বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৯

অভীক মুখোপাধ্যায়

(অষ্টাবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৯

রিচার্ড নিক্সন বনাম জন এফ কেনেডি। রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্র্যাট। আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের ইতিহাসে ১৯৬০ সালের ভোটকে বলা হয় ওয়াটারশেড ইলেকশন। এবারেই প্রথম নিয়ম তৈরি হল যে, একজন ব্যক্তি তৃতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়তে পারবেন না। আগে ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট চারবার টানা ভোটে জিতে আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি পদের শোভা বর্ধন করেছিলেন।

রিচার্ড নিক্সনের পোস্টারে লেখা ছিল — ‘অভিজ্ঞ নেতাকে বেছে নিন।’

আর কেনেডির পোস্টারে?

‘বেছে নিন নতুন মুখ।’

কেনেডির জন্ম হয়েছিল ১৯১৭ সালে। নিক্সনের ১৯১৩। মাত্র চার বছরের ফারাক। দুজনে একইসঙ্গে সংসদে এসেছিলেন। নিক্সন উপরাষ্ট্রপতি হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাস বলছিল তখনো পর্যন্ত মাত্র একজন পদাসীন উপ রাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রপতি – নির্বাচনে জিততে পেরেছিলেন — সেটাও বহু বছর আগে। পরে অবশ্য আরেকজন জিতেছিলেন — জর্জ বুশ সিনিয়র।

বাইরে পোস্টারে অভিজ্ঞতার কথা লেখা হলেও লড়াইটা কিন্তু চলছিল ধর্মের। ক্যাথলিক ভার্সেস প্রোটেস্ট্যান্ট। কেনেডি অবশ্য আগেই বারে বারে বলেছেন, আমি ক্যাথলিক হিসেবে ভোটে লড়ছি না। নিকসন তা সত্ত্বেও কেনেডির ক্যাথলিক ধর্মকেই ইস্যু করছিলেন। তবে শহুরে আমেরিকানরা ব্যাপারটাকে আমল দিচ্ছিলেন না।

নিক্সন তখন পদাধিকারী। এফ বি আই তাঁর হাতেই ছিল। বিলো দ্য বেল্ট আক্রমণ করলেন নিক্সন। বেরিয়ে এল কেনেডির সেক্স রেকর্ড। তাঁর সঙ্গে একাধিক মহিলার অবৈধ সম্পর্কের কাহিনির হাঁড়ি খোলা হাটে ভাঙা আরম্ভ করা হল। সেখানে এক সৈনিকের স্ত্রী থেকে একজন এয়ার হোস্টেস অবধি সকলের নাম জড়িয়ে গেল। কিন্তু চালে ভুল ছিল। যেহেতু কেনেডির বেশিরভাগ সম্পর্কই ছিল তাঁর বিয়ের আগেকার ঘটনা, তাই সেগুলো হালে পানি পেল না। উলটে হালফিলে ভারতের তোতাপাখি এপিসোডের মতো আমেরিকানরা বলতে শুরু করল — এফ বি আই কি আমাদের বেডরুমে উঁকি মারার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল?

কেনেডি নিক্সনকে টেলিভিশনের পর্দায় তর্ক করার জন্য সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। নিক্সন কিন্তু সুবক্তা ছিলেন। নিজের রাজনৈতিক জীবনে দেশে – বিদেশে বহুবার টিভিতে ডিবেট করেছেন। উনি দেখলেন, এই মোক্ষম সুযোগ। কেনেডির ভূতটাকে এবারে ঝেড়ে নামিয়ে দেব। ডিবেটে গিয়ে উনি সমানে কেনেডির কেচ্ছার দিকটা নিয়ে বলে চললেন, আর কেনেডি বলে চললেন দেশের নানা সমস্যা নিয়ে।

কেনেডির বক্তব্য ছিল — ‘আপনাদের সরকারে থাকাকালীন দেশের বেকারত্বের হার বেড়েছে।’

নিক্সনের উত্তর ছিল — ‘আমাদের হিসেব বলছে, যদ্দিন বেকারের সংখ্যাটা পঁয়তাল্লিশ লক্ষের নীচে থাকবে, তদ্দিন এটা কোনো সমস্যাই নয়।’

‘মিস্টার ভাইস প্রেসিডেন্ট, চুয়াল্লিশ লক্ষ নিরানব্বই হাজার নশো নিরানব্বই জন মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা সমস্যাই।’

চোখা চোখা বাক্যবাণে জর্জরিত করে দিয়ে নিক্সনকে এই টিভি ডিবেটে কিন্তু হারিয়েই দিলেন কেনেডি। এরপরে ইলেকশনের জন্য যেখানে যত ডিবেট হল, সব জায়গাতেই কেনেডি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারত্বের সমস্যা, আর্থিক উন্নতি ইত্যাদি নিয়েই বলে চললেন।

এটা ছিল মুদ্রার একটা চিক। অন্য দিকটাতে পাপা জো আর ববি নিজেদের মতো করে খেলছিলেন। সেই খেলার পেয়াদা ছিল শহরের মেয়র থেকে মাফিয়া সব্বাই। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের নব্যযুবা ববি, কিন্তু পেশাদার ভাবে সবকিছু সামাল দিচ্ছিলেন। পার্টির লোকেদের একটাই কথা বলতেন — ‘কীভাবে জিতব সে নিয়ে ভাবার দরকার নেই। জেতা দরকার!’

