চক্র

– শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

এলএলবি পাস করল বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় হয়ে। বাবার ইচ্ছা, হয় বিচার বিভাগ নয় কোনও বাণিজ্য সংস্থায় চাকরি। প্র্যাসটিস করলেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেস। আদালতে ফৌজদারি মামলা লড়া যথেষ্ট ঝুঁকির। দিনরাত জঘন্য সব অপরাধ নিয়ে নাড়াঘাঁটা। প্রতাড়িত নির্যাতিতদের পাশাপাশি ভয়ঙ্কর সব অপরাধীরাও আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। যথার্থ। ওদিকে সাধারণ দেওয়ানি মামলা অন্তরাকে এমনিতেই টানে না। বিশ পঁচিশ বছর পর রায় রেরোলে কেস জেতা ও হারার মধ্যে তফাৎ অনুভব করা মুশকিল। তাই বাবার পরামর্শ মেনে বিচারক হওয়ার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের টুকে পাস করা যায় না বলে দুর্নাম এবং সেইহেতু রাজ্যের জুডিশিয়ারি চাকরির সিংহভাগ দখল করার সুনাম দুটোই আছে। অন্তরাও তাই আশাবাদী

কিন্তু পরপর দুবার দুর্ঘটনা। প্রথমবার হঠাৎ টাইফয়েড। অসুখ নিয়েই পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল। যা প্রস্তুতি ছিল, হয়তো পেরেও যেত কিন্তু মা বাবা দুজনেই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন, “শরীর আগে, পরীক্ষা পরে”বাবা বলেছিলেন, “পরের বারের জন্য প্রিপারেশন নে। বয়স পালাচ্ছে না।” পরের বার বয়স না পালালেও ঠিক পরীক্ষার আগেটায় বাবাই চলে গেলেন। 

ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলযে চোখ দুটো কন্যাকে বিচারকের আসনে দেখবে বলে দিন গুনছিল, সেই দুটোই বুজে গেল চিরতরে। জুডিশিয়ারি পরীক্ষাটা কেমন যেন অপয়া মনে হতে লাগল। পরপর দু’বার বাধা পড়ল। একবার মেয়ের জীবন সংশয়, আর একবার বাপের জীবনাবসান। এক জ্যোতিষীর ভাষায়, “মহাগুরুর পতন যোগ” আইনের পেশা নাকি জাতিকার গ্রহ নক্ষত্ররা অনুমোদন করছে না

জীবন তবু থেমে থাকে না। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থায় আইন আধিকারিক পদের আবেদন করার পাশাপাশি, কর্পোরেট ল নিয়ে স্বাধীন প্র্যাক্টিস করার পরিকল্পনা শুরু করলবাড়িতে মিলি বা অন্তরার সিভিল না ক্রিমিনাল না কর্পোরেট – তাই নিয়ে মাসাধিক কাল রোজই প্রায় প্রত্যহ টেবিল বসে যায়। শেষে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা কর্পোরেট আইনজীবিকাই লক্ষ্য হিসাবে স্থির হল। 

এখন যে দিকেই যাক, আনকরা আইন পাস করা ছাত্রছাত্রীদের নিজে সরাসরি প্র্যাকটিস শুরুর আগে কোনও বড় উকিল বা আইনজীবীর অধীনে শিক্ষানবিশ থাকতে হয়, না হলে বাজারে কল্কে পাওয়া দুস্করঅনেকে তো নিজেরা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরেও সিনিয়ারের সঙ্গে গাঁটছড়া খোলে না। অন্তরাও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে বিশ্বাসী  বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তারা কেউই বিশেষ আমল দিল না। দ্বিতীয় বছর বিভাগীয় শিক্ষা ভ্রমণের অঙ্গ হিসাবে হাইকোর্ট ভিজ়িটের সময় রথীন ঘোষ বলে একজন উকিলের সঙ্গে পরিচয় হতে সে নিজের কার্ড দিয়েছিল। তাকে ফোন করাতে সে নিজের সিনিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করে দেবে বলল।

