বঙ্গের পুনর্জাগরণ – কী এবং কেন (প্রথম কিস্তি)

0
658

একদা গুরুর নিকটে আমরা – অর্থাৎ বঙ্গজ হিন্দুসন্তানগণ – শুনিয়াছিলাম যে খালি পেটে ধর্ম হয় না। বেশ কথা। গুরুর সে আদেশ শিরোধার্য করিয়াই বুঝি বা পেট ভরাইবার নিমিত্ত যাহা কিছু প্রয়োজন তাহার সংগ্রহ-চেষ্টায় আমরা কোনোরূপ খামতি রাখি নাই। বিলাতি আদর্শে গঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার সহিত মানাইয়া লইয়া বিলাতি ভাষা, বিলাতি বোলচাল, বিলাতি বিদ্যা, বিলাতি কারিগরি-বাণিজ্য-চিকিৎসা-স্থাপত্য-শিল্পকলাদি খুব কষিয়া শিখিয়াছি। আপন পুত্রকন্যাদিগকে দিশি ভাষাশিক্ষা তথা দেশীয় বিদ্যাশিক্ষা না করাইয়া, পূর্বে উদ্ধৃত ঐসকল বিলাতি কর্মকুশলতায় ব্যুৎপত্তি লাভ করাইবার জন্য কালাপানি পার হইয়া ম্লেচ্ছ দেশে পাড়ি দিয়া এমনকী সেখানে বাস করিতেও নিরন্তর উৎসাহ যোগাইয়াছি। মধ্যপ্রাচ্য এবং বিলাতের ভাষা হইতে শব্দরাজি ধার করিয়া, এবং ঐসকল বিজাতীয় ভাষার কথনভঙ্গি মিশাইয়া আপন মাতৃভাষার সত্তা-স্বাক্ষর-সাবলীলতা ঘুলাইয়া দিয়াছি। একদা যে ভাষার কষ্টিপাথরে ঘষিয়া মাজিয়া অমার্জিত বাংলা গদ্যকে সবল সুতীক্ষ্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যে ভাষার সাহিত্যসমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়া কৃত্তিবাসের কাল হইতে আরম্ভ করিয়া শ্রীমধুসূদন হইয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবধি বাঙালি কবিপুঙ্গবগণ বঙ্গভাষার কাব্যকে অমূল্যমণিমাণিক্যখচিত দিগ্বিজয়ী কলায় উন্নীত করিয়াছেন, সেই মাতৃস্বরূপা দেবভাষা সংস্কৃতের পুণ্য পয়স্বিনী-উৎস হইতে আমরা – দেশভাগোত্তর নব্য বঙ্গজরা – আমাদিগের মাতৃভাষাকে সমূলে উৎপাটিত করিয়াছি। এই সকল অস্বাভাবিক এবং ক্রূর কর্মের ফল হইয়াছে মারাত্মক। স্বদেশের মৃত্তিকায় প্রোথিত মণিমুক্তা হেলায় ফেলাইয়া ছড়াইয়া বিদেশ হইতে এমন সব বিষবৃক্ষ আমদানি করিয়া এই সুজলা সুফলা ভূমিতে আমরা রোপণ করিয়াছি যে একদা মাত্র এক দশকে – সত্তরের রাষ্ট্রবিপ্লবের কালে – একখানি সম্পূর্ণ প্রজন্ম এক অর্থহীন উন্মাদ মৌষল পর্বে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে, তাহার পরবর্তী প্রজন্মগুলি আপনার পরিচয় না জানিয়া অথবা সে পরিচয় ঘৃণা করিতে শিখিয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, উঠিতেছে।

