তৃণমূল কর্মীরা এখন তরমুজের মত; ভেতরে লাল, বাইরে সবুজ!

শ্রী শীতাংশু গুহ

পশ্চিমবাংলায় অধুনা কিছু লোকের ‘বাঙ্গালী প্রেম’ উথলিয়ে উঠছে। লোকসভা নির্বাচনের পরই এই প্রেম বাড়ছে এবং ক্রমশ বাড়ছে। ‘জয় শ্রীরাম’ ঠেকাতে এঁরা ‘জয় বাংলা’ আমদানী করছেন। যাঁরা বলছেন ‘বাংলাকে উন্নয়নের নিরিখে গুজরাট’ বানাবেন, তাদের ঠেঁকাতে গিয়ে এরা বাংলাকে ‘পশ্চিম বাংলাদেশ’ বা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ বানিয়ে ফেলতে চাইছেন। বিজেপি ঠেকাতে এরা ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ’ করতে উদ্যত। ‘বাঙ্গালী হিন্দু’ স্বভাবজাতভাবে উদার। এই উদারতা এখন দুর্বলতা হিসাবে গণ্য হচ্ছে; অনেকটা দুর্বলের ক্ষমা করে দেওয়ার মত! ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ, কিন্তু সেটা সবলের পক্ষে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুর ভাগ্য ভালো যে, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পাকিস্তান ভাগ করে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ দিয়ে গিয়েছিলেন।

নইলে কি হতো? প্রথমত: আপনি ‘মহান ভারতের’ নাগরিক হতেন না! বহির্বিশ্বে ভারতের একটি আলাদা মর্যাদা আছে, এজন্যে ভারতীয়রা গর্ব করতে পারেন। পাকিস্তানীরা তা পারে? উত্তর – না. মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তা পারেনা। বাংলাদেশী হয়েও আমাদের তাই ‘ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ’ খুলতে হয়। বাংলা পড়েছিল পাকিস্তানের ভাগে। আপনি হতেন ‘পাকিস্তানী’। পাকিস্তান মুসলমানের দেশ; সেখানে আপনার জায়গা নেই। কোনভাবেই নেই; থাকতেও পারেনা। ১৯৪৭ এ পাকিস্তানে আপনার মত তেত্রিশ শতাংশ হিন্দু বা বিধর্মী ছিলো; ওরা সাফল্যের সাথে তা কমিয়ে এক শতাংশে নিয়ে এসেছে। তাতেও কি থামছে? থামছে না, তাই বিধর্মী নাবালিকা অপহরণ, ধর্মান্তর; গীর্জায় আগুন, blasphemy, ধর্ষণ আজো চলছে। লক্ষ্য একটাই, দেশটাকে সৌদি আরবের মত একশ’ শতাংশ মুসলমানের দেশ বানানো।

ভাবছেন, আপনি তো পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলায় থাকতেন! তা ঠিক, একটু পিছনে ফিরে যান, পরিসংখ্যান দেখুন ‘৪৭ এ। সেখানে কত শতাংশ হিন্দু ছিল? থাক, অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই, বাংলাদেশে ‘৭২ সালে প্রায় কুড়ি (১৯.৭%) শতাংশ হিন্দু ছিলো। এখন দশ শতাংশের নীচে। কারণ কি? বাংলাদেশের মানুষ খোলাখুলিই বলেন, এটা মুসলমানের দেশ। সেখানে আপনার জায়গা কোথায়? কাজেই আপনি সেখান থেকেও বিতাড়িত হতেন। বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের হতভাগ্য হিন্দু কোথায় গেছে? তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম বা পূর্ব-ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। পশ্চিমবাংলা যদি পাকিস্তানের ভাগে পড়তো, এরা বিহার, উড়িষ্যায় আশ্রয় নিতো। আপনিও থাকতেন এদের সাথে। বড্ড বেঁচে গেছেন দাদা। কিন্তু কতদিন বাঁচবেন? আপনি বাঁচলেও, আপনার উত্তরসূরী কি বাঁচবে?

