অগণতান্ত্রিক কংগ্রেসের স্বৈরতান্ত্রিক রীতি-নীতি

– শ্রী দীপঙ্কর সরকার

 

[১৯৬৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু কংগ্রেস ও জাতীয় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এক বিহ্বলতার সৃষ্টি করে। শূন্যপদ দ্রুত পূর্ণ করার জন্য প্রারম্ভ হয় কংগ্রেসের ক্ষমতার অলিন্দে দ্বন্দ্ব। শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যময় মৃত্যু তা আরও তীব্র করে। পরিশেষে, কংগ্রেসের বয়োবৃদ্ধ নেতৃত্বের আশীর্বাদ নিয়ে প্ৰধানমন্ত্রী পদে আসীন হন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী – অচিরেই তাঁর প্রথম কার্য হয়ে ওঠে সেই একই নেতৃত্বের বিনাশ সাধন করা – সম্পাদকীয়]

শেষমেশ, দলবিরোধী কাজের অভিযোগে, কংগ্রেস সভাপতি, কর্ণাটকের সিদ্ধাবনহল্লি নিজালিংগাপ্পা, ইন্দিরা গান্ধীকে দল থেকে তাড়িয়েই দিলেন। তারিখটা ছিল ১২ই নভেম্বর, ১৯৬৯ সাল।

স্বাধীনতার দুই দশক পেরোতে না পেরোতেই ভারত, তিন-তিনটি পুরোদস্তুর যুদ্ধ লড়ে ফেলেছে – ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের সাথে। ১৯৬২ এ চীনের সঙ্গে। ১৯৬৫তে, আবার পাকিস্তানের সাথে।

জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর, ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রীজী, ৯ই জুন, ১৯৬৪ সালে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, ১৯৬৫ সালের জুন মাসে, পাকিস্তান শুরু করল ‘অপারেশন জিব্রলটার’ – সেই কাশ্মীরকে কব্জা করার নোংরা খেলা। লেগে গেল যুদ্ধ।

এবং যথারীতি মুখ পুড়ল পাকিস্তানের। জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে বেধড়ক মার খেয়ে, পাক বাহিনীর তখন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতি হল। ১০ই জানুয়ারি, ১৯৬৬, উজবেকিস্তানের রাজধানী (উজবেকিস্তান তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) তাসখন্দে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিচুক্তি হল। চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক, জেনারেল আয়ুব খান।

পরের দিন, ১১ই জানুয়ারি,১৯৬৬, রাত দু’টো নাগাদ, লালবাহাদুরের রহস্যময় মৃত্যু হল ওই তাসখন্দেই (সেই রহস্যভেদ হয়নি আজ, ঘটনার ৫০ বছর পার হয়ে যাবার পরও!)।

তড়িঘড়ি, গুলজারিলাল নন্দকে কর্মনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী করে, স্থায়ী প্রধানের খোঁজ শুরু হল কংগ্রেসে।

তখনও কংগ্রেসে একটা ‘সর্বভারতীয় রূপ’ ছিল। এখনকার মত একেবারে ‘১০, জনপথ রোডমুখী’ ছিলনা। দলের সভাপতি ছিলেন তামিলনাড়ুর কুমারস্বামী কামরাজ, যাঁকে ভারতীয় রাজনীতির ‘বিগ ড্যাডি’ বলা হত। বলতে গেলে, কামরাজই ছিলেন দলের সর্বেসর্বা।

কামরাজ প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করলে হয়তো কংগ্রেস দলটা ভাঙতোই না। কিন্তু, কামরাজ, তাঁর ইংরেজি ও হিন্দি বলার অক্ষমতার দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্বর দাবী থেকে সরে দাঁড়ালেন। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি সমসাময়িক সবার মনে আছে নিশ্চয় – ” No Hindi, no English – How?

