বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৩

অভীক মুখোপাধ্যায়

(দ্বাবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৩

একনায়কের মৃত্যু ঘটলে একনায়কতন্ত্রও তার সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যু হলো শেষ হয়ে গেল স্তালিনবাদ

স্তালিন সোভিয়েত রাশিয়াকে একটি মহাশক্তিতে পরিণত করে গিয়েছিলেন কিন্তু তার পরে কী হলো? কোনো উত্তরাধিকারী নেই, কোনো গণতন্ত্র নেই, কোন রাষ্ট্রপ্রধান নেই নিকিতা ক্রুশ্চেভের এর মতো লোক নেতা হয়ে উঠে এসেই সোভিয়েত থেকে স্তালিনের নাম মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন

ক্রুশ্চেভ একটা ভাষণ দিলেন — ‘স্তালিন হাজার হাজার সাম্যবাদীকে হত্যা করেছেন স্তালিন একজন আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি ছিলেন তিনি নিজের বিরোধীদের শেষ রাখতেন না বেছে বেছে মেরে ফেলতেন এধরণের ব্যক্তি এই দেশের নামে কলঙ্ক!’

একটি মিটিং চলাকালীন ক্রুশ্চেভ এই ভাষণ দেন। বলা হয়, এই ভাষণ শোনার পরে বেশ কিছু মানুষ ওই মিটিং চলাকালীন অবস্থাতেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান স্তালিনের এক অদ্ভুত ইমেজ ছিল। তাঁর সেই সুন্দর ছবি নষ্ট হয়ে যাওয়াটাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। দেশের মানুষ তাঁকে নিজেদের অদ্বিতীয় অভিভাবকের মতো সম্মান করতেন এই ভাষণ শোনার পরে তারা কেঁদে ফেলেছিলেন যাই হোক, সেই ভাষণের কথা বাইরে এলে পরে আমেরিকা কিন্তু ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেয়ে যায়। ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এই ভাষণটাকে বাইরে লিক করে দেয়। আমেরিকার রেডিও থেকে এই ভাষণটাকে বারংবার চালানো হয়েছিল কমিউনিস্টের বিরুদ্ধে এর থেকে ভালো প্রোপাগাণ্ডা আর কীই বা হতে পারত?

স্তালিন চলে যেতেই ছত্রাখান হয়ে পড়তে লাগল সাম্যবাদ। পূর্ব জার্মানি আর পোল্যান্ডে মজদুরেরা পথে নামল। হাঙ্গেরিতে দেখা দিল একটা বিরাট বিদ্রোহ আমেরিকা গোপনে সেইসব বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে লাগল চারিদিকে জ্বলতে লাগলো লাল ঝান্ডা জনগণ কমিউনিস্ট নেতাদের ধরে পেটাতে লাগলো

১৯৫১ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে স্তালিনের সত্তরতম জন্মদিনে একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। দেশবাসীদের পক্ষ থেকেই এটাই ছিল মহামান্যকে দেওয়া উপহার। সাম্যবাদ বিরোধী ঝড়ে স্তালিনের সেই মূর্তি গুঁড়িয়ে দিল হাঙ্গেরির লোকেই।

আর নিকিতা ক্রুশ্চেভ? তিনি কিন্তু অতিসত্বর সাম দাম দন্ড ভেদ নীতির প্রয়োগ করে নিজের রাশ সামলে নিলেনহাঙ্গেরিতে ট্যাংক পাঠানো হলো হাজার হাজার বিদ্রোহীদের মেরে দিল সরকার। একই পদ্ধতিতে অন্য দেশগুলোকেও আয়ত্তে এনে ফেললেন ক্রুশ্চেভ। পশ্চিমের দেশগুলো একজোট হয়ে তৈরি করল নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো। তার পালটা সাম্যবাদী দেশগুলো ভার্সাইয়ের সন্ধি করে একজোট হলক্রুশ্চেভ যুগোশ্লোভিয়ার একনায়ক মার্শাল টিটোকেও নিজের দলে করে নিলেন। ক্রুশ্চেভ তখন স্তালিনের ভুলগুলো শোধরাচ্ছিলেন।

