বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

চতুর্দশ পর্বের পর

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বাধীনতার ঘোষণা ও বাংলাদেশ গণহত্যা: মূল নিবন্ধ: ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যা

সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন “তিরিশ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করো, তখন দেখবে বাকিরা আমাদের হাত চেটে খাবে।” সেই পরিকল্পনা মতো ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” নাম দিয়ে শুরু করে গণহত্যা [এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী]। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালী সদস্যদেরও নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়। ছাত্র বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে চলে নির্বিচারে গণহত্যা যার মধ্যে নারী নিধন ছিল সবচেয়ে রোমহর্ষক।

হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। অন্য সূত্র জানাচ্ছে ২৫-শে মার্চ থেকে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সকল সাংবাদিককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২ দিন যাবৎ অবরুদ্ধ করে রাখে। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা হলেও পুরো দেশজুড়ে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল ‘জগন্নাথ হল’ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, যাতে ৬০০ থেকে ৭০০ ছাত্র নিহত হয়। যদিও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ধরনের ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছে, তবে ‘হামিদুর রহমান কমিশন’-এর মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিলো। জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য ছাত্র হলগুলোতে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ভিডিও-টেপে ধরে রাখেন তদানীন্তন ‘পূর্ব পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনলজি’ (বর্তমান বুয়েট)-এর প্রফেসর নূরুল উলা।

বলা বাহুল্য পুরো বাংলাদেশেই হিন্দু এলাকাগুলি ছিল বিশেষ আক্রোশের স্বীকার যদিও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ও উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দাবিদারদের মধ্যে হিন্দুরা বিরলই ছিল। মধ্যরাতের আগেই ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলো। ২ আগস্ট, ১৯৭১ ‘টাইম সাময়িকী’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, “হিন্দুরা, যারা মোট শরণার্থীদের তিন-চতুর্থাংশ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল”।

গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেপ্তার করে। এরপর আর আলোচনার অবকাশ থাকে না। টেক্সাসে বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নথি সংগ্রাহক মাহবুবুর রহমান জালালের মতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ লিখিত ঘোষণা করে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছিল অন্য কারও ঘোষণার অনেক পূর্বে। এর অনুদিত রূপ হল: “এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।” ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকেও ঘোষিত হয় যে “শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে সাড়ে সাত কোটি জনগণকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন”।

গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার মূল ঘোষক কে ছিলেন তা নিয়েও বিতর্ক কম ছিল না। এই কারণে ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে প্রকাশিত একটি ইতিহাস পুস্তকে ৩টি বিষয় পরিষ্কার করা হয় – ১. শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঘোষণাপত্র লিখেন ২৫ মার্চ মাঝরাত কিংবা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে। ২. শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাপত্রটি ২৬ তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। কিন্তু সীমিতসংখ্যক মানুষ সেই সম্প্রচারটি শুনেছিল। ৩. পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হয়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রচারিত হয়ে বিশ্বাবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জানতে পারে। ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপঃ
“On behalf of our great national leader, supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman do hereby proclaim the independence of Bangladesh. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is sole leader of elected representatives of 75 million people of Bangladesh. I therefore appeal on behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman to the government of all democratic countries of the world specially big world part and neighboring countries to take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The legally elected representatives of the majority of the people as repressionist, it is cruel joke and contradiction in terms which should be fool none. The guiding principle of a new step will be first neutrality, second peace and third friendship to all and anonymity to none. ─ May Allah help us, Jai Bangla.” [“আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। এটি আরও ঘোষণা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমি সেই কারণে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশেষ করে বৃহৎ বিশ্ব ও প্রতিবেশীদের কাছে কার্যকারী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার ফলে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়েছে। অধিকাংশ জনগণের বৈধভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিপীড়নকারী, এটি একটি ক্রূর কৌতুক ও মিথ্যা অপবাদ যার কাউকে বোকা বানানো উচিত নয়। বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রধান পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথম হতে হবে নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয় শান্তি এং তৃতীয় সকলের সাথে বন্ধুভাবপন্ন ও কারো সম্বন্ধে অজ্ঞানতা নয়। ─ আল্লাহ্ সহায় হোক, জয় বাংলা।”]
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠিত করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজ়রুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের উপর। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে শপথ নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ‘২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। আর পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে বাংলাদেশময় ছড়িয়ে পড়ে গেরিলা বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার পরিসংখ্যান বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিশ্বকোষ (ইউকিপেডিয়া) ও বিভিন্ন বইতে সংখ্যাটি ২,০০,০০০ থেকে শুরু করে ৩০,০০,০০০ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।[২০] একটুও অতিরঞ্জন ছাড়াই মনে করা হয় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাটি ৩০ লক্ষর কম নয়। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় না নিলে সংখ্যাটা আরও কোটি খানেক বাড়তে পারত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে পাকিস্তানপন্থী বাঙালী রাজাকাররা বাংলাদেশের শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।[৪৯] নয় মাস টানা তাণ্ডব চালানোর পরেও ভারতের হস্তক্ষেপে যুদ্ধের পরিণতি যে পাকিস্তানের অনুকূলে যাবে না ডিসেম্বরের শুরুতেই তা বুঝতে পেরেছিল তারা। তাই স্বাধীনতার ঠিক আগে সুপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেওয়া যায়। ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়, যার মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি অন্যতম যেখানে বর্তমানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপিত। ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পরবর্তীকালে আরও বেশ কিছু গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং মাঝে মাঝেই নতুন নতুন গণহত্যার নিদর্শন আবিষ্কৃত হচ্ছে। যেমন ঢাকায় অবাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে একটি কূপের ভেতর গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়)। ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান কনসুলেট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেটস ডিপার্টমেন্টে পাঠানো টেলিগ্রামেও যুদ্ধ শুরুর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনতার ওপর চালানো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ রয়েছে।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কত বাঙালী নারী যে সম্ভ্রম ও প্রাণ হারায়, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ধারণা করা হয় প্রায় ২,০০,০০০ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অসংখ্য ‘যুদ্ধশিশু’ জন্ম নেয়। ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে পাকিস্তানি সৈন্যরা বহু মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে। এদের নারকীয় যন্ত্রণার খণ্ডচিত্র পরে আলাদাভাবে তুলে ধরছি।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ:

লাগাতার বেপরোয়া গণহত্যা চালিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের দমাতে না পেরে ঘটনার মোড় ঘোরাতে পাকিস্তান ৩রা ডিসেম্বর ভারতের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। এমনিতেই ভয়াবহ সন্ত্রাসের জেরে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে পালিয়ে আসছিল। তার ওপর ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় ‘রেডিও পাকিস্তান’ এক বিশেষ সংক্ষিপ্ত সমাচারে প্রচার করে যে “ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।” মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী ও অভ্যন্তরীণ অংশে হানা দেয় পাকিস্তান। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, “I am placing my country in the war front.” আরও বলেন, “এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” যুদ্ধ এড়ানোর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ।
বাধ্য হয়ে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণা করে একই সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তে তাদের পাকিস্তানের মোকাবিলা শুরু করে, আর পূর্বে ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের ‘মুক্তিবাহিনী’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘যৌথ বাহিনী’ গঠন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালি অভিমুখে; (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে; (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আরেকটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।[৪২]
ভারতীয় সেনা অবতরণের পর সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এড়িয়ে যৌথবাহিনী দ্রুত ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের। ভারতীয় সেনারাই তখন ছিল তাদের খান সেনাদের নৃশংস নারকীয় বর্বরতা থেকে পরিত্রাতা। ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। তার আগেই ভারতীয় বিমান হামলায় ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি বিমানবাহিনী পরাস্ত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ঢাকার সমস্ত সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়েও নষ্ট দেওয়া হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা-আধিকারিকরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে নি। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ানের হস্তক্ষেপ ছাড়া মার্কিনি আগ্রাসন ভারত রুখতে পারত কিনা সন্দেহ।

চলবে