আজকে রাতের রাজা – ৫

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

পাঞ্জা
দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে ফ্রেশ হয়ে যখন নতুন জামা-প্যান্ট পরছি তখনই টের পেলাম, তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে আমি আজ মোবাইল নিতেই ভুলে গেছি। হয়তো হরিদা,স্বপন, বলবাহাদুর কিম্বা রফিকের মধ্যে কেউ ফোন করে খবর দিতে চেয়েছিল আমাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত মোবাইলের নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দেওয়া হয়নি। আমি জানতেও পারিনি। ক্ষমা করে দিও হরিদা। স্বপন, বল, রফিক তোরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোদের ওপর মিথ্যে অভিমান করেছিলাম।
গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার আগে ড্রাইভারের সিটে বসা অমরদীপ আমার পাশে বসা আলবার্তোকে বলল, এক্ষুনি মেসেজ পেলাম যে খুব সিলেকটিভলি ওয়্যারলেস চালু হয়েছে। ওয়াকি-টকিতে কথা বলা যাবে, তেমন দরকারে।
—আর মোবাইল? আলবার্তো জিজ্ঞেস করল।
— এখনও কোনও নিউজ নেই। মোবাইল সারভিস আবার কখন চালু হবে, বলা কঠিন। অমরদীপ হতাশ গলায় বলল।
ওদের কথা শুনতে শুনতে ভাবলাম, মোবাইল যদি সঙ্গে থাকত, তাহলে হয়তো আজ শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত আসতামই না। মাঝপথেই ঘুরিয়ে নিতাম সাইকেল আর যে সমস্ত অকল্পনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকলাম গত দু’ঘণ্টা ধরে তার কোনওটার মুখোমুখিই হতাম না কখনও। রকেট যে গতিতে পৃথিবী থেকে চাঁদে যায় তার চেয়েও দ্রুত আমি হকার থেকে রাজা বনে গেলাম। একেবারে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ’র রাজা। আর রাজার রাজত্ব যতক্ষণই থাকুক তাতে তার মর্যাদা কিছু কমে না। যতদিন দুর্গাপুজো হয় ততদিনই তো ঢাকি ঢাকে বোল তোলে, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ’, তাতে কি মা দুর্গার মর্যাদা কমে যায়?
—আপনি কোথায় যেতে চান, প্রথমে? অমরদীপ জিজ্ঞেস করল।
মিষ্টি করে উত্তর দিতে গিয়ে মনে পড়ল, প্রথমবার কারা তা বলা সম্ভব না হলেও দ্বিতীয়বার এই চারটে লোকের মধ্যে একজন আমার মাথায় সেই বীভৎস গাঁট্টা মেরেছিল। আলবার্তো হয়তো নয় কারণ সৈন্য হলেও ও সামান্য ভাবুক কিন্তু অমরদীপ হতেই পারে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পরে যে আবার গাঁট্টা মেরেই ভাগিয়ে দেবে না তার কি গ্যারান্টি? কিন্তু এখন ওকে আমার সুরে সুর, তালে তাল মেলাতেই হবে। গলাটা গম্ভীর করে বললাম, রেড রোড চলো। আর বিন্দাস লাগল এটা ভেবে যে আমি ওদের তুমি করে বললেও ওরা আমাকে আপনি করে বলতে বাধ্য হচ্ছে…
আলবার্তো একদম ভাবলেশহীন গলায় বলল, অমরদীপ, রেড রোড…

রেড রোডে প্রথম এসেছিলাম একটা ২৬শে জানুয়ারি। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখতে। আমি একা নই, আমাদের রাজাপুরের পাঁচ-ছ’টা গ্রামের প্রায় পঁচিশটা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিল মৃন্ময় কাকু। হ্যাঁ, মৃন্ময় দে-সরকার আমাদের কাছে কাকুই ছিল তখন। আগুনখেকো যুবনেতা থেকে এলাকার সকলের সব বিপদের ত্রাতা, মৃন্ময়কাকুর একটা কথায় তখন রাজাপুরের প্রত্যেকটা ঘাটে, বাঘে-গোরুতে-মানুষে একসঙ্গে জল খায়। খাবে না কেন? হয় কে নয় করার ক্ষমতা ছিল মৃন্ময়কাকুর। সাজনে থেকে কিশোরপুর যেতে গেলে ঘুরপথে কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে হত। নাক বরাবর পাকা রাস্তা তৈরি সম্ভবপর ছিল না কারণ দুটো গ্রামের মধ্যে একটা মস্ত বড় ব্রিটিশ আমলের বাংলো ছিল আর টানা পিচ রাস্তা করতে হলে সেই বাংলোর হাতা থেকে খানিকটা জমি নিতে হত। দিল্লিতে থাকা বাংলো মালিকদের ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখলেও কোনও উত্তর আসেনি তাই অঞ্চলের সব লোকই বৃষ্টি-বাদলায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে ওই কাঁচা রাস্তাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল।কিন্তু মৃন্ময়কাকু যে মানেনি তা বুঝতে পেরেছিলাম পরে।
অচানক একদিন আগুন ধরে গেল ওই বিরাট বাংলোয়। টানা দু’দিন নেভেনি সেই আগুন।বাড়িটার কেয়ারটেকার তার দুটো বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে কেয়ারটেকারের বউ নিজেও মরে। রাজাপুর তখন গ্রামাঞ্চল আর সেখানে দমকলের অস্তিত্ব শুধুমাত্র মানুষের মাথায় নয়তো রেডিওর খবরে। মহল্লার একটা-দুটো বাড়িতে টিভি এসেছিল আর তার মধ্যে আমাদের বাড়ি ছিল একটা। আগুনে ওই বিরাট বাংলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর, পরপর দু’তিন সপ্তাহ আমাদের বাড়ির সাদা-কালো টিভিতে শনিবারের বাংলা আর রবিবারের হিন্দি সিনেমা চলেনি। তখন কোথায় তিনশো বারোটা চ্যানেল, কীসের মোবাইল? কিন্তু মানুষের আনন্দ-বেদনা স্পর্শ করত অন্য মানুষকে। টিভি দেখতে যে ভিড় উপচে পড়ত আমাদের বাড়িতে, টিভি বন্ধ রেখে সেই ভিড়ই আলোচনা করত কীভাবে বাংলোর কেয়ারটেকারকে একটা বিকল্প বাঁচার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, ওর বাচ্চা-দুটোকে যতদিন প্রয়োজন পালা করে রাখা যায় গ্রামের বাড়ি-বাড়ি।
