আজকে রাতের রাজা – ৪

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস

রামখিলাওন আমার হাতটা ধরল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ডেলিবারেটলি লোডশেডিং করে রাখা হয়েছে দেশের বড় শহরগুলোয়। আর জ্যামিং করে দেওয়া হয়েছে যাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া না যায়। সব সিগনাল ব্লক করে দেওয়া হয়েছে বলে, টিভিতেও কোনও ছবি আসছে না, শুধু জরুরি সূচনাগুলো দেওয়ার জন্য দরকার মতো রেডিও স্টেশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, তুমি আসলে কে? এতসব জানো কী করে? জিজ্ঞেস করে বসলাম, কেন?

রামখিলাওন আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ওই মাতাল রিকশাওলা ঠিকই বলেছে। চায়না হ্যাজ ডিক্লেয়ারড ওয়ার অন ইন্ডিয়া। চিন, ভারত আক্রমণ করেছে।

গত রবিবারের পরের অংশ…

চৌকা

ট্রেনটায় আমাকে উঠতে দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না যেহেতু ট্রেন ভরতি করে ভারতের সৈনিকরা কোনও অজানা গন্তব্যে যাচ্ছিল। সেই গন্তব্যের বিষয়ে আমার যেমন কিছু জানা ছিল না, ভিতরে যারা ছিল তারাও কি জানত? কে জানে! যতবার আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, কোন স্টেশন পর্যন্ত যাচ্ছে ট্রেনটা, ভিতরের কেউ কোনও উত্তর দিতে পারছিল না। ওরা আমার কথা বুঝতে পারছিল না, তা নয়, আমি হিন্দিতেই প্রশ্ন করছিলাম। হ্যাঁ, এটা হতেই পারে যে ওরা আমার কথার উত্তর দিতে চাইছিল না কিম্বা ক্যানেস্তারা হাতে ঝুলিয়ে ট্রেনে উঠতে চাওয়া একটা লোককে প্রশ্নের উত্তর পাবার যোগ্য বলে বিবেচনা করছিল না। সবই সম্ভব কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল যে গায়ে উর্দি আর হাতে ইনসাস রাইফেল থাকলেও, ওরাও কোথাও একটা আমারই মতো অসহায় বোধ করছে, কিম্বা, কে জানে, আমার চাইতেও বেশি। আমার না হয় আগে-পিছে কেউ নেই কিন্তু ওদের তো আছে। বাবা-মা-ভাই-বোন, বউ কিম্বা গার্লফ্রেন্ড। যদিও বয়স সবারই বেশ কম, তবু বাচ্চা-কাচ্চাও নিশ্চয়ই আছে কারও- কারও। ভারতের অনান্য প্রভিনসে তো লোক বিয়ে করার জন্য বুড়ো বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। বিহার-ইউপি’র কতো ট্যাক্সি-ড্রাইভার’এর সঙ্গে আলাপ হয়েছে শিয়ালদায়। লোকগুলো কুড়ি না পুরতেই শাদি সেরে এসেছে আর চল্লিশে দাদু হচ্ছে। একইসঙ্গে দাদু আর বাবা দুইই হচ্ছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।

কিছু আছে, বাঙলার বর্ডার পেরোলেই জলে এমন একটা কিছু আছে যাতে লোকের শরীরে হেভি জোশ পয়দা হয়। আর আমাদের পোড়া-কপালে হরবখত গ্যাস-অম্বল লেগেই আছে। এই পেটজ্বালা আর বুকজ্বালার জন্য কত যে কাস্টমার মিস হয়ে যায় আমার প্রত্যেকদিন, ইয়ত্তা নেই তার। ছেলে ঘুগনি অর্ডার করে ফেলেছে, তখন তার মা তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে গত সপ্তাহে বদহজমের জন্য উইকলি পরীক্ষায় সে কত নম্বর কম পেয়েছিল তন্দ্রা আন্টির থেকে। প্রেমিক হাত বাড়িয়েছে দু’প্লেট ঘুগনির জন্য, প্রেমিকা সেই হাতে চিমটি কেটেও যখন সামলাতে পারছে না, তখন বগলে কাতুকুতু দিয়ে বলে উঠছে, ‘ ডায়রিয়া হল বলে তুমি অফিস-ট্যুর ক্যানসেল করতে বাধ্য হলে আর তোমার চিরপ্রতিদ্বন্দী সোমরাজ তোমার বদলে কঙ্গো চলে গেল, মনে নেই ?’। ঘুগনির প্লেট ব্যাক না করতেও পারি আমি এরকম অবস্থায়; ঢালা যখন হয়ে গেছে তখন খাও-না-খাও পয়সা দিতেই হবে, এমন একটা স্ট্যান্ডপয়েন্ট নেওয়াই যায়। কিন্তু আমার করুণা হয়। ওই মা, সেই প্রেমিকার ওপর রীতিমতো করুণা হয়। নম্বর কীসে কম পেয়েছে, না উইকলিতে; জীবনের পরীক্ষায় ওই উইকলির দাম কতটুকু? প্রেমিকা তো আরও কয়েক ডিগ্রি ওপরে। বিলেত-অ্যামেরিকা নয়, কঙ্গো ট্যুর বাতিল হয়েছে বলে কাঁদছে। আরে তোর নাগরের ডায়রিয়া হল বলে তুই পৃথিবীর ব্যাকটেরিয়াকে প্রণাম কর, অকাল-বৈধব্য থেকে ওরাই তো বাঁচাল তোকে। নইলে এয়ারপোর্ট থেকে কিডন্যাপ করে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে খরস্রোতা নদীর জলে চুবিয়ে এনে চারশো ডিগ্রি ফারেনহাইটে রোস্ট করে, তোর হবু বরকে যে ইদি আমিনের ছেলেপুলেরা খেত না, কী গ্যারান্টি আছে তার?

