আজকে রাতের রাজা -২

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস

আঁধার কেটে বেরোবার চেষ্টা করেছি যে আবারও হ্যারিকেনের কথা মনে এলেই আমার পা কাঁপতে শুরু করে।আজও করল। আমি সঙ্গে-সঙ্গে ‘স্টেডি, স্টেডি’ বলে মাথা থেকে সিগনাল পাঠাতে থাকলাম পায়ে। শক্ত হাতে ধরলাম, সাইকেলের হ্যান্ডেল। দ্রুত প্যাডল করতে থাকলাম। মনে মনে বলতে থাকলাম, আমি ঠিক বিকেল পাঁচটা-পঞ্চান্ন’র লোকালটা ধরতে পারব। আমাকে পারতেই হবে…

গত রবিবারের পরের অংশ

এক্কা

ছোটবেলাতেও আমাদের বাড়ির মস্ত দরজা খোলাই থাকত। কতগুলো ঘর ছিল সেই বাড়িতে এখন আর মনেও পড়ে না। একতলা-দোতলা মিলিয়ে আট-ন’টা তো হবেই। কেবলমাত্র ঘর নয়, বাড়িতে ঢুকতেই মস্ত একটা উঠোন, সেই উঠোনে কী সুন্দর একটা তুলসীমঞ্চ, সেই তুলসীমঞ্চে সন্ধে হলেই মায়ের জ্বেলে দেওয়া প্রদীপ আর পিছনের গোয়াল থেকে ভেসে আসা গোরুর ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাকুমার সুর করে রামায়ণ পড়া। শুধু কি তাই? কতরকমের মানুষ, পশুপ্রাণী আর আওয়াজ যে দিনরাত ঘুরে বেড়াত বাড়িটার হাওয়ায়-হাওয়ায়। বাবার এক শহুরে বন্ধু বেড়াতে এসে বলেছিল, ‘তোমাদের বাড়িতে তো দিনরাত অর্কেস্ট্রা চলে হে’। অর্কেস্ট্রা কাকে বলে, সেটা খায় না মাথায় দেয়, তাই জানতাম না তখন তবু বাবাকে খুশি হতে দেখে আমরা সবাই খুশি হয়েছিলাম। আর সেই খুশি ধানের গোলা থেকে বাড়ি-লাগোয়া পুকুরে উছলে উঠেছিল। মাছে, দুধে , ধানে, সবজিতে, অতিথিতে ভরপুর আমাদের বাড়ি যেন সবার কানে-কানে নিঃশব্দে বলে উঠেছিল, আছে, সব আছে। আছে কারণ, আন্তরিকতা আছে, ভালোবাসা আছে।

হ্যাঁ, আমরা গ্রামে থাকতাম। কিন্তু কতদূর সেই গ্রাম কলকাতা শহর থেকে? বারো-পনেরো মাইল, ম্যাক্সিমাম। তবু সেইটুকু তফাত যেন এক যুগ,একটা দেশের তফাত। গ্রামের লোক মজা করে একে অন্যকে বলত, ‘কলকাতা যাচ্চো, তা পাশপোট নিয়েছ?’; যাকে বলা হত,সেও হেসে উত্তর দিত, ‘তা নিইচি কিন্তুক ভিশা এখনও পাই নে।’ পাসপোর্টকে ‘পাশপোট’, ভিসাকে ‘ভিশা’ বলত প্রায় সবাই কিন্তু তাতে কীসের অসুবিধে ? কলকাতার বাবুদের,বিবিদের যেমন নিজের ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটে যেতে পাসপোর্ট- ভিসা লাগে আমাদের তো তেমন লাগত না। আমরা জানতাম গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িই আমার বাড়ি, তেমনি আমার বাড়িটাও গ্রামের আর সবার। কতদিন বিকেলে ফুটবল খেলে ফেরার পথে একে অন্যকে কাদা মাখিয়ে দিয়েছি তারপর আবার সবাই মিলে ঝাঁপ দিয়েছি পুকুরে। সেই পুকুরের মালিক কে, কার দায় পড়ত খোঁজ নিতে? আবার স্নান সেরে উঠে শর্টকাটে ফিরতে গিয়ে যখন দেখেছি ভোলার বাগানের মস্ত শেয়াল তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে গা-ঘেঁষে তখন ভয়ের চোটে যার বাড়ি আগে পড়েছে, সেখানেই ঢুকে গেছি। সেই বন্ধুর নাম কী, তার বাবা কী করে, তারা বড়লোক না গরিব, সেসব ভাবব, এমন বর্ণপরিচয় আমরা পড়িনি।