এই যে মূল্যবোধ, যার দৌলতে প্রতিটা প্রাণই অমূল্য, এটা নিয়ে বোধহয় একটা প্রবলেম ছিল মৃন্ময়কাকুর। আর আমি সেটা বুঝেছিলাম, বাই চান্স, সাজনে আর কিশোরপুরের মধ্যে পাকা রাস্তার উদ্বোধন হওয়ার দিন। সেদিন দু-তিনটে গ্রাম জুড়ে আলোর রোশনাই, বাজি ফাটছে মুহুর্মুহু, প্যান্ডেল খাটিয়ে হাজারও লোকের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন আর তার মধ্যে নতুন পাঞ্জাবি-পাজামায় সজ্জিত আমি পড়েছি এক মহা সমস্যায়। হিসু পেয়েছে খুব কিন্তু পাজামার দড়ি খুলতে পারছি না, আবার পাজামাটাকে টেনে নামাতেও পারছি না। একসময় আর না পেরে পাজামাতেই হিসু হয়ে গেল আমার। প্যান্ডেলের একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার ভিতর থেকে ছোট নদী বয়ে চলেছে, পাজামা নষ্ট করে মাটির ওপর দিয়ে। ভিজে আলগা হয়ে গিয়েছিল বলেই বোধহয় এরপরই পাজমাটা খুলে পড়ে যায় মাটিতে। আর লম্বা পাঞ্জাবির নিচে কিচ্ছু না পরা আমি বন্ধুদের টিটকিরির হাত থেকে বাঁচতে হাঁটতে হাঁটতে ভোলার বাগানের দিকে চলে গিয়ে একটু উঁচু একটা ঢিবির ওপর দুজনকে দেখে কীরকম যেন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। তখন ন-দশবছর বয়স হবে আমার। আজকের শহুরে বাচ্চারা নিশ্চয়ই কম্পিউটার গেমস, ইন্টারনেট, হেলথ ড্রিঙ্কের কারণে অনেক বেশি স্মার্ট কিন্তু আমরা খেলতাম ডাঙ্গুলি; খেতাম হয় দুধ-মুড়ি নয়তো দই-চিড়ে। আর বড়দের এমনই ভয় পেতাম যে সামনে গিয়ে পড়লে মুখ খুলতে টাইম লাগত। তবু মৃন্ময়কাকুকে গলা তুলে ডাকতে না পারি নিজের কাকুকে তো পারতাম।
পারিনি। মৃন্ময়কাকুর কাছের বন্ধু বলে আমার যে কাকুকে চিনত সবাই, বিয়ে করতে বললেই যে আমাকে মায়ের সামনে নিয়ে গিয়ে বলত, ‘তোমার ছেলেরই একটা বিয়ে দিয়ে দাও বউদি, ও তো বেশ লায়েক হয়ে উঠেছে’, সেই কাকুকে সামনে দেখেও আমি ডাকতে পারিনি কারণ কাকুর মুখের মধ্যে একটা পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মৃন্ময়কাকু। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, খেলা। ওরা দুজন মিলে ক্যাপ ফাটানোর খেলা খেলছে কিন্তু ব্যাপারটা যে খেলা নয় সেটা ওই আকাট আমি’র কাছেও জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যখন কাকুর মুখ থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়ে মৃন্ময়কাকু একটা ঘুসি মারল কাকুর মুখে। আর টলে পড়ে গেল কাকু। যখন উঠে দাঁড়াল তখন নাক থেকে গড়াতে গড়াতে ঠোঁট পেরিয়ে থুতনি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে রক্ত। তবু সেই অবস্থাতেই, আমি স্পষ্ট শুনলাম, কাকু বলছে, ‘পিস্তল কেন কামান দিয়েও তুই আমার মুখ বন্ধ করতে পারবি না। আজ নয় কাল লোকে জানবেই যে তুই বাংলোতে আগুন লাগিয়েছিস কারণ এই রাস্তার কন্ট্রাকটরের থেকে পয়সা খেয়েছিস তুই’।
সেদিন কথাগুলোর মানে বুঝতে পারিনি। তবে যে ওই কেয়ারটেকার আমাদের বাড়িতে বসে কপাল চাপড়াচ্ছিল আর বলছিল, ‘হায় ভগোয়ান, আগ কিঁউ লাগায়া?’… মৃন্ময়কাকুই কি সেই ভগবান? তা নইলে কাকু ওকে ওরকম বলছে কেন? আর আজ তো পাড়ার সবাই খিচুড়ি-বেগুনভাজা-লাবড়া খাবে, মৃন্ময়কাকু সেসব না খেয়ে পয়সা খাবে কী করে? গলায় পয়সা আটকে গিয়ে পালপাড়ার একটা বাচ্চা মেয়ে মরে গেছে, টিফিনের সময় দিদিমণিরা বলল আমাদের, ওরা কি মৃন্ময়কাকুকে বলেনি?
রাস্তা উদ্বোধনের তিনদিন পর যখন কাকুর লাশ ভেসে উঠল বারাসাতের একটা ঝিলে তখন আমাদের বাড়ি ভরতি পুলিশ। কিন্তু আমি একটা কথাও বলতে পারিনি যেহেতু ওদের প্রত্যেকের কোমর থেকে পিস্তল ঝুলছিল। আমি ভোলার বাগানে যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম সেই সবকিছু বলে দেওয়ার জন্য আমার ভিতরটা কামড়াচ্ছিল কিন্তু খালি মনে হচ্ছিল বলতে গেলেই যদি ওরা আমার মুখের মধ্যে ওই পিস্তল ঢুকিয়ে দেয়? পাথরের মতো গুম হয়ে বসেছিল বাবা, আমি বাবার সামনে কতবার গেলাম আর ফিরে এলাম। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল মা। জ্ঞান ফিরতেই আবার কাঁদতে শুরু করল। আমি মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে একবার টানলাম, দু’বার টানলাম। ফোলা-ফোলা চোখে মা তাকাল আমার দিকে। আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার বোন একটা লুডোর সেট হাতে নিয়ে কাঁদছিল আর বলছিল ‘কাকু তুমি আমার সঙ্গে একদান খেলবে বলেছিলে’। আমি ওর কাছেও গেলাম। ওকে বলতে চাইলাম যে একটা লোক অন্যরকম খেলা খেলেছে কাকুর সঙ্গে ; কিন্তু বলতে গেলেই যদি ওই পুলিশগুলোর কোমরের পিস্তল আমার মুখে ঢুকে যায়? সেই ভয়ে বোনকেও কিছু…
অনেক রাতের দিকে মৃন্ময়কাকু আমাদের বাড়িতে এল আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে-মুছতে বলল যে সাজনে থেকে কিশোরপুর পর্যন্ত পাকা রাস্তার যে স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে, তার পিছনে আমার কাকুর অবদানও কম নয়। তারপর একটু থেমে ঘোষণা করল যে ওই রাস্তাটার নাম আমার কাকুর নামেই হবে। অত কান্নাকাটির বাড়িতেও এই কথাটা শুনে হাততালি দিয়ে উঠল মৃন্ময়কাকুর সঙ্গে আসা লোকগুলো। আর কারা যেন পিছন থেকে কাকুর নাম বলে বলল, ‘অমর রহে’। আমি এই এতক্ষণে সবাইকে চমকে দিয়ে একটা বিকট চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু সেই চিৎকারটা শুনে যখন মৃন্ময়কাকু আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল, তোমার কাকুর স্মৃতিতে রাস্তা হচ্ছে, তোমার ভালো লাগছে না?’, তখন কিচ্ছু বলতে পারলাম না।
ওই না বলতে পারা নিয়ে বড় হতে থাকলাম আমি। মাঝেমাঝেই জ্বর হতে থাকল আমার, কীরকম শুকিয়ে যেতে থাকলাম ভিতরে-ভিতরে; অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি,কবিরাজি কিছু করেই কোনও লাভ হল না যখন তখন বাবা একদিন খেতে বসে বলল, তোকে কলকাতার একজন বড় স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে যাব। অনেক ভিজিট, কিন্তু তা হোক।
—সেই ডাক্তারকে দেখালে সারবে?মা জিজ্ঞেস করল।
—সারবে না মানে? দেশ-বিদেশ থেকে রুগি আসে ওনার চেম্বারে। তিন থেকে চারমাসের আগে ডেট পাওয়া যায় না, নেহাত মৃন্ময় ব্যবস্থা করে দিল,তাই…
আমি খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি যাব না।
— যাবি না কেন?
