রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্য : এক বীরগাথা

0
1863

স্নেহাংশু মজুমদার

ষোড়শ শতকের সূচনায় যখন সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে বিস্তার হতে থাকে অত্যাচারী মুঘল সাম্রাজ্যের ছায়াময় অন্ধকার, সেই অমানিশার ক্রান্তিলগ্নে পূর্ব ভারতে স্বতন্ত্র সনাতনী শাসনের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল বাঙ্গালার ৮ টি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য । এই রাজ্যসমূহের মধ্যে যশোর রাজ্যের অগ্নিকুলগৌরব রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজাধিরাজ প্রতাপাদিত্যের নেতৃত্বে হিন্দুর ক্ষমতা ক্রমশ রূপ নেয় স্পর্ধার, মুঘল সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে সমগ্র বৃহৎবঙ্গে শাসন বিস্তার করে তিনি নির্মাণ করেন অখণ্ড সনাতনী যশোর সাম্রাজ্য ।

ষোড়শ শতকের শেষে মহারাজা প্রতাপাদিত্য উড়িষ্যা সালতানাতের লোহানী পাঠান ও খাঁড়ি অঞ্চলের পর্তুগিজদের দমন করে যশোরের সীমানা পুরী থেকে সন্দ্বীপ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। সমগ্র পূর্ব ভারত থেকে মুঘলদের উৎখাত করে এবং সদর্পে বাঙ্গালার স্বাধীনতা ঘোষণা করে তিনি বাঙ্গালী জাতির শৌর্যের অতীত গরিমাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন । মহারাজ প্রতাপাদিত্য মুঘলদের মোট ৮ টি যুদ্ধে পরাজিত করে বিহারের পাটনা পর্যন্ত অঞ্চল জয় করেন ও সমগ্র পূর্ব ভারতে স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । বারাণসীধামে মহারাজ প্রতাপাদিত্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত চৌষট্টি ঘাট আজও তাঁর গৌরব অম্লান রেখেছে।

১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে (বঙ্গাব্দ ৯৬৮) কাশ্যপ গোত্রীয় অগ্নিকুলদীপকঃ বঙ্গজ কুলীন ক্ষত্রিয় কায়স্থ গুহরায় রাজবংশে যশোরনৃপতি রাজা শ্রীহরি বিক্রমাদিত্যের প্রাসাদে মা ভবানীর বরপুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন যুবরাজ প্রতাপাদিত্য । জন্মের পঞ্চম দিনেই সুতিকাগৃহে তাঁর মাতা ইহলোক ত্যাগ করেন, পিতৃব্য বসন্তনারায়ণ রায়ের স্ত্রী অভয়াদেবী তাঁকে পুত্ররূপে লালনপালন করেন । অভয়াদেবীকে প্রতাপ নিজ মাতৃরূপে জ্ঞান করতেন ও পরবর্তীকালে তিনিই যশোর রাজ্যের রাজমাতারূপে সম্মানিত হন । অভয়াদেবীর কাছেই প্রতাপ শৈশবে রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীশ্রীচণ্ডী ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন; শশাঙ্ক, ধর্মপাল, দেবপাল, লক্ষ্মণসেন প্রমুখ স্বজাতীয় মহান সম্রাটগণের কীর্তিগাথা তাঁর মনে স্বাদেশিকতার উন্মেষ ঘটায়; স্ববর্ণ দেববংশীয় নৃপতিগণের বিধর্মী আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে ২০০ বছর ধরে সঞ্চালিত হিন্দু প্রতিরোধের ইতিহাস তাঁর মননে এক স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য নির্মাণ আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে ।