আমাদের গ্রামের নাম ছিল, সাজনে। কেন এরকম নাম, জানি না। কেউ কি কাউকে বলছিল, ‘সেজে নে’ আর সেই কথাই ঘুরতে-ঘুরতে, ভাঙতে-ভাঙতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ‘সাজনে’য়? হবে হয়তো। আশেপাশের গ্রামের নামগুলোও কম ইন্টারেস্টিং ছিল না। যেমন আমাদের পাশের গ্রামের নাম, ‘হস্তীকাঁদা’। সেখানে কি হাতিদের কান্নার কোনও কারণ ঘটেছিল? কী কারণ? কত গল্প ঘুরে বেড়াত। ওই গ্রামে নাকি একজন মস্ত বড়লোকের পোষা হাতি পাগল হয়ে গিয়ে কেঁদে বেড়াত। কে জানে, মিথ্যে না সত্যি। কিন্তু শোনার সময় মজা পেতাম খুব। সেই মজার খোঁজেই কিশোরী রায়ের নাতিকে আমরা বলতাম যে কিশোরপুর গ্রামটা ওর দাদুর নামে। গ্রামটা দেড়শো বছরের পুরোনো আর ওর দাদু তখনও বেঁচে তাই এমন কিছু হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু নাতিটা এমন আকাট যে এরকম কিছু শুনলেই আমাদের খাওয়ানোর জন্য দু’টাকা, পাঁচটাকা বের করত। তাই নাতি এলেই কোনও না কোনও অছিলায় দাদুর নাম আর গ্রামের নাম মিলেমিশে যেত …
আমাদের অঞ্চলটার নাম ছিল, রাজাপুর।হয়তো তাই আমরা ভাবতে পারতাম, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে…’ আর শুধু ভেবেই রণে ভঙ্গ দিতাম না, আমাদের শয়নে-স্বপনে কোথাও একটা সুর বাজত যে আমরা রাজা।
সেই রাজাপুর এখন কলকাতার লেজে গজিয়ে ওঠা নতুন কলকাতা। সেখানে সতেরো-আঠেরোতলা কত বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে। বিপ্লব আসছে; লেনিন, স্তালিনের নির্দেশিত পথে উন্নয়ন আসছে বলতে বলতে যারা এগিয়ে এল, গ্রামের সরল-সিধা লোকরা খেয়াল করেনি তাদের পিছনে- পিছনে কারা আসছিল। আসছিল সব টাকার কুমির মারোয়ারিরা। কিন্তু ওরা বেওসাদারের জাত, বেওসা করতে এসেছে। ওরা তো মুনাফার জন্য সবকিছু করতে করতে পারে। ওদের দোষ দেবার আগে ভাবতে হবে বাংলার মাটিতে বসে বাঙালির সর্বনাশ ওরা করতে পারত কি যদি না নতুন মীরজাফরের দল নতুন ষড়যন্ত্র করত? সেই নতুন মীরজাফররা নামে- পদবীতে বাঙালি কিন্তু পরিচয়ে ইন্টারন্যাশনাল। তারা চিকিৎসা করাতে যায় চিনে, ছেলেমেয়েকে পড়তে পাঠায়, অ্যামেরিকায়। আর বইয়ের তাকে মার্কস, রাসেল, পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলেও বাড়ির বাসন-মাজা ঝি দু’দিনের জায়গায় চারদিন কামাই করলেই মাইনে কেটে নেয় একদম ক্যালকুলেটরে হিসেব করে।

আমি জানি কারণ আমাদের রাজাপুর অঞ্চলের গৃহস্থ বাড়ির বউ-ঝি’রাই তো এখন ওইসব সতেরো-আঠেরোতলা বিল্ডিং’এর প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে ‘কাজের মাসি’ হয়েছে। যেখানে আমাদের ধানের গোলা ছিল সেখানে বেডরুম হয়েছে একের ওপরে এক। যেখানে আমাদের পুকুর ছিল, সেখানে ডাইনিং টেবিল বসেছে আর সেই টেবিলে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসি কাটাপোনা ঝকঝকে কাচের পাত্রে থকথকে গ্রেভির ভিতরে শুয়ে আছে। যেখানে আমাদের তুলসীমঞ্চ ছিল, সেখানে এখন ব্যালকনির ওপরে ব্যালকনি। সেই ব্যালকনিতে ফাঁকা মদের বোতলে মানিপ্ল্যান্ট আছে। তুলসীগাছ নেই। আর যেখানে স্বপ্ন ছিল? ওই মাঠ, ক্ষেত, দীঘি, গাছপালা, গোয়ালের যেখানে যেখানে স্বপ্ন ছিল আমাদের? চেনা- অচেনা অনেকেই বলে যে হারিয়ে গেছে কিন্তু আমি জানি যে স্বপ্নগুলো হারায়নি। ওইসব স্বপ্নের বুকের ওপরেই গোলাপি- সাদা- খয়েরি-নীল কমোড বসেছে। ফারনিশড ফ্ল্যাট কেনা রইস আদমিদের কমোড। ‘উন্নয়ন’ আছোলা বাঁশ হয়ে আমাদের পাছায় ঢুকে গেছে । না পারছি বসতে, না দাঁড়াতে।
কীভাবে এই বৈপ্লবিক উন্নয়ন হল, সে গল্প বলতে অনেক সময় লাগবে। সেই সময় আমার হাতে নেই। কারণ বসা আর দাঁড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে বলে এখন রাত্রিদিন ছুটে বেড়াতে হয়। ছুটছি। সকালে টিউশন মাস্টার ছুটছে, দুপুরে সাট্টার পেন্সিলার ছুটছে, সন্ধ্যায় ঘুগনি বিক্রেতা ছুটছে। ওই মাস্টার, ওই পেন্সিলার, ওই ঘুগনিওলা—তিনটেই আমি। ব্রহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বরের মতো আমি এখন তিনে এক, একে তিন। বসা কিম্বা দাঁড়ানোর সময় নেই। কোনওদিনই থাকে না। শুধু মানুষের চেহারাটা ধরে আছি বলেই হয়তো ক্বচিৎ- কখনও একটা শোয়ার চান্স এসে পড়ে। ওই পুতুলের মতো কোনও সর্বহারা মহিলা আমার মতো সর্বহারা পুরুষকে নিজের না- থাকাটুকু সমর্পণ করতে চায়। কিন্তু সেই সমর্পণের আগের মুহূর্তে ও যেই ওর স্বপ্নের কথা বলে ফেলে, যে স্বপ্নে একটা নর্দমার পোকা ওর সারা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,ওকে চুমু খাচ্ছে, অমনি আমার সর্বাঙ্গে কে যেন কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কে লাগাল, আগুন কে লাগাল? আমি পাগলের মতো খুঁজতে থাকি আর তখনই টের পাই, আগুন লাগিয়েছে আমার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের অল্প একটু জানে বলে পুতুল আমাকে আদর করেই ‘নর্দমার পোকা’ বলে ডাকে, এই আধা-বস্তিতে উঠে আসার পর থেকে আমার পাগল হয়ে যাওয়া মা যে নামে আমায় ডাকত। কিন্তু নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য আমাকে দায়ী করা মা যখন সৌভাগ্যবতী ছিল? চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া আমার সেই ঢাকাই শাড়ি পড়ে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়া মা’কে পুতুল তো কখনও দেখেনি। দেখেনি বলেই ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে এই ‘নর্দমার পোকা’ একদিন নিজের মায়ের কাছে, ‘সোনাবাবা’ ছিল, ‘গোপাল’ ছিল। সব হারানোর সঙ্গে-সঙ্গে আমি নিজের নামগুলোও হারিয়েছি তাই আজ কেউ আমাকে, ‘মাস্টার’ বলে ডাকে, কেউ ‘এই পেন্সিলার’ বলে ইশারা করে, কেউ বা ‘ওই ঘুগনিওলা’ বলে আওয়াজ দেয়। আমি তিনটেতেই সাড়া দিতে দিতে ভাবি আমার মতো সর্বার্থে সর্বহারা আর কে আছে? পুতুল? ওর কবে কী ছিল যে হারাবে? কুড়িবছর বয়সে যে-লোকটা অন্ধ হয়েছে তার বেদনা, জন্মান্ধ কখনও বোঝে না। আমার আর পুতুলের ভিতর তাই কোনও সম্পর্ক দূরে থাক, শরীরের লেনাদেনাও চলতে পারে না। বিকজ, ওয়ান্স আপন আ টাইম আই ওয়াজ সামওয়ান স্পেশাল। আমার একটা আলাদা পরিচয় ছিল।