—তুমি কেন বলতে গেলে আমার অসুখের কথা, তোমাকে কে সাহায্য নিতে বলেছে…
বাবা অবাক চোখে তাকাল, এতে সাহায্য নেওয়ার কী আছে? মৃন্ময়, তোর কাকুর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল…
চেয়ার-টেবিল ছিল না আমাদের। মেঝেতে পিঁড়ি পেতে খেতে বসা হত। আমি সেই পিঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম শুনতে শুনতে। আর ছুটে ঘরের বাইরে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলাম যা খেয়েছিলাম।
মা সেই দৃশ্য দেখে ভয় পাওয়া গলায় বাবাকে বলল, তুমি কোনও কথা শুনো না। ওকে কলকাতায় নিয়ে যাও। চিকিৎসা করাও। সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। তাতে আমার গয়না লাগে গয়না দেব, জমি বিক্রি করতে হয়, তাই করব। কিন্তু ওকে সারিয়ে তোলো। পুরুষমানুষ; ওকে তো খেটে খেতে হবে।
বাবা সেই কথা শুনে আরও তেতে গেল। আমার ওজর-আপত্তি ধোপে টিকল না। আমি কলকাতা গেলাম, ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু দু’দুটো ভিজিট দিয়েও আমার তেমন কোনও উন্নতি হল না। সেই জ্বর আসতে থাকল মাঝেমাঝে, দড়ি পাকিয়ে যেতে থাকল শরীর। মা, বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করতে থাকল, বাবা ধৈর্য হারাতে থাকল আর ওই অবস্থায় আরও একবার আমাকে কলকাতার সেই বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে এল।
সেদিনই ঘটল ঘটনাটা। ট্রামের জানলার ধারে বসে আমি দেখলাম, একটা বাঁদর, নাচ না দেখিয়ে ঘুরে গিয়ে অ্যাটাক করেছে মাদারিকে। আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছে একদম। রাস্তার লোকের একটা অংশ এই উলটো কিসসা দেখে দেদার মজা পেয়ে হাততালি দিচ্ছে আর বাঁদরটাকে তাতাচ্ছে। অন্য একটা অংশ আবার বাঁদরটা এবার ওদের দিকে ধেয়ে আসতে পেরে ভেবে কেটে পড়ছে জায়গা থেকে। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম তখনই ট্রামের ভিতরে একটা লোক বলে উঠল, ‘ঘোর কলি চলছে। নইলে বাঁদর মাদারিকে অ্যাটাক করে? আরে ওই লোকটা না থাকলে তুই খাবি কী?’
পিছন থেকে অন্য একটা লোক বলে উঠল, ‘দাদা, মাদারি বাঁদরকে খাওয়ায় না। বাঁদর নাচে বলেই মাদারি খেতে পায়’।
কথাটা যেন বুলেটের মতো চার্জ করল আমাকে। তার মানে, মৃন্ময়কাকু ক্ষমতাশালী বলে আমার কাকুকে সরে যেতে হয়নি। আমার কাকুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে ওই লোকটা পাওয়ারফুল হয়ে উঠতে পারে। দুনিয়া দেখার অ্যাঙ্গেলটাই পালটে গেল আমার। আমি দুম করে উঠে দাঁড়ালাম আর বাবাকে কিছু না বলে ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম স্টপেজ আসতেই।
ব্যাপারটায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল বাবা। ট্রাম থামিয়ে নেমে দেখল, আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছি। হাঁপাতে- হাঁপাতে আমায় ধরে ফেলল বাবা। খপাৎ করে হাতটা পাকড়ে জিজ্ঞেস করল, নেমে পড়লি কেন?
—আমি ওই ডাক্তারের কাছে আর যাব না। এমনিই ভালো হয়ে যাব।
—এমনি কেউ ভালো হয় না। চল।
—না যাব না।
—কেন এরকম করছিস বাবা? তোর শরীর খারাপ নিয়ে ভেবে-ভেবে তোর মা নিজের রোগ বাধিয়ে ফেলল, আমার প্রেশার বেড়ে গেছে, তোর চিন্তায়, এখন তুই একটু হেল্প না করলে তোকে আমরা সারিয়ে তুলি কী করে বল তো? বাবার গলা নরম হয়ে গেল।
আমার খুব খারাপ লাগল বাবার মুখে ‘হেল্প’ কথাটা শুনে। তাই গলায় অনেকটা জোর এনে বললাম, আমি সুস্থ হয়ে যাব বাবা, খুব শিগগির। তোমরা দেখে নিও। কিন্তু ওই মৃন্ময়ের সুপারিশ করা ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে যেও না।
জীবনে প্রথমবার ‘কাকু’ শব্দটা পিছনে না লাগিয়ে, ‘মৃন্ময়’ নামটা উচ্চারণ করলাম আমি। কিন্তু বাবা খেয়াল করল না। কেমন একটা টেন্সড গলায় বলল, ডাক্তারবাবু তো তোর সঙ্গে কত ভালো করে কথা বলে। তোর ওনাকে খারাপ লাগল কেন?
—ডাক্তারবাবুকে খারাপ লাগেনি কিন্তু ওই মৃন্ময় লোকটা খারাপ তাই আমি ওর হেল্প নেব না।
—মৃন্ময় খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে? বাবা একটা অন্যরকম গলায় জিজ্ঞেস করল।
আমার মাথার মধ্যে তখন মাদারির গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঁদরটা লাফাচ্ছে-ঝাঁপাচ্ছে। আমি স্পষ্ট গলায় বললাম, খারাপই তো। ভীষণ খারাপ।ওই তো কাকুকে খুন করেছে।
ওই বড় রাস্তায়, হাজারও লোকের চলাফেরার মধ্যে বাবা একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর সপাটে একটা চড় মারল আমার গালে।আমি সেই চড় খেয়ে চুপ করে গেলাম না,উলটে গলা তুলে বলতে শুরু করলাম কী-কী দেখেছিলাম সেই রাস্তা উদ্বোধনের দুপুরে, পাজামা না-পরা অবস্থায়। বাবা বিশ্বাস করছিল না অবিশ্বাস বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু সেদিন ডাক্তারের কাছে না গিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম আর সারাটা পথ আমার হাতটা একবারের জন্য নিজের হাতছাড়া করল না বাবা।
বাড়িতে ফিরেও বাবা একদম গুম হয়ে রইল কিন্তু প্রায় ভোররাতে আমার ঘরে এসে আমাকে ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তুলে মা জিজ্ঞেস করল, তুই কী দেখেছিস?
