মিনহাজ মার্চেণ্ট
ভারতীয়দের একাংশ বিশ্বের আঙিনায় আমাদের সাধের ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত।সেই সব আপাত চিন্তাশীল ভারতীয়রা ‘বিবিসি’ এবং ‘সিএনএন’ – এর মত চ্যানেল দেখেন, খবরের কাগজ পড়তে হলে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ও ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পড়েন এবং নিত্য নিদারুণ চিন্তায় ভোগেন যে ভারতে গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে- স্বাধীন চিন্তা ও আলোচনার কোনও জায়গায় নেই,ধর্ষণ-দাঙ্গা, জাতপাত ও ধর্মের হানাহানির জন্য ভারতবর্ষ বিশ্বের কাছে ভীষণ হীন প্রতিপন্ন হয়ে গেছে।
একজন সাপ্তাহিক রবিবাসরীয় কাগজের সাংবাদিক দুঃখ করে লিখেছিলেন যখন ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ -র মতো সংবাদ পত্রিকা ভারতবর্ষকে বিশ্বের ধর্ষণের রাজধানী আখ্যা দেয় তখন প্রবাসী ভারতীয়দের কি বিরক্তি ও চরম অপমানের কারণ ঘটে সেটা।
ভারতীয়দের অতি অবশ্যই অধিকার আছে ভারতে ঘটে চলা প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনা,প্রতিটি জাতপাত-ধর্মের হানাহানি,প্রতিটি মতবিরোধ-মতপার্থক্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার।কিন্তু আমরা অযথাই ভুল চিন্তা করছি যে পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যম ভারতবর্ষ নিয়ে কি ভাবছে ভেবে। এখানে জানালাম এর কারণ।
ভারতবর্ষ একটি বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ।পৃথিবীতে কোথাও আপনি এত নিদারুণ দারিদ্র্যতা,সামাজিক বৈষম্য,নিত্য নৈমিত্তিক সাধারণ ভাবে ঘটে চলা হিংসার সাথে সাথে বিশ্বের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দেওয়া উদ্যোক্তা,বিশাল মাপের ব্যক্তিত্ব,অসাধারণ বৈজ্ঞানিক, প্রাণপাত করে দেওয়া সমাজসেবী একত্রে একই দেশে পাবেন না।
এই চূড়ান্ত আলো-অন্ধকারের ভারতবর্ষকে কোনও বিদেশী সাংবাদিকের হৃদয়ঙ্গম করা খুবই কঠিন।তারা তাদের প্রয়োজনীয় বিক্রির উপযোগী খবর জোগাড় করে নেয় দিল্লির কিছু কর্মহীন বুদ্ধিজীবী ও অযথা রাগান্বিত রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে।এইসব মানুষেরা বিদেশী সাংবাদিকদের ঠিক তাই বলে যা পশ্চিমী গণমাধ্যম শুনতে চায় যেমন: ভারত ভীষণ গভীর সংকটের ভিতরে রয়েছেন,আলোচনার জায়গা শেষ হয়ে গেছে,মতবিরোধ চলে না,গণতন্ত্রে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
এদের মধ্যে সবথেকে নামী পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম এই সমস্ত মিথ্যাচারের চোখ দিয়েই ঘটনাবলী দেখে। তারা খুব ভালো করেই জানে যে ধর্ষণ এবং অন্যান্য হিংস্র অপরাধ তাদের সমৃদ্ধ দেশে যেমন ঘটে তেমনই ভারতেও ঘটে। তারা নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিষয়ে ‘দ্য হিন্দু’, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রত্যহ কড়া সমালোচনা শোনে।’ইন্ডিয়া টু ডে’-র প্রাইম টাইমের সঞ্চালকের চোখের চাতুর্য্য দেখে,দেখে ‘এনডিটিভি’ মোদীর অর্থনীতিকে প্রবল বিক্রমে উপহাস করছে।
তারা ‘দ্য ওয়ার ‘-র মতো সংবাদ মাধ্যম খোঁজে যারা সরকারের বিদেশ নীতির তীব্র সমালোচনা করে এবং ‘এএলটিনিউজ’-এর মত ওয়েবসাইট খোঁজে যারা ক্রমাগত সরকারকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আক্রমণ করেই চলে। এর মধ্যে একটা সংবাদ প্রতিষ্ঠান সরকারের দেওয়া ছাড়পত্রও পায়নি এমনকি তারা মিথ্যা খবর তৈরীর জন্য অনেকক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধও হয়।
পশ্চিমী সাংবাদিকরা এইসব মনগড়া মিথ্যা কল্পনার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষকে দেখে।আলোচনার জায়গা মৃত নয়,বরং তা শতগুনে প্রাণবন্ত।ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রভূত শাখা আমলাতন্ত্রের মধ্যে ছড়ানো।তার প্রমাণ এই যে বিরোধী দলগুলি রাজ্য,পুলিশ এবং বুদ্ধিজীবীদের শাসন ও এমনকি অঙ্গুলিহেলনে চালনা পর্যন্ত করতে পারে,ফলতঃ গণতন্ত্রের জন্য আসন্ন কোনও বিপদের সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই।
কিন্তু নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে বসে পত্রিকার সম্পাদকেরা চাইবেন খারাপ খবরের উপর লেখা তৈরি হোক যেটার বাজারদর বেশি।