বদলে যাওয়া রাজাপুর, মস্ত-মস্ত সব আকাশচুম্বী বাড়ির ঠিকানা,ঝাঁ-চকচকে রাজাপুর, ‘নিউ সিটি’ হয়ে উঠবে বলে পুরোনো সব গন্ধ ঝেড়ে ফেলে দিতে থাকা রাজাপুরের ভিতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে আমি এইসব ভাবতে থাকি। আমার সাইকেলের হ্যান্ডল থেকে বড় একটা ক্যানেস্তারা ঝোলে যেটার ভিতরে স্টোভ। এই স্টোভ আমি স্টেশনে পৌঁছেই জ্বালিয়ে দিই আর ট্রেনে উঠে এমনভাবে আঁচ বাড়াই,কমাই যে স্টোভের ওপরে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ভরতি ঘুগনি একইসঙ্গে গরম আর সুস্বাদু থাকে। ওই দুটো অঙ্ক একসঙ্গে মেলাতে না পারলে পরে ঘুগনি বিক্রি হবে না। সাইকেল চালাতে চালাতে দুদিকে তাকাই আর ভাবি ওই দৈত্যের মতো বাড়িগুলোতে যেমন, বস্তিতেও তেমন,জীবনকে একইসঙ্গে গরম আর সুস্বাদু রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে লোক। কেউ দুটো অঙ্কই মিলিয়ে দিয়ে হাত ভরে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ একটাও মেলাতে না পেরে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। আর বেশিরভাগই একটা মেলাচ্ছে তো অন্যটা মেলাতে পারছে না,ভুলটা ঠিক করতে গিয়ে দেখছে ঠিকটা কখন যেন ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু অত ফিলোসফি দিয়ে আমার হবে কী ? এই ঘুগনি নিয়ে অফিস-ফেরতা লোকের ভিড়ে দমবন্ধ ট্রেনে উঠতে না পারলে বিক্রি চৌপাট। তাতে অফিস-বাবুদের কাঁচকলা কিন্তু আমার হাতে হ্যারিকেন। জীবন আমার চোখের সামনে এত-এত অন্ধকার নামিয়ে এনেছে আর এত-এতবার সেই আঁধার কেটে বেরোবার চেষ্টা করেছি যে আবারও হ্যারিকেনের কথা মনে এলেই আমার পা কাঁপতে শুরু করে।আজও করল। আমি সঙ্গে-সঙ্গে ‘স্টেডি, স্টেডি’ বলে মাথা থেকে সিগনাল পাঠাতে থাকলাম পায়ে। শক্ত হাতে ধরলাম, সাইকেলের হ্যান্ডেল। দ্রুত প্যাডল করতে থাকলাম। মনে মনে বলতে থাকলাম, আমি ঠিক বিকেল পাঁচটা-পঞ্চান্ন’র লোকালটা ধরতে পারব। আমাকে পারতেই হবে।