—মৃন্ময়, কাকুর মুখে পিস্তল ভরে দিয়েছিল।
—খুন করতে দেখেছিস?
—না। কিন্তু আমার মনে হয়…
—তোর কী মনে হয় কেউ জানতে চায়নি। এইসব কথা সেদিন বলতে পারিসনি যখন, এখন বলার কোনও দরকার নেই।
—সেদিন অত পুলিশ দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম,মা।
—আমাদের বললি না কেন? তোর বাবাকে, আমাকে?
—বলতে চেয়েছিলাম। কেমন যেন গলায় আটকে গেল। ওই আটকে গিয়েছিল বলেই তো অত অসুখ করত আমার। কিন্তু এখন আমি সুস্থ হয়ে গেছি, যখন বলতে পারলাম তারপর থেকেই শরীরটা ভালো লাগতে শুরু করল। আমি ফেরার পথে অনেক জোরে জোরে হেঁটেছি, তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস কোরো…
—আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করব না। আর আমাকেও যেন কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করে। তুই ওসমস্ত কথা কাউকে বলবি না।
—কিন্তু কথাগুলো তো …
—কথাগুলো কী? সত্যি? কীভাবে প্রমাণ করবি তুই? কে মেনে নেবে তোর কথা?
—তুমি মানবে, বাবা মানবে। আর তারপর তোমাদের কথা পাড়ার সব লোক মানবে। তোমাদের এতদিন ধরে যারা চেনে যারা, যারা কাকুকে ভালোবাসত…
—তারা কেউ মানবে না। লোকে তার কথাই মানে যার ক্ষমতা আছে। আর মৃন্ময়ের এখন অনেক ক্ষমতা। অনেক উঁচুতে চলে গেছে ও। মা কীরকম একটা অদ্ভুতভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ঘুম এল না আমার। জেগে থেকে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভাবলাম, কত উঁচুতে চলে গেছে মৃন্ময় দে-সরকার? ওই যে উঁচু ঢিবিটার ওপরে দাঁড়িয়ে ও কাকুকে শাসাচ্ছিল, সেখানে তো আমিও উঠতে পারি এখন।কিন্তু অদৃশ্য ঢিবিগুলো যে আরও অনেক উঁচু তা তখনই বুঝিনি…
বুঝলাম যখন একদিন স্কুল ছুটির পর অতনু আমায় দাঁড়িয়ে যেতে বলল। তখন আমার ক্লাস টুয়েলভ। যে স্কুলে ছোট থেকে পড়তাম সেটা মাধ্যমিক স্কুল ছিল তাই ইলেভেনে নতুন স্কুলে ভরতি হয়েছিলাম আমি। আর সেই স্কুলে অতনুই হয়ে উঠেছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ওর হাত ধরেই আমি প্রথম লুকিয়ে কলকাতা যাই। একটা আধো-অন্ধকার গলির ভিতরের সিনেমাহলে আমায় নিয়ে ঢুকেছিল অতনু। বাবা-মা’ কিম্বা মা-মাসিদের সঙ্গে কলকাতার হলে সিনেমা আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু এই সিনেমার সঙ্গে তার কোনও মিল ছিল না। এখানে ফার্স্ট সিন থেকে হিরোইনরা হিরোদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুয়ে পড়ছিল। আর হিরোগুলো ওদের ওপরে চেপে ব্লাউজ খুলে ফেলছিল। টান মেরে খুলে দিচ্ছিল ব্রা। তারপর ভূগোল স্যার ক্লাসে যে সাইজের গ্লোব নিয়ে ঢুকতেন সেরকম দুটো গ্লোব বেরিয়ে আসছিল। হিরোগুলো হাত দিয়ে সেই গ্লোবদুটো চটকাতে শুরু করলে, সিটির আওয়াজে ফেটে গেল হল। আর হিরোইনগুলো নিজেরাই নিজেদের শাড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়ে সায়াটা তুলে দিল হাঁটুর ওপরে।
কীরকম অসুরের মতো দেখতে সেই হিরোগুলোকে। তাগড়াই চেহাড়া, মিশমিশে কালো রং, ইয়া মোটা গোঁফ। আর হিরোইনগুলোর কী মস্ত বড় বুক আর পাছা। ওদের কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে আমি অতনুকে কনুইয়ের ঠেলা দিলাম।
অতনু গম্ভীর গলায় বলল, এগুলো মালয়ালি সিনেমা। ডায়ালগ শোনার জন্য কেউ এগুলো দেখতে আসে না।
ইন্টারভ্যালের পর অতনুই আমাকে কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে বলল, সামনের সিনেমা তো অনেক দেখলি, এবার পিছনের সিনেমা দ্যাখ।
আমি ওই অন্ধকারে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, ছায়ার ওপরে ছায়া চেপে বসছে, ছায়াকে কাত করে জাপটে ধরছে ছায়া। আর চেয়ারের ক্যাঁচকোঁচের সঙ্গে নারী-পুরুষের ক্যাঁচকোঁচ মিলে যাচ্ছে। এরকম ক্যাঁচকোঁচ আগে একবারই দেখেছি আমি। মায়ের খুড়তুতো ভাই সোনামামা যখন নতুন বিয়ে করে বউ নিয়ে ক’দিনের জন্য আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। আগেকার জয়েন্ট ফ্যামিলিতে সব একসঙ্গে জড়াবড়ি করে থাকত বলে তুতো ভাইবোন না নিজের মায়ের পেটের, আলাদা করা যেত না। সোনামামাকেও খুব ভালোবাসত মা। মামার পানের নেশা ছিল বলে দুপুরবেলা আমাকে দিয়ে পান পাঠাত মামার ঘরে। ওই পান হাতে নিয়ে মামার ঘরে ঢুকতে গিয়েই প্রথম বিশ্বরূপ দর্শন হয় আমার। গায়ে শাড়ি, বুকে ব্লাউজ না থাকা সোনামামি মামার খোলা বুকে মাথা রেখে কীসব বিড়বিড় করছে দেখে আমি সরে আসি দরজা থেকে, কিন্তু পুরো সরতেও পারি না। সারা গায়ে কাঁটা নিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রেখে অপেক্ষা করতে থাকি এরপর যা ঘটবে, তার। ঘটেও। মামির ঠোঁটে,গালে, গলায়, বুকে চুমু খেতে-খেতে উত্তেজিত সোনামামা উঠে বসে। উঠে বসে বলে, ‘তোমার বাবা তো একটা মিথ্যাবাদী। বলেছিল, নগদের বাকি দশহাজার টাকা, বিয়ের একমাসের ভিতরে দিয়ে দেবে, কিন্তু তিনমাস পেরিয়ে গেল, দশ পয়সা ছোঁয়াল না’। কথাটা শুনেই সোনামামি কাঁদতে শুরু করে। আর তখনই আমার ওর বুক-পেট থেকে সরে যায় দৃষ্টিটা। কে জানে কেন, ওই নতুন বউয়ের কান্নার থেকে চোখ সরাতে পারি না আমি। খালি মনে হতে থাকে, আমাদের পাড়ার রঘুর কথা। রঘু বলেছিল, ‘ছেলেরা গায়ে হাত দিলে পরে যে মেয়েরা পয়সা চায়, তাদের বেশ্যা বলে’। কিন্তু বউরা গায়ে হাত দিলে যে বররা টাকা চায়, তাদের কী বলে?