শৈশবেই প্রতাপ সংষ্কৃত, বাঙ্গলা ও পারসিক ভাষা অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন । পিতৃব্য বসন্ত রায়ের নিকট তিনি শস্ত্রচর্চা অধ্যয়ন করেন । বর্শা, তরবারি, ধনুর্বান ইত্যাদির সাথে সেই সময়ের নবপ্রচলিত বন্দুক পরিচালনায় তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন । প্রতাপ বন্ধুবান্ধবসহ সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে প্রায়শ বাঘ, হরিণ, গণ্ডার প্রভৃতি জন্তু শিকার করতেন । এসময় প্রতাপের পরিচয় হয় দ্বারহট্টের ভাগ্যান্বেষী সাহসী ব্রাহ্মণ যুবক শঙ্কর চক্রবর্ত্তী’র সাথে, ক্রমশ তাঁরা পরমমিত্র হয়ে ওঠেন ও সর্দার শঙ্কর চক্রবর্ত্তী যশোর রাজ্যের সেনাপতি ও কূটনৈতিক প্রধানরূপে নিয়োজিত হন।

প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক ও মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ :

সূর্যসিদ্ধান্ত মতানুসারে ৯৮৯ বঙ্গাব্দে (১৫৮২ খ্রি:) বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে যশোর রাজধানী ধূমঘাটে সভাপন্ডিত ও গুরু শ্রীকৃষ্ণ তর্কপঞ্চাননের মধ্যস্থতায় যথাশাস্ত্র প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয় । অভিষেকের পর প্রতাপাদিত্য ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে ভারতবর্ষীয় নৃপতিগণের মধ্যে সার্বভৌম একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন ।

ধুম্রঘট্ট বা ধূমঘাটে রাজধানী স্থাপন করে মহারাজ প্রতাপাদিত্য যশোর রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যশোরেশ্বরী মন্দির সংস্কার তথা পুনর্নির্মাণ করেন । যশোর রাজ্যের স্বাধীন নৃপতি হিসেবে মহারাজ প্রতাপাদিত্য নিজ নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা প্রচলন করেন, যার মধ্যে বিশুদ্ধ বঙ্গলিপিতে খোদিত ছিল – “শ্রীশ্রীকালী প্রসাদেন ভবতি শ্রীমন্মহারাজপ্রতাপাদিত্যরায়স্য” (প্রথম তল)/ “বদৎছিক্কাবছিমো জরষে বাঙ্গালা মহারাজ প্রতাপাদিত্য জদ্দাল” (দ্বিতীয় তল)

যশোর রাজ্যের সৈন্যবাহিনী সংস্কার :

যশোরের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠান করেই মহারাজ প্রতাপাদিত্য সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন, যার ফলে মুঘল বাদশাহের সাথে তাঁর সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী । তাই ভবিষ্যৎ যুদ্ধসমূহের পরিকল্পনা করেই তিনি শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রশিক্ষণ ও উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র বিনিয়োগ করে যশোর সেনাবাহিনীতে প্রভূত সংষ্কার করেন।

মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে নয়টি ভাগ ছিল। প্রধান সেনাপতির অধীন এর প্রত্যেক বিভাগে পৃথক পৃথক সেনানী ছিল। সেনাবাহিনীতে ঢালী বা পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী সৈন্য, তীরন্দাজ সৈন্য, গোলন্দাজ সৈন্য, নৌ সৈন্য, গুপ্ত সৈন্য, রক্ষী সৈন্য, হস্তী সৈন্য, পার্বত, কুকী সৈন্য, এই নয় বিভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধে ঢাল, তলোয়ার, শড়কী, বল্লম, লেজা, কামান, বন্দুক, বর্শা, তীর প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র ব্যবহৃত হতো।

ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতে লিখিত আছে যে, সে সময়ে তাঁহার বায়ান্ন হাজার ঢালী, একান্ন হাজার তীরন্দাজ, বহুসংখ্যক অশ্বারোহী, বহুযূথ হস্তী, অসংখ্য মুদ্গরধারী সৈন্য ছিল।

“যস্য দ্বারি দ্বাপঞ্চাশৎসহস্রচর্ম্মিণঃ একপঞ্চাশৎসহস্রধন্বিনঃ অশ্বারোহা অপি বহুবঃ মত্তহস্তিনাং বহুযুথাঃ সন্তি অন্যে চাসংখ্যা মুদ্গরপ্রাসাদিহস্তাঃ।”