নাগের বাজারের নাম করা উকিল পুলকেশ ঘোষাল। বাড়িতে মক্কেলদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা থাকলেও তাঁর চেম্বার হাইকোর্ট চত্ত্বরে। বেশ কয়েকবার তদ্বিরের পর সাক্ষাতকারের হল। যেমনটা শুনেছিল, তেমন মোটেই মনে হল না। বেশ হাসিখুশি অমায়িক ভদ্রলোক। ব্যবহারে হুপো নয়, যথেষ্ট আন্তরিকতার ছাপ। অন্তরার আইনি জ্ঞানগম্যি পরখ করার বাইরেও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যাপারেও খুঁটিয়ে জানলেন। শেষে বললেন, “শতদ্রুর কাছে কাজের সব ডিটেইলস জেনে নিন।

পাস করার পর আড়াই বছর অতিবাহিত। হতাশায় গ্রাস করা মনটা নেচে উঠল। তবে ভদ্রলোক শুধু কর্পোরেট কেস নয়, জমি সম্পত্তি সংক্রান্ত সবরকম মামলাই লড়েন। এই জাতীয় মামলার বিশেষজ্ঞ বলা যায় বড়বড় বিল্ডারদের স্বার্থ যেমন দেখেন, তেমনি বিল্ডারের কাছ থেকে প্রতারিত গ্রাহককে মোটা ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার ইতিহাসও আছে। পুলকেশ ঘোষালের নিজের নামডাক তো আছেই, তাঁর দুজন জুনিয়ররাও স্বাধীন জমিজমা সংক্রান্ত কেস লড়ে ভালোই সফল। তারা ‘স্যর’ বলতে অজ্ঞান। ভদ্রলোক আধঘণ্টা কথা বলার জন্যও দেড় হাজার টাকা দক্ষিণা নেন, ওটাই সর্বনিম্ন। সাদা কাগজে একটা মামুলি চিঠি বা অভিযোগপত্র খসড়া করে দিতেই ন্যূনতম আঠাশশো টাকা নিয়ে থাকেন। পুরোদস্তুর উকিলের চিঠির দর তো অনেক বেশি। শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতে মক্কেল ছড়িয়ে। তাদের তালিকা জানলে সমীহ হয়। সেই তুলনায় দক্ষিণা নাকি কমই নেন যাতে সাধারণ মানুষও সাহায্য পেতে পারে। এমন একজনের অধীনে কাজ শুরু করতে চলেছে? অন্তরার মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে নাগের বাজারে যাতায়াত তুলনায় সুবিধার হলেও কাজ করতে, শিখতে ও বেশি অভিজ্ঞতার খাতিরে যেতে হবে হাইকোর্ট পাড়ায়, সেই বাবুঘাটের কাছে।

কত টাকা স্টাইপেন্ড সেটা পুলকেশ ঘোষালের কাছে জানা হয়নি অবশ্য। তবে এমন রাঘব বোয়ালের জুনিয়ার যখন, নেহাৎ কম হবে না। কাজের বিবরণ জানতে গিয়ে শতদ্রু মণ্ডলকে মৃদু গলায় প্রশ্নটা করায় উত্তর পেয়েছিল, “স্যর জানেন।”

মোটামুটি কীরকম হতে পারে?”

সেটা স্যরই বলতে পারবেন। বাট ডোন্ট ওয়ারি। কাজ শুরু হলে এগুলো বলতে লাগে না। আগে তো শেখো ঠিক করে। বিভিন্ন কেসগুলোর ফাইল মেইনটেইন করা শিখতেই কতদিন কেটে যায়। তাহলে আগামী শুক্রবার থেকে এসোযদিও রবিবার পয়লা, তবে সোমবার থেকে যাতে কাজে লাগতে পারো, তাই পরশু আই মীন শুক্রবার আসতে বলছি।”

শতদ্রুর বয়স অন্তরার কাছাকাছি, বা ছোটও হতে পারে। প্রথম আলাপেই ‘তুমি’টা কানে লাগল। কিন্তু বড় বটবৃক্ষের ছায়ায় এসে রোদে পোড়া মন এতদিনে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পেয়েছেবাড়িতে বলায় মা ও ছোট ভাইও নিশ্চিন্ত

দু মাস হয়ে গেছে। শিক্ষানবিশ ভাতা বা মাইনের কোনও উচ্চবাচ্য নেই। পুলকেশবাবুকে প্রশ্ন করেই ফেলল। উনি বললেন, “শতদ্রুর সঙ্গে কথা বলো।” শতদ্রুর উত্তর, “সে তো স্যর ডিসাইড করবেন” স্যারের কাছে কথা পাড়লেই দেশের আর্থিক মন্দা, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক সমস্যা, নৈতিক অবক্ষয়, অপরাধের বাড়বাড়ন্ত, মহামারী ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসে পড়ে। আর সেই আলোচনায় জড়িয়ে অন্তরাও নিজের সমস্যা ভুলে দেশ দুনিয়ার জন্য বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