কথাটা রঘুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি আমার আর। কিন্তু অতনুর পাশে বসে ওই ডবকা হিরোইনগুলোকে দেখতে দেখতে রোগা-পাতলা চেহারার সোনামামির কথা মনে পড়ছিল।হল থেকে বেরিয়ে অতনু যখন জানতে চাইল, এনজয় করেছি কি না তখন অন্যমনস্ক আমি জবাব দিতে পারলাম না ঠিক করে।
অতনু যাদের জন্য আমায় দাঁড়িয়ে যেতে বলেছিল তারা অবশ্য অন্যমনস্ক হবার কোনও সুযোগই দিল না । কিল-চড়-লাথি দিয়েই শুরু করল কথা। আমি বেশ কিছুক্ষণ চিৎকারও করতে পারলাম না, এতটাই বিহবল হয়ে গিয়েছিলাম। আর ওরা লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে চলে যাবার পর, অতনুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম ভ্যাবলার মতো।
অতনু একটু লজ্জা পাওয়া গলায় বলেছিল, আমি এরকমটা চাইনি বিশ্বাস কর। আসলে তোর সিক্রেটটা মদের ঠেকে বলে ফেলেছিলাম মুখ ফসকে।
গোপন কিছু বলেছিলাম আমি অতনুকে? কই মনে পড়ছে না তো। লুকোবার মতো আমার আছেই বা কী? আমি বলেছিলাম আমার বুকে যে পাথরটা আটকে আছে, তার কথা। আর অতনু সেটা বলে দিল মদের ঠেকে? বলেছে, বেশ করেছে। আমি তো চাই লোকে জানুক।
আমার চাওয়া ফলল। এলাকার স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ক্লাস নিতে ঢুকে স্যার দেখলেন চক দিয়ে লেখা, ‘মৃন্ময় দে-সরকার একটা খুনি’। একই কথা লেখা হল, অঞ্চলের কোনও দাতব্য চিকিৎসালয়ের বাইরের সাইনবোর্ডে। আর সেই লেখালিখির ফল আয়লা হয়ে আছড়ে পড়ল আমাদের বাড়িতে। আমার বাবাকে রাস্তার মোড়ে চড় মেরে গেল দুটো লুম্পেন, আমার মাকে ফল আর মিষ্টির পাশাপাশি সাদা থান পৌঁছে দিয়ে গেল মৃন্ময়ের এক ক্যাডার আর আমার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল একদিন। সকালে টিউশন পড়ে ফেরার পথে বাড়িতে ফিরল না বোন। ফিরে ভাত খেয়ে স্কুলে যাবে, এমনটাই জানা। কিন্তু বোন ফিরল না। সকাল গড়িয়ে দুপুর,দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, বোন ফিরল না। রাজাপুরের পাড়ার পর পাড়া আমি চষে ফেললাম সাইকেলে কিন্তু বোনের হদিশ পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম কত লোককে। কিন্তু সবার মুখেই যেন পিস্তল ঢুকিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। দু-একটা কথা বলতে চাইল কেউ-কেউ কিন্তু বলে উঠতে পারল না। বাবাকে নিয়ে থানায় গেলাম আমি কিন্তু সেখানে নাকি মিসিং ডায়েরি নেবার আগেও তিনদিন অপেক্ষা করতে হয়, যে মিসিং সে ফিরছে কি না দেখার জন্য।
—কোন আইনে লেখা আছে এটা? থানার মধ্যেই চিৎকার করে উঠলাম আমি।
—আইন দেখাচ্ছিস? চোখ দুটো গেলে দিলে আইন দেখতেও পারবি না,দেখাতেও পারবি না। চুতিয়া কোথাকার। ঠান্ডা গলায় বলে উঠল চেয়ারে বসা লোকটা।
—একটু দয়া করুন স্যার। বাবা ওসির হাত দুটো চেপে ধরল হাত বাড়িয়ে।
— আমাকে বলছেন কেন? মৃন্ময়বাবুর পায়ে ধরে ক্ষমা চান আর বলুন আপনাদের দয়া করতে। ওসি, বাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।
মৃন্ময় দয়া করল আমাদের। রাত যখন বারোটা পেরিয়ে গেছে তখন তিন-চারটে লোক বাড়ির ভিতর ঢুকল আমার বোনকে সঙ্গে নিয়ে। দেখলাম, আমার প্রায় সংজ্ঞাহীন বোনটার মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা। ঠেলে দিতেই বোন হুমড়ি খেয়ে পড়ল দাওয়ার ওপর। আমি ওর মুখের বাঁধনটা খুলে একটু জল খাওয়ানোর চেষ্টা করছি তখন মৃন্ময় দে-সরকার ঢুকল আমাদের বাড়িতে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমারও জল তেষ্টা পেয়েছিল কিন্তু তোমার হাত থেকে জল খাওয়া কি সেফ হবে?
বাবা বাইরেই ছিল কিন্তু ওর গলার আওয়াজ পেয়ে মা’ও ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। সারাদিন না খেয়ে মড়ার মতো পড়ে ছিল মা। হঠাৎ করে কোথায় এমন জোর পেল যে উঠোনে এসে চিৎকার দিয়ে উঠল, কেন এরকম করছ মৃন্ময়, তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলে ছিলে?
মৃন্ময় হাসতে হাসতে জবাব দিল, ঘরের ছেলেকে তো আপনারাই বে-ঘর করতে চাইছেন, বউদি। আপনার ছেলে লোক ডেকে ডেকে বলে বেড়াচ্ছে, আমি নাকি খুন করেছি, আপনার দেওরকে। আচ্ছা বলুন তো,কথাটা সত্যি?
বাবা ,মা নিস্তব্ধ হয়ে রইল। আর ওদের চুপ করে থাকতে দেখে মৃন্ময় বলে উঠল, তার মানে আপনারাও বিশ্বাস করেন কথাটা। আর আমি কি বিশ্বাস করি বলুন তো? শুধু আমি নই, এলাকার হাজারও মানুষ আজ বিশ্বাস করে যে আপনারাই খুনি।
—আমরা খুনি? বাবা বজ্রাহত গলায় বলে উঠল।
—অফ কোর্স। আপনিই নিজের বউয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের ভাইকে খুন করেছেন। খুন করেছেন, এই গোটা সম্পত্তি যাতে আপনার ছেলে একা ভোগ করতে পারে।
— মিথ্যে,মিথ্যে। মা বলল।
— থাউজ্যান্ড পারসেন্ট সত্যি। দেওরের বিয়ে দেননি কেন আপনি?
