লকডাউন-১: সোশাল ডিস্টেন্সিং

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্য়ায়

খেতে বসেছে অমিতেন্দু। লকডাউনের বাজারেও একেবারে ধড়ফড়ে জ্যান্ত মাছ পাওয়া গেছে। মা রেঁধেওছে বেশ জম্পেশ করে। সুরভী কোটা বাছা মশলা বাটা এসব করে দিলেও রান্নাটা মা পারতপক্ষে ছেলের বৌয়ের হাতে দিতে চায় না। ‘দারুণ হয়েছে’ জাতীয় প্রশস্তিতে ভাগ পড়া পছন্দ নয় তাঁর।

আর উর্মিলা তো নিজের পড়াশুনোর বাইরে কানে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউব বা সোশাল মিডিয়ার অধরা নিজস্ব জগতে ডুবে থাকে। সংসারে কুটো নেড়ে দুটো করে না বলে মা হিসাবে সুরভী বকলেও ঠাকুমা এসে নাতনির পক্ষ নিয়ে পুত্রবধূকে তুলোধোনা করে দেন। মেয়েটা শুধু দাদু ঠাকুমা নয়, বাপের কাছেও আস্কারা কম পায় না। একটু আহ্লাদী গোছের হলেও পড়াশুনোয় ভালো। উঠতি বয়সের মেয়েদের উড়ু উড়ু ভাব-ভঙ্গী নিয়ে যে চিন্তা থাকে অভিভাবকদের, উর্মিকে নিয়ে সেই চিন্তা নেই। অবশ্য দিনকাল যা হয়েছে, তাতে ছ মাসের কচি মেয়ে থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধা, কে যে নিরাপদ?

পুরো পরিবার একসাথে খাবার টেবিলে বসতে পারে না। পূর্ণেন্দুবাবু আর তাঁর দুই ছেলে অমিতেন্দু ও তুষার খেয়ে ওঠার পর তাঁর স্ত্রী আরতি, বড় পুত্রবধূ সুরভী ও নাতনী উর্মির পালা। উর্মি অবশ্য মাঝে মাঝে বাবা কাকাদের ব্যাচেও বসে পড়ে। তুষারের এখনও বিয়ে হয়নি। কথা চলছে।

দরজায় বেল বাজল। ওফ্‌! এই সময় আবার কে? কাজের মহিলাকে তো মার্চের মাইনে চুকিয়ে লকডাউন ওঠা পর্যন্ত ছুটি দেওয়া আছে। তাহলে কি খবর কাগজ? শহরতলি হলেও এত ভেতরের অলিগলিতে কাগজ সাত সকালে আসে না। কিন্তু এত বেলায়? তা সে ব্যাটাকে তো গতকাল নিয়ে তিনবার বলা হয়েছে লকডাউন চলাকালীন আপাতত কাগজ বন্ধ রাখতে। আবার বাজল পরপর দু’বার। এত তাড়া কার রে বাবা? কাগজওয়ালা শিবেন তো একবার বাজিয়ে চলে যায়। তাছাড়া ওর টাকাও তো বাকি নেই। গত মাসের শেষেই চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি অনলাইন কেনা কোনও কিছু পৌঁছোতে এসেছে? এই ছোকরাগুলো প্রায়শ অসহিষ্ণু হয়ে বেল বাজায়। কিন্তু অনলাইন কোম্পানিগুলো তো এখন অধিকাংশ সময় ডেলিভারি দেওয়ার বদলে অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে। ডেলিভারি বয়রা নাকি অত্যুৎসাহী পুলিসের কাছে প্যাঁদানি খাচ্ছে। তার মধ্যে একটি কোম্পানি দয়া করে গতকাল কিছু গোলদারি জিনিসপত্র দিয়ে গেছে। আর কিছু তো আসার কথা নয়।