মহারাজ প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন দুজন ব্রাহ্মণ সর্দার শঙ্কর চক্রবর্ত্তী এবং রুদ্রাদিত্য ভট্টাচার্য । নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন সেনাপতি সূর্যকান্ত গুহরায় ও অগষ্টাস পেড্রো । পদাতিক বাহিনী প্রধান ছিলেন কালীদাস ঢালী এবং মদনমোহন মল্ল । প্রতাপের গোলন্দাজ বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন পর্তুগিজ ফ্রান্সিসকো রডা। রক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন রত্নেশ্বর রায়, যজ্ঞেশ্বর রায়, বিজয়রাম ভক্তচৌধুরী প্রমুখ। হস্তী সৈন্য বাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন জামাল খান লোহানী।

ভারতচন্দ্র’র ‘অন্নদামঙ্গল’ অনুসারে প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীতে ৫২০০০ ঢালী পদাতিক যোদ্ধা ছিল। সেনাপতি রঘুরামের নেতৃত্বে অনেক কুকী সৈন্য যশোর সেনায় অংশগ্রহণ করে। অশ্বারোহী বাহিনীতে ১০ হাজার সৈন্য ছিল, যাদের সেনাপতি ছিলেন প্রতাপসিংহ দত্ত। যশোর সেনাতে মোট ৫১০০০ তীরন্দাজ যোদ্ধা ছিল, তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুন্দরদাস এবং ধুলিয়ান বেগ। জয়পুর বংশাবলী অনুসারে মোট ১৬০০ হাতিকে যশোর সেনায় যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও প্রতাপাদিত্যের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী ছিল, সুখা নামক এক দুঃসাহসী বীর গুপ্ত বাহিনীর প্রধান ছিলেন ।

হিজলির যুদ্ধ, উড়িষ্যা বিজয় ও জগন্নাথ মন্দির পুনরুদ্ধার (১৫৮৯ খ্রি:)

১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে কাররানী আফগানরা উড়িষ্যা জয় করে ও পুরী অঞ্চলে তাদের ডেরা বানায় । ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে মুঘলদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর বিহারের কাররানী আফগানরা সিপাহসালার কাতলু খানের সাথে উড়িষ্যায় পালিয়ে যায় ও স্বাধীন আফগান রাজ্য সালতানাত-এ-উড়িষ্যাহ (سلطانا به اودیشا) প্রতিষ্ঠা করে । বলা বাহুল্য এই আফগান শাসনে উড়িষ্যাবাসী হিন্দুদিগের শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল । ইতিপূর্বে পাঠানদের দ্বারা পুরী জগন্নাথ মন্দির ও বিগ্রহ বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এখন পাঠান সুলতানের হুকুমে মুশরিকদের ইবাদতস্থান এই জগন্নাথ মন্দির পুরোপুরিভাবে বন্ধ ও বার্ষিক জগন্নাথ রথযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ।

এই কঠিন অবস্থায় পুরী মন্দিরের একজন রক্ষক বিজয়রাম ভঞ্জ বাঙ্গালার স্বাধীন হিন্দুরাজ্য যশোরে আসেন ও মহারাজের কাছে জগন্নাথ মন্দিরের দুর্দশার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেন । প্রতিবেশী স্বধর্মীয়দিগের ওপর এই অত্যাচারের সংবাদে মহারাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি উড়িষ্যা আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন। আষাঢ়’র শুরুতেই উড়িষ্যা আক্রমনের জন্য নৌবাহিনী সঞ্চালন শুরু হতে থাকে, নৌসেনাপতি সূর্যকান্ত গুহরায় ও মদনমোহন মল্ল মিলে কোষা, মাচোয়া, বেপারি, জালিয়া ও সর্বাধিক বিধ্বংসক ঘুরাব ইত্যাদি বিভিন্ন দুর্দম বঙ্গদেশীয় নৌকাবাহিনী সজ্জিত করে উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন ।