এইসব ভাবনা যেদিন নিজের মনে চেপে না রেখে প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে শেয়ার করি, বিক্রি বেড়ে যায় হুহু করে। আসলে, নিজের মনের কথা অন্যের মুখ থেকে শুনতে ভালোবাসে সবাই। বেড়ে পাকা দু-একজন সবসময়,সবজায়গাতেই থাকে যারা জেনারেল নলেজের ভুল ধরতে পারলে আর কিছু চায় না। সেরকমই একটা কেউ বলে ওঠে , ‘ কঙ্গো নয়, ইদি আমিন ইথিওপিয়ায় থাকত’। এবার বাঙালির আর যে দোষ থাক, অন্যের কথা নির্বিচারে মেনে নেওয়ার দোষটা নেই। ‘সূর্য পূর্বদিকে ওঠে’ এরকম এক-আধখানা ব্যতিক্রমী মন্তব্য বাদ দিলে বাদবাকি সবকিছুর একটা পালটা মন্তব্য আসবেই। এক্ষেত্রেও এল। দেখা গেল, ওই একটা কামরাতেই সেদিন অন্তত এমন চারজন আছেন যারা ইদি আমিন বিষয়ে অক্সফোর্ড থেকে পিএইচডি করে আসতে পারেন,ইচ্ছে করলেই। কিন্তু লোকাল-ট্রেনের জার্নি-টাইম বাঁধা, তাই পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যেই মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে চলে আসা গেল,যে, ইদি আমিনের মামাবাড়ি কঙ্গোয়।এই ধরণের ডিবেটে সবসময়ই কেউ না কেউ একটা শেষ কথা বলে দিয়ে লাস্ট স্টেশনের আগের স্টেশনে নেমে যান। সেই ধারার পরিবর্তন না ঘটিয়ে নামতে নামতে একজন বলে গেলেন, ‘ ক্ষমতায় বসার পর থেকে ইদি কখনও মামাবাড়ি যায়নি কারণ কঙ্গো আর ইথিওপিয়া, চির-প্রতিদ্বন্দী’।

এই আর একটা শব্দ, চির-প্রতিদ্বন্দী। ইদানিং খুব খাচ্ছে। খাবে না কেন? আগে তো শব্দটা ‘রিজার্ভড’ ছিল। ভারত-পাকিস্তান, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, সাপ-বেজি। এরাই ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দী। কিন্তু এখন? তিনবছরের,প্যান্টে হেগে ফেলা, বাচ্চার পাশে যে পৌনে তিন বছরের, প্যান্টে হিসু করে দেওয়া, বাচ্চা বসে আছে কেজি স্কুলে, তারা দুজনেও চির-প্রতিদ্বন্দী। প্রত্যেকটা অফিসে, প্রতিটি পাড়ায়, এমনকি বাজারে, পাশাপাশি আঁশবটি সাজিয়ে খদ্দেরের গলা আর মাছের পেটি একসঙ্গে কাটবে বলে বসে থাকা মাছওলারাও একে অন্যের চির-প্রতিদ্বন্দী। আমার তো টিভি দেখার সময় বা উপায় কোনওটাই নেই কিন্তু যারা দেখে তাদের মুখ থেকে শুনি ইদানিং সবকটা টিভি সিরিয়ালে নাকি একটা থিম কমন। একটি ছেলের দুটো বউ। ট্রেনে যে হকারি করে তার গম্ভীর-গম্ভীর ভাবনাচিন্তা করা মানায় না তবু এই একবিংশ শতাব্দীতে, সেকটর ফাইভ আর ফাস্ট-ফুডের জমানায়, খোদ কলকাতায়, ‘সতীন’ কনসেপ্ট কেন রমরমিয়ে চলছে কেউ ভেবে দেখেছেন? উত্তর একটাই। দুই সতীন পরস্পরের, চির-প্রতিদ্বন্দী।

সেই চির-প্রতিদ্বন্দীদের তালিকায় আজ একটা নতুন শব্দ যোগ করতেই হবে আমাকে। ‘হকার’। এতদিন জানতাম একই লাইনে রগড়ালেও যেহেতু আলাদা-আলাদা জিনিস বেচি তাই আমাদের মধ্যে ওরকম কম্পিটিশন আসবে না। কিন্তু যখন জামার বোতাম, চুলের ক্লিপ বিক্রি করা হকারের থেকে ঘুগনি বিক্রি করা হকার একটা ইনফরমেশন পর্যন্ত পায় না তখন ‘সকলের তরে সকলে আমরা’, বলতে পারব না। তার চেয়ে ওই চির-প্রতিদ্বন্দী দিয়েই শুরু করি। পাকিস্তান কেটে চিন বসিয়ে নিই। আর চিনকে টাইট দিতে আমার এই ঘুগনি কীরকম হেল্পফুল হবে, সেটাই শোনাই। তারপর যার ইচ্ছা করবে খাবে …

এমনই ব্রত অন্তরে নিয়ে সবে পাদানিতে পা রেখে উঁকি দিয়েছি কামরায়, একটা ইলেকট্রিক গাঁট্টা খেলাম। এমনই হাই-ভোল্টেজ সেই গাঁট্টার যে ওটা কোনও মানুষের হাত থেকে আমার মাথায় নেমেছে, বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোথাও কোনও গুপ্ত ইলেকট্রিক সুইচ আছে নাকি এই ট্রেনে? ভাবনাটা দানা বাঁধতে পারল না কারণ একটা দমদার গলা হেঁকে উঠল, ‘উতর যাও’। নেমেই গেলাম এবং এতক্ষণ যে দেশভক্তির পারদ চড়চড় করে চড়ছিল তা কেমন যেন মিইয়ে গেল একটু। চিনে সোলজাররাও কি দেশের পাবলিককে এমন গাঁট্টা দিয়ে অভ্যর্থনা জানায় নাকি সে দেশে সৈনিক আর জনতার সম্পর্ক অতি মধুর? এইরকম ভাবনাও বুজগুড়ি কাটছিল মাথায় যতক্ষণ না আমাদের বাচ্চাবেলায় ঘটা তিয়েন-আন-মেন’এর কথা মনে পড়ল। দশহাজার না বিশহাজার কত লোক যেন নিকেশ হয়ে গিয়েছিল তাতে? যাক, সেই তুলনায় এই গাঁট্টা কিছুই নয়। ব্রহ্মতালুতে একশোটা লঙ্কা ডলে দিলে যেরকম লাগবে, সেরকম একটা ফিলিং হচ্ছে বটে কিন্তু একটু জল বুলিয়ে দিলেই মনে হয় কমে যাবে। জলই গরিবের অ্যান্টিসেপ্টিক। আর ঘুগনি ভিটামিন। সেই ভিটামিন হাতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে সাইকেল কালেক্ট করে হ্যান্ডেলে চাপাব ক্যানেস্তারা আর রাজাপুরের ভিতর দিয়ে ফিরতে ফিরতে যেখানে বাচ্চাদের দঙ্গল দেখব, দাঁড়িয়ে পড়ব। চিন আক্রমণ করেছে বলে তো ভারতের লোকের ক্ষিদে-তেষ্টা উবে যায়নি। তিন-চারটে বাচ্চাদের গ্রুপের সামনে দাঁড়ালেই আমার মাল খতম, পয়সা হজম।