আবার বাজল। সঙ্গে কাতর কণ্ঠ, “অমিত খোল। শিগগির খোল।”
দরজার বাইরে নীলাদ্রী উদ্‌ভ্রান্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে। অমিতেন্দু দরজা খোলা মাত্র বলল, “কথা আছে অমিত।”
“বল শুনছি।”
“বাইরে বলা যাবে না। খুব সিরিয়াস!”
“এই অবস্থায় তো সরকার বাড়ির বাইরে যাওয়া আসা মানা করছে। কিছু মনে করিস না। এখানেই শুনছি; তোরও সেফটির ব্যাপার…”
“আমার আরও অনেক বড় বিপদ অমিত। প্লীজ়! আমরা বাড়ির মধ্যে থেকেও নিরাপদ নই। সবটা এখানে দাঁড়িয়ে বলতে পারব না…” নীলাদ্রী হাউ হাউ করে উঠল।
“বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু আমি বাড়িতে একা নই। আমার বয়স্ক মা-বাবা আছে, মেয়ে বৌ ছোট ভাই সবাই আছে। তাদের কথা ভেবে… তাদের আপত্তি থাকতে পারে। যা বলার এখানেই বল।”

বন্ধুর ওপর অভিমান করার সময় নয় এটা। অগত্যা নীলাদ্রী চাপা গলায় জানাল। বেশ কিছুদিন ধরেই কিছু বখাটে লালচুলো ছেলে ওর মেয়ে সোমাকে রাস্তায় বিরক্ত করত। বাড়াবাড়ি করায় সে বাড়িতে জানায়। যথারীতি নীলাদ্রীরা মেয়েকে পাত্তা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। তাতেও ওদের উৎপাত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বাসে করে স্কুলে গেলে ওরা অকারণেই একই বাসে উঠে বারাসাতে ওর স্কুল পর্যন্ত ঘুরে আসা যাওয়া শুরু করেছিল। শুধু অনুসরণ নয়, ভিড় বাসে নানারকম নোংরামিও করত। সোমা বিরক্তি প্রকাশ করলে ওরা বলত, “তাহলে বাসে চোড়ো না, ট্যাক্সি নিয়ে যাও। বাবাকে বলো গাড়ি কিনে দিতে।” বাসে যাত্রীরা কেউ প্রতিবাদ করা তো দূর, উল্টে সোমাকেই ঠেস দিত যেন তার সম্মতি রয়েছে, কিংবা “বাসটা বাপের যেন জমিদারি”! বারাসাত লাইনের অধিকাংশ বাসে মেয়েদের আসন প্রায়ই থাকে না, বা থাকলেও নগণ্য। একদিন ইসমাইল নামে একটা ছেলে, তার এমন স্পর্ধা, অত লোকের ভিড়ের মধ্যে ওর স্কার্টের পেছন দিকটা নোংরা করে দেয়!

এইটুকু শুনে অমিতেন্দু কষ্ট করে হাসি চেপে বলল, “এ তো খুব কমন ব্যাপার। সোমা নিশ্চয়ই ইনডালজ্‌ করেছে, নইলে এতটা সাহস হত না। ওকে বল ইগনোর করতে।”

“কী যাতা বকছিস! সোমা ইনডালজ্‌ করে হিউমিলিয়েটেড হবে? সেদিন স্কুলের স্টপেজে নেমেই নিজের ড্রেসে আজেবাজে জিনিস নোটিস করে বাড়ি ফিরে এসে কী কান্না! এতদিন আমাকে ছেলেদের ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে সংকোচ বোধ করত। কিন্তু সেদিনের পর আর পারছে না। বলছে হয় গাড়ির ব্যবস্থা করো, নয় সঙ্গে করে পৌঁছে দাও। গাড়ির ব্যবস্থা করা সহজ নয়। ওদের স্কুলের বাসটা সেই অটো করে মধ্যমগ্রাম রোডে গিয়েই ধরতে হবে, প্লাস ইলাভেন টুয়ালভের স্টুডেন্টদের স্কুলে রোজ যেতেও হয় না বলে এতদিন দিইনি। বেকার মাসে আট দশদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য আঠেরোশো টাকা লেগে যাবে বলে ওর মাই গা করেনি। কিন্তু সেফটির জন্য এবার দেব ঠিক করেছি…”

