ইউপি মডেলের কার্যকারিতা প্রমাণ করে যে নেতৃত্বের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে

0
999
  • উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাগত দিক থেকে যে আকস্মিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, সেটি রাজ্যের প্রাপ্ত খারাপ ও একতরফা চাপের পরিমাণ বিবেচনার নিরিখে একেবারে অপ্রত্যশিত। কিন্তু আসল চিত্রটি প্রায়শই হিস্টিরিয়া এবং এর ব্যাখ্যানের ভঙ্গির মধ্যে নিহিত থাকে।

  • তবে ইউপি মডেলের সত্য ঘটনাটি কী?

যাঁরা কেবল বলেন এবং যাঁরা প্রকৃত কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে সুবিশাল পার্থক্য নিরূপণের জায়গাটি হল এই যে, এক একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ভারতে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর একদিকে, এমন একটি রাজ্য নেতৃত্ব আছে, যাঁরা প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন আর এই মর্মে শিরোনাম তৈরি করেন যে কীভাবে কেন্দ্র থেকে তাঁরা সহায়তা পাচ্ছেন না। সেখানে অপর পক্ষে, আরো কিছু রাজ্য আছে, যারা তাদের হাতে যা কিছু আছে, তা দিয়ে এবং অন্য সকলের মতোই তারাও কেন্দ্র থেকে যতটুকু সাহায্য পেয়েছে, তা দিয়ে তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে চলেছে।

এরকম একটি রাজ্য, যারা ‘প্রকৃতভাবে কাজ করে’ আখ্যা পাওয়ার চরিত্রসম্পন্ন, তা হল উত্তরপ্রদেশ। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে সংবাদমাধ্যমের কাছে খুব বেশি বিবৃতি দিতে শোনা যায়নি, বরং তাঁকে সংকটপূর্ণ এলাকায় দ্রুততা, তৎপরতা ও সহানুভূতিশীলতার সহিত কাজ করতে দেখা গেছে। যে রাজ্যের ক্ষেত্রে অনুমান করা হয়েছিল যে এটি ধীরে ধীরে সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটি এখন গ্রামাঞ্চল সহ সমগ্র রাজ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার জন্য গৃহীত গুপ্ত প্রণালীর জন্য প্রশংসিত হচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশে সুস্থ হবার হার সবচেয়ে ভাল এবং দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। এই পজিটিভ হবার হার ২.৪৫% এ নেমে গিয়েছে এবং সুস্থ হবার হার হল ৯১.০৪%, যা সারা দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ। সর্বমোট সক্রিয় কেসের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩,১০,৭৮৩ থেকে কমে বর্তমানে হয়েছে ১,২৩,৫৭৯ এবং এটি খুবই দ্রুত আরো কমছে। এটি একমাত্র রাজ্য যা একদিনে তিন লাখ কোভিড পরীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। এটিই প্রথম রাজ্য যে ১৮-৪৪ বছরের দশ লাখ মানুষের টীকাকরণ সম্পূর্ণ করতে পেরেছে।

উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাগত দিক থেকে যে আকস্মিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, সেটি রাজ্যের প্রাপ্ত খারাপ ও একতরফা চাপের পরিমাণ বিবেচনার নিরিখে একেবারে অপ্রত্যশিত। কিন্তু আসল চিত্রটি প্রায়শই হিস্টিরিয়া এবং এর ব্যাখ্যানের ভঙ্গির মধ্যে নিহিত থাকে। তবে ইউপি মডেলের সত্য ঘটনাটি কী?

প্রথমেই এবং সবচেয়ে আগে যে দৃষ্টিভঙ্গিটি আমাদের বুঝতে হবে, তা হল যে এইখানে অক্সিজেনের বিতরণের কাজটি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সম্পাদিত হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান কোভিড-১৯ কেসের সংখ্যা অবিলম্বে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছিল। যেহেতু কেন্দ্র ব্যাপক পরিমাণে এককভাবে অক্সিজেন উৎপাদনের কাজ করছে, তাই রাজ্যগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যে তারা যেন অক্সিজেন সংগ্রহ করেন এবং নিশ্চিত ভাবে লক্ষ্য রাখেন যাতে তা অবশ্যই অন্তিম উপভোক্তা অর্থাৎ হাসপাতালগুলির কাছে গিয়ে পৌঁছায়।