চুলোয় যাক পয়সা। আজ ঘুগনি ব্যবসার শেষ দিনটা একটু চ্যারিটি করে যাই। সৈন্যদের নাই বা পারলাম, দেশের ভবিষ্যৎকে একটু হাত খুলে খাইয়ে যাই। কাল থেকে আর ঘুগনির নাম মুখে আনব না। শালা,হকারিই করব না আর। যেখানে ইউনিটি নেই সেই লাইনে ঘেন্না। যুদ্ধ ছেড়ে বিশ্বযুদ্ধ লাগলেও সাট্টার মার্কেট বন্ধ হবে না। আমি ওতেই কনসেন্ট্রেট করব এবার থেকে। সার্বিক অনিশ্চয়তার ভিতরে সাট্টাই একমাত্র জায়গা যেখানে লেগে থাকলে রিটার্ন পাওয়া যাবেই। কারণ, নামে জুয়ো হলেও এখানে পুরো ব্যাপারটাই গট-আপ।

গট-আপ কোথায় নেই? কিন্তু তার ভিতরেও কিছু ফাঁকফোকর থাকে। রেসের মাঠে যেমন। কোন ঘোড়ায় কত বাজি ধরা হয়েছে রিপোর্ট পাওয়ার পরই কে ফার্স্ট, কে সেকেন্ড হবে নির্দেশ এসে যায় ওপরতলা থেকে আর হুকুমের চাকর জকিরা সেই মতো চাবুক চালিয়ে তেড়ে ছোটায় ঘোড়াকে কিম্বা ঢিল দিয়ে দেয় । পুরোটাই, মালিকের লাভের কথা মাথায় রেখে, গট-আপ। কিন্তু ফুলপ্রুফ নয়। কারণ জকি বুঝলেও ঘোড়া তো গট-আপ বোঝে না। হাজার চাবুকেও একদিন সে জোরে দৌড়োয় না, হাজার সিগনালেও স্পিড কমায় না। ব্যস, অন্যরকম হয়ে যায়, রেজাল্ট।

সাট্টায় সেই চাপ নেই। এখানে যে নম্বর ডিক্লেয়ারড হলে পরে কিং-পিন’এর ঘর থেকে সবচেয়ে কম টাকা খসবে সেই নম্বরটাই ঘোষণা করা হবে। এবার সেই নম্বরে তো পাঁচ-দশটা লোক টাকা রাখবে! সেদিনের মতো তারাই লাকি। তারাই চিৎকার করে পাঁচশোটা লোককে জানাবে, ‘ দ্যাখো খেলা হয়েছে বলেই আমি জিতেছি’ আর পরদিন এসে আবার বাজি ধরবে শূন্য থেকে দশের ভিতরে একটা কোনও নম্বরে। নির্ঘাত হারবে সেদিন। কিন্তু ওই যে একদিন জিতেছিল সেই ভরসায় দিনের পর দিন হারতে আসবে। হারতে হারতেও হান্ড্রেড পারসেন্ট গট-আপ ধান্দাটাকে খেলা বলে দাবি করবে। কিন্তু খেলা তো নয়। আর নয় বলেই সাট্টার সঙ্গে জড়িত লোকদের পথে বসার কোনও চান্স থাকে না। হ্যাঁ, যদি পুলিশের সঙ্গে বখরা নিয়ে ঝামেলা হয় তাহলে অন্য কথা কিন্তু সেটা বাদ দিলে এখানে পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত। আর আমার জীবনের কোথাও যেহেতু আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তাই একটা ব্যাপারের কমা-সেমিকোলন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায় এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে। দেখতে ভালো লাগে, অসংখ্য মহল্লা থেকে অগুনতি পেন্সিলার লিখে নিচ্ছে, কে কত নম্বরে কত টাকা লাগাচ্ছে আর তারপর যে নম্বরটা ঘোষণা করা হলে সেই সম্মিলিত টাকার সবচেয়ে কম পারসেন্টেজ ফেরত দিতে হবে, সেটাই উঠে আসছে বিজয়ী নম্বর হিসেবে। একদম সোজা আর সরল অঙ্ক।

মাফিয়া থেকে মিডিয়া, পুলিশ থেকে পেটোবাজ সবাই সেখান থেকেই নিজের-নিজের ক্ষমতা ও পোজিশন মাফিক হিস্যা পায়। আমার মতো জীবনের অঙ্কে ফেল করা লোকের কপালেও ছিটেফোঁটা জোটে। সেই পারসেন্টেজটাই বাড়াতে হবে এবার। আরও বেশি লোককে বোঝাতে হবে যে, নিজের কমিশন বাড়ানোর জন্য নয়, তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে দিতে চাইছি বলেই তাকে ইনভেস্ট করতে বলছি…