“তাহলে তো ল্যাটা চুকেই গেল। আর তাছাড়া এখন লাকডাউন শুরু হয়েছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে না? এঃ, হাতটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাছটা অর্ধেক খেয়ে এসেছি।” অমিতেন্দু হাত দেখিয়ে অসহিষ্ণুতার ইঙ্গিত করল।

“ল্যাটা চুকে গেলে দৌড়ে আসতাম না। এখনই তো আরও বড় সমস্যা শুরু হয়েছে রে। ছেলেগুলো ওকে ফলো করে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত চিনে গেছে। সব রহড়ার ছেলে। কাল একবার সোমা ওষুধের দোকানে গিয়েছিল নিজের দরকারে, তখন রীতিমতো টানাটানি করেছে। পাশেই ট্রাফিক পুলিস আর সিভিক ভল্যান্টিয়াররা দাঁড়িয়ে ডাণ্ডা দিয়ে কিছু বাইক ভাঙচুর করছিল। সোমা হেল্প চাইতে ওকেই ধমকায়, বাড়ির বাইরে বেরিয়েছে কেন।”

“সেটা তো আমারও প্রশ্ন, এখন এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে গেল কেন ”

“নিজের পার্সোনাল প্রোডাক্ট দরকার হতে পারে না? ইউজু়য়ালি ওর মাই কিনে আনে। কিন্তু কাল…। এনিওয়ে, ওরা কাল রাতে বাড়িতে এসে রীতিমতো দরজা পিটিয়ে গেছে। তার সঙ্গে কদর্য সব ভাষা! অনেক রাত পর্যন্ত ফুল ফ্যামিলি তটস্থ হয়ে ছিলাম। আজ একবার পুলিসে কমপ্লেন করব। তুই সঙ্গে যেতে পারবি? আমার বাইকেই চলে যাব।”

“রাস্তায় একা বেরোলেও প্যাঁদাচ্ছে, আর বলছিস তোর বাইকের পেছনে বসতে? মাথা খারাপ? ও সব পুলিস টুলিস করে কোনও লাভ নেই। চুপচাপ থাক। দেখ, কিছুদিন পরে সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। লকডাউনের মধ্যে কী আর করবে?”

“ঠাণ্ডা মারার হলে এভাবে নাওয়া খাওয়া ফেলে দৌড়ে আসতাম না। লকডাউন তো আমাদের জন্য। ওরা বিন্দাস ঘুরছে, রহড়া, পাতুলিয়া, টিটাগড়, বন্দীপুর, মুড়াগাছা – গিয়ে দেখ না।”

“এই আমরা ওরা করে কথা বলিস না তো। আমার ভীষণ ইরিটেশন হয়। অল্পবয়সী ছেলে ছোকরা, তার ওপর শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য – আমাদের দেশ ও সমাজ কম দায়ী নয় আজ ওদের এই অবস্থার জন্য। আমরা ওদের কী দিতে পেরেছি? হ্যাঁ– যাচ্ছি। অ্যাই ভেতর থেকে বাবা বাবা করে ডাকছে মেয়ে। দুটো দিন দ্যাখ। এত হাঁকপাঁক করার মতো কিছু হয়নি।”

নীলাদ্রী বাড়ি ফিরে স্নান করে নিজের মেয়ের ওপর খানিক চোটপাট করে খেতে বসল। সঙ্গে অসীমা। সদর দরজায় বিকট শব্দ। কয়েকবার দুমদাম হওয়ার পর বোঝা গেল কেউ দরজায় ইটপাটকেল পাথর ছুঁড়ছে। খাওয়া মাথায় উঠল। উঠে একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেওয়া মেয়ের ঠাস্‌ করে একটা চড় কষিয়ে দিল। “তোর জন্য… অসভ্য মেয়ে কোথাকার! যতসব আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মেশা। যা বেরো। যেখানে খুশি চলে যা ওদের সঙ্গে। আমরা শান্তি পাই।”