স্তালিনের হাবেভাবে একটা মিলিটারি মেজাজ ছিলক্রুশ্চেভ আবার সেসবের ধার ধারতেন না — বিন্দাস ব্যক্তিত্ব। তবে স্তালিনের মতোই তিনিও অসম্ভব ধূর্ত ছিলেন।

ক্রুশ্চেভের সঙ্গে যখন আইজেনহাওয়ারের প্রথমবার দেখা হল, আইজেনহাওয়ার ক্রুশ্চেভকে বললেন — ‘আমরা একে অপরের দেশে এরিয়াল এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি। আপনারা আমাদের ছবি নেবেন, আমরা আপনাদের ছবি নেব আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পারদর্শিতাটাও অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত।’

ক্রুশ্চেভ বললেন — ‘আপনারা (আমেরিকানরা) অন্যদের বেডরুমে উঁকিঝুঁকি দিতে খুব পছন্দ করেন তাই না?’

কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে সোভিয়তেত কিন্তু দ্রুত উন্নতি করছিল পরমাণু বোমার বেশ কয়েকটি সফল পরীক্ষা করার পরে তারা হাইড্রোজেন বোমারও পরীক্ষণ করে দেখালো এমন কিছু বোমারু বিমান বানিয়ে ফেলল, যেগুলো আমেরিকায় গিয়ে বোমা ফেলে আসতে সক্ষম ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত প্রথমবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি করে ফেলল। সেই ক্ষেপণাস্ত্র এক মহাদেশের মাটি থেকে নিক্ষেপ করলে অন্য দেশের মাটিতে গিয়ে ধ্বংসলীলা দেখাতে সক্ষম এবং ওই বছরই সোভিয়েত জাগতিক বাধা অতিক্রম করে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করে দিল তারা মহাকাশে স্পুতনিক পাঠাল। সেই স্পুতনিক পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীকে পরিক্রমা করতে শুরু করলো

আমেরিকা এই রেসে বেশ পিছিয়ে পড়েছিল আমেরিকান ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা কমে গিয়েছিলওদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যেকটি ছাত্র কিন্তু অংক ভৌতবিজ্ঞান নিয়েই পড়ছিল। এইসব দেখে আমেরিকা একটু তাড়াহুড়ো করেই একটি মহাকাশযানকে পরীক্ষামূলকভাবে নিক্ষেপ করলকিন্তু সেই রকেট মাটিতেই ফেটে গেল। খবরের কাগজের শিরোনামে লেখা হলো ‘ফ্লপ নিক’

রিচার্ড নিক্সন আমেরিকান বিজ্ঞানীদের সাফল্যকে বড় করে দেখানোর জন্য ১৯৫৯ সালে একটা কালার টিভি নিয়ে মস্কোতে চলে গেলেন সেখানে গিয়ে বললেন — ‘আপনারা রকেটের দিকটায় আমাদের থেকে এগিয়ে গেছেন, আর আমরা টেলিভিশনের দিকটাতে আপনাদের থেকে এগিয়ে গেছি। এই দেখুন, কালার টিভি।’

ক্রুশ্চেভ নিক্সনকে কথা শেষ করতে নাদিয়েই হেসে বলেছিলেন — ‘যদি আমরা রকেট বানাতে পারি, তাহলে টেলিভিশনও বানাতে পারব। ও কোনো ব্যাপার নয়।’

এই সাক্ষাৎকার টেলিভিশনে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এর নাম ছিল কিচেন ডিবেট। পরবর্তীকালে নিক্সনের ভোটে হেরে যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল এই কিচেন ডিবেটটাই। ক্রুশ্চেভের মিসাইল নীতি আর স্পেস – রেস আমেরিকার রিপাবলিকান গভর্নমেন্টকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল।

তবে এই সবকিছুর ফলে একজনের জয়ের পথ ক্রমশঃ সুগম হয়ে উঠছিল। তিনি ছিলেন জন এফ কেনেডি।

(ক্রমশঃ)