ট্রেনের চাকা ঘুরতে শুরু করল। কে জানে কী ভেবে আমি একবার হাত নাড়িয়ে টা টা করলাম। ভিতরের সৈন্যরা কেউ খেয়ালও করল না। ঘর-বাড়ি ছেড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ওরা,এখন কোথাকার কোন ঘুগনিওলা হাত নাড়ল না পা কী এসে যায় ওদের? কিছুই না। আমি তাও একটু এগিয়ে গেলাম ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটা গতি বাড়াল। আর তখনই খেয়াল করলাম লোকটাকে। ছুটতে ছুটতে আসছে, ট্রেনটা ধরবে বলে। আমি ছাড়া পৃথিবীর সব হকারই তো খবর পেয়ে গেছে যে আজ আর কোনও ট্রেনে বিক্রিবাটা হবে না। পৃথিবীর সব প্যাসেঞ্জার আত্মগোপন করেছে নিজের নিজের কুঠুরিতে। সেই জাপানি বোমার ভয়ে যেমন আলোর মুখে ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতায়, তেমনই এক অন্ধকার যেন আবার নেমে আসছে এই শিয়ালদা স্টেশনে, সন্ধের মুখে। তার ভিতরে ওই ছুটে আসছে, কে ও?

ভাবনাটা গোল হয়ে শুরুর জায়গায় ফিরতে যতটা সময় নেয় তার চাইতে কম সময়ের মধ্যে চলন্ত ট্রেনের লেজের দিকের একটা কামরার হ্যান্ডেল ধরে ফেলল লোকটা। আর হ্যান্ডেলটা ওর হাত থেকে স্লিপ করে গেল তৎক্ষণাৎ। লোকটা পড়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি আছড়ে পড়বে প্ল্যাটফর্মে,নয়তো পিস-পিস হয়ে যাবে চাকার নীচে, এটা দেখার পর আমার ওকে দু’হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলা আর ট্রেনটার স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে কত সেকেন্ড চলে গেল আমি জানি না। কিন্তু সেই সবকটা সেকেন্ড মিলিয়েই বোধহয় একটা স্প্লিট সেকেন্ড তৈরি হয়। একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে, আমাকে ধন্যবাদ জানানোর সময় লোকটা ওই শব্দটা উচ্চারণ করল। আর আমার মাথার মধ্যে মন্ত্রের মতো পাক খেতে থাকল, ‘স্প্লিট সেকেন্ড’। পৃথিবীতে ভালো বা খারাপ, সবই তো স্প্লিট সেকেন্ডে হয়। আর তার ফল কত-কতদিন ধরে বয়ে নিয়ে চলে মানুষ। যেমন দু’হাত বাড়িয়েও লোকটাকে বাঁচাতে না পারলে সেই খারাপ অভিজ্ঞতার গ্লানি অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হত আমাকে। হয়তো ওই ট্রেনটার চাকা কিম্বা প্ল্যাটফর্মের শানও শরিক হত সেই খারাপ লাগার। কিন্তু ট্রেনটা তো দাঁড়িয়ে পড়েছে একটু দূরে গিয়ে। ওই তো ট্রেনের ভিতর থেকে অজস্র উর্দি-পরা সৈনিক নেমে পড়েছে। ছুটে আসছে এদিকেই।

ওরা সবাই যে একটা ভালোলাগার শরিক হতে ছুটে আসছে সেটা বুঝতে আমার কিছুক্ষণ সময় লাগল। যেমন সময় লাগল,ওই লোকটা আসলে কে, সেটা বুঝতে। যখন বুঝলাম, তখন থম মেরে গেলাম। লোকটা ইন্ডিয়ান আর্মি’র মস্ত বড় অফিসার। পুরো ইস্ট আর নর্থ-ইস্ট জোন, ওর আন্ডারে। ওকে ঘিরে ধরে থাকা সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে হটাৎ, ‘অ্যাটেনশন’ বলে উঠল লোকটা। ওই এক ইশারায় মুহূর্তের মধ্যে এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল সৈন্যরা যে মনে হতে থাকল, সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে পোজিশন নিয়েছে।

একটা লম্বা তালগাছের মতো এবার সটান উঠে দাঁড়ালেন উনি। হিন্দিতে বলে উঠলেন, চিন আমাদের অ্যাটাক করেছে, এটা এতক্ষণে গোটা দেশের লোক জেনে গেছে। কিন্তু যেটা দেশের লোক জানে না এবং দেশের লোককে এই মুহূর্তে আমরা জানতে দিতেও পারি না, সেটা হচ্ছে, কেমিক্যাল ওয়ার শুরু করতে যাচ্ছে চিন। মনে রাখতে হবে, ১৯৬২’র চিন আর আজকের চিনে অনেক তফাত। সেদিন চিনা শত্রুরা, আমাদের শত্রু হলেও, সরাসরি এগিয়ে এসেছিল আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আর আমরাও বীরের মতো মোকাবিলা করেছিলাম। সেটা ছিল পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যুদ্ধ, বীরের সঙ্গে বীরের যুদ্ধ। কিন্তু আজকে চিন যা করতে যাচ্ছে সেটা যুদ্ধ নয়, কাপুরুষতা। কারণ কাপুরুষরাই শুধু অন্য দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে পেরে না উঠলে, সেই দেশের সাধারণ মানুষ, ঘরের বউ, মা,বোন, শিশুদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। বিষ দিয়ে ক্ষেতের ফসল, জলের মাছ নষ্ট করে দেয়। এমন গ্যাস ছড়ায় যে দমবন্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়, আট থেকে আশি।

— এটা কি নিউক্লিয়ার ওয়ারের মতোই স্যার? একজন সৈনিক প্রশ্ন করল।

আমার ধারণা ছিল যে মিলিটারিতে ওপরের অফিসাররা যখন কথা বলে, নিচের কেউ কথা বলে না। ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার নাটকের ডিরেক্টর,বাবুয়াদা এই ধারণার জন্ম দিয়েছিল আমার মধ্যে। প্রতি তিনমিনিট অন্তর একবার করে ‘ মিলিটারি ডিসিপ্লিন’ চাইত বাবুয়া’দা। কিন্তু ওই কমান্ডারকে হাসি মুখে অধস্তন একজনের প্রশ্ন রিসিভ করতে দেখে আমি শিওর হয়ে গেলাম যে মিলিটারিতে মিলিটারি ডিসিপ্লিন চলে না।