বিমলা মিশ্র নামে সেই বৃদ্ধা মহিলা এসেছেন চেম্বারে। নিজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি প্রমোটরের কাছে বিক্রি করেছিলেন দুটি বহুতল টাওয়ার বিশিষ্ট ছোট আবাসন করা হবে জেনে। লোকটা অনেকদিন ধরে লেগেছিল। নগদ টাকা নিয়েছেন যৎসামান্যই, মাত্র বিশ লাখ টাকা। বদলে তাঁর আবাসনের দুটি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা। কিন্তু আজ তিন বছর বোঝা গেল, যেটা তৈরি হচ্ছে সেটা একটা মাদ্রাসা এবং তার সংলগ্ন একটা ছাত্রাবাসবারাসাতে ময়গড়ার মতো জায়গায় একলপ্তে দু বিঘে জমির বাজার দর কোটির ওপরদুটো দুই কামরার পাশাপাশি ফ্ল্যাট জুড়ে সপরিবারে স্বপ্নের বাসা পাওয়ার কাগুজে প্রতিশ্রতি নিয়ে কী করবেন ভেবে বৃদ্ধা দিশাহারা। এখন থাকছেন নিজেরই মাত্র এক কাটা জমিতে তৈরি করোগেটেড ছাউনি দেওয়া ঘরে। ভাগ্যিস ঐটুকু রেখেছিলেন নিজের সাময়িক মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে। ফ্ল্যাট পেলে ওটাও মূল ফটকের কাছে নিরাপত্তা গুমটি নির্মাণের জন্য প্রমোটারকে দিতে হবে। বহুতল টাওয়ারের চিহ্নই নেই। তাঁকে ফ্ল্যাট দেওয়ার বদলে উল্টে প্রমোটারের মাস্তান বাহিনী এসে ঐ কাটা খানেকও ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই কেসটা অন্তরাই দেখছে। দেওয়ানি মামলা হলেও গতিপ্রকৃতি ফৌজদারি দিকেও কেসে প্রচুর মেরিট কিন্তু পুলিস থাকলেও রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক নিরুত্তাপে সেই মেরিটের কদর হবে কিনা সন্দেহ। পুলিস তো এফআইআরই নেয়নি। শতদ্রু তো ভাগিয়েই দিচ্ছিলকিন্তু ভদ্রমহিলার কাতর প্রার্থনা আর অন্তরার আগ্রহে পুলকেশ আশ্বাস দিয়েছিলেন – জালিয়াতি কেসে জয় তো হয় যদিও প্রশ্ন কতদিনে? ভদ্রমহিলার জীবদ্দশায় যেন নিস্পত্তি হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ কেসের যাবতীয় নথিপত্র রক্ষা ও অগ্রগতি দেখার দায়িত্ব অন্তরাকেই দিয়েছেন পুলকেশ ঘোষাল। ভদ্রমহিলাও চেম্বারে এলে অন্তরার সঙ্গেই কথা বলেন মূলতবাকিরা পাত্তা দেয় না, যদিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ।

স্যর তাঁর নবীনতম সহকারীর প্রতি একটু বেশিই আস্থা দেখানোয় বাকিদের বোঝা যাচ্ছে একটু জ্বলুনি হচ্ছে। অথচ চার মাস পরেও এখনও পারিশ্রমিক পাওয়া শুরু করেনি। দু’বার মোবাইল রিচার্জ করা হয়েছে শুধু। কিন্তু সে কথা উঠলেই অন্যান্য সহযোগীদের উত্তর বাঁধা, “এত ব্যাকুল হওয়ার কী আছে? কদিন হল? এর মধ্যেই কতটা ইম্পর্টেন্স পাচ্ছ স্যরের কাছে, ভেবে দেখেছ? আমাদের তো প্রথম মাস তিনেক ফাইল ঝাড়পোঁছ ছাড়া কোনও কাজই ছিল না।

রথীন মন্তব্য করে, “আমার কিন্তু ডে ওয়ান থেকে মিটার ডাউন হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অন্তরাকেও দেবেন, একসাথেএখনও অবজ়ারভেশনে রেখেছেন।