জন এফ কেনেডির ট্যাকটিক্স ছিল একটু আলাদা। নিজের কট্টর বিরোধী, তীব্র সমালোচকদের দরজায় নিজেই যেতেন, এবং নিজের দরজাও তাঁদের জন্যে খোলা রাখতেন। একবার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের কাছেও ভোট চাইতে গেলেন।

ট্রুম্যান সাংবাদিকদের বললেন — ‘আমি পাপা জো কেনেডি তথা সম্পূর্ণ কেনেডি পরিবারকে ঘেন্না করি। কিন্তু তার থেকেও বেশি ঘেন্না করি এই নিক্সনকে, কারণ ও আমাকে কমিউনিস্ট প্রমাণ করতে চেয়েছিল। যা সর্বৈব মিথ্যা! তাই যদি আমার সামনে শুধু এই দুজনই বিকল্প হিসেবে থাকে, আমি জন এফ কেনেডিকেই বেছে নেব।’

ভোট পর্ব আরম্ভ হল। পঞ্চাশটি রাজ্যের জনগণ মত দিল। দেখা গেল কয়েক দশকের মধ্যে সবথেকে বেশি ভোট পড়েছে। প্রথম রাউন্ডের রাজ্যগুলোর দেওয়া ভোটে যখন কেনেডির জেতার খবর আসতে লাগল, তখন রাত তিনটে বাজে। জন ওই খবর শুনে শুতে গেলেন। সকাল ন’টায় ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলেন বাকি রাজ্যগুলোতেও জয়ের হাওয়া কেনেডিরই পক্ষে বইছে। কিন্তু এখানে মনে রাখার মতো বিষয় হল মাত্র ০.২% পপুলার ভোটের ফারাকে কেনেডির জিতেছিলেন। ইলেক্টোরাল ভোটেও কিন্তু জয়ের ব্যবধান ছিল অতি সামান্যই।

ভোটের ফলাফল বেরোনোর পরে নিক্সন দুটো রাজ্যে কিছু হুজ্জুতির কথা তুলেছিলেন। একটা ছিল শিকাগর মাফিয়া গ্যাংস্টারদের এলাকা। হয়তো কিছু গণ্ডগোল সত্যিই হয়েছিল, কিন্তু এটাও সত্যি যে ওই এলাকার ভোট না-মেলালেও কেনেডি জিতেই যেতেন। শেষমেস হার মেনে নিলেন নিক্সন। আমেরিকার ৩৫তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন জন এফ কেনেডি।

এই জয়ের সময়েই একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা পরবর্তী কালে কেনেডির জীবনে প্রভাবও ফেলেছিল। জর্জিয়ার পুলিশ এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে ধরে জেলে ভরে দিয়েছিল। এসব তখন আকচার ঘটত। পুলিশ তুলে নিয়ে যেত, কোনো গোপন কোনায় নিয়ে গিয়ে গুলি মেরে এনকাউন্টার করে দিত। কিন্তু এবারে তুলে নিয়ে যাওয়া লোকটির অপরাধ খুবই সামান্য ছিল, তার স্ত্রী ছিল প্রেগন্যান্ট।

ওই ব্যক্তির অপরাধ কী ছিল?

আমেরিকাতে তখনো হোয়াইট অনলি রেস্তোরাঁ চলত। এমনই একটি রেস্তোরাঁর সামনে কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের বিরোধে সামিল ছিল ওই মানুষটি। আর বলা হয়েছিল, সে ট্রাফিক আইন মানেনি। তখন রাষ্ট্রপতি ভোটের ক্যাম্পেইন চলছিল। কৃষ্ণাঙ্গ ওই ব্যক্তির স্ত্রী দুই পদপ্রার্থীকেই সব জানিয়ে চিঠি লিখেছিল। নিক্সন ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিলেন, সাদা চামড়ার লোকদের চটিয়ে ভোটে জেতা যাবে না। কিন্তু কেনেডি তা করলেন না। কেনেডির নিজের স্ত্রী-ও তখন গর্ভবতী ছিলেন, তিনি খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন।

জন ববিকে বলে দিলেন — ‘লোকটাকে চুপচাপ ছাড়িয়ে আন।’ ববি ব্যাপারটায় তদ্বির করতে গেলে জর্জিয়ার গভর্নর বললেন — ‘এটা তখনই সম্ভব, যদি সেনেটর কেনেডি নিজে আমাকে ফোন করে বলেন।’

কেনেডির পরামর্শদাতারা বোঝালেন, এই সাদা – কালোর মাঝে ঢুকবেন না। ভোটে এর প্রভাব পড়বে। কেনেডি এসব না-শুনে নিজেই ফোন করলেন। ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হল। হতে পারে, এর ফলে বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ ভোট কমে গিয়েছিল, কিন্তু এটাও সত্য এর ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট একচেটিয়া ভাবে কেনেডির ভাগেই আসে।

সেদিন জেল থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষটা পরে আবার আমেরিকায় ইতিহাস গড়েছিল। বিপ্লবের অগ্রদূত। নামটা না-বললে পাপ হয়। মার্টিন লুথার কিং।

(ক্রমশ)