২০২১ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যার ফুলঝুরি – ৩

0
757

(দ্বিতীয় পর্বের পর)

১১। বহুল ব্যবহৃত মিথ্যা খবর যে নরেন্দ্র মোদি প্রতিটি নাগরিককের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা করে দেবেন

যেকোনো বিরোধী দলের মত, মমতা ব্যানার্জী বহুবার এই মিথ্যা বলে বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা করে দেবেন। বস্তুত, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে করোনা ভাইরাসের সংকটের মধ্যে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আবারও সেই একই বহুল ব্যবহৃত ও ক্লান্তিকর ভুঁয়ো খবর প্রচারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করেছিলেন।

তাঁর অভিযানের সময়, মমতা ব্যানার্জী পুনরায় বলেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদি প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্কে ১৫ লাখ টাকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি একধাপ উপরে উঠে দাবি করেন যে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই ঘোষণা করেছে যে প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে, প্রধানমন্ত্রী কখনোই এমন প্রতিশ্রুতি দেননি। বিদেশে কালো টাকা পাচারের কথা বলতে গিয়ে তিনি কৌতুকপূর্ণভাবেই বলেছিলেন যে বিদেশে জমা হওয়া টাকার পরিমাণ এত বেশি যে ভারত সরকার যদি এই সব টাকা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়, তবে প্রতিটি নাগরিক তাদের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা পেতেন।

১২। করোনার ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে মমতার মিথ্যা

২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনকে মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সকলকে টিকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও মোদি সরকারের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর সরকার রাজ্যের সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে যথেষ্ট পরিমাণে টিকা দিচ্ছে না।

মমতা ব্যানার্জী একটি জায়গায় ভোটারদের খুশি করার জন্য বলেছিলেন, এক মাস আগে, নির্বাচনের আগে, আমি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলাম। আমরা বাংলায় সব লোকদের নিজেদের খরচায় টিকা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আমাদের অনুমতি দেয়নি

এই দাবিটি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বহু বছর ধরে বলে আসা অসংখ্য মিথ্যা কথার তালিকায় অপর একটি মিথ্যা হিসেবে কেবল সংযোজিত হল। কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্ট করে বলে যে তারা পশ্চিমবঙ্গকে ৫২.৯ লাখ ভ্যাক্সিনের ডোজ পাঠিয়েছে, যার মধ্যে কেবল ৩০.৮ লাখ সেই সময় ব্যবহৃত হয়েছিল।

১৩। মমতা বলেন যে বিজেপি বিহারের ভোটের ইস্তাহারে উল্লিখিত বিনামূল্যে টিকাকরণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে

গত বছর মমতা ব্যানার্জী বিজেপিকে বিহারের ভোটের ইস্তাহারে উল্লিখিত বিনামূল্যে টিকাকরণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দোষে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন যে বিহারের বিধানসভার নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় এলে রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে কোভিডের টিকা দেবেন। কিন্তু তিনি দাবি করেছিলেন যে এটি রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভেক ছিল।

যাইহোক, দেখা গেল যে মমতা ব্যানার্জী আবারও নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করছেন। বিহারের সরকার ২০২১ সালের মার্চ মাসে ঘোষণা করে যে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা সারা রাজ্যে সকলের করোনাভাইরাসের টিকার খরচ বহন করবে এবং এমনকি রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলিতেও। বস্তুত ভোটের ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সকলকে বিনামূল্যে টিকা দিয়ে মন্ত্রী পরিষদ বিহার সরকারের সকল রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার প্রস্তাব মঞ্জুর করেছিলেন এবং মমতা ব্যানার্জী আবারও একবার অপমানে লাল হয়ে গিয়েছিলেন।

১৪। মমতা ব্যানার্জী দাবি করেছেন যে বাংলায় ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে ঝাড়গ্রামের একটি মিছিলে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভ্রান্তপথে চালনা করে বলেছিলেন যে বাংলায় ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিদ্রুপ করে মমতা ব্যানার্জী ঝাড়গ্রামে বলেছিলেন যে, আমি বলি যে সাধারণ মানুষকে কোভিডের ইঞ্জেকশন দিন, কিন্তু যতক্ষণ না কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিচ্ছে, কিছুই হবে না। আমি আপনাকে বলছি (নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে)যে আমায় করোনা ভাইরাসের টিকা দিন, আমি এর জন্য টাকা দেব; যাতে আমি সকলের জন্য করোনা ভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে দিতে পারি

তিনি বলেন, আজ যদি আমরা পোলিও, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর জন্য বিনামূল্যে টিকা দিতে পারি, তবে আমরা কোভিডশিল্ডও দিতে পারব

মজার বিষয় হল, এটি মমতার অন্যতম প্রধান জালিয়াতি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে কারণ বিশ্বের কোনো সরকারই আজ অবধি ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার কোনো টিকা সরবরাহ করতে পারেনি।

জাতীয় শিক্ষা প্রকল্প অনুসারে, ভারত সরকার টিকাকরণের কাজ শুরু করেছিল ১৯৭৮ সালে, যাতে শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য প্রাণঘাতী অবস্থা থেকে রক্ষা করা যায়।

এই টিকাকরণ প্রকল্পে, সরকার বর্তমানে নিম্নলিখিত টিকাগুলি শিশু ও সদ্যোজাতদের দিয়ে থাকে : বিসিজি টিকা, হেপাটাইটিস বি টিকা, রোটাভাইরাস টিকা, মৌখিক পোলিও ভাইরাস টিকা,নিষ্ক্রিয় পোলিও টিকা, পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা (সেটি শিশুকে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাফ, হেপাটাইটিস বি এবং হিমোফিলিস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি শ্রেণির থেকে রক্ষা করে), বসন্তের টিকা, ভিটামিন এ, ডিপিটি টিকা (যা ডিপথেরিয়া, পারটুসিস(হুপিং কাফ ও টিটেনাস), টিটেনাসের টিকা। যাইহোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যা দাবি করেছেন, সেইমত আজ অবধি কোনো সরকার ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার টিকা সরবরাহ করতে পারেনি।