প্রশ্নের জবাবে আর্মি কমান্ডার বললেন, নিউক্লিয়ার যুদ্ধে তখন-তখন ধ্বংসের পরিমাণ অনেক বেশি হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা ভীষণভাবে দেখাও যায়। এখন, ইন্টারন্যাশনালি মিডিয়া এতটাই অ্যাকটিভ আর হিউম্যান রাইটস গোষ্ঠীগুলো এত স্ট্রং যে চিন এই কাজটা করবে না। করলে পরে, ওয়ার্ল্ডওয়াইড বদনাম হয়ে যাবে, চায়না’র। সেই রিস্ক ওরা নেবে না। তার বদলে ওরা এমনকিছু করার চেষ্টা করবে যাতে ইন্ডিয়া’র ক্ষতি বিরাটভাবে হয়,কিন্তু সেই ক্ষতিটা যে করছে সে আড়ালে থাকতে পারে। তাই কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ার কারণ এই যুদ্ধটা করার জন্য আর্মি লাগে না। লাগে একটা বড় ল্যাবরেটরি, বিষাক্ত সমস্ত গ্যাস আর সাঙ্ঘাতিক সব পয়জন। আর সেগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কিছু লোক অ্যাপয়েন্ট করা হয় যারা এগুলোকে স্প্রেড করে । স্প্রেড করার সময় বিষ ওই লোকগুলোর শরীরেও ঢোকে আর ওরা পোকামাকড়ের মতো মরে। বাট আই হ্যাভ নো সিম্প্যাথি ফর দেম। আই ডোন্ট ইভেন কনসিডার দেম অ্যাজ সোলজারস।