অবজ়ারভেশনে রাখা মানে পুরো ভরসা না করা। অথচ বিমলা মিশ্রের জটিল কেসটা ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল রক্ষণাবেক্ষণ, সেই মক্কেলদের সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করা, যথাস্থানে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, বাকিদের জানানো, কেসের গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুগুলোর নোট নেওয়া, এমনকি পুলকেশ ঘোষালের তিন থেকে পাঁচ হাজারি চিঠির প্রাথমিক খসড়াও তৈরি করতে হচ্ছে অন্তরাকে।

পুলকেশবাবুর ব্যবহার এমনিতে যথেষ্ট আন্তরিক। শুধু মাইনে বা স্টাইপেন্ড তো দূর, কাজের নিমিত্ত হওয়া খরচটুকু পর্যন্ত দিতে চান না। এমন ভাবখানা যেন এসব তুচ্ছ দুশো পাঁচশোর কথা তোলা ভীষণ ছ্যাঁচড়ামি হয়ে যাচ্ছে। বাকিরা নিজেদের সঞ্চয় ও আয়কর নিয়ে আলোচনা করে, স্টেশনারির ভাউচার জমা দেয়। তাদের ছ্যাঁচড়ামির প্রয়োজন হয় না।

চেম্বারে সারাদিনে দু বার বিনা দুধের লাল চা আর সস্তা বেকারির বিস্কুট ছাড়া আর কিছু দেওয়ার রেওয়াজ নেই। আগে তো লিকার চায়ে চিনি দেওয়ারও চল ছিল না। অন্তরা চিনি ছাড়া চা মুখে দিতে পারে না বলে সে কথা প্রায়ই উল্লেখ করে সিকি চামচ করে চিনি দেওয়া হয় ওর কাপে। রথীন ঘোষও দুধ চিনির পক্ষপাতী বলে অনেক সময় ভাঁড়ের চা কিনে খেয়ে আসে। আর দুপুরের খাবার তো যার যার নিজের গাঁট থেকেঅন্তরাকে মাঝেমাঝে রথীন ভাঁড়ের চা খাওয়াতে গিয়ে বিস্কুট ও মুড়িও খাইয়েছে। কিন্তু অন্তরার রোজকার না থাকুক, রুচির বহর আছে। বাড়ি থেকে খাবার না আনলে হাইকোর্ট চত্তরের ফুডকোর্টে গিয়ে ভদ্রস্থ কিছু খেয়ে আসে। রথীনদাকে দু এক দিন খাওয়ানোর ইচ্ছা থাকলেও নিজের পার্সের দিকে তাকিয়ে উপায় থাকে না। যাওয়াতেই প্রতিদিন পঞ্চাশ ষাট টাকা বেরিয়ে যায়। সামনের ভাইফোঁটায় অবশ্যই ডাকবে। আর স্বয়ং মালিক প্রচুর উপদেশ, আলোচনা, কাজের পাহাড়ের সঙ্গে মুখের মিষ্টি ভাষা পরিবেশন করেই কাজ সারেন। আর তাতেই কেল্লা ফতে। বাড়িতে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক আলো, পাখা ও এসি সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খরচ কত হয়, তার হিসাব রাখা সম্ভব নয়। ওগুলো নিয়োগকর্তার পরিবর্তে বাড়ির ওভার হেড খরচে ঢুকে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে এসিটা এসেছিল বাবার মৃত্যুর পর থোক টাকা সংসারে আসায়।

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাড়িতে এসে ভেঙে পড়েছে অন্তরাবাবার পেনশন নেইবাবার মৃত্যুতে জীবন বীমার টাকা আর তাঁর আজীবন জমানো পুঁজির ওপর পাওয়া সুদের টাকায় সংসার চলছে। সেটাও ক্রমহ্রাসমান ভাই পলিটেকনিকের ছাত্র। কিছু টিউশন করে নিজের হাতখরচ চালায়, বাড়িতেও দেয় মাঝেমধ্যেভাই তার রোজকার ঘ্যানঘানানিতে রেগে যায়, “ছেড়ে দে নাআচ্ছা ছ্যাঁচড় তো! সবাইকে দিচ্ছে আর তুই কি বন্ডেড লেবার? স্লেভ? নিজের টাকায় তো ছাতা পড়ছে। অথচ কাজ করিয়ে মাইনে দেবে না, খরচটুকু দেবে না। তোরই দোষ। গোড়াতেই কথা বলে নিসনি কেন?”