এক্কা
আজ এমন ফেঁসে গিয়েছিলাম যে সাট্টার ঠেকে যাওয়াই হয়নি। আর এক্কা দিন ওই পেন্সিলারের কাজ না করতে পারা মানে আমার দুগগি লস। এই দ্যাখো, আবার ওই ভাষায় কথা বলছি।আসলে সাট্টার সঙ্গে লেপ্টে গিয়ে আমি এক,দুই, তিন, চার বলতে ভুলে গেছি। সাট্টায় তো, শূন্য মানে গোল্লা, এক মানে এক্কা, দুই মানে দুগগি, তিন মানে তিয়া, চার মানে চৌকা। কতবার আমি সকালে বাচ্চাদের ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস পড়ানোর সময়, পাঁচ বলতে গিয়ে বলে ফেলেছি পাঞ্জা, ছয় বলতে গিয়ে ছক্কা। তারপরও ওরা আমার কাছেই পড়তে আসে কারণ ওদের বস্তি থেকে আমার সেমি-বস্তিতে বই-খাতা নিয়ে আসা যতটা সহজ, ফিটফাট কোচিং সেন্টারে যাওয়া ততটা নয়। আরও বড় কারণ হল, টাকা। একশোটাকায় দুটো , দেড়শোটাকায় চারটে সাবজেক্ট, কে পড়াবে আমি ছাড়া? তাও তো দশজনের ভিতরে পাঁচজনের বাকি থাকে অলটাইম। আমি ভেবে দেখেছি, আমার স্টুডেন্টদের বাবা-মা’রাও সব ছোটখাটো মাড়োয়ারি, গুজরাতি। ভ্যান-রিকশাই চালাক কিম্বা লোকের বাড়ি বাসন মাজুক, দুর্দান্ত ব্যবসাবুদ্ধি ওদের।বড় বড় বিসনেসম্যানরা যেমন বাড়ি কিম্বা কারখানার ট্যাক্স দেয় না, ফেলে রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত না অ্যামাউন্টটা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় চলে যায় যে কর্পোরেশন বাধ্য হয়, ওয়েভার স্কিম চালু করতে, এরাও ঠিক সেই পলিসি ফলো করে। দু’মাস, তিনমাস, চারমাস মাইনে না দিতে দিতে একদিন এসে এমন কেঁদে পড়ে যে মনে হয় এদের কাছে আমি পাঁচশো-ছ’শো নয়, পাঁচ-ছ’লাখ টাকা পাই। আমি প্রথমটা একটু লোক-দেখানো তর্ক করি নইলে ওরা একেবারে পেয়ে বসবে। তবু শেষ অবধি যে আমি অনেকটা রিবেট দিয়ে দেব, সেটা আমার মতোই, ওরাও জানে। তবে বলা ভালো যে আমি এই পরাজয়টা এনজয় করি। আমার ভালো লাগে ওই অতগুলো কচি-কাঁচার ডাকে ঘুম থেকে উঠতে। ‘ও ছার,এটা বুঝতে পারছি না’ বলে ওরা যখন তাকায় আমার দিকে তখন বুকটা ভরে ওঠে গর্বে। মনে হয়, আমি তো ‘ছার’, সবদিক দিয়েই । শুধু ওদের মনের ভিতরে আমার একটা ‘স্যার’ ইমেজ বেঁচে আছে ।মুশকিল অন্য জায়গায়। আর সেটা হল, গর্বে বুক ভরে উঠলেও, পেট ভরে না। এবার পেট ভরানোর জন্য সাট্টার পেন্সিলার হতে হয়েছে বললে বেশ ট্র্যাজিক শোনাবে কিন্তু আদতে ব্যাপারটা আর একটু জটিল। সহজে বুঝতে গেলে জানতে হবে, খাজনা আদায়ে জোর দিই না বলে, টিউশানি থেকে সামান্যই আয় হয় আমার। আমার আসল ইনকাম হতে পারত ঘুগনি বিক্রি করে। কিন্তু এখান থেকে এক পয়সাও আসে না আমার, উলটে পকেট থেকে আরও খসে। কখনও-কখনও মনে পড়ে, আমার নয়,এটা আমার জিগরি দোস্ত শিবুর ব্যবসা ছিল। আমি শুধু মাঝেমাঝে ওর এগিয়ে দেওয়া বাটি-ভরতি ঘুগনি হাতে নিয়ে টেস্ট করে এক্সপার্ট কমেন্ট দিতাম।

সেই কমেন্টেটর একদম বোবা হয়ে গেল, শিবু তিনদিনের জ্বরে মরে যাওয়ায়। চিরকাল জানি যে ডেঙ্গু বড়লোকের রোগ, টিবি গরিবের কিন্তু শিবু মরে প্রমাণ করে দিয়ে গেল,গরিবের রোগ বড়লোকের না হলেও, উলটোটা হতেই পারে। শিবুর বউ তখন একটা তিনবছরের মেয়ে আর পেটের ভিতর একটা অজানা জেনডার নিয়ে খাবি খাচ্ছে। ডেডবডি ঘরে আসতেই আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদতে শুরু করল, ‘ওগো তুমি আমাদের কেন এভাবে ভাসিয়ে গেলে গো?’ অথবা, ‘ তুমি একবার বলে যাও, আমাদের কী হবে গো’? বাস্তবিক খুব সত্যি কথা জিজ্ঞেস করছিল শিবুর বউ কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে জ্যান্ত মানুষ প্রশ্নের উত্তর দেয় না, মরা মানুষ কীভাবে দেবে?

আমি ওই ঘরের ভিতর থাকতে পারছিলাম না বলে বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আধবুড়ো একটা লোক সামনে এসে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসি দিল, ব্রাদার একটা স্মোকিং হবে?

ওর বাক্যি শুনে প্রবল খচে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারলাম না। আমার পাঁজরের হাড় ভেঙে দিয়ে আমার বন্ধুটা চলে গেল আর এই হতভাগা তো শুধু একটা সিগারেট চাইছে।

সুখটান দিতে দিতে লোকটা যাত্রাদলের বিবেকের ঢঙে বলে উঠল, ভিতরের ড্রামাবাজিটা শুনলে ব্রাদার?

—কার? আমি কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
—ওই শিবুর বউয়ের।
—একটা ঠাটিয়ে চড় মারব শালা। মেয়েটা একে পোয়াতি, তার ওপর বিধবা হয়েছে, ওর কান্নাটাকে নাটক মনে হচ্ছে তোমার?
—নাটক ছাড়া অন্য কী? লোকটা বড় একটা টান দিয়ে বলল।

আমার ধাতানির সামনে লোকটাকে এত নির্লিপ্ত দেখে আমি অবাক হলাম। কিন্তু তখন মনমেজাজ এত খারাপ যে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না।

লোকটা নিশ্চয়ই আমার মনমেজাজ নিয়ে ভাবিত ছিল না তাই দিব্যি চনমনে গলায় বলল, কান্নার বিষয়, কী? না, তুমি আমায় ছেড়ে কেন গেলে গো, এবার আমার কী হবে গো, শালা যে লোকটা চলে গেল, সে কোথায় গেল, তাই নিয়ে একবারও হাঁক পাড়তে দেখলে? ব্রাদার, এই দুনিয়া চূড়ান্ত স্বার্থপর। যে বেঁচে আছে সে চরম দুঃখের মুহূর্তেও নিজের বেঁচে থাকার সুখটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।আমি সরে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। খেঁকুটে চেহারার লোকটা যা বলছে তার একবর্ণ তো মিথ্যে নয়। তবে কি আমরা নিজের জন্যই বাঁচি আর অন্য কেউ মরে গেলে,তার জন্য নয়, তার বিহনে আমার কী হবে, সেই ভয়ে কাঁদি?

