গাজীপুর

0
1069

 

লেখক- নীরব কবি

রায় পরিবারের মেয়ের বিয়ে। ধর্মভীরু ব্রাহ্মণ বংশ, জাতের কচকচানি নেই। মেয়ে পড়াশুনো করে শিক্ষিত, ছেলে ও তাই। বাড়ির অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছলই বলা উচিত। তবে একদিন খুব কষ্টে দিন কেটেছে। বিক্রমপুরের আদিবাস থেকে ভিটে ছেড়ে চলে আসা খুব কষ্টের ছিল। আজকের কনের যে দাদু, তিনি ছোট ছিলেন তখন। প্রথমে বিক্রমপুর থেকে নদী পেরিয়ে খুলনা, খুলনা থেকে ভারত। তাঁর এক পিসির খোঁজ পাওয়া যায় নি। তিন বোনের মধ্যে ছোটটি, বড় আদরের। মাঝেমাঝেই বাড়ির উঠোনে এসে কারা যেন বলে যেত, “দাদাবাবু, দুইডা মাইয়্যারে হিন্দুঘরে দিসেন, এইডা আমাদের ঘরে দ্যান। ভালো দামে জমিবাড়ি বেচার ব্যবস্থা কইরা দিমু।” জমিবাড়ির দাম, মেয়েটা দুটোই খেয়েছে আগুনজ্বলা মাটি।

সেসব কথা থাক এখন, কলোনির ইস্কুলে পড়ে ব্যাঙ্কে চাকরি, সিনিয়র অফিসার এখন মেয়ের বাবা। দুই ছেলে মেয়েও ‘বাংলা বলতে এখন বাংলাদেশ’ খোঁজে। শ্যামাপ্রসাদের কথা উঠলে কানে আঙুল দিয়ে বলে, ওই বদলোকটা না থাকলে বাংলা ভাগ হত না। ভারতরাষ্ট্রের খবরদারি চলছেনা চলবেনা ইত্যাদি। ভারতের ওপর অবশ্য ছেলেমেয়ের দাদুরও খুব রাগ ছিল। তবে সেটা অন্য কারণে। বলত, রাইফেলের নল গুলো ঢ্যামনা সাপের ফণা হয়ে গেছিল শুয়োরের বাচ্চাদের। পারতনা, ঝামেলাবাজ গুলোকে গুলি করে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিতে? দেখল শুধু… আমার পিসিটাকে কারা তুলে নিয়ে গেল সন্ধেবেলা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে। মরার আগে পর্যন্ত বুড়োর দুঃখ ঘোচেনি। কটা খুচরো পয়সা নাকি চৌকাঠের ফাঁকে গুঁজে রেখে এসেছিল, পরে নিয়ে যাবে বলে। আসার রাস্তায় পাছে খরচ হয়ে যায়, তাহলে শীতে লাটাই ঘুড়ির টাকা কম পড়ে যাবেনা? সেইসব ও খেয়েছে আগুনখাকির দেশ।

আচ্ছা এসব কথা বলছি কেন? আজ রায় পরিবারের মেয়ের বিয়ে। হিউম্যান্স আর ওয়ান, নো বর্ডার, নো কান্ট্রিজ – এই নীতিতে বিশ্বাস রাখেন রায়বাড়ির নবপ্রজন্ম। বাড়ির ছোট ছেলে, একপ্রকার বাবা-মায়ের অমতেই ফিরোজের বউকে বাড়িতে বহাল করেছে। ফিরোজ টোটো চালায়, টোটোর ফোন নাম্বারে ফোন করলেই বাড়ি চলে আসে। তার বউ রায়বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধে অবধি কাজ করে। মাঝেমধ্যে তাকে দুপুরে খেয়েও যেতে বলে বাড়ির ছোটপুত্তুর। প্রথমদিকে গাঁইগুঁই করলেও এখন মেনে নিয়েছে সবাই।

বিয়ের দিন সকালে গায়ে হলুদ হচ্ছে কনের। বাড়ির সবাই উপস্থিত, কোন এক বন্ধু কে সবাই মিলে হলুদ মাখাবে বলে ধরেছে, হলুদ মাখা এবং পালটা মাখানোর মধ্যে ফিরোজের বাচ্চামেয়েটিকে একটু হলুদ ছুঁইয়ে দেয় কেউ, ফিরোজের বউকেও। ফিরোজের বউ সাথে সাথে বেসিনে ধোয়ার চেষ্টা করে, মেয়েটির আর নিজের গা থেকে। সবাই একটু অবাক হয়, ফিরোজের বউ ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বললাম আমার গায়ে হলুদ দেবেন নে, সেই দিয়ে দিলেন তো! আমায় জাহান্নামে পাঠাবেন নাকি, আমরা মুসলমান, আপনাদের বাড়ি কাজ করতে এসে জাত খোয়াব নাকি!

বাড়ির ছোটপুত্র একবার মৃদু প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করে, রুকসানা তুমিও তো বাঙালী। গায়ে হলুদ লাগলে কি হবে একটু! রুকসানা ঝাঁঝিয়েই জবাব দেয়, আমি বাঙালী হতে যাব কোন দুঃখে!

শ্রাবণ সংক্রান্তির দুপুরবেলা গুগল ম্যাপ জানায় – বিক্রমপুরের নতুন বাসিন্দারা জায়গাটাকে গাজীপুর নাম দিয়েছে।