার। তাঁর চিন্তা, তাঁর ভাবনা, তাঁর মনন আমেরিকার তাবড় তাবড় নেতাদের থেকেও অনেক বেশি অগ্রণী ছিল। সে যে কোনো কারণেই হোক না কেন, কেনেডি একদম ভিন্ন গোত্রের ছিলেন।

কেনেডি কিন্তু ভারতের আবির্ভাবের সব খবরাখবর রেখেছিলেন। তিনি একটা থিওরি নিয়ে ভাবছিলেন — ‘সাম্যবাদের প্রসারে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই যদি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলা যায়, তাহলে সাম্যবাদ আপনা আপনি নিপাত যাবে।’

কেনেডির মৃত্যুর পরে ষাট বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। দেখুন, কত সত্যি ছিল তাঁর থিওরি। কমিউনিস্ট সোভিয়েত মুছে গেছে, রয়ে গেছে গণতন্ত্র।

১৯৫১ সালে জন এফ কেনেডি নিজের ছোট ভাই ববি কেনেডিকে নিয়ে এশিয়া ভ্রমণে বেরোলেন। জনের বক্তব্য ছিল, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েতনাম এগুলোর মধ্যে প্রচুর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং সেই সম্পর্ককে মজবুত করে তোলা খুব জরুরি বিষয়, কারণ ভারত হল বিশ্বের সবথেকে বড় গণতন্ত্র।

জন এফ কেনেডি এইসব কথা কখন বলেছেন?

যখন তিনি একজন সাংসদ মাত্র। তিনি কোনো সরকারি সফরে ভারতে আসেননি। তখনো তো আর পণ্ডিত নেহরু জানতেনই না যে এই যুবকই আগামীদিনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবেন।

‘জন এফ কেনেডি:অ্যান আনফিনিশড লাইফ ১৯১৭-১৯৬৩’ বইতে রবার্ট ডালেক এই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন। সরলীকরণ করা যাক—

নেহরু কেনেডির সঙ্গে খুব একটা ভালো করে কথা বলছিলেন না। হয়তো ইচ্ছে করছিল না। কিংবা বোর লাগছিল। জন আর ববির বোন প্যাট্রিসিয়াও সঙ্গেই ছিলেন। বেশ সুন্দরী। নেহরু তবু তাঁর মুখপানে চেয়ে দু –একটা কথা বলছিলেন। বাকি সময়টা তিনি ছাদের দিকে তাকিয়ে বেশ গুরুগম্ভীর ভাবে মতামত দিয়ে চলেছিলেন।

নেহরু বলছিলেন — ‘ফ্রান্স শুধু শুধুই ফ্রেঞ্চ ইন্ডোচায়নার (বর্তমান ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বোডিয়া) মোহে পড়ে আছে। এসব কলোনিয়াল প্র্যাকটিস আর চলবে না। আর আমেরিকা ফ্রান্সকে তোল্লাই দিয়ে চলেছে। আপনারা এমন একটা ভাঁড়ে টাকা রাখছেন, যার নীচেটাতে ফুটো হয়ে গেছে। জানেন, ভিয়েতনামে সাম্যবাদ কেন ছড়াচ্ছে? কারণ সাম্যবাদ ভিয়েতনামকে এমন কিছু দিচ্ছে, যার জন্যে ভিয়েতনামবাসীরা নিজেদের জান দিয়ে দিতেও কসুর করে না। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলো বছরের পর বছর ধরে ওদের লুট করে গেছে। অর্থ দিয়ে ওদের মন জয় করতে পারবেন না, ভালোবাসা চাই।’

নেহরুর এই গুরু-জ্ঞান তখন জনের পছন্দ হয়নি। নীরস মনে হয়েছিল। কিন্তু যদি কেনেডি নিহত না –হতেন? তাহলেও কি তিনি নেহরুর দেওয়া এই জ্ঞানবাক্যগুলিকে অপছন্দই করে যেতেন?

