বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৫

অভীক মুখোপাধ্যায়

(চতুর্বিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৫

কালার টিভি আসার আগে আমেরিকানরা তথা বিশ্ববাসী বাইরের দুনিয়াটাকে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটেই দেখত। দুটো মাত্র রঙ — শুভ্র এবং শ্যাম। সাদা আর কালো। আর কালার টিভি আসার পরেও আমেরিকানরা আমেরিকাটাকে এই দুটো রঙেই দেখত। দেখেও। দুটো ভাগে বিভক্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আজও। শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ। হোয়াইটস্ আর নিগ্গারস্। কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো চামড়ার মানুষ আজও আমেরিকার সাদা চামড়াদের কাছে নিগ্রো।

সম্ভ্রান্ত, অভিজাত কেনেডি পরিবার কৃষ্ণাঙ্গদের নীচু চোখেই দেখত। চাকরের মতো ট্রিট করতো। তাঁদের বক্তব্য ছিল, নিগ্গারস্-দের নিগ্গারস্-ই বলা উচিত। জোসেফ ম্যাকার্থি যখন কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছিলেন, তখন ববি কেনেডি আর পাপা জো কেনেডি তাঁর পাশে ছিলেন। এমনকি ডেমোক্র্যাট নেতা লিন্ডন জনসন যখন কৃষ্ণাঙ্গদের এই কট্টরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন, তখন সমস্ত ডেমোক্র্যাট তাঁর পক্ষ একমত হলেও একজনই বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জন এফ কেনেডি।

কিন্তু নিয়তি কাকে দিয়ে যে কী কাজ করায় তা কেউ জানে না। এই জন এফ কেনেডির ভাগেই আমেরিকার কালো –সাদার ভেদাভেদ, বৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি লিখেছিলেন বিধাতা। প্রথম মাধ্যমটা ছিল গান — সঙ্গীত। আহত মনই সবথেকে সুন্দর গান উপহার দিতে পারে।

আসলে এটা ছিল প্রান্তিকজনের সঙ্গীত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কৃষ্ণাঙ্গজনেরা খেতে মজুরের কাজ করতেন। দিনের শেষে শ্রান্ত ক্লান্ত দেহমন নিয়ে বাজনার তালে-তালে গাইতেন সান্ধ্য-সঙ্গীত। যেমন ভারতে গাওয়া হয় বিরহা – বিদেশিয়া। ওই যে ভিখারি ঠাকুরের লেখা গানগুলো। কিংবা কীর্তন। সে-ও তো প্রান্তজনেরই গীত। এখন কট্টর পলিটিক্যাল মত নিয়ে বসে থাকা বিদ্বানেরা দরিদ্র ব্রাহ্মণকে প্রান্তিক মানুষ বলে গণ্য করবেন কিনা জানি না, নইলে তাঁদের মুখের ভজন, নামগানটাও এই ছাঁচের বাইরে পড়ে না। মন বড় স্বদেশী স্বভাবের, ফাঁকতাল পেলেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসতে চায়। আবার ফিরে যাই সেইসব আমেরিকান সন্ধ্যায়, যখন গানবাজনায় ছিল কান্ট্রি ব্লুজ। শ্বেতাঙ্গ মানুষদেরও কিন্তু নিজস্ব গীত নাদ তাল ছন্দ লয় সুর সবই ছিল। কিন্তু এই কান্ট্রি ব্লুজ-এর পাশে সেগুলো ক্রমশঃ আলুনে, ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ – সঙ্গীত কিন্তু বাজারে তেমন চালু ছিল না। অবশ্য কয়েকটা ট্রুপ ছিল, শুঁড়িখানাগুলোতে গাইত – বাজাতো। কখনো কোনো সাদা চামড়ার সাহেব ভুল করে কৃষ্ণাঙ্গদের বস্তি দিয়ে যেতে –যেতে এই গান শুনেছিল। ততদিনে গানে সুন্দর তাল এসে গেছে — রিদম অ্যান্ড ব্লুজ।

শ্বেতাঙ্গদের কাছে এই গানগুলো গিয়ে পড়তেই তারা চুরি করতে শুরু করে দিল। গানগুলোর কভার ভার্সন আনল তারা। সেগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল কিছুদিনের মধ্যেই। বিল হ্যালির একটা গান এল — রক এরাউন্ড দ্য ক্লক। সাদা – কালোদের গানের মিক্সচার। নতুন এক সঙ্গীত রীতি জন্ম নিল — রক অ্যান্ড রোল।

একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীর নাম শোনা গেল। শ্যাম ফিলিপ্স মেমফিস। ভদ্রলোক একটি এমন পরিবার থেকে এসেছিলেন, যেখানে কৃষিই আয়ের মূল উৎস। পুরো ছোটবেলাটাই কেটেছিল কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের সঙ্গে খেলে আর ঘুরে। তিনি আনলেন ‘সান রেকর্ডস’ আর ‘সান স্টুডিও’। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ – সঙ্গীত রেকর্ড করা আরম্ভ হল। কিন্তু যেখানে সাদা আর কালো চামড়ার মানুষদের মধ্যে এত বিভেদ এবং সাদারা কালোদের ওপরে ডমিন্যান্ট, সেখানে তারা কালো মানুষদের গান শুনবে কেন? ভালো গান হলেও বিদ্বেষ আছে যে।