এসময় উড়িষ্যায় শাসন করতেন ‘মসনদ-এ-আলা’ (علا در مسند) ঈশা খান লোহানী, যিনি মূর্তিপূজকদের ওপর অত্যাচারের জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন । যশোরের রাজার আক্রমনের খবর শুনে ঈশা খান উড়িষ্যার উত্তর সীমান্তে হিজলি বন্দরে সেনা সাজিয়ে রাখেন। আষাঢ়’র এক বৃষ্টিমুখর দিনে হিজলিতে ঈশা খানের সাথে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সম্মুখ সাক্ষাৎ হয় । সুবর্ণরেখা নদীর পশ্চিম তীরে পাঠান সেনার সাথে যশোর সেনার এক বিধ্বংসী নৌযুদ্ধ হয় । অপরাহ্নের সাথেই মহারাজ প্রতাপাদিত্য ঈশা খান কে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন ও ঈশা খান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করে ।

বিজয়ী রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্য পুরীক্ষেত্রে প্রবেশ করেন ও দীর্ঘ ১৪ বছরের অচলাবস্থার পর পুনরায় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদঘাটন ও নিত্যপূজাচর্চার সূচনা হয় । পুরীতে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের প্রত্যক্ষ শাসন স্থাপিত হয় ও উড়িষ্যা সালতানাত যশোর রাজ্যের অধীনে একটি সামন্তরাজ্যে পরিণত হয়, উড়িষ্যার শাহজাদা জামাল খান ও সিপাহসালার কামাল খান যশোর সেনায় সেনাপতিরূপে যোগদান করে ।

উড়িষ্যা জয়ের স্মারক হিসেবে পিতৃব্য বসন্তনারায়ণ রায়ের অনুরোধে প্রতাপাদিত্যে পুরী থেকে উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ ও গোবিন্দদেব বিগ্রহ আনয়ন করেন । যশোরের গোপালপুরে গোবিন্দদেব মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় ও বসন্ত রায়ের উদ্যোগে বেদকাশীতে মন্দির নির্মাণ করে উৎকলেশ্বর মূর্তি স্থাপিত হয় । বেদকাশীস্থিত উৎকলেশ্বর শিবমন্দিরের শিলালিপিতে উল্লিখিত রয়েছে –

“নিৰ্ম্মমে বিশ্বকর্ম্মা যৎ পদ্মযোনিপ্রতিষ্ঠিতম্।
উৎকলেশ্বরসংজ্ঞঞ্চ শিবলিঙ্গমনুত্তমম্ ॥ প্রতাপাদিত্যভূপেনানীতমুৎ কলদেশতঃ ।
ততো বসন্তরায়েন স্থাপিতং সেবিতঞ্চ তৎ ॥”

সাতগাহের যুদ্ধ ও বাণিজ্যবন্দর অধিকার (১৫৯২ খ্রি:)

উড়িষ্যায় পাঠানদের পরাজিত করার পর মহারাজ প্রতাপাদিত্যের আত্মবিশ্বাস ও সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে যায়, উপরন্তু ভারত থেকে বিধর্মীয় শাসকদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বতন্ত্র ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে । অতঃপর তাঁর দৃষ্টি স্থিত হয় পশ্চিমের মুঘল সাম্রাজ্যের দিকে । ভারতবর্ষকে তিনি মুঘল শাসনের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প হন ।

পূর্ব ভারতে মুঘলদের বাণিজ্যের অন্যতম অর্থকরী কেন্দ্র ছিল সাতগাহ নৌবন্দর । প্রতাপাদিত্য এই বন্দর দখল করে মুঘলদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, উপরন্তু সাতগাহর মতো ঐশ্চর্যশালী বন্দর যশোর রাজ্যের সমৃদ্ধির কারন হবে । সুতরাং ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে ৬৪ দাঁড়বিশিষ্ট ১০০টি ঘুরাব যুদ্ধনৌকা সহযোগে ও পর্তুগিজ সেনাপতি ফ্রান্সিসকো রডার বিধ্বংসী কামানবাহিনীর সাথে প্রতাপাদিত্য সাতগাহ আক্রমন করেন ।

সাতগাহের মুঘল নবাব এই অতর্কিত আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে মুঘল সেনা যশোর সৈন্যবাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু যশোরের দুর্মদ ঘুরাব নৌবাহিনীর আক্রমন ও অগণিত গোলাবর্ষণে সকল মুঘলদের সলিলসমাধি ঘটে । প্রতাপাদিত্য সাতগাহ বিজয় করে এটিকে যশোর সাম্রাজ্যের প্রধান বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ।