—জুটমিলে ছিলাম ব্রাদার। লকআউট হওয়ার আগের পৃথিবীও দেখলাম, পরেরটাও দেখছি। পুরো হেভেন অ্যান্ড হেল। যাদের ঘরে এনে খাইয়েছি, শুইয়েছি, তারাও এখন রাস্তায় দেখলে অন্য ফুটপাতে চলে যায়, যদি ধার চাই।
—হুমম। বলে আমি কেটে পড়বার তাল করলাম কারণ এই লোকটার গল্প শোনার কোনও মানে হয় না। ওর চেয়ে খারাপ ভাগ্য নিয়ে হাজারও লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে দুনিয়ায়। আমি নিজেই হয়তো তাদের একজন।
—আর একটা স্মোকিং দিয়ে যাবে নাকি ব্রাদার?
একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে লোকটাকে ভস্ম করে দিতে গিয়ে,কে জানে কেন,আর একটা সিগারেট তুলে দিলাম, লোকটার হাতে। আর শিবুর শ্রাদ্ধ (তা সে যত নমো নমো করেই হোক) প্রায় একার দায়িত্বে তুলে দেওয়ার দু-তিনদিন বাদে মুখোমুখি হলাম,ওর বউয়ের।
—তোমার বন্ধু তো আমাদের জলে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল। এবার আমাদের কী হবে, ভেবেছ? শিবুর বউ জবা কথা শুরুই করল বাউন্সার দিয়ে।
—পালিয়ে কেন যাবে? ও কি মরতে চেয়েছিল? আমি মৃদু গলায় বললাম।
— সে চেয়েছিল কি চায়নি,আমি জানি না। বাচ্চা কেন চাইতে গেল? তখন কত করে বললুম,এই রোজগারে এক্ষুনি আর একটা রাক্ষস সংসারে এনে জুটিয়ো না। তা শুনল আমার কথা?
—তুমি চাওনি বাচ্চা?
—মা গো মা, একটা এখনও হামলে পড়ে বুক টানে এরমধ্যে আবার একটা? কিন্তু তোমার বন্ধুর তো ছেলে-ছেলে করে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই না? কত করে বললাম, ধইজ্জ ধরো, জীবনের সাধ-আহ্লাদ একটু মিটিয়ে নিই, কিন্তু কে শোনে আমার কথা?
— তোমার নিজেরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল…
— আমি সতক্ক হয়ে কী করব শুনি? মেয়েমানুষের হাতে কি কিছু থাকে? তোমার বন্ধু তো গতবছর থেকে কন্ডোম ব্যাভার করাই ছেড়ে দিল।

মানুষের অবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যদি তার রুচিও ওঠানামা করত, কী ভালোই না হত। কিন্তু আমার রুচি দুর্ভাগ্যবশত সেই জায়গায় নামেনি যেখানে দাঁড়িয়ে একজন সদ্য-বিধবার সঙ্গে কন্ডোম ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করতে পারি। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম তাই।জবা আমার নীরবতাকে সমর্থন ধরে নিয়ে বলতে লাগল, আর আমিও এমন মুখ্যু যে ওই পিল-টিলের খোঁজও করিনি। তোমার বন্ধু কীসব তারিখ-ফারিখ ধরে বোঝাত, ওই তারিখে হলে হয় না, সেই তারিখে হলে চিন্তা নেই… আরে তুমি তো হইয়ে দিয়ে কেটে পড়লে,এখন?
—ক’মাস চলছে তোমার ?
—খালাস করাবে বলে বলছ? সে টাইম আগেই পেরিয়ে গেছে। এই ছ’মাসে পড়ল। এখন তুমিই ভরসা।
—মানে? জবার শেষ কথাটা বুলেটের মতো এসে বিঁধল।
—তুমি ছাড়া আর কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব বলো?
কী ঘটতে যাচ্ছে ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, তোমাকে কিছু টাকা দিয়ে যাব?
— সেই টাকায় ক’দিন চলবে? ফুরিয়ে গেলে পর কতবার করে হাত পাতব, তোমার কাছে? তার চাইতে আমি বলি কি…

জবা যতক্ষণ চুপ করে রইল ততক্ষণ আমার চোখে সেই সিগারেট চাওয়া লোকটার ছোপ-ধরা দাঁতের হাসি খেলে বেড়াতে লাগল। লোকটা যেন আমায় বলছে , ‘দ্যাখ কেমন লাগে। এবার বোঝ,তুই নিজে স্বার্থপর কি না। জবা যদি ওর কোলের আর পেটের বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে বলে তোকে,কী জবাব দিবি?’।

অসহ্য সাসপেন্স ভঙ্গ করে জবা মুখ খুলল। আর লোকটা সরে গেল, আমার চোখের সামনে থেকে। হ্যাঁ, একরকম আমাকে ওর পরিবারের দায়িত্বই নিতে বলল জবা। কিন্তু আমি ভয় পেতে পারি এমন কোনও শর্তে নয়।