এক্ষেত্রে একটাই উপায় ছিল। যদি এমন কোনো শ্বেতাঙ্গ পাওয়া যায়, যে ঠিক কৃষ্ণাঙ্গদের মতোই গায়।

উনিশ বছরের এক ট্রাক-চালককে পাওয়া গেল। সে একেবারে নিপুণ কণ্ঠে কৃষ্ণাঙ্গ –সঙ্গীতের আদব কায়দা তুলে নিল। এলভিস প্রেসলি তাঁর নাম। গায়ের রং সাদা। হাঁটু নাড়িয়ে, চুল ঝাঁকিয়ে, মাইক নাচিয়ে এলভিস যখন ‘দ্যাটস্ অলরাইট মাম্মা’ গাইলেন, তখন আমেরিকা তো বটেই সারা বিশ্ব তাঁর জন্যে পাগল হয়ে গেল। শাম্মি কপূর এই এলভিস সাহেবকেই নকল করতেন।

আমেরিকার উত্তর ভাগে শিকাগোর মতো কিছু শহরে ফ্যাক্টরি চালু হল। কৃষ্ণাঙ্গদের ডাক পড়ল কাজ করার জন্যে। তারা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটত। আর তারপর সন্ধের আসরে শুরু হতো নাচগান। এমনই এক আড্ডা থেকে জন্ম নিলেম চাক বেরির মতো লেজেন্ড। আমেরিকা তখন চাক বেরির নাম শুনলে আবেগে কাঁপছে। শ্বেতাঙ্গ নারীরা এই ব্ল্যাক সুপারস্টারের জন্য উন্মাদ তখন। এও এক বিপ্লব বইকি।

লিটল রিচি। কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি যখন ‘টুটি ফ্রুটি’ গাইতেন, তখন লোকে মুগ্ধ হয়ে হাততালিই দিয়ে যেত। পায়ের জুতো ট্যাপ করত তালে – তালে। নাচত। তাঁকে দেখে নকল করতেন জেরি লিউইস। ইনি আবার শ্বেতাঙ্গ। স্টাইলটাও অদ্ভুত আয়ত্ত করেছিলেন। কক্ষনো পিয়ানোর ওপরে পা –রেখে বাজাতেন, আবার কখনো উল্টোদিক থেকেই পিয়ানো বাজাতেন। আমেরিকা এভাবেই আরো একবার স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে চলেছিল। সঙ্গীত বিপ্লবের মাধ্যমে। ভেঙে যাচ্ছিল সাদা আর কালোর মধ্যেকার পাঁচিল।

কিন্তু সেটাই বা কতদিন?

কারণ সংসদ তো তখনো সাদাদের দখলে। সেখান থেকে ঘোষণা করা হল — ‘রক অ্যান্ড রোল আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যুবসমাজ আর মহিলারা বিপথে চালিত হচ্ছেন। সবাই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। এই বিপদ সাম্যবাদের বিপদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।’

সেই সময়কার বিখ্যাত রেডিও জকি অ্যালান ফ্রিডের বিরুদ্ধে ব্লুজ, কান্ট্রি, রিদম অ্যান্ড ব্লুজ ইত্যাদির প্রোমোশনের জন্যে কেস করা হল। অল্পকালের মধ্যে অবশ্য তাঁর মৃত্যু হয়। লিটল রিচি জানালেন যে তিনি গানবাজনার জগত ছেড়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকছেন। প্লেন ক্র্যাশ হয়ে মারা গেলেন বাডি হলি। জেরি লিউইস তেরো বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে বেশ ভালোমতো ফাঁসলেন। তাঁর গান ব্যান করে দেওয়া হল। এলভিস প্রেসলি ততদিনে গানের জগতে অস্তমান। হলিউডে কাজচলা গোছের অভিনয়ের দিকে মন দিয়েছেন।

একজনই কাঁধে পতাকা বয়ে নিয়ে চলেছিলেন। রক অ্যান্ড রোলের একমাত্র আশা ভরসার নাম তখন চাক বেরি। চাক ছিলেন বিদ্রোহী মেজাজের, কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়। যাই হোক, কমবেশি দশ বছরে কিন্তু এই রক অ্যান্ড রোলের ঝড়ে আমেরিকা অনেক বদলে গিয়েছিল।

কেনেডি বললেন — ‘দেখুন, সাম্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে – লড়তে আমরা কীভাবে আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকেই ভুলে গেছি।’

রক অ্যান্ড রোল আমেরিকা থেকে কয়েক বছরের জন্যে বিদায় নিল। আবার ফিরে এল দাঁড়িয়ে – দাঁড়িয়ে আস্তে- আস্তে গিটার বাজিয়ে গান করার ‘সভ্য’ ইমেজ।

এরই মধ্যে সোভিয়েত এবার বার্লিনের বুকে একটা পাঁচিল তুলছিল।

কারণ কী?

যাতে পূর্বের সাম্যবাদের মুঠি ছেড়ে কেউ পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদের হাত না ধরে ফেলে।

অপরদিকে দুটো ছোট্ট ছোট্ট দেশে তুষের আগুন জ্বলছিল।

এক, কিউবা — আমেরিকার প্রতিবেশী রাষ্ট্র। এবং

দুই, ভিয়েতনাম — আমেরিকা থেকে অনেক দূরের দেশ।

আমেরিকার ইয়াংগেস্ট প্রেসিডেন্ট সবথেকে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব পেতেছিলেন।

(ক্রমশঃ)