রায়গড়ের যুদ্ধ ও আজিম খানের হনন (১৫৯৫ খ্রি:)

বঙ্গাধিপ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যের গৌরব দিন দিন সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত হচ্ছিল। সাতগাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হারানো ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে এক বিশাল ক্ষতি । অতঃপর মুঘল বাদশাহ আকবর প্রতাপের ক্ষমতা নির্মূল করিবার জন্য আজিম খাঁ নামক অপর এক সিপাহসালারকে বহু রণনিপুণ সেনা সমভিব্যাহারে বাঙ্গালা আক্রমণে প্রেরণ করেন। আজিম নির্বিঘ্নে পাটনা ও রাজমহল অতিক্রম করিয়া আসিলেন, প্রতাপের পূর্ব নির্দেশমতে কেউ তাকে বাধা দিল না । পরিস্থিতি শান্ত বিবেচনা করে সিপাহসালার আজিম খান রায়গড়ের কাছে বাঙ্গালার শ্যামল প্রান্তরে শিবির খাটিয়ে নিরুদ্বেগে বিশ্রাম সুখ উপভোগ করতে থাকেন।

“সংবাদমশিবং শ্ৰুত্বা আকব্বরমহীপতিঃ । প্রেষয়ামাস সেনান্যমাজিমখানসংজ্ঞকং ॥ বিংশসহস্র সৈন্যানি ঘাতয়িত্বা ক্ষণং তদা ।
আজিমং পাতয়ামাস তীব্রাঘাতেন ভূতলে”

এই অবস্থায় নিশীথ রাত্রে প্রতাপাদিত্য সৈন্যবাহিনীসহ চতুৰ্দ্দিক হইতে ভীষণ বিক্রমে মোগল সেনা আক্রমণ করেন । এই আকস্মিক আক্রমণে মোগল সেনা বিধ্বস্ত হয়ে পরে । সমস্ত রাত্রি দুই পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। বহু মোগল সেনা বঙ্গীয় যোদ্ধাদের শাণিত কৃপাণের মুখে পড়ে খণ্ড খণ্ড হতে থাকে। এই ভীষণ যুদ্ধে আজিম খান ভূতলে পতিত হয়ে নিহত হয়, প্রায় বিশ হাজার মোগল সৈন্য নিহত ও বন্দী হয় এবং প্রচুর যুদ্ধোপযোগী বহুমুল্য দ্রব্যে প্রতাপের রাজকোষ পূর্ণ হয়।

● রাজমহলের যুদ্ধ (১৫৯৭ খ্রি:)

রায়গড় যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সামরিক আধিপত্য সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়ে পরে, সমগ্র উপমহাদেশে রাষ্ট্র হয়ে যায় যে সমগ্র হিন্দুস্তানকে দাপটের মধ্যে রাখা মুঘল বাদশাহ বাঙ্গালার নৃপতির কাছে একের পর এক যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হচ্ছে । এদিকে বন্দি ২০০০০ মুঘল সেনাও যশোর বাহিনীতে যোগদান করে সাম্রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি করে ।

এহেন অবস্থায় তিনি পূর্ব ভারতের মুঘল রাজধানী রাজমহল আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন । আসন্ন যুদ্ধের জন্য কূটনৈতিক পরিকল্পনা শুরু করেন বীর সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী । ৫০০০ অশ্বারোহী বাহিনী সুসংযত করেন সেনাপতি প্রতাপসিংহ দত্ত, এদিকে সেনাপতি কালীদাস ঢালী ২০০০০ ঢালী বাহিনী নির্মাণ করেন ।