বহু কষ্ট, মৃত্যু এবং ত্যাগের ফলে প্রাপ্ত বাঙালি হিন্দুর এই অবশিষ্ট একফালি পিতৃভূমিতে বিদেশি বিজাতীয় বিসদৃশ মতাদর্শ, রাষ্ট্র ও সমাজভাবনা, অর্থনীতি (যাহা বিশেষ করিয়া বঙ্গদেশীয় জলবায়ুর পক্ষে অনুপযুক্ত) আমরা এমন গভীরভাবে বপন করিয়া দিয়াছি যে তাহা আজ আমাদিগের চিন্তা বুদ্ধি বিবেককে প্রায় সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করিয়াছে। তবে চোখে পড়িবার মতো বিষয় হইতেছে যে চিন্তার জগতে তথা কর্মের জগতে এই সকল উৎকট, অপ্রাকৃত, স্ববিরোধী এবং পিতৃমাতৃদ্রোহী কার্য সম্পাদন করিয়াও আমাদিগের অন্নবস্ত্রের সংস্থানব্যাপারে সিদ্ধিলাভ খুব একটা মন্দ হয় নাই। জীবন নির্বাহ করিবার নিমিত্ত মনুষ্য যাহা কিছু উদ্যম গ্রহণ করিতে পারে, যে যে ক্ষেত্রে বিচরণ করিতে পারে, তাহার প্রায় কোনোটিই বঙ্গীয় হিন্দু বাদ রাখে নাই। আর যাহাই বলে বলুক, অদ্য কোনো নিন্দুকে তাহাকে অন্ততঃ আলস্য কিংবা জড়বুদ্ধিতা দোষে দুষ্ট বলিতে সাহস করিবে না। দেশভাগোত্তরকালে দীর্ঘ সত্তরখানি বৎসর যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু তাহার ধর্ষিত বাস্তব, খণ্ডিত মাতৃভূমি আর বিদলিত মর্যাদার রূঢ় সত্যের সহিত ঘর করিয়াছে। ইহা যে এক মহাসংগ্রাম ছিল, তাহাতে সন্দেহ কিছুমাত্র নাই। প্রাণরক্ষার দায়ে পূর্ববঙ্গের মাতৃভূমি হইতে বিধর্মী কর্তৃক বিতাড়িত অসংখ্য বাঙালি হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে পলাইয়া আসিয়া অস্তিত্ব রক্ষার জন্য উদয়াস্ত খাটিয়াছে। এইরূপে মাতৃভূমি দ্বিখণ্ডিত করিয়া পূর্ববঙ্গ হইতে হিন্দু বিতাড়নের ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গীয় ভূমিজ বাঙালি হিন্দুর জীবন-জীবিকার উপরেও স্বাভাবিকভাবেই নামিয়া আসিয়াছে মারাত্মক চাপ, সে চাপ অনেকাংশে সহ্য করিয়া এপারের স্থানীয় বাঙালি হিন্দুও যারপরনাই আপনার জীবনসংগ্রাম বজায় রাখিয়াছে। হয়তো বা এই সংগ্রামের ফলস্বরূপ পূর্ববঙ্গ হইতে বিতাড়িত অধিকাংশ হিন্দুদিগের জাতকুলশীলমান খোয়াইতে হইয়াছে, তথাপি সবেধন নীলমণি প্রাণখানি রক্ষা করা গিয়াছে, কোনোরকমে ধরিয়া রাখা গিয়াছে বংশধারাও। কাজেই এই সংগ্রামের ফল অবিমিশ্র গৌরব নহে। তবে এই সত্যখানি একবাক্যে স্বীকার করিয়া লওয়াই শ্রেয় যে গুরুর বাণী মনে রাখিয়া (অথবা না রাখিয়া) বাঙালি হিন্দু নিজ পিত্তরক্ষার বন্দোবস্তটি মন্দ করে নাই। তাহা সে অত্যাধুনিক বাণিজ্যবুদ্ধির প্রয়োগকৌশলে স্টার্ট-আপ তৈয়ার-প্রচার-প্রসার করিয়াই হউক, অথবা প্রোমোটারি-গুণ্ডামি করিয়াই হউক, অসংখ্য ছিন্নমূল (এবং বদ্ধমূল) বাঙালি হিন্দু আপন ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে কালে সক্ষম হইয়াছে। আর তাহাদের গৃহে ক্ষুধার নিমিত্ত সে ক্রন্দন নাই, মস্তকের উপর হইতে ছাদের আবরণ খোয়াইবার মত নিদ্রাহরণকারী দুশ্চিন্তাখানি নাই। যাঁহারা পূর্ববঙ্গের পিতৃভিটা হইতে তাড়া খাইয়া এপারে আসিয়াছিলেন, অথবা যাঁহারা এপারেই ছিলেন এবং এখনো আছেন, উভয় পক্ষের বংশধরেরাই আজ কর্মের নানা ক্ষেত্রে দিগ্বিদিকে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহার সুলভতম উদাহরণ আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যায় বাঙালির নামযশ, যাহা সর্বজনবিদিত। মূলতঃ প্রবাসে বাঙালি নিজ কর্মগুণ এবং উদ্যমের দ্বারা ধনমান অর্জন করিয়া কমবেশি প্রমোদবিলাসে জীবনযাপন করিতেছে এমন কথা বলা খুব ভুল হইবে না। মোট কথা, তাহার পেট আর খালি নাই।