তাই বলছিলাম, বাংলা প্রেম ভালো। বাংলা প্রেমের নামে হিন্দী বিদ্বেষ ঠিক হচ্ছেনা। অধুনা কিছু মিডিয়ায় যেসব হেডিং দেখছি তা সুখকর নয়, যেমন: মেডিক্যালে ‘ডোমিসাইল বি’ বাতিল না হওয়ায় রাজেন পান্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসছে বাঙালি/ ‘বিহারী’ আচ্ছেলাল যাদবের দাদাগিরিতে ক্ষুব্ধ কোন্নগর ও হিন্দমোটরের মানুষ/ রানীগঞ্জে মাড়োয়াড়িদের শ্মশান আলাদা, প্রবেশ নিষেধ বাঙালি বা বিহারীদের, ক্ষোভে ফুঁসছে সকলে’। ধারণা করি, বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘বাঙ্গালী প্রেম’ আরো জাগবে। তবে সম্প্রতি জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই কবিতাটি স্মরণ রাখা উচিত। সেটি হচ্ছে, “মমতা ভাবে আমি জয়ী, ডাক্তার ভাবে আমি, মধ্যখানে মুচকি হাঁসে দুইট্ৰাক ভর্তি হারামী”। কবিতাটি আমার নয়, হারামী শব্দটি আমার পছন্দ নয়, কিন্তু উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলাম না। বা হয়তো, হারামী শব্দটি ওদের জন্যে উপযুক্ত!

সদ্য তৃণমূল এমপি নুসরাত জাহান জৈন লোকসভায় শপথ নিয়ে ‘জয়হিন্দ, বন্দে মাতরম এবং জয়বাংলা’ বলেছেন। মমতার তৃণমূল হঠাৎ করে জয়বাংলা নিয়ে পড়ল কেন? জয়বাংলা তো মূলত এবং প্রতি স্তরেই বাংলাদেশের শ্লোগান। বিজেপি’র ‘জয় শ্রীরাম ঠেকাতে মমতা ব্যানার্জি ‘জয় বাংলা’ নিয়ে টানাটানি করার কারণটা হচ্ছে, বাঙালীত্ব জাগিয়ে যদি টিকে থাকা যায়। যাবে কি? আর একটি কথা, যাঁরা ‘জয় বাংলা’ বলতে গদগদ হয়ে যাচ্ছেন তাঁদের জানা দরকার, জয় বাংলায় এখন ‘মরু সংস্কৃতি’র বাড়বাড়ন্ত। বাংলাদেশে এখন প্রায় সবাই বাঙ্গালী মুসলমান। শরৎচন্দ্র, মধুসূদন নির্বাসিত। রবীন্দ্রনাথ যাই যাই করছেন। বঙ্কিম নিষিদ্ধ। আগে স্কুলে ছিলো, ‘অ’-তে আম; এখন ‘অজু’। সেখানে পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হচ্ছে, ‘অমুসলমানরা পশুর অধম (পঞ্চম শ্রেণির ‘ইসলাম ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা’ বইয়ের ১৬ ও ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এভাবেই অমুসলিমদেরকে পরিচয় দেওয়া হয়েছে)। সুতরাং যাঁরা বৃহত্তর বাংলার দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তাদের ঘোর ভাঙ্গতে খুব সময় নেবেনা। আরো জেনে রাখুন, বাংলাদেশের দুই কোটি হিন্দু এর বিপক্ষে, কারণ তাঁরা ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ’ দেশে থাকার ‘মজা’ টের পেয়ে গেছেন।

তৃণমূল হয়তো প্রকাশ্যে যুক্ত বাংলার কথা বলতে পারবে না, কিন্তু ‘জয় বাংলা’ বলে উস্কানী দেবে। ক্ষমতায় থাকার জন্যে মমতা ব্যানার্জি শুধু যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছেন তা নয়, তিনি একই সাথে ভারত বিরোধী, হিন্দু বিরোধী হয়ে পড়ছেন। মুসলমানরা অনেকে যুক্ত বাংলা চায়, কারণ তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন। আর তাঁরা সংখ্যায় বেশি হলে কি হয় তা তো বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আশার কথা, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দিন হাতে গোনা। কংগ্রেস যেমন একসময় বামদের অথবা বামরা তৃণমূলের জোয়ার ঠেকাতে পারেননি, তৃণমূলও এবার বিজেপি’র জোয়ার ঠেকাতে পারবেন না। ইতিহাস তাই বলে! পশ্চিমবাংলার মানুষ কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল দেখেছে, পদ্মফুলও দেখুক না কেন? পশ্চিমবঙ্গের ইসলামীকরণ ঠেকাতে মমতার বিদায় দরকার। তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও তা বুঝতে পারছেন। তাই তাদের অবস্থা এখন তরমুজের মত, ‘ভেতরে গেরুয়া (লালচে), বাইরে সবুজ’!