১৫। যদি আপনি ভোটার তালিকায় থাকেন, তবেই আপনি একজন নাগরিক

যতবারই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর মূর্খতার নিদর্শন দেখিয়েছেন, ততবারই তিনি নিজের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন। রাজ্যে একটি সমাবেশে বক্তব্য দেবার সময় মমতা দাবি করেছিলেন যে, যেকোনো ব্যক্তি যদি ভোট না দেন, তবে মোদি তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে সরিয়ে দেবেন এবং দাবি করবেন যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক নন।

তিনি আরো বলেন যে, ভালো করে দেখে নিন আপনার নাম ভোটারদের তালিকায় আছে কিনা। বাকি সব কিছু আমি সামলে নেব এবং বলেন, কাউকে রাজ্য ছাড়তে হবে না

সাদা চোখেই বোঝা যায় যে এটি মিথযা, যা তৃণমূল কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের অবমাননা করার জন্য ও তাঁর ভোটারদের উজ্জীবিত করার জন্য বলেছিলেন। বাস্তবে এরকম কোনো নিয়ম নেই। যদি কোনো ব্যক্তি ভোট না দেন, তাও তাঁর ভোটার পরিচয়পত্রটি বাতিল হবে না।

১৬। মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পকে নিয়ে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছেন

কেন্দ্রের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প নিয়ে কথা বলার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা দাবি করেছিলেন যে আয়ুষ্মান ভারতের তহবিলের ৪০ শতাংশ রোগীদের নিজেদেরই দিতে হবে।

এখানেও মোদি ও তাঁর প্রধান স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পকে কলঙ্কিত করার জন্য মমতা একটি নতুন গল্প ফেঁদে বসেছিলেন, যার মধ্যে কিছুমাত্র সত্যতা ছিল না।

আসল বিষয়টি হল ভারতের দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলির কাছে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বিমা প্রদান করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জন স্বাস্থ্য যোজনা (এবি-পিএমজেএই)বিশ্বের বৃহত্তম এবং এটি কেন্দ্র সরকারের দ্বারা পোষিত।

এই প্রকল্পের আওতায় মোদি সরকার ভারতবর্ষে ১০.৭৪ কোটি দরিদ্র পরিবারকে তাদের সদস্যদের হাসপাতালে ভর্তির জন্য প্রতি বছর ৫ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। রোগীর চিকিৎসা ছাড়াও রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে ও পরের খরচা কিছু পরিমাণ বহন করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে প্রিমিয়াম দেওয়ার অবদানের অনুপাত উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি ও তিনটি হিমালয় নিকটবর্তী রাজ্য ছাড়া প্রায় সমস্ত রাজ্যেও ৬০:৪০, যেখানে আসলে অনুপাত হয় ৯০:১০। এর অর্থ, মমতা যে রোগীদের ৪০% প্রিমিয়াম বহন করার দাবি করেন, তা ভিত্তিহীন। রোগীকে কেবল একটি ৩০টাকা দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে, এটিও আবার গোল্ডকার্ডের অধিকারীদের জন্য বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।

মজার কথা, মমতা কেন্দ্রীয় সরকারকে এই আজব অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গেই নিজে নিজের মিথ্যের জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে এই প্রকল্পটির কৃতিত্ব মোদি সম্পূর্ণ ভাবে নিজে গ্রহণ করেছেন এবং এতে রাজ্যের অবদানকে স্বীকার করেননি, তাই তিনি আয়ুষ্মান ভারত’- থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এএনআই প্রতিবেদনে লেখে যে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, প্রকল্প চালাতে হয়, তবে কেন্দ্রকে এর খরচা সম্পূর্ণ নিজেকে বহন করতে হবে

প্রশ্ন হল, তাঁর কথামত যদি রোগীকে প্রিমিয়ামের ৪০% বহন করতে হয়, তবে তিনি কেন বললেন যে তাঁর রাজ্য আয়ুষ্মান ভারতের তহবিলের ৪০% দেবে না এবং কেন্দ্রকে কেন তিনি পুরোটা বহন করতে বললেন?

১৭। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঝড় ফণীকে নিয়ে রাজনীতি

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মোদি সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ব্যবহার করতেও লজ্জাবোধ করেননি। ২০১২ সালে ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন ঘূর্ণিঝড় ফণীর ফলে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেচগিল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘূর্ণিঝড়টিকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করে বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী যখন ওড়িশা সফরে গিয়েছিলেন, তখন তাঁকে ডাকেননি।

এর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠিকে ফোনের মারফত মমতা ব্যানার্জীর কাছ থেকে ঘুর্ণীঝড় ফণীর ফলে স্থল পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকে পাঠালে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে মোদি রাষ্ট্রের সার্বভৌম কাঠামোকে সম্মান করেন না।

যাইহোক, আতঁর দাবিগুলি খুব শীঘ্রই পিএমও খণ্ডন করেছিল এবং প্রকাশিত হইয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের ঘূর্ণিঝড়ের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি জানতে দুইবার মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফোনে সাড়া দেননি।

 

(ক্রমশ)

মূল লেখাটি লিখেছেন ঝঙ্কার মোহতা, অপইন্ডিয়া পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।