মাঝখান হইতে ধর্মের কথা সে বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছে। উদ্দেশ্য ছিল – পেটের বন্দোবস্ত পাকা করিয়া তাহার পর ধর্মপথে অগ্রসর হইবে, গুরুর আদেশ ছিল যে তাঁহার শিষ্যেরা ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গের সাধন করিয়া মোক্ষলাভের পথ প্রশস্ত করিয়া লইবে, বাকি দেশবাসীকে তথা বিশ্ববাসীকেও আপন ধর্মাচরণ দ্বারা মুক্তির পথ দেখাইতে প্রবৃত্ত হইবে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে শিষ্যদল অর্থ ও কাম অর্জন করিয়াই নিবৃত্ত রহিল, আর ধর্ম অবহেলায় অতি অযত্নে এক কোণে রহিল পড়িয়া। ধর্মবিযুক্ত অর্থ এবং ধর্মবিযুক্ত কাম লাভে প্রবৃত্ত হইয়া শিষ্যদল অর্থ ও কামের সম্পূর্ণ উদযাপন করিতে তো পারিলই না, উপরন্তু মোক্ষলাভের সাধু সঙ্কল্পটিও বঙ্গোপসাগরের লবণাম্বুতে বিসর্জিত হইল। ইহা হওয়ারই কথা, কারণ ধর্মকে এড়াইয়া যাইলে অর্থ অথবা কাম – কোনটিরই পূর্তি হয় না, কোনো বর্গেই সিদ্ধি লাভ হয় না। কেবল উপর উপর খানিক এদিক ওদিক লাফাইয়া বেড়ানো হয় মাত্র। তেমন সাফল্য পশুতেও পাইতে পারে – আখেরে যথাবিধি ট্রেনিংপ্রাপ্ত হইলে ইতর প্রাণী কতই না চমৎকারসাধন করিতে পারে – তাহার জন্য মনুষ্যযোনিতে জন্ম লভিবার কষ্ট ধারণ করিতে হয় না। মনুষ্যপদবাচ্য হইতে হইলে প্রবৃত্তিমার্গ ছাড়িয়া নিবৃত্তিমার্গের আশ্রয় লইতে হয়, শ্রুতি যেমন কহিয়াছেন – তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিৎ ধনম্‌[১]। শাস্ত্র বলিতেছেন ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ এই চারি বর্গের সাধন মনুষ্যের কর্তব্য। এখন প্রশ্ন, অর্থ কী? সম্পদ ও সম্পত্তি, লোকবল, পুত্রপ্রজাদি লাভ করিয়া বীতশোক হওয়া, যাতে কাম্যবস্তু লাভের উপায়গুলি হাতে থাকে – ইহাই অর্থের সাধন। অর্থ কী কারণে প্রয়োজন? কেন, কাম্যবস্তু লাভ করিব, তাই। এই কারণে বর্গাদির ক্রমতালিকায় অর্থের পরেই কামের স্থান। কামবর্গ কী? কাম্যবস্তু লাভের উপায়গুলি হাতে পাইলে পর তাহাদের কাজে লাগাইয়া সকল কামনা চরিতার্থ করিয়া বীততৃষ্ণ হওয়া – ইহাই কামসাধন। যাহা কিছু কামনা তাহার পূর্তি হইলে কামবর্গে সিদ্ধিলাভ হইল। কিন্তু ইহার “যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারিব” এরূপ অর্থ করিলে যথেচ্ছ আচরণ করিবার লাইসেন্স শাস্ত্র দিতেছেন বলিয়া বোধ হয়। ঠিক এই কারণে আর্ষ পরম্পরায় ধর্মকে চতুর্বর্গের একেবারে আদিতে স্থান দেওয়া হইয়াছে। ধর্মরূপ দৃঢ়ভিত্তির উপরে মনুষ্যের সকল কর্ম স্থাপন করিতে হইবে, একমাত্র তাহা হইলেই সে প্রেয় এবং শ্রেয়ের পার্থক্য নিরূপণ করিতে সক্ষম হইবে, একমাত্র তাহা হইলেই যথেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রিত হইয়া কামনাসকলের পূর্তি মঙ্গলজনক হইবে। বিবেকরূপ নিক্তিতে শ্রেয় এবং প্রেয়ের সূক্ষ্ম বিচারভেদ করিয়া মনুষ্য ধর্মসম্মত অর্থবর্গ ও কামবর্গের সাধনে সিদ্ধ হইয়া মুমুক্ষু হইবে ইহাই শাস্ত্রের নির্দেশ। ‘ধর্মসম্মত’ কথার তাৎপর্য বহুজনের পক্ষে যাহা মঙ্গলজনক, সেইমত কার্যসাধন। প্রথম দৃষ্টিতে আপাতবিরোধী মনে হইলেও, বহুজনের পক্ষে যাহা মঙ্গলপ্রদ, তাহা একের পক্ষেও শ্রেয় – তলাইয়া ভাবিলে এইরূপই বুঝা যায়।