—কিন্তু এটা যদি অলরেডি চায়না শুরু করে দিয়ে থাকে? অন্য একটা সৈনিক জিজ্ঞেস করল।
— যদি শুরু করে দিয়ে থাকে তাহলে তার মোকাবিলাও শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আর সেই মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের গোর্খা রেজিমেন্ট। বিকজ, সিকিম থেকে দার্জিলিং’এর যে পাহাড়ি এরিয়া তার প্রত্যেকটা পাথর আর অর্কিড ওরাই চেনে। মেক নো মিসটেক, চিন যে ‘গোর্খাল্যান্ড’ বলে একটা আলাদা কান্ট্রি তৈরি করার প্ল্যান কষছিল তার একমাত্র কারণ কিন্তু ইন্ডিয়ার ভিতরে নিজের স্যাটেলাইট বানিয়ে রাখা নয়। আরও বড় কারণ হল, ইন্ডিয়ান আর্মি’র গর্ব যে গোর্খা রেজিমেন্ট, তার মনোবল ভেঙে দেওয়া। গোর্খা সোলজারের মনে একটা দ্বিধার জন্ম দেওয়া, সে আদৌ ভারতীয় তো?
— এই লোকটা কে স্যার? কমান্ডারের কথার মধ্যেই দু’টো লোক বলে উঠল,আমাকে দেখিয়ে।
আমি চমকে গিয়ে বলে উঠলাম, আমি একজন পেন্সিলার।
সবাই অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি ভাবছি, বিষয়টা এক্সপ্লেন করার আগে আবার একটা ইলেক্ট্রিক গাঁট্টা খাব কি না, দেখলাম কমান্ডার হাসতে হাসতে বলছেন, হি ইজ আ সিভিলিয়ান। কিন্তু আজ এই সিভিলিয়ান না থাকলে হয়তো তোমাদের কাছে পৌঁছনোর আগেই…
—আপনি ইউনিফর্ম পরেননি কেন স্যার? ইউনিফর্ম পরলে পরে তো আপনাকে ট্রেনের ভিতর থেকে চিনতে পারতাম।অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বলে উঠল।
—ইউনিফর্ম পরার অসুবিধে ছিল কারণ যে ইনফরমেশনটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আসছি, সেটা টপ সিক্রেট। আর এই সিক্রেট ব্যাপারটা যে ইন্ডিয়ান মিলিটারি জেনে গেছে সেটা চাইনিজ মিলিটারিকে জানতে দেওয়া যাবে না।
— একটু ডিটেলে এক্সপ্লেন করা যাবে স্যার? একজন জিজ্ঞেস করল।
সঞ্জয় রাঠোর দু’রকম ইশারা করলেন উত্তরে। প্রথম ইশারায় চারজন সৈনিককে বাদ দিয়ে বাকিরা দু’কদম পিছিয়ে গেল। যে চারজন আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল তাদের মধ্যে দু’জনের চেহারা দেখে কোথাকার লোক মালুম না হলেও,অন্য দু’জনের একজন শিখ আর অন্যজন গোর্খা। রাঠোরের দ্বিতীয় ইশারায় ওরা আমাকে হ্যাঁচকা টানে ট্রেনের একটা কামরায় তুলে ফেলল। আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, কী মতলব?
চারজনের মধ্যে একজন পরিষ্কার বাংলায় বলল, মতলবটা স্যার বলবেন।
স্যার কেন বাকিদের প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে রেখে দুম করে এই চার চ্যালাসমেত আমাকে নিয়ে ট্রেনের মধ্যে উঠে পড়লেন, ভেবে ঘাম দিতে শুরু করল আমার। এবার কি এনকাউন্টার হবে নাকি? কিন্তু আমার ঘুগনির ভিতর তো কোনও কেমিক্যাল নেই। ওরা চাইলে টেস্ট করে দেখতে পারে।
—আমি সঞ্জয় রাঠোর। আর আজ আমাকে বাঁচানোর জন্য দেশের তরফে আপনাকে ধন্যবাদ, কারণ এখন আমার দেশের আমাকে প্রয়োজন। আর আপনাকেও। কমান্ডার নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে আমার হাতটা খুলে যাবে মনে হচ্ছিল। তার মধ্যেই ওই কামরায় উপস্থিত চারজন নিজেদের নাম বলল, আমায়। শিখ যে তার নাম ,অমরদীপ, গোর্খা যে, সে শ্যামরাজ আর যে দু’জনকে চেহারা দেখে চিনতে পারিনি তাদের একজনের নাম, ইমরান;বাড়ি জব্বলপুরে। বাংলা যে বলছিল তার নাম আলবার্তো রডরিগস।
— নিজের নামটাও ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে বলতে হচ্ছে? আমি স্থান-কাল-পাত্র ভুলে বলে ফেললাম।
— এটাই আমার নাম।আমার ঠাকুরদার বাবা গোয়া থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। আলবার্তো বাংলাতেই জবাব দিল।
আমাদের দু’জনের কথাবার্তায় কিছুটা অধৈর্য হয়ে সঞ্জয় রাঠোর বলে উঠলেন, এখন আমাদের সামনে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ আর তার মোকাবিলা করতেই হবে আমাদের। খুব সংক্ষেপে বলছি, চিন যে কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ারের ব্যাপারটা বর্ডার এরিয়াতেই সীমাবদ্ধ রাখবে তা কিন্তু নয়। আমার কাছে স্পেসিফিক ইনফরমেশন আছে, পাটনা, গৌহাটি, ইম্ফল এবং বিশেষ করে কলকাতার বিপদ সবচাইতে বেশি কারণ ভারতের পূর্বাঞ্চলকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করাটাই চিনের লক্ষ্য। পাকিস্তানেরও উদ্দেশ্য একই। কিন্তু মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের থেকে রিসোর্স আর ইন্টেলিজেন্স পাওয়ার অনেক বেশি বলে চিন ভারতের মাটিতে যে নাশকতার প্ল্যান করছে, তার ধরণটা কমপ্লিটলি আলাদা। তার আঁচ পাওয়ামাত্র, আমি তোমাদের থামানোর জন্য বেরিয়ে পড়ি। তোমাদের ট্রেনটাকে আটকাতে পেরেছি,খুব ভালো হয়েছে; এখন বর্ডার এরিয়ার থেকে ম্যাক্সিমাম সিটিগুলোকে প্রোটেকশন দেওয়া বেশি জরুরি। ফার্স্ট অ্যাটাকগুলো এখানেই হবে বলে সন্দেহ করছি ।
— কী করতে পারে ওরা? অমরদীপ জানতে চাইল।
— দে উইল টার্গেট আওয়ার লিডারস। পারটিকুলারলি আমাদের ইস্টার্ন স্টেটসগুলোর মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, বিচারপতিদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে চিন। যে কেমিক্যাল অ্যাটাকের ভয় পাচ্ছি আমরা সেই অ্যাটাক সিকিম, অরুণাচল বা কালিম্পং’এর গ্রামে স্টার্ট না করে যদি অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং বা হাইকোর্টে শুরু করা যায় তাহলে ম্যাক্সিমাম ড্যামেজ করা যায়, কারণ, আ কান্ট্রি ইজ লেড বাই ইটস লিডারস।
—আমাদের অ্যাকশন প্ল্যান কী হবে তাহলে এখন? শ্যামরাজ জিজ্ঞেস করল।
—উই উইল সেফগার্ড আওয়ার লিডারস। এটাই আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আর তার জন্য তাদের গুপ্ত কোনও জায়গায় রাখতে হবে আপাতত। উল্টোদিকে চিনকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমরা প্রচার করে দেব যে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ইজ আন্ডার মিলিটারি কমান্ড। তারপর, টিভি সম্প্রচার যেহেতু বন্ধ তাই স্যাটেলাইট মারফত পূর্বাঞ্চলের সুপ্রিম কমান্ডারের ছবি ছড়িয়ে দেব। কিন্তু সেই ছবিটা আমার হবে না। হবে একদম সাধারণ একটা লোকের। সেই লোকটাই এই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের তুরুপের তাস। তাকে সামনে রেখেই আমরা মুভ করব। চিন মিসগাইডেড হয়ে যাবে।
—কিন্তু এই ব্যবস্থা কতদিন চালাতে পারবেন? আলবার্তো জিজ্ঞেস করল।
—যতদিন দরকার। তবে আমার ইনটিউশন বলছে, এই সিচুয়েশন বেশিদিন লাস্ট করবে না। অলরেডি আন্তর্জাতিক স্তরে তোলপাড় পড়ে গেছে, খুব দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টাবে। কিন্তু এই ইনিশিয়াল স্টেজটা খুব ক্রুশিয়াল। প্রথম চালটা আমরা ঠিকঠাক দিলেই, চিন ব্যাকফুটে চলে যাবে। আর তার জন্য…
—আমাদের একটা নকল সুপ্রিম কমান্ডার চাই। ইমরান বলল।
—পাবেন কোত্থেকে? বাকি তিনজন একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
রাঠোর হাসলেন, তোমাদের সামনেই তো বসে আছে। লোকটা একদম নো-বডি হতে পারে কিন্তু ওর সাহস আর উপস্থিত-বুদ্ধি দুটোই আছে। নয়তো আমি যখন পিছলে পড়ে যাচ্ছি তখন অত কুইকলি রিয়্যাক্ট করতে পারত না। ওই মুহূর্তেই আমার মাথায় ব্যাপারটা ক্লিক করে।

ওদের ওই স্ট্র্যাটেজি শুনতে শুনতে কেমন একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল তাই রাঠোরের একদম শেষ কথাগুলো কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকেনি। কিন্তু যখন ওর চারজন অ্যাসিসটান্ট একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ এখন এই তাহলে আমাদের সুপ্রিম কমান্ডার?’, আমার চটকাটা ভেঙে গেল। আমি ফ্যালফেলিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি নেমে যাব?