—আমি বলছিলাম যে তুমি যদি শিয়ালদা- নৈহাটি লাইনে ঘুগনিটা বিক্রি করো, তাহলে আমরা না-খেয়ে মরি না অন্তত। ও তো ইদানিং কল্যাণী পর্যন্ত চলে যেত। খুব পপুলার, তুমি দু-একদিন গেলেই বুঝবে। আমি নিজে বানাই বলে বলছি না, লোকে দু’বার-তিনবার করে কিনে খেত। বিক্রি দুম করে বেড়ে যাওয়ার জন্যই তো এক্ষুনি একটা ছেলের বাপ হওয়ার জন্য…

কথা শেষ না করে থেমে যাওয়া জবার চোখে,এই প্রথম, আমি একটু লজ্জার ছায়া দেখতে পেলাম। ভালো লাগল আমার। একটু আগেই যে জবাকে দেখে ভাবছিলাম, কী নির্লজ্জ, কত সহজে মৃত স্বামীর সেক্স হ্যাবিট নিয়ে কথা বলছে,সেই জবাই এখন কত নম্র, কত সুন্দরী। আসলে পেটের খিদে এমন একটা জিনিস, যার সামনে কোনও আড়াল, কোনও আব্রু টেকে না। সেই খিদের মীমাংসা হয়ে গেলে শিশু নিজের শৈশব, নারী তার নারীত্ব ফিরে পায়। জবাও পাবে, যদি আমি একটু এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিই। মুহূর্তের মধ্যে ক’দিন আগেই কাগজে ছবি ছাপা হওয়া ছেলেগুলোর মুখ জেগে উঠল স্মৃতিতে। ব্রাইট সব ছেলে। কেউ এমএ বিএড, কেউ এমকম, কেউ এমএসসি। সবাই ফোরথ ক্লাস স্টাফ, কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে। নিজেদের যোগ্যতা কম করে দেখিয়ে চাকরি নিয়েছে। কেন নিয়েছে, জিজ্ঞেস করলেওরা জবাব দিয়েছে যে এই চাকরির আকালে কোনও কাজই ফেলনা নয়। তো ওই এমএ, এমএসসি পাশ ছেলেগুলো যদি টেবিল থেকে টেবিলে চায়ের কাপ, জলের গ্লাস দিয়ে আসতে পারে, তাহলে, অনার্স গ্র্যাজুয়েট আমি কেন পারব না, শিবুর ঘুগনি নিয়ে ট্রেনের কামরা থেকে কামরায় ঘুরে জবা আর ওর সন্তানদের নিশ্বাস নেওয়ার মতো একটু ব্যবস্থা করে দিতে ? জবা তো আমাকে ওর বাচ্চাদের বাপ হতে বলছে না!

সেই শুরু হল,ঘুগনির সঙ্গে আমার জার্নি। শ্রবণ যেমন বাবা-মা’কে ঝাঁকায় বসিয়ে তীর্থ-দর্শনে বেরিয়ে পড়েছিল, আমি ঘুগনি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।প্রত্যেকটা স্টেশন আমার তীর্থ আর প্রত্যেক কাস্টমার একটা করে দেবতা। সেই দেবতাদের আশীর্বাদে শিবুর বড় মেয়েটার পড়াশোনা, ছোট মেয়েটার বেবিফুড, জবার একটা নতুন শাড়ি, ভালো একটা গায়ে মাখার সাবান…

জবার আশা অবশ্য আরও বেশি ছিল, আর আমি তাতে দোষের কিছু দেখিনি। স্বামী মারা গেছে বলে যদি স্ত্রীর বেঁচে থাকার সব অধিকার কেড়ে নিতে হয়, তাহলে সতীদাহ প্রথা খারাপ কী করেছিল? তাই জবা যখন বিউটিশিয়ান কোর্সে ভরতি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ললিত নামের একটা বিহারি ছেলের সঙ্গে হালকা-ফুলকা প্রেম শুরু করল,আমি জেনেও না জানার ভান করলাম। কিন্তু এই গরিব এলাকার বাসিন্দারা বেশিরভাগই রাজাপুরের উন্নয়নের উচ্ছিষ্ট। তাদের জমি হাতিয়ে নিয়েছে হাঙর-কুমির-দালালরা আর হাতে আসা সামান্য টাকা খরচা হয়ে গেছে দু’দিনের ফুটানিতে। এখন থাকার মধ্যে আছে শুধু ক্ষোভ, হতাশা আর রাগ। অন্য কাউকে, তা সে যত অকিঞ্চিৎকর লোকই হোক, সামান্য সুখ পেতে দেখলেই সেই রাগ এমন হিংসার চেহারা নেয় যে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। জবার ক্ষেত্রেও তাই হল। আর একে ফরটিসেভেন থেকে বেরোনো ঝাঁক-ঝাঁক গুলির মতো, অসংখ্য তীব্র, তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, আমার দিকে ধেয়ে এল কারণ, জবাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর পিছনে আমার একটা ভূমিকা তো ছিলই।

