বাঙ্গালী নৃপতি গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপসেন দিল্লির সুলতানদের পরাজিত করে বারাণসীধামে বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন

স্নেহাংশু মজুমদার

অরিরাজ-ঘাতুকশঙ্কর সগর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র পরমসৌর গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন ত্রয়োদশ শতকে বাঙ্গালার গৌড় সাম্রাজ্যের পরমপ্রতাপী চন্দ্রকূল সেনবংশীয় সনাতনী শাসক ছিলেন। তিনি বাঙ্গালার নৃপতি গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন এবং মহারানী বাসুদেবীর পুত্র এবং গৌড় রাজ্যের কনিষ্ঠতম যুবরাজ ছিলেন। তাঁর শাসনকালের গৌরবময় রাজত্ব, বারাণসী পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার এবং মদনপাড়া, ইদিলপুর ও ঢাকার তাম্রশাসন থেকে যবনদের উৎখাত করে সনাতনের বিজয়ের উল্লেখ রয়েছে। তাঁর সম্পুর্ন উপাধি ছিল – “সমস্ত সুপ্রস্তপেত অশ্বপতি গজপতি নরপতি রাজ্যত্রয়াধিপতি সেনকূলকমল বিকাশভাস্কর সোমবংশ প্রদীপ-প্রতিপন্নদান কর্ণ সত্যব্রত গাঙ্গেয় শরণাগতবজ্রপন্থর পরমেশ্বর পরমভট্টারক পরমসৌর মহারাজাধিরাজারিরাজ ঘাতুকশঙ্কর সগর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র গৌড়েশ্বর শ্রীশ্রীশ্রী বিশ্বরূপ সেন”।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট লক্ষণ সেন ইহলোক ত্যাগ করেন। এর কিছুকাল পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হেমচন্দ্র মাধবসেন হিমাচলের গারোয়াল অঞ্চলে প্রস্থান করেন, এদিকে দ্বিতীয় পুত্র রাজা কেশবসেন তখন রাঢ়ভূমে রাজনগর রক্ষায় ব্যস্ত। অতঃপর কনিষ্ঠ পুত্র বিশ্বরূপ সেন পরবর্তী গৌড়েশ্বররূপে বাঙ্গালার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্মমতের পথে তিনি ভগবান সূর্যদেবের উপাসক ছিলেন এবং “পরমসৌর” উপাধি ধারণ করেতেন।

এদিকে ১২১১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির তখত এ বসেন কুতুবউদ্দিন আইবকের জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিস। দিল্লিতে এসময় তখত-এর দখল নিয়ে তুর্কি আমির গোষ্ঠীর মধ্যে ষড়যন্ত্র চলছিল, ফলে শাসনব্যবস্থায় ফাটল ধরে। অবস্থা বুঝে উত্তর ভারতের একাধিক হিন্দু রাজারা দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, উপরন্তু তাঁরা উত্তর ভারতে দিল্লির শাসনের অবসান ঘটাতে তৎকালীন আর্যাবর্তে টিকে থাকা একমাত্র স্বাধীন হিন্দুশক্তি গৌড়রাজ্যের সহায়তা কামনা করেন।

বারাণসী শৈবক্ষেত্র পুনরুদ্ধার :

উত্তর ভারতে শৈবক্ষেত্র বারাণসী পুনরুদ্ধার করতে ১২১২ খ্রিষ্টাব্দে, গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন তাঁর বিশাল গৌড়ীয় নৌসেনার সাথে, পশ্চিম পথে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেছিলেন। গৌড়ীয় বাহিনী কাশীতে প্রবেশ করে এবং সেখানকার দিল্লি সালতানাত অধীনস্থ গারঝা (Oghuz) মামলুক বাহিনীকে আক্রমণ করে। নৌযুদ্ধে গৌড়ীয় সেনা ছিল অপ্রতিরোধ্য, অন্যদিকে মামলুকদের নৌসেনা অতীব ক্ষীণ তথা দুর্বল। চার দিনের মধ্যেই অধিকাংশ মামলুক সেনা নিহত হয়ে যায় এবং নবাব আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