মা বোঝান, “মাথা গরম করিসনি। এই যে কাজ শিখছিস তারও তো একটা দাম আছে। আস্তে আস্তে নিজে প্র্যাকটিস শুরু কর। একটা বড় উকিলের অ্যাসোসিয়েশনটার তো একটা সুনাম আছে, অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তাহলেও মাইনে না দিক, অন্তত খরচটা তো পুষিয়ে দেবে। আসলে তুই নতুন তো-”

মা, দিদি নতুন বলে কম টাকা দিতে পারে, তাও অন্যদের সঙ্গে একটা প্যারিটি রেখে। কিছুই দেব না, এ কেমন মেন্টালিটি? তুই ছেড়ে দিয়ে পরের বছর আবার জুডিশিয়ারি দে। নয়তো অন্য সিনিয়র দেখ।” ভাই চেঁচায়।

আবার জুডিশিয়ারি?” মা আঁৎকে ওঠেন। দেখলি না দুদুবার কেমন অঘটন ঘটল? আবার অ্যাটেম্পম্ট্ নিতে গেলে যদি আরও বড় কিছু হয়? তুই আর দিদিকে মাতাস নারোজ কোর্টে গিয়ে বসলে দলিল লেখার কাজ বা টুকটাক কিছু করেও তো রোজকার হয়। কোম্পানির কেস ছাড়া লড়ব না, এমন ইগো রাখলে চলে না। সব রকম চেষ্টা করতে হয়। তোর তো ফাইনাল ইয়ার। ঠাকুরকে ডাক যাতে একটা চাকরি পাস। মিলির বিয়ের কথাও তো ভাবতে হবে। 

মা, বাবু ভুল কিছু বলেনিআমার নিজেরই তো তেড়ে গাল দিতে ইচ্ছে করছে পুলকেশ ঘোষাল আর তার চামচাদের। আর প্লীজ় মা, এলএলবি পাস করে মুহুরীর কাজ করতে বোলো না।” অন্তরা কেঁদে ফেললবাবু জানিস তো, এই লোকটার কাজ করতে গিয়ে আমি নিজের পরীক্ষার প্রিপারেশনও নিতে পারছি না। যাতায়াতেই কতটা সময় নষ্ট হয়। তার ওপর ওখানে এতটুকু ফুরসত নেই, বাড়িতে এসেও কেসর চিন্তাপ্রথম দিকে ইম্পর্টেন্ট কাজগুলোর দায়িত্ব পেলে খুব ভালো লাগত। মনে হতো স্যর আমার মেধার কদর করছে, ভরসা করছে। যতগুলো আছে শাগরেদ, তাদের মধ্যে আমার ইংরেজি ড্রাফট সবচেয়ে ভালো হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলে খুব ভালো লাগত; উৎসাহ পেতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার ট্যালেন্ট আছে, কিন্তু কপাল নেই, তাই দেখে সিম্পলি এক্সপ্লয়েট করছে।একটু থেমে বলল, “অবশ্য এটাও বলে, আশা কোরো না। যদি পাও তাহলে সেটা সারপ্রাইজ় থাক। শতদ্রু রথীনদাও তেমন হিন্ট দেয়।”

নিজের ঘাম ঝরানো ন্যায্য পাওনা সারপ্রাইজ়? চমৎকার!”

আজ জৈন বিল্ডারস্এর স্বয়ং একজন ডাইরেক্টর এসেছেনপুলকেশের চেম্বারে যুদ্ধকালীন ব্যস্ততা। এদের ফাইল যদিও অনেক পুরোনো, রথীন ঘোষ আর সঙ্গে শতদ্রু মিলে দেখাশোনা করে; তবে রথীন না আসায় ডাক পড়ল অন্তরার। যে কোনও মামলার গল্প শুনে সারাৎসার বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা অন্তরার আছে। আগে যে ফাইল ওর স্পর্শ করার অধিকার ছিল না, আজ সেই ফাইল খুলে আট ন বছরের ধাঁধা আধ ঘণ্টার মধ্যে বুঝে ফেলতে বলে যেন ধন্য করে দিচ্ছে ওরা। 