এখন বাঙালি হিন্দুকে যদি পিতৃদত্ত পরিচয় রক্ষা করিতে হয়, যদি আত্মপরিচয় ও আত্মসম্মান রক্ষা করিয়া বাঁচিবার ইচ্ছা তাহার থাকিয়া থাকে, তাহলে তাহাকে ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। ধর্ম হইতেছে অনুশাসন – ব্যক্তির, এবং সমাজের। একটির উপর সে অনুশাসন সে আত্মসংযম কার্যকর না হইলে অন্যটি কিছুতেই বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। কলিকাতা সমেত পশ্চিমবঙ্গের গুটিকতক নগরে বাঙালি হিন্দুর সমাজ একপ্রকার মরিয়াছে, কারণ নগরভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিবার একত্র থাকিতে পারে নাই। পরিবার ভাঙিয়াছে বলিয়া স্থানীয় সমাজ ভাঙিয়াছে। তাহার পরিণামে বৃহত্তর সমাজ ভাঙিতে বসিয়াছে। ইহার একখানি চোখে পড়িবার মত উপসর্গ হইল বাঙালি হিন্দুর জীবনে যেটি কেন্দ্রীয় উৎসব, সেই শারদীয়া শ্রী শ্রী ঁদুর্গাপূজাকে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের সামগ্রীমাত্রে পর্যবসিত করা। এদিকে গ্রামের সমাজও শহরের দুর্নিবার টানে দ্রুত সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে। যেটুকু অবশিষ্ট রহিয়াছে, তাহারও হিন্দু চরিত্রখানি মুছাইয়া দিবার ষড়যন্ত্র চারিদিক হইতে ঘনাইয়া উঠিতেছে। এই অন্যায়ের প্রতিকার তো দূরে থাক্‌, প্রতিবাদটুকু করিবার মত চৈতন্যও আজ বাঙালি হিন্দুর নাই।

