বিশ্বমানের শিক্ষাবিদ এবং প্রকৃত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার

0
472

অঙ্কুশা সরকার

চতুর্থ পর্বের পরে

এই সিরিজের পঞ্চম উপাখ্যানে, জি.এস. সরদেশাই একটি বৃহৎ প্রতিকৃতি এঁকেছেন যা ইতিহাসে যদুনাথ সরকারের অসামান্য উদারতা এবং মৌলিকত্ব প্রদর্শন করে।

একজন শিক্ষাবিদ এবং ঐতিহাসিক হিসেবে যদুনাথ সরকার

যদুনাথের পরবর্তী দিকের সকল সাহিত্যিক কার্য, প্রেমচাঁদ রায়চাঁদের প্রবন্ধ ‘ইন্ডিয়া অফ ঔরঙ্গজেব: ইটস স্ট্যাটিসটিক্স, টোপোগ্রাফি এন্ড রোডস (১৯০১)’ -এর ন্যায়সঙ্গত এবং যৌক্তিক সম্প্রসারণ। এই ক্ষীণ সূচনা থেকে, শক্তিশালী গঙ্গার মত তাঁর প্রতিভা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকাণ্ড বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ১৮০৩ সালে এর ঐতিহাসিক সমাপ্তি ঘটেছিল।

কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য যদুনাথের সকল কর্মশক্তি এবং জ্ঞান ধারণের জন্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে প্রমাণিত হয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলার ও মারাঠা ইতিহাসের শুষ্ক ইতিহাস, প্রচণ্ড পাহাড়ী প্রবাহর মতই একজন ঐতিহাসিক হিসেবে যদুনাথের প্রতিভার বহির্গমনের দ্বারা উপকৃত হয়েছে। একজন যোদ্ধা যে জীবনের সংগ্রাম লড়ছেন, বয়সের প্রভাব তাঁর কর্মশক্তি ও আশাবাদের কাছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তাঁর নিয়মতান্ত্রিক কাজ আরও কাজের দাবি রাখে, যদিও তাঁর শত্রুরাও বলতে পারবেন না যে তিনি কখনো খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা অথবা একজন লেখক হিসেবে টাকা উপার্জনের কথা ভেবেছেন।

তাঁর প্রথম শ্রেণীর লেখনী ‘দ্য হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব’, ‘শিবাজী অ্যান্ড দ্য ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’ ব্যতীত ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর লেখাগুলির তালিকা তৈরী করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি যা লিখে গেছেন তা চিরহরিৎ এবং নতুন থেকে যাবে, কারণ তাঁর কলম মুঘল সাম্রাজ্যের সভা-শিল্পীর বুরুশের মত চালিত হয়েছে। তিনি তাঁর ইংরেজী ধারায় সর্বাধিক প্রচেষ্টা করতে মনোনিবেশ করেছিলেন।

যদুনাথ সরকার প্রায়ই মন্তব্য করেছেন যে শৈলী এবং উপস্থাপনা তাঁর মগজে অধিক চাপ প্রয়োগ করে, যেখানে তাঁর প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণ এবং বর্ণনার সহিত একাগ্রতার সহযোগে তিনি প্রায় পরিপূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। একদা তিনি আমাকে লন্ডন টাইমসের প্ৰখ্যাত সংবাদদাতা স্যার উইলিয়াম হওয়ার্ড রাসেলের একটি দীর্ঘ কাহিনী বলেছিলেন, যাঁর সম্বন্ধে আমি এর আগে কখনো শুনিনি। তাঁকে ক্রাইমিয়া এবং পরবর্তীকালে ভারতে যথাক্রমে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং বিদ্রোহের রোমহর্ষক কাহিনীগুলির প্রতিবেদন করতে এবং ১৮৭৪ সালে শেষবারে প্রিন্স অফ ওয়েলসের সহিত পাঠানো হয়েছিল। রাসেল শৈলী এবং পর্যবেক্ষণের বিশারদ ছিলেন এবং তাঁর প্রতিবেদনগুলি স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাগুলি সত্য। সুতরাং, দেখে বোঝা যায় যে যদুনাথের শৈলীর উপর রাসেলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল, যিনি সেনা অভিযান, যুদ্ধের অগ্রগতি, সেনানায়কদের কৌশল এবং অবরোধ কালের ক্লান্তির বর্ণনায় তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন। যতক্ষণ না তিনি একটি লক্ষণীয় প্রভাব সহ একটি সুন্দর ঝকঝকে রচনার সৃষ্টি করতে পারতেন যা সর্বদা জীবনের শিক্ষাপ্রদ ও গূঢ় অর্থপূর্ণ হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি তিনি সেটি লিখতে, সংশোধন এবং পুনর্লিখন করতে ক্লান্ত বোধ করতেন না।
রমানন্দ চ্যাটার্জী এবং যদুনাথ সরকার ১৯০২ সালে বন্ধু হয়ে ওঠেন। রমানন্দ তখন সবেমাত্র তাঁর বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’ শুরু করেছিলেন এবং তিনি যদুনাথকে জোর করেছিলেন সেই মাসিক পত্রিকার জন্য কিছু ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু লিখতে। কিছু সময় পরে, চ্যাটার্জী চলতি রাজনীতি এবং ঐতিহাসিক গবেষণা নিয়ে একটি ইংরেজী পত্রিকা শুরু করার পরিকল্পনা করেন।