হাইকোর্ট চত্তরে ফাইফরমাস খাটা একটা ছোকরাকে দিয়ে কোর্টের ক্যান্টিন থেকে নিরামিষ স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, পিৎজ়া ও নরম পানীয়ের বোতল আনানো হয়েছে। কৃপণ পুলকেশকে কোনও দিন জুনিয়রদের চায়ের সঙ্গে সিঙাড়া পর্যন্ত খাওয়াতে দেখেনি অন্তরা; অন্তত ও যে কদিন এসেছে। অন্তরা দুধ ছাড়া চা পছন্দ করে না জেনেও চেম্বারের নিজস্ব বৈদ্যুতিক কেটলিতে কখনও দুধ চা হয়নি, বাইরে থেকেও আনানো হয়নি। চায়ের বদলে কফি বেশি পছন্দ বলে এবং বস ও সহকর্মীদের আচরণে অভিমান করে মাসখানেক হল, অন্তরা চেম্বারের চা না খেয়ে হাইকোর্টের ফুড কোর্ট থেকে কফি খেয়ে আসছেতাতেও কোনও হেলদোল নেই। বরং রসিকতা ভেসে এসেছে, “আমি গরীব মানুষ, অত বিলাসিতা পোষায় না। চায়ের জলে চা পাতা ছাড়া আর যা কিছু অ্যাড করি না কেন, সেটাই লাক্সারি।” আজ সেই পুলকেশ ঘোষাল জিতেশ জৈন ঠাণ্ডা পানীয় নেবেন না শুনে বারবার প্রশ্ন করলেনতাহলে চা না কফি, দুধ দেওয়া হবে কিনা, নাকি ফুডকোর্ট থেকে ক্যাপুচিনো আনাবেনজিতেশ বাইরের খাবার বিশেষত তৈলাক্ত মিষ্টি পেস্ট্রি খেতে আগ্রহী নয় বলার পরেও “আরে বহত বঢ়িয়া হেয় হমারে হাইকোর্ট কা খানা। খা কর তো দেখিয়ে…” ইত্যাদি বলে খাবার প্যাকেট আনিয়েছেন।

জৈন সাহেব পুলকেশ ও শতদ্রুর সঙ্গে কাজের কথার ফাঁকে অনেক অনুরোধেও স্যান্ডউইচ ছাড়া আর কিছু মুখে দিল না। অন্তরাকে দূরের চেয়ারে বসে কিছু কিছু নোট নিতে হচ্ছিল। পুলকেশ বললেন, “অন্তরা, জম্পেশ করে কফি করো দেখি। কাবার্ডের কোণায় গুঁড়ো দুধের প্যাকেট আছে, কেটে ঢালতে হবে।” 

অন্তরা অবাক চোখে তাকালদুধের প্যাকেট কাটতে হল না। জৈনের চাহিদা মতো কালো কফি করে দিল কোনও মতে। দাঁতে দাঁত চেপে বাকি তিনজনকে দিয়ে নিজে নিল না। এরা কেউ হয় না তার, তবু অসহায় অপমানবোধের পাশাপাশি একরাশ অভিমান গলার কাছে দলা পাকাচ্ছেঅতিথির জন্য তার আপত্তি অগ্রাহ্য করেও এত আয়োজন। অথচ যাকে নিত্যদিন দপ্তরে ডেকে কাজ করাচ্ছে, এমনকি ছুটির দিনেও যখন তখন ফোনে এটা সেটা ফরমাশ করছে, তাকে তার ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকু দিতেও অসুবিধা হচ্ছে! আর সে কথা উল্লেখ করলেই চীনের চাল, পাকিস্তানের উদ্দেশ্য, ভারতের বিধেয় ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে কথা ঘোরানো! অন্তরার মুখচোখ দেখে শতদ্রু একবার ইশারায় কী হয়েছে জানতে চাইলেও বাকিরা খেয়াল করেনি। কেনই বা করবে?

এই বিশেষ উপলক্ষে বিরল সৌজন্যবোধে পুলকেশ ঘোষাল ও তার জুনিয়রদের জন্যও একটা করে স্যান্ডুইচ আনিয়েছেনউপরন্তু অতিথি দেবতা সব না খাওয়ায় উদবৃত্ত পিৎজ়া ও পেস্ট্রিও পড়ে আছে। ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতলও খোলার অবকাশ হয়নি। পুলকেশ বললেন, “অন্তরা তো ভালোবাসো এসব। নিজে রেস্টুরেন্টে গিয়ে একা একা খেয়ে আসো, আমাদের ভাগ দাও নানাও তুমিই নাও। বয়সও কম।” 