এমত বাস্তবের সম্মুখীন হইয়া আমাদিগের সমাজ যে উৎসন্নে যাইতে বসিয়াছে এ কথা যদি স্বীকার না করি, তবে সে কেবল আত্মপ্রবঞ্চনা করা হইবে। তবে উপায় কী? ধর্মের গূঢ় অর্থ বুঝিয়া সেই বেদীর উপরে কর্মশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলে বাঙালি হিন্দুর কতক আশা আছে। এই ধর্মের বাহ্য, সামাজিক রূপ হইতেছে বর্ণাশ্রম ধর্ম, যাহা আজিকার কাস্ট-বেস্‌ড্‌ পলিটিক্স হইতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র, যাহার সংজ্ঞা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় দিয়াছেন – “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টম্‌ গুণকর্মবিভাগশঃ” – “গুণানুরূপ কর্মবিভাগ অনুসারে চাতুর্বর্ণ্য আমার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে”[২]। এই শাস্ত্রপ্রমাণ বর্ণাশ্রমের বর্তমান বিকার জাতিভেদের মূলে সজোরে আঘাত হানে। বর্ণাশ্রম ভারতবর্ষের অশেষ উপকার সাধন করিয়াছে তাহার সমাজকে বাঁধিয়া রাখিয়া। কালে তাহা মনুষ্যোচিত লোভমোহাদি দোষের কবলে পড়িয়া আপন আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছে। সকল শুভদায়ক ব্যবস্থাই কালপ্রভাবে ভ্রষ্ট বিনষ্ট হইয়া থাকে, ইহাতে নূতন অথবা ব্যতিক্রমী কিছু নাই। আদর্শভ্রষ্ট, লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া বর্ণাশ্রম ধর্ম জাতিভেদ নামক নৃশংস কুসংস্কারমাত্রে পর্যবসিত হইয়াছে, অদ্য ইহা শুধুমাত্র জন্মগত অধিকারবলে বেদাধিকার ঈশ্বরজ্ঞানলাভাধিকার এবং সমাজে প্রতিষ্ঠালাভে মনুষ্যের জন্মসিদ্ধ অধিকারসমূহ কিছু বাছাই করা পরিবারের হস্তে কুক্ষিগত করিবার চাবিকাঠিতে পরিণত হইয়াছে। বর্ণাশ্রম ধর্মের উদ্দেশ্য – যাহার যেমন গুণ এবং কর্মপ্রবৃত্তি তাহাকে সেইপথে চালিত করিয়া উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছাইবার সুযোগ করিয়া দেওয়া এবং তদ্দারা আদর্শ জ্ঞানযোগী ব্রাহ্মণ, আদর্শ কর্মযোগী ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্রের আবির্ভাব ঘটানো ও মনুষ্যজন্মের যাহা চরম উদ্দেশ্য, সেই আত্মজ্ঞান/ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথ প্রশস্ত করা। যদি বাঙালি হিন্দুজাতিকে বাঁচিতে হয়, তবে এই সুমহান আদর্শ আমাদিগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। আর্যোচিত সভ্যতার উত্তরাধিকার পাইতে হইলে, বৈদিক সমাজের আদর্শটিকে ধরিয়া থাকিবার প্রয়োজন আছে বৈকি। রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন –

“আবেগ ব্যতীত কাজ ও কাজ ব্যতীত সমাজ চলিতে পারে না। এই জন্যই ভারতবর্ষ আপন সমাজে গতি ও স্থিতির সমন্বয় করিতে চাহিয়াছিল। ক্ষত্রিয় বৈশ্য প্রভৃতি যাহারা হাতে কলমে সমাজের কার্যসাধন করে তাহাদের কর্মের সীমা নির্দিষ্ট ছিল। এইজন্যই ক্ষত্রিয় ক্ষাত্রধর্মের আদর্শ রক্ষা করিয়া নিজের কর্তব্যকে ধর্মের মধ্যে গণ্য করিতে পারিত। স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ঊর্ধ্বে ধর্মের উপরে কর্তব্য স্থাপন করিলে, কাজের মধ্যেও বিশ্রাম এবং আধ্যাত্মিকতালাভের অবকাশ পাওয়া যায়।”[৩]

দেশভাগোত্তর বাঙালি হিন্দুর সমাজে অনেক কিছু না থাকিলেও ভদ্র আচরণ, ভদ্রজন কর্তৃক অলংকৃত সভা-সমাগম এবং সর্বোপরি ভদ্রতার প্রতি একটি শ্রদ্ধার ভাব অনেককাল অবধি অক্ষুণ্ণ ছিল। অধুনা ‘ভদ্রলোক’-এর ধারণাটিকে ক্রমাগত নানান আকাদেমিক কূটতর্কের দ্বারা আঘাত করিয়া, অনবরত তাহার ছিদ্রান্বেষণ করিয়া বিজাতীয় মতাদর্শের অহিফেনে বুঁদ আত্মঘাতী বাঙালি সেই শ্রদ্ধাকে ধাপার মাঠে ফেলিয়া আসিয়াছে। সমাজের উদ্ধার করিতে হইলে ভদ্রজনের সেই হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করা আবশ্যক। শিষ্ট, মার্জিত এবং ভদ্র ব্যবহারের অর্থ কী তাহা আমাদের ফিরিয়া শিক্ষা করিতে হইবে। এই শিক্ষার একাংশ বঙ্গসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি-লেখকগণের রচনা নিবিড়ভাবে পাঠের মাধ্যমে হইবার সম্ভাবনা আছে।