—আমি দিনে পাঁচবার করে বিয়ে করতে বলতাম বাপ্পাকে। বাপ্পাই তখন পার্টির কথা তুলে বলত ‘বউদি ওসব বোলো না’, বিয়ে-ফিয়ে আমাদের জন্য নয়।
—নয় কেন? আমি বিয়ে করিনি? পার্টি কি আমি কিছু কম করি? আর বাপ্পার বিয়েতে অমত ছিল না, আমি জানি। অমত ছিল আপনাদের। বাপ্পার ছেলে-মেয়ে হলে এই সম্পত্তির ভাগ পাবে তাই…
—না। চিৎকার করে উঠল মা।
—চিৎকার করে কিম্বা ছেলেকে দিয়ে নোংরা প্রচার করিয়ে আসল সত্য চাপা দেওয়া যাবে না। আপনারাই খুনি। আর শুধু বাপ্পাকেই নয় , এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নকেও খুন করছেন আপনারা। রাজাপুর এরিয়া খুব তাড়াতাড়ি পালটে যাবে। বড় বড় বিল্ডিং হবে, চওড়া হাইওয়ে হবে, অফিস হবে,কারখানা হবে। ওইসব বিঘের পর বিঘে বেগুন-বরবটির চাষ-ফাষ উঠে যাবে। গ্রাম থেকে শহর হবে রাজাপুর।
—আর যে সেই উন্নয়ন নিয়ে আসছে, যার হাত ধরে আমাদের এরিয়ার ভোল পালটে যাবে সেই মৃন্ময়দার নামে কুৎসা ছড়িয়ে আপনারা আমাদের সর্বনাশ করবেন সেটা আমরা হতে দেব না। আমার বোনকে নিয়ে ভিতরে ঢোকা লোকগুলোর একটা বলে উঠল।
— যদি কোনও অন্যায় করে থাকে আমার ছেলে আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু বিশ্বাস করো নিজের ভাইয়ের থেকে আলাদা করে তোমায় দেখিনি কখনও। বাবা সত্যি সত্যি হাতজোড় করল।
—বিশ্বাস করি তো। নিজের ভাইয়ের থেকে আলাদা করেন না বলেই ভাইয়ের মতো আমাকেও খুন করতে চাইছেন। মৃন্ময় ঠাট্টার গলায় বলল।
—খুন আমার বাবা করেনি, করতে জানে না, খুন করেছ তুমি। আমি বোনের পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলাম।
কথাটা বলামাত্র আমার মা আমার গালে একটা থাপ্পড় মারল প্রচণ্ড জোরে। আর ওর পিছন থেকে সামনে এগিয়ে আসা লোকগুলোকে হাতের ইশারায় থামতে বলে মৃন্ময় বলল, খুন কে করেছে কবে বুঝবি বল তো? যেদিন তোর বোন আর ফিরবে না। এবার তো আমি অনেক কষ্টে সবাইকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে পরেরবার দেখবি রেপড হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, কিম্বা ভেসে উঠছে খালের জল থেকে। তিনদিন পরে।
—দয়া করো, মৃন্ময়। মা জড়ানো গলায় বলে উঠল।
—দয়া আপনারা করুন। রাজাপুর ছেড়ে চলে যান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। বাড়ি-জমি বিক্রির ব্যবস্থা আমার ছেলেরা করে দেবে। নতুন জায়গায় নতুনভাবে সেটল করুন। নইলে কখন কী ঘটে যাবে, আমি কোনও গ্যারান্টি দিতে পারব না। মৃন্ময় ওর দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমি একার চেষ্টায় বোনকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। বেরিয়ে আসার সময় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে একফোঁটা জল। আমি ডানহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে সেই জল মুছিয়ে দিলাম। দেবার সময় মনে হল, সেন্স আছে। এতকিছুর পরও যখন চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে তখন ভিতরে কোথাও নিশ্চয়ই সেন্স আছে।
বাইরে এসে তুলসীমঞ্চে মাথা ঠুকে কাঁদতে থাকা মা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাইরে হিম পড়ছে, ঘরে চলো মা।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিল মা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। —আর কখনও আমার কাছে আসবি না, আমায় ছুঁবি না। তোর জন্য, শুধু তোর জন্য ওই নোংরা লোকগুলোর হাত আমার মেয়ের গায়ে পড়েছে, ওদের পা আমার শ্বশুরের ভিটেয় পড়েছে। ওই নোংরা তুই নিয়ে এসেছিস সঙ্গে করে। তুই একটা নর্দমার পোকা। আমি মানুষ পেটে ধরিনি। ধরতে পারিনি। মা ডুকরে উঠল।
আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা একটা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। চোখ সরিয়ে নিল, আমার চোখ থেকে।

রেড রোড ধরে গাড়ি ছুটতে যত সময় নেয়, স্মৃতি তত সময় নেয় না। আমি কয়েকটা মুহূর্তের ভিতর মানুষ থেকে নর্দমার পোকা হয়ে আবার আমার রাজার স্ট্যাটাসে ফিরে এলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল সেই রাত্তিরটায়। সেবার প্রথম আমাদের বাড়িতে কোজাগরী লক্ষীপুজো হল না। কাকু খুন হয়ে যাওয়ার বছরও যে পুজো বন্ধ হয়নি সেই পুজো বন্ধ হয়ে গেল সেবার। রাজাপুরের অন্য গ্রাম থেকে যারা আমাদের বাড়িতে প্রসাদ পেতে আসত তারা অনেকেই খবর পেয়ে গিয়ে আসেনি।কিন্তু কেউ কেউ চলেও এসেছিল। পুজো হয়নি, সেই খবরটা জানাতে গিয়ে মা তাদের বলছিল, ‘আমিই তো অলক্ষী, আমার বাড়িতে লক্ষী আসবে কেমন করে?’। সেই মায়ের পাগলামির শুরু। যত দিন যেতে লাগল, তত বাড়তে লাগল সেই পাগলামি। ততদিনে জমি-বাড়ি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে বাবা। কিন্তু টাকা যা আসছিল মায়ের চিকিৎসাতেই চলে যাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে এয়ারপোর্ট দু’নম্বর গেটের কাছে একটা খুব ছোট একতলা বাড়ি কেনা হল। দুটোমাত্র ঘর তার। ঘিঞ্জি গলির ভিতরে ছোট্ট সেই বাড়িটায় ঢোকার সময় অস্বস্তি শুরু হত আমার আর যত রাত বাড়ত দম আটকে আসত । প্রায় একবিঘে জমির কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাড়িতে আমি হামাগুড়ি দিতে শিখেছি, হাঁটতেও। আমার পক্ষে দু’দিকে দুটো চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে ওই আলো-বাতাসহীন একতলাটা যেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের অন্য একটা নাম।
—ঠিক সময়ে কেস দিয়ে তোদের ভাগিয়ে দিল কেমন দেখলি? ধর্মতলার মোড়ে দেখা হতে পুলক আমায় বলেছিল।
পুলকরা আমাদের পাড়াতেই থাকত। তবে ওর বাবা আমাদের গ্রামের একমাত্র পাঁড় মাতাল বলে বিখ্যাত ছিলেন বলে, মা আমাকে ওর সঙ্গে খুব একটা মিশতে দিতেন না। সেই পুলকের সঙ্গেই স্প্ল্যানেডের একটা বারে বসে প্রথম হুইস্কিতে চুমুক দিই আমি। ঢক করে অনেকটা খেয়ে নিয়েছিলাম একচুমুকে।
—মদ ওভাবে খেতে নেই রে হতভাগা। পুলক হাসল।
—আমি তো তোর মতো খানদানি মাতাল নই, কীভাবে জানব বল?