আলবার্তো বলল, নামবেন কি আপনি তো অন্যদের ট্রেনে তুলবেন। আজকের যুদ্ধে আপনিই আমাদের কমান্ডার। স্যারের কথা শুনলেন না?

এনকাউন্টারের আগে কি ওরা এরকম বাজে রসিকতা করে নাকি? রাগ হয়ে গেল আমার। পরিষ্কার বলে দিলাম, আপনাদের কথা শোনার দরকার বা প্রয়োজন কোনওটাই আমার নেই। আমাকে যেতে হবে এখন। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে যেতেই আবারও একটা ইলেক্ট্রিক গাঁট্টা পড়ল মাথায়। আমি, ‘মাগো’ বলে বসে পড়লাম কামরায়।

রাঠোর একটু কড়া গলাতেই ওঁর সৈন্যদের বললেন, কন্ট্রোল ইওরসেলভেস। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, আপনার কোনও ভয় নেই। ধরে নিন, এই মুহূর্ত থেকে আপনি আমাদের রাজা। রাজার মতো বিহেভ করুন। এভরিওয়ান ইজ অ্যাট ইওর সারভিস।

গাঁট্টার জ্বালায় জ্বালাময়ী সব সত্য বেরিয়ে আসতে শুরু করল আমার মুখ দিয়ে, কেন রাজা করতে চাইছেন আমায়? আপনাদের না মেরে চিনের গুপ্তচররা যাতে আমাকে খুন করে তাই তো? হব না আমি রাজা। যেমন আছি, দিব্যি আছি। মরবার জন্য রাজা হতে যাব কেন?

—মরে তো আপনি এমনিও যাবেন একদিন। তার আগে একটু বেঁচে নিন। চূড়ান্ত ক্ষমতা হাতে পেলে কেমন লাগে, একটু দেখুন। আপনাকে দেখে যা মনে হচ্ছে্‌ আপনি সারাজীবন শুধু হুকুম তামিল করেই এসেছেন। এবার হুকুম দিয়ে দেখুন কেমন লাগে। একরাত না দু’রাত তাই নিয়ে ভাবছেন কেন? একরাতের স্বর্গসুখ কি দশবছরের নরক-যন্ত্রণার থেকে ভালো নয়? আলবার্তো খুব আবেগ দিয়ে বলল।

ওই অবস্থাতেও আমার মনে হল যে এই ছেলেটা নির্ঘাত লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত ছিল,মিলিটারিতে যোগ দেবার আগে। নইলে এই সিচুয়েশনে এত কবিত্ব আসে না। কিন্তু আমি না কবি, না সৈনিক। রোজকার মতো ঘুগনি বিক্রি করতে এসে আমাকে যে এতবড় ঝামেলায় ফেঁসে যেতে হবে, তা কি কল্পনাও করেছিলাম ? —কিন্তু এবার আমি করব কী ?

রাঠোর বললেন, আপনি জিজ্ঞেস করছেন কেন? ইউ আর দা সুপ্রিম অথরিটি নাও। আপনার যেখানে খুশি যান, যা খুশি করুন, আমরা কোনওভাবে আপনাকে ডিস্টার্ব করব না। শুধু এই চারজন কমান্ডারের মধ্যে একজন আপনার গাড়ি চালাবে, একজন আপনার পাশে-পাশে থাকবে আর বাকি দু’জন কাউকে বুঝতে না দিয়ে ফলো করবে আপনাদের। সো কাম অন, লেট’স গেট ডাউন ফ্রম দা ট্রেন অ্যান্ড স্টার্ট আওয়ার মিশন। বাই দা ওয়ে, আপনাকে নিজের ড্রেসটা একটু চেঞ্জ করে নিতে হবে। আর একটু অ্যারিস্টোক্র্যাটিক কিছু… বুঝতে পারছেন তো?

আমি নিজের বগলে রিফু করা শার্ট আর মঙ্গলাহাট থেকে কেনা প্যান্টের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। অনেকটাই চেঞ্জ করতে হবে ড্রেস-ফেস। সে নয় করলাম কিন্তু স্টেশনে পড়ে থাকা ওই ঘুগনির ক্যানেস্তারার কী হবে? ওর ওপর যে বড় মায়া আমার। আর তার চেয়েও বড় কথা ভিতরের ওই অতটা ঘুগনি নষ্ট হবে?

— হোক।রাজাকে রাজার মতো চলতে হয়। এইসব ভাবা তার শোভা পায় না। আমার ভিতর থেকে একটা গলা বলে উঠল, যার আওয়াজ আগে কখনও শুনিনি। আসছে, চেঞ্জ আসছে আমার। একটা সার্বিক মেক-ওভার হচ্ছে টের পাচ্ছি। সেই মেক-ওভারের দাপটে আমি ক্যানেস্তারার দিকে ফিরে না তাকিয়ে স্টেশনের বাইরে চলে এলাম গট-গট করে।সঙ্গে শুধু আমার টাকা-পয়সা রাখা ছোট্ট বটুয়া আর রামখিলাওনের দেওয়া ছোট্ট নীল ডায়েরিটা। এই এত ঝামেলার ভিতর ডায়রিটার প্রথম পাতায় একবার চোখ বোলাতে পেরেছিলাম শুধু। বেশ গোটা-গোটা করে লেখা, ‘রঞ্জন বসুর জীবনের কয়েকটা কথা।’ রঞ্জন বসু? এটাই তার মানে তেত্রিশ বছর, মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্সে কাজ করা লোকটার আসল নাম! কিন্তু সেই নাম ত্যাগ করে ও ‘রামখিলাওন’ সেজেছিল কেন? স্টেশনে এসে আস্তানা গেড়েছিল কীসের খেয়ালে? নিজের খাট-বিছানা ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের শান, বাড়ির বাথরুম ছেড়ে ওই সুলভ শৌচালয়? লোকটা মানিয়ে নিল কী করে ? প্রতিমাসে যে মিনিমাম কুড়িহাজার টাকা পেনশন পায় সে একটা কম্বলের কাঙাল? লোকটা নির্ঘাত সন্ন্যাসী নয়তো উন্মাদ। আর তা নইলে আরও বড় কোনও রহস্য আছে এই ডায়রির পাতায় পাতায় । সেই রহস্য ভেদ করার সময় আমি এখন পাব না কারণ আমার আগু-পিছু রাঠোরের কমান্ডোরা। কিন্তু একটু অবকাশ পেলেই আমাকে ঢুকে পড়তে হবে রঞ্জন বসুর জীবনের ভিতর। রাজা হয়েছি বলে ভুলে গেলে চলবে না।