প্রশ্নের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে একদিন জবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আবার বিয়ে করছ?
জবা কোনও উত্তর না দিয়ে পায়ের নখ দিয়ে ঘরের মেঝে খুঁটতে থাকল, মাথা নিচু করে।
— আমি একটা প্রশ্ন করেছি তোমায়।
—ও চায়। জবা প্রায় একটা অস্ফুট গলায় বলল।
— কে চায়?
—ললিত। জবা আবারও সেই,কান পাতলেও শোনা যাবে না, গলায় বলল।
—তা সে তোমার বাচ্চাদের দায়িত্ব নেবে? নাকি ওদের বাদ দিয়ে নিতে চায় তোমায়?
জবা এবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
মহা ফাঁফরে পড়লাম আমি। দু’একবার গলা খাঁকারি দিয়ে শেষে বললাম, তোমার বয়স এখন কত?—সাতাশ।জবা নাক টানল।
—এই বয়সে নতুন করে সংসার শুরু করার মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই,জবা। আজকাল অনেক মেয়ের বিয়েই হয় না,এই বয়সে।
—আমি এসব কিছু করার কথা ভাবিনি কখনও। কিন্তু ওই যে তুমি বিউটিশিয়ান কোর্সে ভরতি করিয়ে দিলে, ওখানে ললিত আমাদের ট্রেনিং দিত। চুলের বিভিন্ন স্টাইল, কোন চুল কীভাবে কাটতে হবে, তাই নিয়ে। আমার ধরতে একটু অসুবিধে হত,প্রথমদিকে। তখন আলাদা করে স্পেশাল ট্রেনিং দিত আমায়।
— স্পেশাল ট্রেনিং সবসময় আলাদাই দিতে হয় জবা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
— আমি ওকে আমার কন্ডিশন বলেছি। তারপরও ও আমাকেই চায়।
কথাটা শুনে জবাকে আপাদমস্তক জরিপ করলাম একবার। চাওয়ার মতোই। দু’দুটো বাচ্চার মা কিন্তু চেহারা দেখে একেবারেই বোঝা যাবে না। আশ্চর্য লাগল এই ভেবে যে শিবু মারা যাওয়ার পর প্রায় তিনবছর হতে চলল, এরমধ্যে কত জল গড়াল কত নদী দিয়ে কিন্তু আমি আজকের আগে একদিনের জন্যেও দেখিনি, জবার ফিগার ঠিক কীরকম। কেন? শিবু মাঝখানে ছিল বলে? মৃত বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, তার জীবিত স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণের থেকে বেশি? তাই যদি হয়, আজ দেখছি কী করে?
—কী ভাবছ ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জবা জিজ্ঞেস করল।
যা ভাবছিলাম তা জবাকে বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে ভাবনাটা ভিত্তিহীন নয়। জবার ধারালো মুখ, চাবুকের মতো ফিগার আমি খেয়াল করতে পারছি কারণ শিবুর বদলে ওই বিহারী ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দু’জনের মধ্যে। আর ওই ললিত যেহেতু আমার কাছে একটা, ‘নোবডি’ তাই জবা অনায়াসেই ‘সামবডি’ হয়ে উঠতে পারছে।
—চুপ করে গেলে কেন? তুমি আমায় বিউটিশিয়ান কোর্স করতে না পাঠালে পরে, ওর সঙ্গে আলাপ হত বলো?
—তার মানে সব দোষ আমার? আমাকে শিখণ্ডী খাড়া করে জবা নিজেকে জাসটিফাই করার চেষ্টা করছে দেখে গা-পিত্তি জ্বলে গেল।
—আমি তা বলিনি। আমি বলছিলাম যে তোমার জন্যই আমার জীবন আজ আবার নতুন করে শুরু হওয়ার একটা চান্স পেয়েছে। কিন্তু তুমি যদি না চাও…
আমি খেয়াল করছিলাম যে শিবু মরে যাওয়ার সময়ে যে ‘র’ জবা ছিল,তার খোলনলচে অনেকটাই পালটে গেছে। আমার সামনে যে মেয়েটা, সে বেশ কায়দা করে কথা বলতে পারে।
—কিছু বলবে না?–কী বলব বলো তো? আমার মনে হচ্ছে যে তুমি একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছ। আর তাতে যদি তুমি খুশি হও, তাহলে আমিও খুশি। শুধু একটাই কথা বলব, যা করবার বুঝেশুনে কোরো কারণ এখন কাউকে চট করে বিশ্বাস করা কঠিন।
—তোমাকে তো বিশ্বাস করতে পারি।
—সে নয় করলে। কিন্তু আমি পিকচারে আসছি কোথায়?
—তুমি না এলে তো পিকচার শুরুই হবে না। জবা হাসতে হাসতে বলল।
—মানে?
— ললিত আর আমি যদি বিয়েও করি, আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব আমি ললিতের ঘাড়ে চাপাব কেন? ওরা কি ভিখিরি? ওদের একটা আত্মসম্মান নেই?
— তাহলে কে দেখবে ওদের?
—যে এতদিন দেখছিল। ওদের বাবা মরে গিয়ে থাকতে পারে, কাকু তো বেঁচে আছে।
—আমি?
— আবার কে? তুমি আর আমি যদি ঘুগনি ফিরি করে গত তিনবছর ওদের খাওয়াতে পরাতে পেরে থাকি,আগামী তেরোবছরও পারব। জবা মিষ্টি করে হাসল।
বোবা হয়ে গেলাম একদম। মনে হল, গত দু’বছর ধরে জবা বিউটি পার্লারে,কনে সাজানোর খুঁটিনাটি শিখছে না। ও কোনও দুঁদে উকিলের আন্ডারে ট্রেনিং নিচ্ছে, মানুষকে কীভাবে প্যাঁচে ফেলতে হয়। অনেক কষ্টে বলতে পারলাম, কিন্তু তুমি তো এখন ঘুগনির পিছনে সময়ই দিতে পারো না। যা করার মোক্ষদা মাসি আর ওই বাচ্চা মেয়েটা করে…
জবা আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল, তাতে কি ঘুগনির স্ট্যান্ডার্ড একটুও খারাপ হয়েছে? হয়নি। কেন বলো তো? আমি ওদের ধরে-ধরে শিখিয়েছি স্টেপগুলো। এখন ওরা আমার মতোই জানে, কোনটার পর কী করলে টেস্ট খুলবে। আর তোমায় সত্যি করে বলছি, যেখানেই থাকি না কেন, আমার নজর ওই ঘুগনির ওপর থাকবে।
—ললিতের সঙ্গে হানিমুনে গেলেও? ইচ্ছে করে একটা খোঁচা দিলাম আমি।
—দুই বাচ্চার মাকে নিয়ে কেউ হানিমুনে যায় না।
—ভালোবাসে বললে যে?