ভারতীয় সাংবাদিকরা আমেরিকার জন্য লেখে এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম তাদের পত্রিকার সম্পাদককে সেই বিষয় নিয়েই লিখতে দেয় যেটা তারা চায়: ধর্ষণের ঘটনা,হানাহানি,জাতপাতের বিবাদ,ধর্মের বিভেদ।এগুলোর বেশিরভাগই বিকৃত সাংবাদিকতা। বিষয়টা এমন নয় যে তারা একটা সাম্য বজায় রেখে ঘটনা বর্ণনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সব দিক খতিয়ে দেখে ভারতীয়দের চিন্তিত হওয়াই ভুল যে বিদেশি সংবাদমাধ্যম কি ভাবছে সেই বিষয়ে।একটা সমৃদ্ধ গনতন্ত্রের দেশ হিসেবে আমেরিকাকেই দেখা যাক,আমেরিকার নিজস্ব অসংখ্য সমস্যা আছে যেমন – জাতিগত বিদ্বেষ,বর্বর নীতি,শহরের মধ্যে ঘটে যাওয়া সাংঘাতিক সব গুলিচালনার ঘটনা।অতএব ভারতের সমস্যাও প্রাসঙ্গিক।
ভারত বিদেশে অনেককে রাগিয়ে দিয়েছে: কারণ ভারত এমন একটা শক্তিশালী দেশ হিসাবে উঠে দাঁড়াচ্ছে যেটা কেউ ভাবতেও পারেনি।যেখানে ভারতের স্বাধীনতার পর কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে কীভাবে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাওয়ার পর এত বিশাল জনসংখ্যা ও ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের ফলস্বরূপ এতো দরিদ্র জনজাতি,বিষাক্ত জাতপাতের নিয়ম ও ক্রমাগত চলতে থাকা হিন্দু-মুসলমান ঝামেলার আবহাওয়া নিয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে?
পশ্চিমের চিন্তাশীল সাংবাদিককুল জানেন যে তাদের অর্থবান হওয়া শুরু হয়েছে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় ১৭৫০ সালের আক্রমণাত্মক নিষ্ঠুর দাসপ্রথা শুরু হওয়ার থেকে।শোষণমূলক কলোনিয়ালিজম এশিয়াতে শুরু হয়েছে যা শিল্প-বাণিজ্যের জগতে বিপ্লব ঘটাতে জ্বালানির কাজ করছে।
দরিদ্র,শোষিত, অন্ধকারে ডুবে থাকা ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষে স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২%,মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩২ বছর এবং জিডিপি ছিল ২.৭০ লাখ কোটি টাকা।
এখন ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৬%,মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর এবং জিডিপি প্রায় ২০০ লাখ কোটি টাকা,যা বর্তমান টাকার আন্তর্জাতিক হিসেব অনুসারে এককালের ভারতের শোষক ব্রিটিশদের থেকে বেশি।
তার মানে এই নয় যে এইসব তথ্য বিভ্রান্ত বিদেশি সাংবাদিকদের কোনও পথ দেখাবে।পশ্চিমের ব্যবসায়ীরা তাদের কোটি কোটি টাকা নিয়ে দিল্লিতে বিশ্বমানের টেকনিক্যাল স্টার্ট-আপে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে তৈরী হচ্ছেন,কারণ এখানেই বিশ্বের মধ্যে দ্রুততম গ্রাহকের বাজার হতে চলেছে।
কিন্তু মতবিরোধ আর গণতন্ত্র নিয়ে কি বলা যায়?কিছু কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ভারতের মিডিয়ার সাথে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডনের মিডিয়ায় জায়গা করে দেয় তাদের রাগ প্রকাশের জন্য এবং তারা স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত উপরোক্ত বিষয়গুলি ভুলে যায়।
ভারতীয় রাজনীতি ও ভারতীয় সমাজ এক সম্পূর্ণ ভোলবদলের পথে চলেছে।পুরোনো সামাজিক জীবন তার যাবতীয় প্রাচীন চিন্তাধারা নিয়ে এক উদীয়মান সামাজিক জীবনের সামনে জোরালো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।সেই প্রাচীন চিন্তাধারা পুরনোকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়,নেপটিজমকে জিইয়ে রাখে, নিজের চেনা পরিচিত বৃত্তে কাজ করতেই এরা পছন্দ করে।এটা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে একপ্রকার মই-এর কাজ করেছিল,কিন্তু ১৯৭০ সাল ও ১৯৮০ সাল থেকে ধীরে ধীরে মই-এর এক একটা ধাপ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে,পথ রুক্ষ হয়ে উঠেছে।
এই পুরোনো প্রাচীন সমাজ ভারতকে এক প্রাচীন অধিকার স্থাপনের বুদ্ধিমত্তার চোখ দিয়ে দেখে।ক্রমাগতভাবে এটা আমাদের ইতিহাসের একটা ভুল দিক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে – পাকিস্তানের টাকায় লালিত জঙ্গী বুরহান ওয়ানিকে অমূলক প্রশংসা করা,চায়নার জন্য ক্ষমাশীলতা দেখানো এবং বিশ্বের দরবারে ভারতকে নিম্নমানের দেখানো।
ভারতবর্ষে রোজ প্রতিমুহূর্তে সশব্দে গণতন্ত্রের দামামা বাজে।গণতন্ত্র প্রত্যেককে সমালোচনার অধিকার দেয়।গণতন্ত্র ভারতবর্ষে এমনভাবেই উদযাপিত হয়। এটাই ভারতের আসল শক্তি।
মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তৃষিতা