বাইরে থেকে ঝাঁপ ফেলা একটা দামী পার্লারে ঢুকলাম আমি। স্টেশন থেকে আধ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে এরকম একটা জায়গা আছে কোনওদিন চোখে পড়েনি তো। অবশ্য একজন হকারের চোখ কোলে মার্কেট আর পাইস হোটেলের বেশি কীই বা দেখতে সক্ষম?কিন্তু এখন আমায় চোখ পাল্টাতে হবে। এই ‘স্পা’ না ‘ফা’ থেকে যখন বেরোব তখন যেন গা থেকে ঘুগনি নয় ফ্রেঞ্চ পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসে।

দুটো মেয়ে এগিয়ে এসেছিল আমায় শ্যাম্পু-ট্যাম্পু করে ঘাড়-মাথা মাসাজ দিয়ে দেবে বলে। কিন্তু ইমরান আর শ্যামরাজ ইশারায় ভাগিয়ে দিল ওদের। রাগে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত জ্বলে গেল আমার। কেন মেয়ে-দুটোকে আসতে দিল না আমার কাছে? ওরা কি ব্রহ্মচারী রাজা চায় নাকি? তাহলে খুঁজে নিক অন্য কাউকে, আমার দ্বারা হবে না। রাজাই যদি হতে হয়,তাহলে গদ্দাফির মতো রাজা হতে চাই আমি। সাট্টার ব্যবসায় টালমাটালের সময় যখন রেগুলার কাগজ পড়ছি তখন প্রায় প্রতিদিন লোকটার নিউজ থাকত, ফ্রন্টপেজে। ওর বডিগার্ডদের মধ্যে একটাও পুরুষ নেই, এমনটাই পড়েছিলাম। ছবিও দেখেছিলাম, সব বিলো টুয়েন্টিফাইভ মেয়েগুলোর। প্রত্যেকটা অপূর্ব সুন্দরী, প্রত্যেকের দুর্দান্ত ফিগার। অটোমেটিক রাইফেল হাতে গদ্দাফিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি না মিথ্যে জানি না, কাগজে পড়েছিলাম, গদ্দাফি নাকি আগে বিছানায় টেস্ট করে নিয়ে তারপর বডিগার্ড’এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিত। করলে ভালোই করত। এ কি ঘুগনি নাকি যে স্টেশনে ফেলে রেখে পচতে দেবে? নাহয় ওরকম কপাল করেই আসিনি তবু রাজা যখন সাজিয়েছ, স্পা’র দুটো মেয়েকে গালে হাত বুলিয়ে দাড়ি কাটতে দেবে না এ কেমন অত্যাচার? আমি রাঠোরের সঙ্গে কথা বলার সময় দুটো ফিমেল বডিগার্ডের রিকোয়েস্ট করব, ঠিক করলাম।

রিকোয়েস্ট করার জন্য যে সময়টুকু দরকার তাই পেলাম না কারণ স্পা থেকে কমান্ডোদের এনে দেওয়া জামা-কাপড়ের মধ্যে থেকে বেছেবুছে পরে বাইরে বেরোতেই রাঠোর তাড়া দেওয়া গলায় বললেন, আপনি জলদি বেরিয়ে পরুন। যেখানে খুশি যান কিন্তু বি অন দা মুভ। আপনাকে ফলো না করলে আমরা বুঝব কী করে, ওদের প্ল্যান কী?

আমি বলতে গেলাম, রাজা কি প্রজার হুকুমের চাকর? সে ইচ্ছে হলে ঘুরবে আর না ইচ্ছে হলে ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকবে। কিন্তু সদ্য রাজা হয়েছি। কথাগুলো মুখে এলেও জিভ দিয়ে বাইরে বেরোল না।
—লেট করবেন না প্লিজ। রাঠোর হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন।
আমি ওকে পাত্তা না দিয়ে বড় কালো গাড়িটার দিকে পা বাড়ালাম, স্মার্টলি।
গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি রাঠোর ব্যস্ত গলায় পিছু ডাকলেন, এক্সকিউজ মি।
এই পিছুডাকটা আমার বরাবর অসহ্য লাগে তাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
রাঠোর প্রায় দৌড়ে আমার সামনে এসে বললেন, আপনার নামটা কী, সেটাই তো জানা হয়নি, এতক্ষণ।
—তাহলে এখন জেনে কী করবেন?
—উই নিড ইট। ‘সুপ্রিম কমান্ডার’ হিসেবে যার ছবি যাবে, তার নামটা জানাতে হবে না?
আমি মনে-মনে একচোট হাসলাম আর একবার হাত বুলিয়ে নিলাম ওই নীল ডায়েরিটাতে। রঞ্জন বসু নিজের নামে ফিরে গেছেন বলে মালিকানাহীন হয়ে গেছে একটা নাম। কিন্তু এই পৃথিবী তো ভ্যাকুয়াম সহ্য করে না। তাই নাম থাকলে, নামের মালিকও থাকবে।
গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিল আর রাঠোর প্রায় কাতর গলায় বলে উঠলেন, নামটা বলুন আপনার।
আমি রাঠোরের চোখে চোখ রেখে বললাম, আপনাদের সুপ্রিম কমান্ডারের নাম, রামখিলাওন।

ক্রমশ…

(প্রতিটি পর্বের জন্য চোখ রাখুন, রবিবার বঙ্গদেশ নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজে।)