বাপের থাপ্পড় খেয়ে সোমার কান্নায় শ্বাস আটকে গিয়েছিল। তারই মধ্যে কথাগুলো বর্ষার মতো বিঁধল। অসীমা চেঁচাল, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মেয়েটাকে মেরে ফেলবে? কাঁদে না। সোনা মা আমার। দেখেছ, এমন মারলে দম পড়ছে না! কানকপাটিতে কেউ মারে এভাবে? এত বড় মেয়েকে? বাচ্চাকেই বা এভাবে মারবে কেন? পুলিসে যেতে বলছিলাম, গিয়েছিলে?”

“পাড়ার সবাই উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করেছে। মাথার ঠিক থাকে? অমিত তো পুলিস স্টেশনে সঙ্গে গেলই না, উল্টে যাতা বলা শুরু করল।”

“তাহলে তুমি একা যেতে পারতে, আমাকে সঙ্গে নিতে পারতে।”

“বাড়িতে মেয়েকে একা রেখে চলে যাব? কার ভরসায়? দেখছ না কতগুলো দল বেঁধে এসেছে?”

দরজায় পরের পর ইট-পাথর বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এবার জানলার কাচ ভেঙে একটা আধলা ইঁট এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চড়চড় করে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। এতক্ষণ খেয়াল করেনি নীলাদ্রী অসীমারা, আকাশ সকাল থেকেই মুখ কালো ছিল। প্রবল বেগে বর্ষণ শুরু হল। ছেলেগুলো মনে হচ্ছে গালাগাল দিতে দিতে পালাল। সেই ছোটবেলার চিত্তরঞ্জন ছেড়ে আসার পর কলকাতার উপকণ্ঠে গলিঘুঁজিতে বসবাস করার পর থেকে বৃষ্টিতে আর মজা নেই। যদিও পচা গরমে আঁকুপাঁকু করলে আকাশের দিকে তৃষিত নয়নে তাকাতে হয়, কিন্তু রাস্তায় দিনের পর দিন নোংরা জল কাদা জমে থাকা, একতলার ঘরে জল ঢুকে পড়া, বিদ্যুৎ চলে গেলে পানীয় ও স্নানের জলের হাহাকার – বর্ষাকাল তো ত্রাস, এক পশলা মুষলধারে নামলেই রাস্তায় গোড়ালি ডুবে থাকে দিন কয়েক। আজ সেই পচা বৃষ্টি ওদের রক্ষা করল। অসীমা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, “ঠাকুর আছেন, বলেছি না।”

কিন্তু পরের দিন বৃষ্টি থামতেই ঠাকুরের অস্তিত্বের বদলে ইসমাইল, আখতার, মন্টু শেখ, জালালদের প্রবল উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। এবার পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই অন্ধ বোবা কালা। অসীমা ছেলেগুলোকে মিষ্টি মিষ্টি বচনে ভোলানো শুরু করল। “তোমরা ভালো ঘরের ছেলে। এমন করতে আছে?”

“তাহলে ভালো ঘরের বৌ করে পাঠাতে আপনাদের আপত্তি কীসের? আমরাও ভাবীকে নিয়ে…” মন্টু শেখ খ্যাক্‌ খ্যাক্‌ করে হাসতে লাগল।

