বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

একাদশ পর্বের পর

ভাষা আন্দোলন

এই টানাপোড়েনে পেরিয়ে যায় দুই বছর। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পূর্ববাংলার বাঙালীকে ভাষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ১৯৫২ সালের গোড়ায়। একদিকে আইন, পুলিস-প্রশাসনের বল প্রয়োগ, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি অন্যদিকে মুসলিম লীগের হামলা, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার হরণ। এই পরিস্থিতিতেই কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক – সমাজের সব স্তরের বাঙালীর মধ্যে অসন্তোষের বারুদ জমতে থাকে যার বিস্ফোরণ ঘটে ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বাঙালী প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজ়িমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে জিন্নার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল থেকে তিনি তখন সদ্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত সেই ভাষণে তাঁর যুক্তি ছিল কোনও জাতি দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি। প্রসঙ্গত ইনি সেই নাজ়িমুদ্দিন যিনি বাঙালী হয়েও ভারতভাগের সময় সুরাবর্দি প্রস্তাবিত অখণ্ড বাংলার ধারণা খারিজ করে জিন্নার স্বপ্নের পাকিস্তানেই বাংলার সংযুক্তি চেয়েছিলেন এবং সেটা ইসলামি ভাষা নিয়ে ছুৎমার্গের কারণেই। নিজে আংশিক কাশ্মীরি উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলার পাশাপাশি উর্দুতেও পারদর্শী ছিলেন। তাই বাংলাবাসী হলেও খানদানি মুসলিমের ঐতিহ্য বজায় রাখতে বাংলাভাষীদের সঙ্গে নিজেকে কোনও কালেই এক করে দেখতে পারেননি। সোহরাবর্দির সঙ্গে মিল বলতে ছিল তীব্র হিন্দু বিদ্বেষ। সোহরাবর্দি নিজের রাজনৈতিক উচ্চাশার স্বার্থে বাঙালী জাতিসত্তাকে মূলধন করেছিলেন, আর নাজ়িমুদ্দিন মুসলমান হিসাবে নিজের বাঙালী শেকড়টাই অস্বীকার করতেন।

যাই হোক, নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে মিছিল এগোয় বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি) দিকে। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ও আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ’ নামে একটি ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কমির্টি গঠিত হয়। সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেওয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে সমবেত হয়। নওয়াবপুরের জগন্নাথ কলেজ (অধুনা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বেরোয় ছাত্রদের মিছিল। সমাবেশে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি ওঠে পুনর্বার। সমাবেশের শেষে ছাত্রদের এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের নবাবপুর রোডের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ১৪৪ ধারা অমান্যের সিদ্ধান্ত ৩-১১ ভোটে হেরে গেলেও ঐদিন রাতের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এই নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে পুনরায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী ২শে ফেব্রুয়ারির দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। দাবি ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভাষার বিষয়ে জনগণের মতামতকে বিবেচনা করুক। সশস্ত্র পুলিশ সভাস্থলের চারদিক ঘিরে ছিল। উপস্থিত ছিলেন ডীন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। বেলা সোয়া এগারটা নাগাদ ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের সতর্ক করে দেয়। কেউ কেউ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে পালিয়ে গেলেও বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ বন্ধ করার অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরও খিপ্ত হয়ে পুনরায় বিক্ষোভ শুরু করে।

বেলা ২টোর দিকে আইন পরিষদের (legislative assembly) সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয়। কিছু ছাত্র নিজেদের দাবি নিয়ে আইনসভার উদ্দেশ্যে রওনা হলে বেলা ৩টে নাগাদ শুরু হয় ছাত্রাবাসের ওপরফ পুলিসের গুলিবর্ষণ। রফিক উদ্দিন আহমেদ (২৬) এবং আব্দুল জব্বার (৩০) ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তাছাড়া সেই গুলিবৃষ্টিতে মৃত্যু হয় মোহাম্মাদ সালাউদ্দিন (২৬), আব্দুস সালাম, আবুল বরকত (২৫)।

ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে জনগণ ঘটনাস্থলে ছুটে আসতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র-আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনের। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে পুরোনো রেকর্ডিং সম্প্রচার শুরু করে।

ঐসময় গণপরিষদে (constituent assembly) অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিসি গুলি চালনার খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগীশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ ছোট ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে গিয়ে আহত ছাত্রদের দেখার অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখার আবেদন করেন। কোষাগার বিভাগের মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শরফুদ্দিন আহমেদ, সামশুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মসলেউদ্দিন আহমেদ এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন কারও অনুরোধে কর্ণপাত করেন না, বরং অধিবেশনে বাংলা ভাষার প্রতি বিষোদ্গার করে বক্তৃতা দেন।

এই অমানবিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে মিছিল ও বিক্ষোভে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মীরা ও শহরের নাগরিক সমাজও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। তাঁদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় শোকজ্ঞাপক জানাজা। জানাজার শেষে বিশাল মিছিলে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা অমান্য এবং শোক পালন করে। বেলা ১১টার সময় ৩০ হাজার মানুষের একটি মিছিল অগ্রসর হয় কার্জন হলের দিকে। সেখানেও পলিসের প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করায় গুলিবৃষ্টিতে অন্তত (সরকারি হিসেবে) মৃত্যু হয় ৪ জনের।

শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে বেরোতে থাকে জানাজা ও মিছিল। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিসের গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল নামে এক রিকশাচালক। একই রাস্তায় অহিউল্লাহ নামে ৮/৯ বছরের এক বালকের লাশও পড়ে থাকতে দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে, পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে। ক্ষিপ্ত জনতা এরপর সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলি প্রেস এবং মর্নিং নিউজ়ের অফিসে অগ্নিসংযোগ করে।

২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো অপপ্রচার শুরু করে। জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধীদের (হিন্দুদের) প্ররোচনায় ছাত্ররা পুলিসকে আক্রমণ করেছিল। সারাদেশে প্রচারণাপত্র বিলি করা হয়। সংবাদপত্রগুলোকে ক্ষমতাসীন পাশ্চিম পাকিস্তানপন্থীদের স্বার্থে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করা হয়। পাশাপাশি ব্যাপক হারে অব্যাহত থাকে ছা্ত্র-জনতা গ্রেফতারি। পারসিক-আরবি সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্যই ছিল পাকিস্তান ও দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তি। সুতরাং “একমাত্র উর্দু” নীতির বিরোধিতা মানে পাকিস্তানি জাতীয় স্বার্থের বিরোধিতা বা দেশদ্রোহিতা।

এই ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ছাত্রাবাসের পাশে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কাজ শুরু করে ২৪ তারিখ ভোরের মধ্যে শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলে যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে আবুল বরকতের পরিবার। তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসে ইঞ্জিয়ার থেকে রাজমিস্ত্রীরা। মেডিক্যাল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট বালি আর পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট এনে রাতারাতি খাড়া করা হয় এই মিনারফ। এর গায়ে ছিল একটি হাতে লেখা কাগজের ফলক – “শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ”। শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয় ঐ দিনই। “শহীদ বীরের স্মৃতিতে” শিরোনামে দৈনিক আজাদ কাগজে ছেপে যায় সেই খবর। ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া মিনারটি ছাত্রাবাসের পাশে এমন জায়গায় নির্মিত হয়, যাতে ক্যাম্পাসের বাইরের থেকেও সহজে চোখে পড়ে। নির্মাণ শেষ হওয়া মাত্র কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এবং ঐ দিন অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালেই শহীদ শফিউরের পিতা প্রাথমিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কিন্তু ২৬ তারিখ উদ্বোধনের দিনই পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হলে সেটিকেও এসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়। [মূল নিবন্ধ: কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার]

ওদিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের ভাই এবং রফিক-উদ্দিন আহমদের পরিবার হত্যার মামলা দায়ের করার চেষ্টা করলে, উপযুক্ত কাগজের অভাব দেখিয়ে আদালতে সেগুলো গৃহীতই হয় না। ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখে, কল-কারখানার শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ শহরে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে প্রতিবাদীদের ওপর চলে ব্যাপক পুলিশী হামলা।

চাপের মুখে অতঃপর ৮ এপ্রিল সরকার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু তার প্রতিবেদনে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য দর্শাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সেই রিপোর্ট প্রত্যাখান করে। ১৪ এপ্রিল গণপরিষদের (constituent assembly) অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবীভাবে সামনে চলে আসে। সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা নীরবতা পালন করেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তারা বাংলাকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার বিপক্ষে ভোট দিলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। উপরন্তু ১৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিনের ছাত্র সমাবেশের জেরে ‘বিশ্ববিদ্যালয় লীগ কমিটি’র প্রধান নেতা আব্দুল মতিন গ্রেফতার হয়। তৎক্ষণাৎ কমিটি পুণর্গঠিত হয়। ওদিকে ২৭ এপ্রিল বার সেমিনার হলে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহ্বান করে সরকারের কাছে ২১-দফা দাবি পুনরায় উত্থাপন করে।

১৯৫২-র পর থেকে ভাষা আন্দোলনের দ্রুতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সালে ‘কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’ ২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে উদ্দত হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পূর্ববঙ্গব্যাপী অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। আয়োজিত হয় প্রভাত ফেরি। হাজার হাজার মানুষ শোকজ্ঞাপক কালো ব্যাজ পরে ফেস্টুন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মিছিল করে প্রাঙ্গন ত্যাগ করে। হিংসা এড়াতে নিযুক্ত ছিল স্বেচ্ছাসেবক।

এরপর প্রায় লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে আরমানিটোলায় ভাষা সংগ্রাম কমিটির বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ভাষা ছাড়াও মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপিত হয়। রেলওয়ের কর্মচারীরাও ছাত্রদের সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। এই বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়ে তাঁকে কালো ব্যাজ দেখায়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” লেখা সম্বলিত স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং বিশেষ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষার দাবিটি আরও জোরালো করা হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার “ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গানটি ১৯৫২ সালেই কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশ করে বিলি করা হয়। তেমন প্রশাসনিক দমন-পীড়ন শোনা যায় না। কিন্তু পরের বছর ১৯৫৪ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।

চলবে