ফলস্বরূপ, ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মডার্ন রিভিউ’- এর জন্ম হল, এবং প্রথম পত্রিকাতেই যদুনাথের একটি ঐতিহাসিক লেখাটি ছিল। তখন থেকে, তিনি ঐতিহাসিক গবেষণার উদ্দেশ্যে তিনি নিয়মিত প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ লিখতেন। সময়ের সাথে সাথে, যদুনাথের বিচ্ছিন্ন লেখাগুলির সঞ্চিত ভাণ্ডার এত বিশাল এবং এর চাহিদা এত বৃদ্ধি পায় যে তাঁর আগের লেখাগুলিকে প্রস্তুত উল্লেখের জন্য পুস্তক আকারে প্রকাশ করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এবং এইগুলিকে তিনি তাঁর ‘মুঘল ইন্ডিয়া’ (১৯২০) এবং ‘হাউস অফ শিবাজী’ (১৯৪৩)-এর অধ্যয়নে প্রকাশ করেছিলেন।
তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব’ (১৯২৫ সালে)-এর কাজ শেষ হওয়া মাত্রেই, তিনি এটির স্বাভাবিক ধারাবাহিক পথে চলতে থাকেন, পেশোয়াদের অধীনে মারাঠা শক্তির বিস্তার- এর কাজে লেগে পড়েছিলেন। এই নতুন কর্মভারের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা প্রয়াত শ্রী উইলিয়াম ইরভিনের ‘দ্য লেটার মুঘলস’-এর গবেষণামূলক প্রবন্ধের সম্পাদনের কাজ করার ইচ্ছা থেকে এসেছিল। ১৭৩৭ সালে ইরভীনের মৃত্যুতে তাঁর এই প্রবন্ধের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ইরভীনের অধ্যায়গুলিকে ভালোভাবে উপন্যস্ত দুটি খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন, মূল প্রবন্ধের সহিত যদুনাথ তাঁর তিনটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করে ১৭৩৯ সালে এই কাজ শেষ করেছিলেন। এই দ্য ল্যাটার মুঘলস- এর প্রকাশনা পড়ুয়াদের জগতে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে।
এইভাবে পুনার পেশোয়া দপ্তর, কোটার গুলগালে দপ্তর, মহাদাজী সিন্ধিয়ার পারাসনিস প্রবন্ধ এবং পরবর্তীকালের বোম্বে সরকারের উদ্যোগে দ্য পুনা রেসিডেন্সি চিঠিপত্রগুলির সিরিজের গবেষণার মাধ্যমে যদুনাথ সমগ্র মারাঠা যুগের আরও গভীর অধ্যয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই সকল ঐতিহাসিক প্রবন্ধগুলিকে উপযুক্ত আকৃতি প্রদান করার জন্য, যদুনাথ গীবনসের মনুমেন্টাল হিস্ট্রির পরিকাঠামোয় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের উপর একটি পৃথক প্রবন্ধ লেখার মহান পরিকল্পনা করেছিলেন।