প্রতিবেশীদের নিজের বাড়ির দিকে নজর রাখতে অনুরোধ করে বাইকে ভয়ে ভয়ে অসীমাকে বসিয়ে থানায় গেল। রোজ যাদের সঙ্গে দু বেলা কথা হয়, তাদেরও এমন হাবভাব যেন ছায়া মাড়ালে করোনায় মারা যাবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিয়ে নানারকম আলোচনা, উপদেশ ইত্যাদি চলছেই। কেউ কেউ টাকাটা পর্যন্ত সাবান জলে চুবিয়ে নেয়। অসীমা মেয়ের কাছে এসে থাকতে বলায় পাশের বাড়ি পরিষ্কার শুনিয়ে দিল, “এখন নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও না। হু-র গাইডলাইন – কিছু ধরেছ কি হাত স্যানিটাইজ়ার দিয়ে সাফ করো। বাইরে গেলেই পোশাক কেচে ফেলো। এগুলো লোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না বলেই তো করোনা এভাবে ছড়াচ্ছে….” তারপর কে কোথায় ইটালি থেকে ফিরে কাউকে না জানিয়ে পাশের পাড়ায় বসবাস করছে, তার বাবা অন্যদের সঙ্গে মিশেছে – ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতার বন্যা বইয়ে দিল।

মেয়েকেও যে সঙ্গে নিয়ে যাবে, এমনিতেই মোটরবাইকে সম্প্রদায়বিশেষ ছাড়া দুজনের বেশি দেখলেই ফাইন করে, নামিয়ে দেয়; আর এখন তো কথাই নেই। কিন্তু থানাতে না গেলেই নয়। রোজ রোজ ঠাকুর ঝড় বৃষ্টি পাঠিয়ে রক্ষা করবেন না। অবশ্য কদিনের মধ্যে আর একটা বড় ঘুর্ণীঝড় আমফানের পূর্বাভাস আছে। কিন্তু সেই ভরসায় তো বসে থাকা যায় না। এখন সকাল বারোটা পর্যন্ত ছাড় আছে অত্যাবশ্যকীয় কাজের জন্য। থানায় যাওয়াটা আশা করা যায়, জরুরি কাজ বলে বোঝানো যাবে ট্রাফিক পুলিস বা সিভিক ভল্যান্টিয়ারদের।

যাক, রাস্তায় কেউ আটকায়নি।
“স্যার আমার মেয়েকে কয়েকটা বখাটে ছেলে রোজ টীজ় করছিল, স্কুলে পর্যন্ত ধাওয়া করছিল। এখন বাড়িতে এসেও হুজ্জতি করছে, গালাগাল দিচ্ছে, দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে… আমি দরখাস্ত লিখে এনেছি স্যার।”
“এ কী! এখানে হাত দিচ্ছেন কেন? হাত ধুয়ে এসেছেন? বাইরে কল আর সাবান আছে।”
“স্যার দরখাস্তটা…”
“ওই দরখাস্ত তো আমরা বারো ঘণ্টার আগে ধরবই না। রিসিভিং সেকশনে রেখে যান। তারপর পড়ে দেখব।”
“স্যার, এফআইআর করানোর ছিল। ইভ টীজ়িং সাংঘাতিক লেভেলে পৌঁছে গেছে। খারাপ কিছু হয়ে গেলে…” অসীমা ডুকরে উঠল।
“আগে হাত ধুয়ে আসুন। তারপর এখান থেকে কাগজ নিয়ে দরখাস্ত লিখে দিন। আপনারা কি একসঙ্গে? একজন একজন করে আসবেন, দুজনে একসঙ্গে ঢুকেছেন কেন? ভেতরে কে অ্যালাউ করল?”
“স্যার, চিঠির জ়েরস্ক এনেছি। তাহলে অন্তত একটা স্ট্যাম্প মেরে রিসিপ্ট করে দিন। আর আমরা স্যার এফআইআর করাতে চাই। সে জন্যই…”

“কথা একবার বললে বোঝেন না? বললাম না, আপনারা হাত ধুয়ে এই কাগজ নিয়ে চিঠি লিখে বাইরের রিসিভিং সেকশনে চিঠি রেখে যান। বারো ঘণ্টা পরে আমরা পড়ে উপযুক্ত স্টেপ নেব। এখানে ভিড় করবেন না। সোশাল ডিস্টেন্সিং বজায় রাখুন।”