—কোথায় বললাম? বলেছি, চায়। ব্যাটাছেলে আর মেয়েছেলে একে অন্যকে চাইবে না?
—তার মানে তুমিও চাও?
— তুমি যখন বলছ,তখন, মনে হচ্ছে চাই। কিন্তু সেই চাওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার কী সম্পর্ক? ভালোবাসা তো না চাওয়ার মধ্যে। তুমি যেমন আমাকে আর আমার বাচ্চাদুটোকে বাঁচিয়ে রেখেছ গত তিনবছর,কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চাও না, এটাই তো ভালোবাসা,তাই না?
আমার বিন্দুমাত্র সংশয় রইল না যে জবার ওকালতি শিক্ষা কমপ্লিট। আর ওর শেখাটা এত চমৎকার হয়েছে যে ও এখন চাইলে হাইকোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টেও প্র্যাক্টিস করতে পারে। উলটোদিকে আমাকে ঘুগনি বিক্রি করে যেতে হবে অনন্তকাল। লোকাল থেকে লোকালে, প্যাসেঞ্জারের পর প্যাসেঞ্জারকে। কারণ বহুবছর আগে গঙ্গায় সাঁতার কম্পিটিশনে নাম দিয়ে হটাৎ জোয়ারের ধাক্কায় ডুবতে বসেছিল একটা ছেলে। আর নিশ্চিত ফার্স্ট প্রাইজ হেলায় ছেড়ে দিয়ে উলটোদিকে সাঁতরে গিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিল শিবু। বড় হওয়ার পরও ছেলেটা ঘটনাটা ভুলতে পারেনি। সেই ছেলেটাই আমি।

……

বিয়ের বছর গড়াবার আগেই যখন ওই ললিত সিং জবার গলার নলি কেটে দিয়ে ওর টাকাপয়সা,গয়নাগাঁটি যা ছিল সব নিয়ে চম্পট দিল তখন শিবুর বড় মেয়েটা স্কুলে আর ছোট মেয়েটা ঘুমে কাদা। খবরটা যখন পেলাম তখন আমি সদ্য কোচিং শেষ করে গায়ে সর্ষের তেল মাখছি, বালতি হাতে টিউকলে স্নান করতে যাব বলে।ওই অবস্থাতেই প্যান্ট-শার্ট গলিয়ে দৌড় দিলাম।আর একদম স্ট্যাচু হয়ে গেলাম, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকা মৃতা জবাকে দেখে। ওর গলার একদম মাঝবরাবর একটা চাকু চলে গেছে যেন পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে লাইন অফ কনট্রোল। সেই নিয়ন্ত্রণরেখার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল,জবার মুখটা এখনও মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি , তাই চোখ পাকিয়ে আমায় কিছু বলতে চাইছে চলে যাবার আগে।

থানা-পুলিশ-কোর্টের ঝামেলা থিতিয়ে আসার পর, এমনকি ললিত সিং ধরা পড়ার পরও আমার মাথায় জবার শেষ সময়ের ওই চোখ-দুটো জেগে রইল। জেগে থেকে,অহোরাত্র ওর মেয়েদের ভালো-মন্দ দেখতে বলত আমাকে। আগেও আমিই দেখতাম। কিন্তু তখন ওরা জবার দেখভাল’এ ছিল। এখন? কী করব দিশা না পেয়ে মেয়েদুটোকে একটা প্রাইভেট হোমে রেখে এলাম। এখানে যত্ন-আত্তি যেমন ভালো, ফিজটাও বেশ ভালো। সে হোক, ওই শেষ দৃষ্টির সামনে টাকার অঙ্ক ম্যাটার করে না। কিন্তু ম্যাটার না করলেও জোগাড় তো করতে হয়।
টিউশানির অল্প আয়ে কষ্টেসৃষ্টে আমার একার পেট চলে যেত। কিন্তু এখন বাচ্চাদুটোর ভালো থাকা-খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবকিছুর জন্য অনেক-অনেক টাকা দরকার। ঘুগনি বাম্পার সেল হলেও সেই টাকা আসে না। এই ব্যয় আর আয়ের ভিতরকার ফাঁক বোজাতে আমি আবার একবার সামাজিক লাইন অফ কন্ট্রোল পার হয়ে সাট্টার বিজনেসে ভিড়ে গিয়ে পেন্সিলার বনলাম। আবার শুরু হল, সাতের জায়গায় সাট্টা,আটের জায়গায় আটটা, নয় না বলে নওগা, দশ ভুলে বিন্দি বলা। অভ্যেস হয়ে গেল, মেজবাবু,সেজবাবুর সঙ্গে হিসস্যা নিয়ে দরদস্তুর করা, মালিকের হয়ে। আর অভ্যেস করে নিলাম রবিবার সকাল হতে না হতে ভালো জামা-প্যান্ট পরে সেই দুই-বোনকে দেখতে যাওয়া, হোমের খাতায় যাদের বাবার নামের জায়গায় আমার নামটা লেখা আছে।
নাম থাকলে অনেক দাম দিতে হয়। সেই দাম দেওয়ার চক্করে ছাউনিতে সাইকেল জমা রেখে আমি শিয়ালদায় গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে ছ’টা বাজতে আট। আছে, তিনমিনিট সময় আছে এখনও। আর ওই সময়টুকুর মধ্যে ট্রেনে উঠে পড়তে হবে বলে হনহন করে পা চালাতে চালাতে দেখলাম, শিয়ালদা স্টেশনে প্যাসেঞ্জার নেই। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ আর যেদিকে তাকাচ্ছি ইউনিফর্ম পরা সৈন্য। সন্ধে ছ’টা বাজতে যায়। এইসময় যার জনসমুদ্র হয়ে থাকার কথা সেই শিয়ালদা স্টেশনে মানুষ নেই শুধু অজস্র সৈনিক, হলটা কী?