এই নতুন সিরিজটি, তিনি ক্রমে আঠেরো শতকের মুঘল- মারাঠা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাটি চারটি খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন, যা ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু থেকে শেষ সম্রাট শাহ আলমের (১৭০৭-১৮০৩) উপর ব্রিটিশদের শাসন প্রতিষ্ঠা অবধি ইতিহাস বর্ণিত আছে। এই চারটি খণ্ডে ভারতের আঠেরো শতকের বিভ্রান্ত করা ধাঁধাটিকে স্পষ্ট রূপরেখায় এমনভাবে নিয়ে আসা হয়েছে যে এটি বিভিন্ন জটগুলিকে অসাধারণ সাফল্যের সহিত সমাধান করেছে। ভারতীয় চিত্রপটে ব্রিটিশ শক্তির প্রারম্ভ এবং এর দ্রুত বিস্তার সুনিপুণভাবে যদুনাথের লেখায় স্পষ্ট হয়েছে।
তাঁর প্রতিটি লেখাগুলিতে, মৌলিকত্ব এবং বৃহৎ অধ্যয়নের তাঁর নিজস্ব চিহ্ন সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি প্রায়ই বিশ্ব ইতিহাস ও সাহিত্যের যথাযথ উদ্ধৃতি এবং উপযুক্ত উদাহরণ যোগ করার মাধ্যমে বিষয়টিকে নতুন করে তুলতেন। আমি কী বলতে চাইছি বোঝানোর জন্য আমি মাত্র দুটি উদাহরণের উল্লেখ করবো। তাঁর ‘শিবাজী এন্ড হিস্ টাইমস’ (৪র্থ সংস্করণ)-এর ১৪২ নং পৃষ্ঠায় যেখানে শিবাজী সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, “এই কি জসওয়ান্ত যাঁর পিঠ আমার সৈন্যরা দেখেছে?” একটি পাদটীকায়, অনুরূপ ঘটনার ওয়েলিংটন এবং ফ্রান্সের অষ্টম লুইসের মধ্যেকার একটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকার উল্লেখিত আছে। লুইসের ক্ষমার প্রতি উত্তরে চতুরভাবে ওয়েলিংটন জবাব দিয়েছিলেন, “মহারাজের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, আপনার সেনাপতিদের পৃষ্ঠদেশ দেখেই আমি সাধারণত তাদের চিনতে পারি।” অনুরূপভাবে, একই গ্রন্থের ২০৩ নং পৃষ্ঠায়, যদুনাথ, জিজাবাঈয়ের সহিত রানী গৌতমী সাতকর্ণীর তুলনা করেছেন, যিনি তাঁর পুত্রের গরিমায় গৌরবান্বিত বোধ করতেন। এইধরণের নিদর্শনগুলি নিশ্চিতভাবে লেখায় প্রাণ সঞ্চার করে এবং তাঁর সকল লেখায় এইগুলি যথাযথভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে।
যদিও যদুনাথ কোনোদিনও বিদেশ ভ্রমণ করেননি, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে চিন্তা এবং জীবনের বিশ্ব গতিবিধির সহিত তাঁর পরিচিতি কম ছিল। তিনি অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি দ্য টাইমসের পুঁথি- গত পরিশিষ্ট এবং তার পূর্বে দ্য অ্যাথেনিয়াম-এর অবিরাম পাঠক থেকেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে কীভাবে একজন প্রখ্যাত বিশারদ সর্বদা তাঁর সময়ের চলতি খবর, বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, ইতিহাস, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম উল্লেখযোগ্য অনুদানগুলি এবং এই বিষয়গুলির উপর বইগুলির তথ্যমূলক পর্যালোচনা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন।
সংক্ষেপে, যদুনাথের একজন ঐতিহাসিক হওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা অথবা সুযোগজাত ভাগ্যবান সন্তান নন, বরং একটি মহান অভিযানের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, কঠোর শ্রম ও কঠোর একনিষ্ঠ- মূলক জীবনের সার্থকতা।

পরবর্তী অংশে চলতে থাকবে…