অগত্যা থানার চত্তরে একটা কলের সামনে রাখা খয়ে যাওয়া লাইফবয় সাবানে হাত ধুয়ে আবার চিঠি লিখতে বসতে হল। এই বহুব্যবহৃত সাবান কি জীবাণুমুক্ত? তাড়াহুড়োয় স্যানিটাইজ়ারের কথা মাথাতেই ছিল না। কিন্তু অসীমার মন উচাটন অন্য কারণে। মেয়েটা বাড়িতে একা। নিজের মোবাইল রেখে এসেছে যাতে দরকারে সোমা ফোন করতে পারে। বাড়িতে অভিযোগপত্র সেই লিখেছিল। থানায় এসে কেঁদেকেটে হাত কেঁপে আর পেন ধরতেই পারছে না। নীলাদ্রী মেয়ের মুণ্ডপাত করতে করতে পুনরায় দরখাস্ত লিখল।

রিসিভিং সেকশন বলে কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। একে তাকে প্রশ্ন করে দরখাস্ত কোথায় জমা দেবে জানতে চেয়ে যে জানলায় পৌঁছোল, সেখানে লেখা ডেসপ্যাচ্। যাইহোক, জমা দিল। কিন্তু করোনা সংক্রান্ত সাবধানতার কারণে সেখানেও চিঠির কপিতে কেউ ছাপ মেরে দিল না। দুজন মহিলা বসেছিল। ঘটনাটা শুনলই না ভালো করে। নির্বিকারভাবে বলল, “রেখে যান। এখন আপনাদের কাগজ ছুঁতে পারব না। বারো ঘণ্টা পরে বড়বাবুর খুলে দেখবেন। নিশ্চিন্তে চলে যান। ঠিকানা ফোন নম্বর দেওয়া আছে তো? আমরা কল করে নেব।”

“আর আমাদের কপি?”
“কপি চাইলে জেরস্কটাও রেখে যান। কাল এসে নেবেন।”
“এটা তো এফআইআর করার কেস। কপি তো চাইই।”
“কী কেস সেটা ওসি বুঝবেন। আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সোশাল ডিস্ট্যান্সিং পালন করুন।”

দুপুরে না খেয়ে বেরিয়ে বিকেল পার করে খড়দহ থানা থেকে শূন্য হাতে সাবানের গন্ধ নিয়ে যখন বাইকে চড়ার আগে অমিতেন্দু চলভাষ বার করল স্পন্দন টের পেয়ে। অসীমার মোবাইল থেকে এসেছে। মানে সোমা বাড়ি থেকে করেছে। কল লগ পরখ করে দেখল পাঁচবার ফস্কানো ডাক। ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরল ওরা।

গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে বেশ বড় জটলা। একটা অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল। ঐ লালচুলোদেরও তিনজনকে হেলমেট ছাড়া একটা বাইকে বসে ভুস বেরিয়ে যেতে দেখল মনে হল। আবার কার কী হল?

“তোমার মেয়ের করোনা লুকিয়ে পাড়ায় আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলতে চাও? ছিছিঃ! শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি এতটুকু সচেতনতা না থাকে, তাহলে ছোটলোকদের কী বলব? ছোটলোক কাদের বলব?”

ছোটলোক ইঙ্গিত নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর অবকাশ নেই। অসীমা গলা তুলে বলল, “আমাদের মেয়ের করোনা মানে? ওর কোনও সিম্পটম নেই। দিব্যি সুস্থ। এ কী, আমাদের দরজায় তালা কেন? সোমা কোথায়?”

“সব সময় সিম্পটম থাকে না। ভাগ্যিস ইসমাইল না কী যেন, যার সঙ্গে তোমাদের মেয়ের লটঘট, সে জানাল। ছেলেটা এমনিতে ভালো বলতে হয়। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে সোমাকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে গেল।”

“কী?” অসীমা আর্তনাদ করে উঠল। “আমার মন তখন থেকেই কু গাইছিল। পাঁচবার মিসড্‌ কল! তুমি একবারও শুনতে পাওনি? কী লাভ হল থানায় গিয়ে? একটা ডায়রি নেওয়া তো দূর, অ্যাপ্লিকেশনটা রিসিভ করে পর্যন্ত দিল না। কোন কোয়ারেন্টাইন সেন্টার? আমাদের নিয়ে চলো।” অসীমা টলে পড়ে যাচ্ছিল।