শতদ্রু ভাগ করা শুরু করেছে। অন্তরা ভাবল বলে, শরীর ভালো নেইযদিও আজ দুপুরে পেটে দানাপানি না পড়েই পেট চুঁই চুঁই করছে, বুকে গ্যাসের ব্যথা। এই অবস্থায় খাদ্য প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে হাউহাউ করে বলে উঠল, “স্যর, অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করা ভদ্রতা। না করলেও দোষের কিছু না, বড়জোর দৃষ্টিকটুকিন্তু কাজের লোককে মাইনে দেওয়া কিন্তু আমাদের কর্তব্য। খাটিয়ে নিয়ে মজুরি না দেওয়াটা আইনের চোখেও অপরাধ।”

বেরোজকার রোগা মেয়েটা পুলকেশদের হতভম্ব করে দিয়ে নিজের বোতল থেকে দু ঢোক জল পান করে ছলছলে চোখে বেরিয়ে এল।

বাড়ি ফিরে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠতে লাগল। সব অর্থহীন! এতটা শূন্য বাবা চলে যেতেও লাগেনি। এত কষ্ট করে এত ভালো নম্বর নিয়ে আইন পাস করেও বেকার! পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়রা জানে খুব বড় উকিলের অধীনে সে নিযুক্ত। কিন্তু অন্তরার মনে হচ্ছে সব কিছু থেকেই নিজেকে বিযুক্ত করে নেয়; জীবন থেকেও। ভাই ঠিক নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। কিন্তু মা? 

হ্যালোঅন্তরা ম্যাডাম, আমি বিমলা মিশ্র বলছি – আপনার মক্কেল।”

আমার মক্কেল? ইয়েমাসিমা, আমি আসলে ওখানে দিন পনেরো হয়ে গেল, আর যাই না। আপনার কেসটা স্যর কাকে অ্যাসাইন করেছেন ঠিক জানি না। আপনি চেম্বারের কাউকে ফোন করুন।”

অমন কথা বোলো না মা! আমি ধনে তো নিঃস্ব হয়েইছি, এবার প্রাণেও মারা যাব। প্রমোটারের গুণ্ডারা আমাকে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু থেকেও উৎখাত করতে চাইছে। রীতিমতো হুমকি দিয়েছে, আমার মেয়ে আর নাতনিকে তুলে নিয়ে….” ভদ্রমহিলা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

রাগ, দুঃখ, ভয়, অসহায়তা সব মিলিয়ে মাথাটা দপদপ করতে লাগল অন্তরারষাঠোর্ধ এই মহিলা ‘তুমি’ বলার অনুমতি পেয়েও ‘আপনি’ করেই বলেন। এই প্রথম অন্তরের আকূতিতে “মা তুমি” বেরিয়ে এসেছে।

নিম্ন আদালতে ফৌজদারি কেসগুলো তুলতে পারলে অন্তরা প্রথম প্লীড করার সুযোগ পাবে, কারণ পুলকেশ ঘোষাল হাইকোর্ট ছাড়া লড়েন না। যদি সদর্থক নিষ্পত্তি হয় হয়তো সামান্য প্রসিদ্ধিও জুটতে পারে। কিন্তু এইসবের উত্তেজনার চেয়েও এখন যে চিন্তাটা কাজ করছে তা হল, ও সরে গেলে কেস যতই পোক্ত হোক, পুলিস বা পুলকেশ কেউই মাথা ঘামাবে না। শুধু এক পরিবারের তিন নারীর জীবনাশঙ্কা নয়, এক ভয়াবহ সর্বনাশের অশনিসংকেত!

মে আই কাম ইন স্যর?”

তুমি? কী মনে করে?”

স্যর, বিমলা মিশ্র ফোন করেছিলখুব বিপদে আছেন। যে কোনওদিন রেপ খুন যা খুশি হতে পারে। ওনার কেসটা এখন পুরোপুরি ক্রিমিনাল হিসাবে সাজাতে হবে…”

যাক, রাগ পড়ল? আমি তো কেসটা ছেড়ে দিইনি, তুমিই নিজের টু মাচ এক্সপেটেশন থেকে ছেড়ে দিয়েছ। আমি তো ক্রিমিনাল কেস নিইই না। কিন্তু নিজের অন্তরাত্মার ডাকে আর তোমার ইন্টারেস্ট দেখেই নিয়েছি। তুমিও পরার্থে কিছু করে দেখো, তার চেয়ে বড় রেমুনারেশন আর কিছু হয় না।

অন্তরা অসহায়ভাবে মাথা নাড়ল।