২৪ ঘন্টার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ সরকার অক্সিজেন বহনকারী ট্রাকগুলিকে পথিমধ্যে আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পূর্বের রাজ্যগুলি থেকে উত্তরপ্রদেশে অক্সিজেনের সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য রেল নেটওয়ার্ক মোতায়েন করা হয়েছিল এবং বায়ু বাহিনীর সহযোগিতায় খালি সিলিন্ডারগুলিকে আগ্রা, হিন্ডন ও লখনউ থেকে বায়ুপথে নিয়ে আসা হয়েছিল পুনরায় ভর্তি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ট্র্যাকিং এর ব্যনবস্থাপনার মধ্যে একটি লাইভ ড্যাশবোর্ডও ছিল। ড্যাশবোর্ডে যে প্রকার তথ্য দেওয়া হচ্ছিল,তার ভিত্তিতে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং বরাদ্দের ব্যবধানটি চিহ্নিত করা হয়েছিল।

অক্সিজেন সরবরাহ সংগ্রহ করা এবং এগুলিকে নানা স্থানীয় কেন্দ্রে বিতরণ করা এবং বিমানবন্দরে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলি নিয়ে যাওয়া –এই সম্পূর্ণ চক্রটি বড়জোর ১০ ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তিনদিনের মধ্যে একটি ব্যবস্থাপনা স্থির হয়ে যায়, যারা প্রতি ২৪ ঘন্টায় সমস্ত প্রধান স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের স্থানগুলিতে ৮০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। মে মাসের শুরুতে, উত্তরপ্রদেশ ২৫০ মেট্রিক টন অক্সিজেন সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে এই সংখ্যাটি একলাফে ১০০০ মেট্রিক টনে পৌঁছে যায়।

উত্তরপ্রদেশ মডেলের দ্বিতীয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি অত্যন্ত অনুকরণযোগ্য- এটি হল যে কীভাবে উত্তরপ্রদেশ সরকার গ্রামাঞ্চলে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করছেন। কয়েক মাস ধরে চলে আসা কৃষক-বিক্ষোভ এবং মহারাষ্ট্র ও দিল্লি, অর্থাৎ দুটি সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত স্থান থেকে প্রত্যাবর্তনরত পরিযায়ী শ্রমিকদের আসার ফলে মহামারিটি অতি শীঘ্র আসন্ন বলে বোধ হচ্ছিল।

রাজ্য সরকার প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে থাকে। নিয়ন্ত্রক দলগুলি গ্রামে গ্রামে ও প্রত্যন্ত এলাকায় টহল দিত এবং যাদের কোভিড-১৯ এর উপসর্গ রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের (আরএটি) মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন। এর মধ্যে যাদের পজিটিভ ধরা পড়ত, তাদের আলাদা করে দেওয়া হত এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেওয়া হত। যে সমস্ত মানুষ কোনো একজন কোভিড পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, তাদেরও পৃথক করে দেওয়া হত এবং তাদের বাড়িতেই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হত।

উপরন্তু, চলমান ভ্যান ও গোষ্ঠীমূলক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ করা হত। উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই ব্যাপক টেস্টের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের প্রশংসা করেছে, তাঁরা দ্রুত উপসর্গযুক্ত মানুষদের পৃথক করে রাখার জন্য বিচ্ছিন্নকরণ করা, রোগ সংক্রমণ আটকানো এবং ভাইরাসের সংস্পর্শে আসা থেকে আটকানোর জন্য শেষ সীমা পর্যন্ত চেষ্টা করার জন্যও উত্তরপ্রদেশ সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

সমস্ত গ্রামাঞ্চলেও যাতে এই কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পাদিত হয়, তার জন্য রাজ্য সরকার রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে ১,৪১,৬১০ টি দল এবং ২১,২৪২টি পরিদর্শনকারী আধিকারিক নিয়োগ করা হয়েছে। সর্বমোট ৭৫টি জেলার মধ্যে ৪১,২৪৮টি কনটেনমেন্ট জোন চিহ্নিত করা হয়েছিল, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, পরিষ্কার করার ও স্যানিটাইজেশন করার সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়।