“ইসমাইল ছেলেটা না বললে তো আমরা জানতেই পারতাম না। মেলামেশা আছে বলেই জানে। পরের ছেলে আপনাদের মেয়ের চিকিৎসা করাতে চাইছে, আর আপনারা নিজেরা রোগ লুকোচ্ছেন? ধন্যি বলিহারি!” ভিড়ের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব পালন করা জনৈক সচেতন নাগরিকের মন্তব্য কানে এল। কিন্তু জবাব দেওয়ার সময় নেই।

আবার উর্ধ্বশবাসে বাইক চালিয়ে নীলাদ্রী বন্দীপুরের একটা স্কুলে করা সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ছুটল। যদি সত্যিই করোনা হয়ে থাকে, তাহলে বাড়িশুদ্ধ পৃথক থাকত। এভাবে মা বাবার অনুপস্থিতিতে একটা বাচ্চা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কী মানে? বাড়ির চাবিও তো সোমার কাছে।

পৃথকীকরণ কেন্দ্রটিতে মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে দেবে না। অনেক কাকুতি মিনতি করে দূর থেকে এক ঝলক দেখেই চলে আসতে হল। বাবার চড় খেয়ে সোমা পুরো দু দিন বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। কিন্তু এখন নীলাদ্রীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেঁদে উঠল, “মা কোথায় বাবা?”

অসীমাকে ওখান থেকে আনাই যাচ্ছিল না। কিন্তু চাবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। যারা ঘরে এসে এই বিচিত্র উপকারটি করেছে, তারা ঘর সাফ করে গেলে কিচ্ছু আশ্চর্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে ক্লান্ত হয়ে ঘুরপাক খেয়ে নিজেরা অসুস্থ হয়ে তো লাভ নেই। এলোমেলো নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে অসীমাকে প্রায় জোর করে তুলে এনে বাড়ি ফিরল নীলাদ্রী।

নাঃ, তালা ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অন্য কোনও তালা খুঁজে দেখতে হবে। না হলে এখন তো সব বন্ধ। তালাচাবি মনে হয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়।

পরের দিন অসীমা তাড়া লাগাল, “বারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। চলো থানা থেকে রিসিভ্‌ড কপিটা নিয়ে আসি।”

নীলাদ্রী বলল, “আবার থানা? দরকার আছে? সোমাকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে গেছে যখন, তখন ঐ ছেলেগুলোর পক্ষে বাড়াবাড়ি করা সম্ভব নয় আপাতত। হয়তো তেমন মতলবও নেই। থাকলে এভাবে সরকারি নজরদারির মধ্যে এনে রাখত না। হয়তো নিজেদের সচেতনতা জাহির করে একটা টিকটক বানাবে।”

“আমার মন কু গাইছে। ধরে নিচ্ছি চোদ্দ দিন পরে মেয়ে ভালোভাবেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু আমরা তো চিঠি অলরেডি দিয়েছি। শুধু নিজেদের কাছে রেকর্ড নেই। ওরা আবার যদি ডিসটার্ব করে তখন এই দরখাস্ত কাজে লাগবে। আর তেমন মতলব নেই বলছ কী করে? সেদিন বাসের ঘটনাটা ভুলে গেলে? তুমি তো মেয়েকে চড় মেরে শাসন করেই খালাস; কিন্তু আমি জানি ও কী মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।”

“একবার আমাকে খোঁচা দেওয়ার চান্স পেলে আর কিচ্ছু চাও না। আমরা কপিটা আনলেই কি ওর মানসিক চাপ কমে যাবে? ও তো জানতেই পারবে না।…. চলো তৈরি হয়ে নাও।”