অতএব, প্রধানমন্ত্রী হবার দৌড়ে রইলেন মোরারজি এবং ইন্দিরা, আর ‘কিং মেকারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন কামরাজ। মোরারজি ছিলেন নেহেরুর পছন্দের ব্যক্তি ; আর ইন্দিরা, খোদ নেহেরুকন্যা। ‘ডুয়েলটা’ যে জমবে জানাই ছিল।

কামরাজ, ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন আর মোরারজিভাইকে, উপপ্রধানমন্ত্রী।

কিন্তু ‘প্রধান’ আর ‘উপপ্রধান’য়ে বিস্তর ফারাক! ইন্দিরা ও মোরারজি – কেউই এক নম্বর হবার দাবি থেকে একচুল নড়লেন না। ফলে সাংসদদের ভোটাভুটি করতে হল। তখন ভারতে ১৪টি রাজ্য ছিল। গুজরাত ও উত্তরপ্রদেশের এম পি’রা দেশাইকে ভোট দিলেন। বাকিরা গেলেন ইন্দিরার পক্ষে। ফলাফল : ইন্দিরা ৩৫৫ আর মোরারজি ১৬৯ ভোট। ইন্দিরা গান্ধীই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন।

ইন্দিরার এই জয়ে, দলের বয়োজ্যেষ্ঠরা সামিল ছিলেন। অথচ, ক্ষমতা হাতে পেয়েই ইন্দিরা, ‘বুড়োদের’ ডানা ছাঁটতে শুরু করে দিলেন। গান্ধী পরিবার অন্য কারো সাথে ক্ষমতা ভাগ করেনা।

এল সাতষট্টির সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে ইন্দিরার নেতৃত্বে, কংগ্রেস জোর ধাক্কা খেল। গুজরাত, মাদ্রাজ, রাজস্থান, ওড়িশা, বাংলা, কেরল ও দিল্লিতে জঘন্য ফলাফল করল দল। অযোগ্যতার বোঝা চাপল ইন্দিরার মাথায়। দলের বয়োজ্যেষ্ঠরাও সেই সুযোগে কোণঠাসা করে দিল নেহেরুকন্যাকে।

এরপর হল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন ভি ভি গিরি। ইন্দিরা, ‘বুড়োদের’ জব্দ করতে, তলেতলে, কংগ্রেসের ও বিরোধী দলের বেশ কিছু এম পি ও এম এল এ’র সাথে একটা যোগসাজশ করে কংগ্রেসের প্রার্থীকেই দিলেন হারিয়ে। ভি ভি গিরি হয়ে গেলেন দেশের রাষ্ট্রপতি।

কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলনা, কার কারসাজিতে কংগ্রেস প্রার্থীর হার হয়েছে, দলবিরোধী কাজ কার।

অভিযুক্ত ইন্দিরার দোষ প্রমাণিত হতেই, কংগ্রেস সভাপতি, নিজালিংগাপ্পা, কংগ্রেস থেকে ইন্দিরাকে বহিষ্কার করে দিলেন।

ইন্দিরার এই ‘ষড়যন্ত্র’কে কাপুরুষোচিত আখ্যা দিয়ে কংগ্রেস সভাপতি নিজালিংগাপ্পা মন্তব্য করেছিলেন, “গণতন্ত্রকে হতাশ করে এমন নেতা, যে জনপ্রিয়তার কারণে ক্ষমতায় এসে, হয়ে যায় আত্মমুগ্ধ।” (Tragedy overtakes democracy, when a leader who rises to power due to popularity, becomes a narcissist.)

ব্যাস্, দু’টুকরো হয়ে গেল কংগ্রেস দল। নতুন দল গড়ে, ইন্দিরা তার নাম দিলেন কংগ্রেস (আর) মানে Congress (Requisitionists). পুরোনো দলটার নতুন নাম হল কংগ্রেস (ও) মানে Congress (Organisation). কামরাজ, নিজালিংগাপ্পা, মোরারজি দেশাই, সঞ্জীব রেড্ডি সমেত বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা সবাই রয়ে গেলেন আগের দলে।

আমার বয়স তখন বছর দশেক হবে। বেশ মনে আছে, সবাই ইন্দিরার দলকে বলত ‘নব কংগ্রেস’ ; আর অন্য দলটিকে, ‘আদি কংগ্রেস’। ‘নব কংগ্রেসে’র দলে বেশি সাংসদ থাকায়, ইন্দিরাই প্রধানমন্ত্রী রইলেন।