অতঃপর প্রায় পঁচিশ হাজার যশোর সৈন্য নিয়ে মহারাজ প্রতাপাদিত্য রাজমহল আক্রমন করেন । এসময় রাজমহলের মুঘল সুবেদার ছিলেন নবাব শের খান ।গঙ্গার তীরে রাজমহলে শের খাঁ’র নবাব বাহিনীর সাথে যশোর রাজসৈন্যের প্রবল যুদ্ধ হয় । অবশেষে নবাব সৈন্যের পরাজয় হয় ও শের খাঁ প্রাণভয়ে দিল্লি পালিয়ে যান । মহারাজ প্রতাপাদিত্যে রাজমহল জয় করে পূর্ব ভারতের মুঘল রাজধানীর পতন ঘটান এবং প্রায় দশ কোটি টঙ্কা ও প্রচুর ঐশ্চর্য (অর্থ) লাভ করে যশোরের শ্রীবৃদ্ধি করেন ।

পাটনা বিজয় ও অখণ্ড যশোর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা (১৫৯৮ খ্রি:)

মুঘল রাজধানী রাজমহল বিজয়ের পর পূর্ব ভারতে মুঘলদের একমাত্র দুর্গ ছিল সুবাহ-এ-বিহারের পাটনাতে (بیهار در سوبا)। পাটনার নবাব শেখ ইব্রাহিম খান সেলিম জানতেন রাজমহল জয়ের পর প্রতাপাদিত্য পাটনা দখলে আসবেন । বস্তুত প্রতাপের মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না, তবে তিনি সীমান্তে মুঘল সেনা প্রস্তুত রাখেন ।

এদিকে প্রতাপাদিত্য গঙ্গাপাড় করে বিহারে প্রবেশ করে দ্রুত উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকেন । পাটনার কাছে মোটালাগঢ় নামক স্থানে মুঘল সেনার সাথে যশোর সেনার যুদ্ধ হয় । আক্রমণাত্মক যশোর সৈন্যবাহিনী বিস্তৃত ত্রিমুখী সজ্জা গঠন করে, সর্দার শঙ্কর চক্রবর্ত্তীর পরিকল্পনা অনুসারে সম্মুখে ঢালী পদাতিক বাহিনীর আক্রমনের সাথে দুদিক থেকে সেনাপতি প্রতাপসিংহের ক্ষিপ্রগতি অশ্বারোহী বাহিনী মুঘলদের নিঃশেষ করে । এরকম বিধ্বংসী সাঁড়াশি আক্রমণে অধিকাংশ মুঘল সৈন্যই নিহত হয়, ইব্রাহিম খান পরাজয় স্বীকার করে ও তাকে বন্দি করা হয় । মহারাজ প্রতাপাদিত্য কিল্লা-এ-পাটনা (پاتنا در کیلا) বিজয় করেন ।

সমগ্র বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে বৃহৎবঙ্গজুড়ে রায়শ্রেষ্ঠ প্রতাপাদিত্যের যশোর সাম্রাজ্যের বিস্তার হয় । সমগ্র পূর্বভারতে হিন্দু সাম্রাজ্যের গৌরবের মঙ্গলময় শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। বিহার জয়ের স্মারক হিসেবে সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্ত্তী মিথিলার দ্বারভাঙ্গা প্রদেশের হায়াঘাটে জগজ্জননী ভগবতী মন্দির স্থাপন করেন । মহারাজ প্রতাপাদিত্য পূণ্যক্ষেত্র কাশীধামে নির্মাণ করেন বিখ্যাত চৌষট্টি ঘাট ও চৌষট্টি যোগিনী মন্দির ।

মহারাজ প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেকের মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র একজন সমকালীন অন্যান্য বৃহৎ রাজ্যের সমমর্যাদার রাজা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হলেন না, তার সাথে বাঙ্গালাকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে এক হিন্দু সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছিল। আর এই উত্থান সম্ভব হয়েছিল কাররানী ও মুঘলদের ন্যায় বিদেশি শক্তিকে বারংবার পর্যুদস্ত করে প্রতাপাদিত্যের সামরিক ও সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে। তাঁর স্বাজাত্যবোধের চেতনা, স্বাধীনতার স্পৃহাই পরবর্তীকালে ভূষণাধীশ্বর মহারাজা সীতারাম রায় থেকে অগ্নিযুগের বিপ্লবী পর্যন্ত সবাইকে সংগ্রামের মহামন্ত্রে দীক্ষিত করেছে ।