খড়দা থানা থেকে অভিযোগপত্রের ছাপমারা প্রতিলিপি তো দূর, কেউ কথাই শুনতে চায় না। নির্বিকার মুখে বারান্দায় প্রহরা দেওয়া মহিলা বলল, “স্যারের টেবিল থেকে কাগজ নিয়ে দরখাস্ত লিখে দিয়ে যান।”
“কাল তো দিলাম।”
“কাল দিয়েছেন? ও। নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে আবার দিয়ে যান।”
“একটা এআইআর নিন না ম্যাডাম। সেটা তো আপনারাই লিখবেন, আমরা ছোঁব না। শুধু মুখে বলে দেব।” মাস্ক অল্প সরিয়ে কথাটা বলে অসীমা ধমক খেয়ে আবার মুখে চাপা দিল।
সারা দিন ধরে একে তাকে একটা এফআইআর নেওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ ও অপেক্ষা করেও আবার নিষ্ফল ফিরতে হল সন্ধ্যাবেলা। বাড়ির সামনে একটা ছোট জটলা, কিন্তু অস্বাভাবিক থমথমে। একটা দস্তানা মুখোশে আবৃত ছেলে বলল, “সোমা বিশ্বাস আপনাদের মেয়ে?”
“হ্যাঁ? কেন?” অসীমা মাথা থেকে হেলমেট খুলতে খুলতে বলল।
“বন্দীপুর হাইস্কুল চেনেন। কোয়ান্টাইন ছেন্টার। ওখানে একবার যেতে হবে।”
“ওঃ! ওকে বাড়ি আনতে হবে? কালকেই বলেছিলাম, ওর কিচ্ছু হয়নি। শুধু শধু ধরে নিয়ে গেল। বাপরে! কাল সবার কত সব লেকচার…” অসীমা উচ্ছ্বল।
ছেলেটা বলল, “বডি দেখতে।”
“মানে?” অসীমার মুখ থেকে ক্ষণকালের জন্য মেঘ কেটেছিল, আবার ফিরে এল দ্বিগুণ কালিমায়।

নীলাদ্রীর আর বাইক চালানোর ক্ষমতা ছিল না। গত কয়েকদিন ধরে এমনিতেই ধকল আর উদ্বেগে আধমরা হয়ে ছিল। অমিতেন্দুর কানে খবর গিয়েছিল মনে হয়। নিজের গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। রক্তশূন্য মুখে অসীমা ও নীলাদ্রী পেছনের আসনে বসল। অসীমা পগোলের মতো বকে চলেছে, “মেয়েটা আমার দিব্যি সুস্থ ছিল। করোনা রুগীদের মাঝে রেখে মেরে ফেলা হল। সত্যিই মারা গেছে? না না, হতেই পারে না। কাল পর্যন্ত…”

স্কুলের প্রাঙ্গনে আপাদমস্তক ময়লা চাদরে মোড়া একটি কিশোরীর দেহ। অসীমা আর নীলাদ্রী ছুটে যাচ্ছিল। একজন সফাইকর্মী বাধা দিল। “কাছে যায়েন না। বেশি দেরি কইরেন না। বডি ধাপায় নি যাবা। একে করোনা ছেন্টার, তার ওপর রেপ কেস।”
“তার মানে?” চিৎকার করল নীলাদ্রী। সামাজিক দূরত্ব ভুলে অমিতেন্দু বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল।

“বডি ধরা মানা। দেখে লাভ নাই, চেনা যাবে না। গ্যাং রেপ করে পিস পিস করে কাটসে। কাউরে বলেন না, আমার চাকরি থাকবা না।”

অমিতেন্দু কঠিন গলায় বলল, “কী করে হল? তোমাদের সবার নাকের ডগায়? পুলিস ডাকা হয়েছে?”

অসীমা মাটিতে থেবড়ে খিলখিল করে হেসে উঠল, “অ্যাই, হাত ধুয়ে আসুন। সবাই সোশাল ডিস্টান্সিং পালন করুন। উঁহুঃ! ঐ চিঠি তো আমরা ছোঁব না…. ছোঁব না, ছোঁবইই– না…..”