—আমি ইচ্ছে করেই সতর্ক করিনি তোকে, কারণ মদের সঙ্গে প্রথম এক্সপিরিয়েন্সটা একটু ‘র’ হওয়াই ভালো।
— ভিতরটা জ্বলে গেল রে শালা।
—কতটা জ্বলল? ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যতটা জ্বলছে তার চাইতেও বেশি?
আবারও ঠিক আগের মতোই বড় একটা চুমুক দিয়ে আমি বললাম, সব আমার দোষে হল।
— বোকা এবং মূর্খরা ঠিক এভাবেই ভাবে। কিন্তু তোকে আমি দুটোর একটা বলেও মনে করি না।
— না রে, আমি ঠিকই বলছি। যদি আমি মুখ না খুলতাম, কাকুর খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ফাঁস না হত, তাহলে…
—তাহলে অন্য কোনও প্ল্যান আঁটা হত তোদের তাড়ানোর জন্য। কারণ তোদের বাড়িটা গ্রামের এনট্রান্সে। বিরাট বড় মাল্টিস্টোরিড কমপ্লেক্স যখন তৈরি হবে তখন তোদের জমিটা না পেলে চলবে কী করে?
— মাল্টিস্টোরিড কমপ্লেক্স তৈরি হবে? আমাদের গ্রামে?
—হাসিস না। রাজাপুরের কোনও গ্রামীণ অস্তিত্ব আর নেই। পুরো জায়গাটার পরিচয় হয়েছে, ‘কলকাতা থেকে দশমিনিট’, কিম্বা ‘এয়ারপোর্ট থেকে পাঁচমিনিট’।
—বুঝলাম না।
— তোরা এখন যেখানে থাকিস সেখানে সব কাজ নিজেরাই করে নিস না কোনও ঠিকে কাজের লোক আছে?
—একটা মেয়ে সকালবেলা এঁটো বাসনগুলো মেজে দিয়ে যায় । কেন?
—কী নাম মেয়েটার?
— ঠিক বলতে পারব না।
— পারবি না জেনেই প্রশ্নটা করেছি। কেন পারবি না বল তো? ওই মেয়েটা তোর কাছে স্রেফ একটা বাসন-মাজুনি। ওর যে মানুষ হিসেবে আলাদা একটা অস্তিত্ব আছে, সেটা তুই মনে রাখিসনি। যে এনআরআইরা কিম্বা দেশের কোটিপতিরা রাজাপুরে ডুপ্লেক্স বাংলো কিনবে, তারাও মানুষ হিসেবে তোর-আমার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। আর যারা আমাদের অস্তিত্বই স্বীকার করে না তাদের কাছে আমাদের গ্রামগুলোর মূল্য কী? তুই চিতল হরিণের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে পারিস হাজারবার, কিন্তু বাঘের কি সেই মুগ্ধতাবোধ থাকা সম্ভব? তার কাছে তো হরিণটা কেবলমাত্র পেট ভরানোর জিনিস, তাই না?
—ব্রাভো! তোর মতো লোকই টাইট দিতে পারবে মৃন্ময় দে-সরকারদের।
—সরি ব্রাদার। উলটে মৃন্ময়ই আমাদের টাইট দিয়ে দিয়েছে। আমরাও রাজাপুরের মায়া কাটিয়ে কলকাতায় উদবাস্তু হয়ে উঠে আসছি।
—বাট হোয়াই?
—আমার বাবা কতটা দিলদরিয়া লোক, সেটা গ্রামের সবাই জানে। কিন্তু সে তো মদ খায় তাই না? তার নামে শ্লীলতাহানির কেস দিয়ে দেওয়া খুব কি মুশকিল?
—কী বলছিস?
—অত অবাক হোস না। খুব সাধারণ অঙ্ক এটা। রাজাপুর থেকে গেঁয়ো ভূতগুলোকে বিদেয় করে ওখানে ‘নিউ সিটি’ বানানোর জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর জমি চাই। আর সেই জমি হাসিল করার জন্য মৃন্ময়ের মতো লোক চাই যারা একইসঙ্গে দালাল আর মাসলম্যান। এরাই আমাদেরটা কেড়ে ওদের হাতে তুলে দেবে।
—তাহলে আমরা যাব কোথায়?
—যমের বাড়ি।
—কিন্তু নিজের দেশে কেউ রিফিউজি হয় পুলক?