প্রকৃত ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যাপক উপস্থিতি থেকেই যে কেউ উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্যমাত্রা ও সুসংহত কার্যপ্রণালীর মূল্যায়ণ করতে পারে।

যুদ্ধকালীন উদ্যোগে টীকাকরণ করানো উত্তরপ্রদেশের এই অতিমারীর ক্ষেত্রে গৃহীত তৃতীয় ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। শনিবার (২২শে মে) একজন রাজ্য সরকারের আধিকারিক ঘোষণা করেন যে উত্তরপ্রদেশে ১লা জুন থেকে সমস্ত জেলা সদর দপ্তরগুলিতে ১৮-৪৪ বছর বয়সীদের টীকাকরণের কাজ শুরু হবে।

সরকারি আধিকারিক আরো বলেন, এখনো অবধি, রাজ্য জুড়ে ৭৫টির মধ্যে ২৩টি রাজ্যে উপরোক্ত বয়সী মানুষদের টীকাকরণের কাজ চলছে। সম্প্রতি, প্রায় ১.৫৪ কোটির উপর ডোজ দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এটি ৪কোটি টীকা সংগ্রহের জন্য বিশ্বব্যাপী দরপত্র সরবরাহকারী প্রথম দিকের রাজ্যগুলির মধ্যে একটি ছিল। যে সমস্ত মানুষের অন্তর্জালের সুবিধা ছিল না, তাদের জন্য সমস্ত জেলায় যুগ্ম পরিষেবা কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে নাম নথিভুক্তকরণের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে।

বারাণসীর কোভিড ব্যবস্থাপনাও নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ ও ব্যাপকভাবে খোঁজ খবর রাখা, পরীক্ষা করানো অ জেলায় জেলায় চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। ফলস্বরূপ, এই জেলার পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ৪০% থেকে ১৩% এ নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির অভিভাবকত্বে জেলা প্রশাসন ২৪*৭ এর জন্য ২০টি নিবেদিতপ্রাণ ফোন লাইনযুক্ত কমাণ্ড ও কন্ট্রোল রুম খুলেছে ও অষ্টপ্রহরের জন্য কর্মী নিয়োগ করেছে।

কাশীর কোভিড মোকাবিলা কেন্দ্রটি প্রশাসনের নানা শাখার সংযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতি নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ২টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট গড়ে তোলা হয়েছিল, প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়নকারী সংস্থা একটি কোভিড হাসপাতাল তৈরি করেছিল এবং প্রয়োজন অনুযায়ী শয়ে শয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ঘনীভূত করার যন্ত্র তৈরি হয়েছে।

বারাণসীতে, প্রতিদিন ৫০০০টি পরীক্ষা দ্বিগুণ করে ১২,০০০ টি করা হয় এবং নিশ্চিত করা হয় যাতে তার ফলাফল ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাতে এসে পৌঁছায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে ভাইরাসের উপস্থিতির বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বারাণসীর প্রত্যন্ত এলাকায় ৭০,০০০ চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ করা এবং প্রাথমিক ও গৌণ চিকিৎসালয়গুলির স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্সিমিটার ও অন্যান্য পরীক্ষা করার সামগ্রীর ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল যাতে তাঁরা অন্যান্য মানুষদেরও শেখাতে পারেন – এগুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে গ্রামে সংকটকালীন পরিস্থিতি আশ্চর্য হারে কমে গিয়েছিল- দিন প্রতি ৮০০ থেকে এটি দিন প্রতি মাত্র ১০০ তে নেমে এসেছিল।

উত্তরপ্রদেশ মডেলের বিশেষত্ব হল সংকটকালীন সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্বদের প্রত্যক্ষ ও কার্যকরী ভূমিকা। উদাহরণস্বরূপ, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সবচেয়ে কম সময়ে দক্ষতার সঙ্গে লোকবল, পদ্ধতি ও প্রযুক্তি মোতায়েন করে সমগ্র প্রশাসনকে পরিচালনা করছেন। এর ফলাফল উত্তরপ্রদেশ মডেলের কার্যকারিতা সঠিকভাবে প্রমাণ করার ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে। অন্যান্য রাজ্যগুলি এই পদ্ধতি হয়ত শিখতে চাইবে।

মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন আয়না। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।