হয়তো নয়। কারণ পরবর্তীকালে ভিয়েতনাম আমেরিকার জন্যে একটা ভাঙা ভাঁড়েই পরিণত হয়েছিল। তবে এই যে পণ্ডিত নেহরু গুরু হয়ে অনভিজ্ঞ কেনেডিকে জ্ঞান দান করেছিলেন, তাঁর বদলে গুরুদক্ষিণাও দিয়েছিলেন কেনেডি। এই ঘটনার এক দশক পরে। ভারত – চিন যুদ্ধের সময়ে। তখনো পণ্ডিত নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন। আর আমেরিকার রাষ্ট্রপতির হটসীটে মিস্টার জন এফ কেনেডি। সে কথাতেও আসব।

পাপা জো কেনেডির কথা আগেই লিখেছি। গরিবের ব্যাপারে তাঁর কোনো কালেই কোনো ধরণের আগ্রহ ছিল না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই গরিব দেশের ব্যাপারেও রুচি দেখা যেত না। কেনেডি এশিয়া ভ্রমণ করে আমেরিকাতে ফিরতেই পাপা জো বাঁকা বাঁকা ভাবে শুনিয়ে দিলেন — ‘এবার মনে হচ্ছে উত্তর মেরুর এস্কিমো আর অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইনদের সঙ্গেও আমেরিকার সুসম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।’

কিন্তু এধরণের কটাক্ষ নিরর্থক ছিল। কেনেডি এশিয়া তথা ভারতে আসার আগেই কিন্তু ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশ ঘুরে এসেছিলেন। আস্তে – আস্তে জনের রাজনৈতিক দৃষ্টিশক্তি আমেরিকার রাজনৈতিক দূরদর্শীতার থেকেও বড় পরিধির হয়ে উঠছিল। আমেরিকার স্পিডোমিটার তখন সোভিয়েতের দোরগোড়ায় আটকে গেছে, আর কেনেডি এগিয়েই চলেছিলেন, এগিয়েই চলেছিলেন। খুব অল্প বয়েস থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে জন যে পরিপক্কতা লাভ করেছিলেন, তা তাঁকে একটা কথাই বলছিল — আগামীতে ভারতের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইউরোপের দেশগুলো ঘুরে আসার পরেই জন রেডিওতে একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন—‘সোভিয়েত্র শুধু ফাঁকা আওয়াজ। আমেরিকা না অন্য কোনো ওয়েস্টার্ন ইউরোপিয়ান কান্ট্রিতে আক্রমণ করার মতো ভুল তারা করবে না। বরং এখন উঠতি দেশগুলোর দিকে নজর রাখা উচিৎ, যাতে তাদের ওপরে সোভিয়েতের প্রভাব না-পড়ে।’

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জন এফ কেনেডির এই চিন্তাধারা পরবর্তীকালে সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। ভারত সোভিয়েতের সাম্যবাদী চিন্তায় যে শুধুমাত্র প্রভাবিত হল তা-ই নয়, ভারতের দক্ষিণে সোভিয়েতের প্রোপাগান্ডা সাহিত্য হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের বাংলাতেই কত রাশিয়ান বইয়ের অনুবাদ হয়েছিল! নেহরু নিজে সোভিয়েতের কুজ্ঝটিকায় ভালোই ফেঁসেছিলেন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মানতেই হবে যে সোভিয়েতও কিন্তু দরকারে সাহায্যের হাতে বাড়িয়ে দিত। ভারত – রাশিয়া ভাই-ভাই। ভারতের হিন্দি সিনেমা তখন রাশিয়ান মহলে জনপ্রিয়। রাশিয়াতে বড় বড় তারকাদের নিয়মিত শো হতো। তাঁদের রাশিয়ান ভক্তদের সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম ছিল না। আর এসবের মাঝেই ভারতের অলিন্দ – নিলয়ে ঢুকে পড়ছিল সোভিয়েতের গুপ্তচর সংস্থা। তাদের আধিপত্যও দীর্ঘদিন ধরে জারি ছিল। আর এসব কিছুর একটাই কারণ, আমেরিকা ভারতকে নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। অবশ্য পরে সেটা করলেন জন এফ কেনেডি।

এশিয়া সফরটা জনের ক্ষেত্রে প্রাপ্তির ভাঁড়ার ছিল। জনের ভাই ববি, তাঁর থেকে প্রায় আট বছরের ছোট ছিলেন। এশিয়া সফরে আসার পর দুই ভাইয়ের মধ্যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক দানা বাঁধে। এটাই পরবর্তীকালে জনের কাজে লেগেছিল। নিজের সেনাপতি পেয়েছিলেন তিনি। ববি জনের ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরতেন।

নিন্দুকে বলে, জন এফ কেনেডির হত্যায় এই ববি কেনেডির একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। বলা মুশকিল। তবে জনের হত্যার বহু বছর পরে তাঁর ছেলে একবার বলেছিলেন — ‘ববি সব জানতেন।’

(ক্রমশঃ)