—হয় । উন্নয়ন যখন বিপ্লবের মুখোশ এঁটে এগিয়ে আসতে থাকে তখন হয়। পুলক জোরে হেসে উঠল।
পুলকের বলা শেষ কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল তাই ওর সেই হাসি আমার কানে মাঝেমধ্যেই বেজে উঠত। বাবার মৃত্যুতে সর্বস্বান্ত হয়ে একতলা বাড়িটা বেচে দেওয়ার সময়, মায়ের বদ্ধ পাগল হয়ে যাওয়ার সময়, বোনের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়, এই বস্তিতে উঠে আসার সময় আর আল্টিমেটলি মা পরপারে চলে গিয়ে সব বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে যাওয়ার সময় আমি নিজের ভিতরে ওই হাসির শব্দ শুনেছি।
আজও শুনলাম।আর শুনতে শুনতেই মনে পড়ে গেল সেই সিনেমাটার কথা যেখানে অনিল কাপুর একদিনের জন্য চিফ মিনিস্টার হয়েছিল। সেই একদিনে অনিল কাপুর সেলস ট্যাক্সের আদায় বাড়িয়ে শূন্য কোষাগার পূর্ণ করে দিয়েছিল, সমস্ত ঘুষখোর আমলাদের বরখাস্ত করেছিল, বোমা বিস্ফোরণ থেকে বাঁচিয়েছিল বম্বে’কে, রানি মুখারজির সঙ্গে প্রেমও করেছিল। চব্বিশঘণ্টার মধ্যে এতকিছু করেছিল বলেই পরদিন থেকে জনতার নায়ক হয়ে গিয়েছিল লোকটা। ঠিকই হয়েছিল। সিনেমায় তো এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আজ একটা অলৌকিক কাণ্ড আমার সঙ্গে ঘটে গেলেও আমি যে সিনেমার নায়ক নই সেটা আমার মনে আছে। আছে বলেই আমি পরিস্থিতিটা এনজয় করছি কিন্তু ভেসে যাচ্ছি না।
কেন ভাসব? সুইডেন থেকে নোবেল প্রাইজ ঘোষণা করা হয়েছে নাকি আমার নামে? একটা সিচুয়েশন হটাৎ করে অন্যরকম একটা জীবনের দরজা খুলে দিয়েছে আমার সামনে। সেটা সুখের পাশাপাশি দুঃখেরও হতে পারে। আজকে যে চিন-ভারত যুদ্ধ শুরু হল, আমিই তার প্রথম শহিদ হব না, কে বলল? যেহেতু আমার জীবনের দাম পৃথিবীর কাছে খুব কম তাই এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে আর্মি একদম ঠিক কাজ করেছে। একটা ফাউ’এর মূল্যে যদি দেশের মাথাদের জীবন বাঁচে তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? কিন্তু যে একদম কিছু না, দেশের হয়ে সার্ভিস দিলে তারও কিছু পাওনা হয়। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে পেনশন দেওয়া হয়, সেটা দেশপ্রেমের বিনিময়েই তো দেওয়া হয়। এভাবে বললে হয়তো শুনতে খুব খারাপ লাগে কারণ ৪২র ‘ভারত ছাড়ো’তে যারা অংশ নিয়েছিলেন কিম্বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেছিলেন, তারা তো দেশের হয়ে মরবেন বলেই ঝাঁপিয়েছিলেন। শহিদ হতে গিয়েছিলেন কিন্তু দেশভাগ হওয়ার পর রিফিউজি হয়ে কলকাতার ফুটপাথে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে এমন একজন দাদু আমাকে, দেখা হলেই, সূর্য সেনের গল্প শোনাতেন। এয়ারপোর্ট দু’নম্বর গেটের কাছেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকা, অকৃতদার সেই মানুষটি একদিন একটা বানরুটি কিনে দিতে বলেছিলেন আমাকে। আমার কলেজ যাওয়ার তাড়া ছিল বলে, রুটিটা কিনে দিয়েই নাগেরবাজারের অটোয় উঠে পড়ি। কিন্তু তিনচারদিন পর আবার একদিন যখন দাদু আমায় একইভাবে একই কথা বলেন, আমি ভালো করে তাকাই। এ কী চেহারা হয়েছে দাদুর? গাল-দুটো তেবড়ে ভিতরে ঢুকে গেছে, চশমাটা ভাঙা, পায়ে ছেঁড়া চপ্পল, শরীরটা যেন লাঠিতে জড়ানো ভিজে পতাকার মতো নেতানো। কেন হল এরকম?
—অরাই তো আমার পয়সায় খায়, আমারে খাওয়াইব ক্যামনে ? দাদু বলেছিলেন।
— কিন্তু আপনার পয়সা কোথায় গেল? মাস গেলে যেটা পান?
—আসে। গরমেন্টের ঘরে জমা হইতাসে। কোন একটা পেপারে নাকি ছাপা হইসে আমি মইরা গেসি, সেই খবর পাইয়া সরকারি দফতরের লোকজন আমার পেনশন আটকাইয়া দিসে। যাগো লগে থাকি, সবকয়টায় তো গোমুখ্যু। চিঠি-চাপাটি কইরা যে আমার পেনশন ছাড়াইয়া আনব সেই ক্ষমতা নাই। তুমি একটু দ্যাখবা নাকি, যদি কিছু করবার পারো?
আমি নই, মূলত আরেকজনের চেষ্টাতেই দাদুর পেনশন চালু হয়েছিল আবার।কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হল, দেশপ্রেমের মূল্যও টাকার অঙ্কে দেওয়া যায়, এই ব্যাপারটা স্বীকৃত। অনেকসময় সেই মূল্য না পেলে, জীবনধারণ করা মুশকিল হয়ে যায়, দাদুর যেমন হয়েছিল। এবার আমাকে কি মূল্য দেবে ইন্ডিয়ান আর্মি? রাজাপুরে একটা বড় ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, বেশ অনেকটা টাকা যাতে এই হকার আর পেন্সিলারের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এতটা না দিলেও কিছু তো দেবেই, দেশের হয়ে রিস্ক নেবার জন্য। বেঁচে থাকলে আমার পাওনাগণ্ডা আমি বুঝে নেব কিন্তু যদি মরে যাই? শিবুর মেয়ে-দুটোর নাম লিখে যাব, ওয়ারিশন হিসেবে। বোনটা যদি নিরুদ্দেশ না হয়ে যেত তাহলে ওর নামও লিখে যেতাম। এখনও যেতে পারি। হায় পোড়া কপাল আমার, আমি তো গোড়ায় গলদ করে এসেছি। যদি বোনের খোঁজ পাওয়াও যায়, আমি এই দুনিয়ায় না থাকলে ও নিজেকে রামখিলাওনের বোন বলে প্রমাণ করবে কীভাবে? শিবুর মেয়েরাই বা কীভাবে রামখিলাওনের উত্তরাধিকারী হবে? অসম্ভব। আমি ছাড়া আমার এই অ্যাডভেঞ্চারের ফল আর কেউ ভোগ করতে পারবে না।
আমি যেন দস্যু রত্নাকরের একইসঙ্গে আধুনিক আর উলটো সংস্করণ যার পূণ্যের ভাগ খাওয়ার কেউ নেই। একাই খেতে হবে। কীভাবে খাব? দেশের ভালো করার চেষ্টা করে? মোলো যা! রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ থেকে বিদ্যাসাগর ফেল করে গেলেন, আমি করব ভালো? তবে কী নিজের ভালো করব? তাই করা উচিত কিন্তু আমি সেই স্টেজ পেরিয়ে এসেছি। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে বোমা পড়ার পর যদি কোনও ফুলওয়ালি, ফুলের বাগান করতে যেত ওখানে, চারা পুঁতত কোথায়? সব হারিয়ে ফেলে আমার জীবনটাও এখন ওই হিরোশিমার মাটি।
জীবনের শেষদিনগুলো, বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারিটা খুব হাঁটকাত বাবা। আমি একদিন কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিল , ‘একটা বাংলা শব্দ খুঁজি। যার মানে, ডেস্ট্রয়েড বিয়ন্ড রিকভারি’। শব্দটা বোধহয় বাংলা ভাষায় নেই। কিন্তু অন্য একটা শব্দ আছে। খুব চেনা শব্দ। ‘প্রতিশোধ’। যাদের অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, লোভ, মিথ্যাচার, ক্রুরতা আর না জানি আরও কত ভয়ংকর বিশেষণের জন্য আজ এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া যায় না আজ রাতে? চিনের দুশমনি আমাকে যে রাতটার রাজা বানিয়েছে, আমার দুশমনদের শেষ করার জন্য সেটাই তো আদর্শ রাত। মনে হতেই,রক্ত যেন নেচে উঠল মাথায়। আমি গাড়ি ঘোরানোর অর্ডার দিলাম, অমরদীপকে।