ঊনিশশো একাত্তরের লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছিল। কংগ্রেসের দুই পক্ষই বুঝেছিল, ওই নির্বাচন হবে তাদের অস্তিত্বের লড়াই। তাই দু’দলই নিজেদের মত ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত থাকল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘জোড়া বলদ’। দু’দলই সচেষ্ট হল এই প্রতীকটি হাতাতে। কিন্তু, নির্বাচন কমিশন, এই ‘জোড়া বলদ’ প্রতীকটি, নতুন কংগ্রেস অর্থাৎ কংগ্রেস (আর)কে ব্যবহার করতে দিলনা। এই প্রতীক কংগ্রেস (ও)র কাছেই রয়ে গেল। ‘জোড়া বলদের’ বদলে ইন্দিরার কংগ্রেস পেল ‘গাই বাছুর’ প্রতীক। পরে সেটা ‘হাত(?)’ বা ‘করতল’ করা হয় (এই ‘গাই বাছুর’ থেকে ‘হাত’ হবার পেছনেও একটা জমাটি ঘটনা আছে। অন্যসময় তা বলব।)

প্রথম রাউণ্ডে ইন্দিরা, হার মানলেন ‘আদি’দের কাছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ‘জোড়া বলদ’ নির্বাচনী প্রতীক অধরা থেকে গেল তাঁর।

এবার এল একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। লাগল আরেক প্রস্থ ভারত-পাক লড়াই। আবার হেরে ভূত পাকিস্তান। কিছুদিন পর লোকসভা নির্বাচন। দেশের মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বাজিমাত করলেন ইন্দিরা। মোট ৫১৮টি সীটের লোকসভায়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য দরকার ছিল ২৬০টি আসন। ইন্দিরার দল ঝেঁটিয়ে তুলে নিল ৩৫২টি, ‘আদি কংগ্রেস’, কুড়িয়ে কাচিয়ে, মাত্র ৫১টি। জাতীয় রাজনীতিতে, ‘জোড়া বলদ’ একদম গুরুত্বহীন হয়ে গেল।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়াল। সত্তরের দশক, ভারতের রাজনীতিতে উত্তাল, জমজমাট, সরগরম। অনেক ঘটনা, অনেক উত্থানপতন। অত বলার পরিসর এখানে নেই।

ওদিকে, ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ বা Indian National Congress (INC) নামটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না তো!

রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই ওই INC নামটা ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছিল কংগ্রেসীরা। কাজটা বৈধ ছিলনা। এই নিয়ে অশান্তিও হয়েছিল। সোনিয়া গান্ধী দলের সভানেত্রী হবার পর, নির্বাচন কমিশনের কাছে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ তকমাটি আবার দাবী করা হয়। পাল্টা দাবী করার কেউই ছিলনা আর। ‘আদি কংগ্রেস’ তো সেই সাতাত্তর সালেই জনতা পার্টিতে মিশে গিয়েছিল। তাই, একতরফা ভাবেই INC তকমার অধিকারী হল ‘ইন্দিরা কংগ্রেস’। তবে ‘জোড়া বলদ’ সেই যে কংগ্রেসের গোয়াল থেকে পালাল, তাদের আর আনা গেলনা।

কংগ্রেসের এই ভাঙনের ইতিহাস, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রজন্ম জানেনা। তারা জানে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বা Indian National Congress (INC), মানে যে রাজনৈতিক দলে গান্ধীজি, নেতাজী সুভাষ, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখরা ছিলেন, এখনকার কংগ্রেস হল ‘সেই কংগ্রেস’। সত্যটা অন্য। ১৯৬৯ সালে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এখনকার কংগ্রেস, সেই দু’টুকরোর এক টুকরো।

সাতের দশকে, আমার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী শ্যামল মিত্র, গৌরীপ্রসন্নর কথায় একটা জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। গানটির শুরুর চরণ দু’টি খুব মনে পড়ছে:

“সবকিছু বদলে গেছে,
এই তুমি তো সেই তুমি নও।”

গানটি প্রেমবিরহের হলেও, বর্তমান কংগ্রেস দলটির ক্ষেত্রে, গানের কলিদু’টি বেশ খাটে।