উত্তর ভারতে বারাণসী পর্যন্ত ক্ষেত্র সেন সাম্রাজ্যের হিন্দু শাসনের অধীনে চলে আসে। ২০ বছরের দীর্ঘ ম্লেচ্ছ শাসনের অবসানের পর কাশীর শৈব তীর্থক্ষেত্রে গৌড়ীয় বাহিনী দ্বারা সনাতন ধর্মের বিজয়ধ্বজ উত্তোলন করা হয়। গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন কাশীতে বিজয়স্তূপ নির্মাণ করেন এবং কাশীকে বিশ্বের নিয়ন্ত্রকের ক্ষেত্র “শিব-বিশ্বেশ্বর” হিসাবে ঘোষণা করেন। গারঝা (সংস্কৃত- গর্গ) গোষ্ঠী যবনদের উৎখাত করার গৌরব স্বরূপ তিনি “সগর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র” উপাধি ধারন করেন। মদনপাড়া তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে –

“শশাস পৃথিবীমিমাং প্রথিত বীরবর্গাগ্রণীঃ।
স গর্গযবনান্বয় প্রলয়কাল রুদ্রো নৃপঃ।।”

বিশ্বরূপ-সাইফুদ্দিন যুদ্ধ (১২৩০-৩৫) : মালিক সাইফুদ্দিন আইবক ছিলেন দিল্লির সুলতান ইলতুতমিস এর অধীনে লখনৌতি র গভর্নর। তিনি সেন শাসিত পূর্ব বঙ্গে একটি অভিযান সামরিক চালান। তবে তিনি এই অঞ্চলের কোন অংশে অভিযান চালান তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার অভিযান সফল হয়নি। মহারাজ বিশ্বরূপ সেন এর বিশাল নৌবাহিনীর আক্রমণে তুর্কি বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয় ।

বিশ্বরূপ – ইউজউদ্দিন যুদ্ধ (১২৩৫-১২৪৪ খ্রি) : ইউজউদ্দিন খিলজির সময় শিখরভূম এর ছাতনা রাজ্যের সামন্ত রাজা উত্তর হামীর রায় রাঢ় অঞ্চলের সমস্ত নৃপতিদের একত্রিভূত করে রাজনগর আক্রমণ করেন। খিলজিদের পরাজিত করে গৌড়ীয় রা লক্ষ্মনুর দুর্গ জয় করে ও রাজনগরে ১৯ বছরের খিলজি শাসনের অবসান হয় । এসময় ইউজউদ্দিন খিলজি বঙ্গভূম অঞ্চলে আক্রমণ করে । মহারাজ বিশ্বরূপ সেন এর বিশাল কৈবর্ত্য নৌবাহিনী ও তীরন্দাজবাহিনী খিলজিদের ধূলিসাৎ করে দেয় । গৌড়ীয় সেনা ক্রমশ সম্মুখে লখনৌতি র দিকে অগ্রসর হতে থাকে । লক্ষনৌতি রক্ষা করতে ইউজউদ্দিন দিল্লির সুলতানের থেকে সৈন্য সাহায্য কামনা করে।

সম্রাট বিশ্বরূপ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গৌড়েশ্বর সূর্যসেন পরবর্তী সম্রাটরূপে বাঙ্গালার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর পুরোহিত তথা সেনাপতি পন্ডিত প্রভাকর রায় সেসময় খাঁড়িমণ্ডলের প্রশাসক হিসেবে সফলভাবে তুর্কি আক্রমন প্রতিহত করেন। এসময় বাঙ্গালায় ম্লেচ্ছনিবহনিধনের কামনায় বিষ্ণুর দ্বাদশ অবতার কল্কি উপাসনার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।