আমরা ইহাও ভুলিয়া যাইতে বসিয়াছি যে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামক বাঙালি হিন্দুর এই স্বদেশভূমি ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট অ্যাকশন গণহত্যা-সংঘটকদিগের কবল হইতে রীতিমতো রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করিয়াই আদায় করিতে হইয়াছিল। দেশভাগের কালে কেহই দুয়োরানী বাঙালি হিন্দুর মুখে এই “বুভুক্ষুর গ্রাস”টুকুও তুলিয়া দিতে উদ্যত হয় নাই। বরং কাড়িয়া লইবার সমস্ত রকম প্রয়াসই করা হইয়াছিল। আমাদিগের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতাগণ এই ঐতিহাসিক সত্যকে বৎসর বৎসর সযত্নে এড়াইয়া গিয়াছেন। ফলতঃ আমাদিগের সন্তানসন্ততি আপন পিতৃপুরুষের ইতিহাস-অভিজ্ঞতা বিষয়ে অজ্ঞই থাকিয়া যাইতেছে। এই ইতিহাসবিমুখতা সমাজের বন্ধন শিথিল হইবার অন্যতম অনুঘটক। হইয়াছেও তাই। চারিদিকে চোখ বোলাইলে অন্ধব্যক্তি এবং উটপাখি ব্যতীত অন্য কেহই লক্ষণ ভালো ঠেকিতেছে বলিয়া দাবী করিবেন না। কঠিন সত্যটি এই – আমাদিগের সমাজ দ্রুত ধ্বসিয়া যাইতেছে। তবে এত অন্ধকারের মধ্যেও আশার কথা এই যে সমাজ ধ্বসিয়া গেলেও তাহাকে পুনর্বার গড়িয়া তোলা চলে। এই পুনর্গঠন অতি কঠিন কাজ, সন্দেহ নাই, কিন্তু অসম্ভব নহে। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বাঙালি হিন্দু আপন তমোগুণ ছিন্ন করিয়া নিজ চেতনা ধর্ম ও কর্মের নবজাগরণ ঘটাইয়াছিল। ইহার ফলে ভারতবর্ষ এবং বিশ্বের মানবমুক্তি ও কল্যাণে তাহার নেতৃত্ব লাভ হইয়াছিল। তাহা যদি সত্য হইয়া থাকে, তবে দুই শতাব্দীকাল পার করিয়া আজিকার এই একবিংশ শতকের প্রারম্ভে ঘোরতর তামসিকতায় নিমজ্জমান বাঙালি হিন্দুর পুনর্জাগরণ ঘটাইবার প্রয়োজন আছে। নিজ আত্মপরিচয় যে বিস্মৃত হইয়াছে, পিতৃপুরুষের পরিচয় বহন করিতে সে ব্যক্তি অক্ষম অযোগ্য, সে ব্যক্তি নিদ্রিতবৎ। এই নিদ্রা হইতে জাগিবার প্রয়োজন আজ অনুভব হইতেছে, কারণ এই জাগরণের উপরেই বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্বরক্ষাকার্য নির্ভরশীল। এই ঘোর তামসনিদ্রা হইতে যদি সে জাগিতে না পারে, তবে নিদ্রাবস্থায় আততায়ীর হস্তে তাহার গর্দান যাইবে, সন্দেহ নাই।

(ক্রমশঃ)

 

তথ্যসূত্র

[১] ঈশ উপনিষদ

[২]  শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা; রাজশেখর বসু কর্তৃক অনূদিত; এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা

[৩] ব্রাহ্মণ, ভারতবর্ষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর